কাজলপারু

কাজলপারু

“পারু তুমি সবসময় ঘন করে কাজল দাও কেন? ভুতের মত লাগে” মন্তব্যটা করেই রাশেদ ভাই দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রতিউত্তর শোনার জন্য,এই একই প্রশ্ন সে আমায় ১১বারের বেশি জিজ্ঞেস করেছে,উত্তর পায়নি,আজকেও পাবে না, হয়ত আরো একদিন একই প্রশ্ন করবে,প্রশ্ন করে তাকিয়ে থাকবে উত্তরের আশায়, আমি জানি সে উত্তর পাবেনা বলেই আমাকে প্রশ্ন করে,আর এটা হলো আমার দিকে তাকিয়ে থাকার বাহানা।

আমি কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিলাম,পেছন থেকে বলেই উঠলো- “আসলে আমি তোমাকে অমন ভাবে কিছু বলিনি পারু,রাগ করোনা” আমি শুধু একবার তাকালাম, সে বলল, “যাও,আল্লাহ হাফেয” আমি হেটে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালাম,বিস্মিত হলো মনে হয়, “রাশেদ মির্জা! এই ঘন ,মোটা কাজল দেয়ার পেছনে সুন্দর একটা গল্প আছে, এই সুন্দর গল্পটা আমি কাউকে বলতে চাইনা,আমি মনে করি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কথাগুলো এই গল্পে লুকোনো,আর এটা শুধুই আমার ব্যক্তিগত” এটা বলে চলে আসলাম।

আজ বৃহস্পতিবার, আমি প্রতি বৃহস্পতিবার খালার বাসায় যাই,ইনি হলেন আমার খালার একমাত্র ছেলে, রাশেদ মির্জা,আধুনিক যুগে যদি কোন ক্ষ্যাত ছেলে তাকে,তবে এনার নাম নিশ্চিত ১০নম্বরে থাকবে, বরাবরের মতই আমার গল্প,কবিতা,উপন্যাস পছন্দ নাহ,আর এই ব্যক্তিটার জীবনটাই যেন এসব নিয়ে,খালার বাসায় গেলেই একটা বই হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবে,”পারু! এটা পড়ো,খুব সুন্দর ” আমি তো চটে গিয়ে উঠে চলে আসি, যতবারই যাই তার সাথে আমার আচরণ এমন হয় যেন একজন অপরিচিত মানুষ, ইচ্ছে করেই এমন করি। আমি বুঝি আমি কেমন,কিছু মানুষ আছে যাদের সাথে অপরিচিত ভঙ্গিতে কথা বলে বেশ মজা পাই, সে মানুষদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি রাশেদ ভাই।

আজ আরো একটি বৃহস্পতিবার, দুই সপ্তাহ হলো খালার বাসায় যাইনা, খালা ফোন করেছে মায়ের কাছে,কেমন আছি,কি করছি? হয়ত রাশেদ ভাই খালাকে জ্বালাচ্ছিল আমার খবর জানার জন্য, হুমায়ূন স্যার ঠিকই বলেছিল, মেয়েদের চমৎকার এক শক্তি থাকে, তারা প্রেমে পরার ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলে। এই প্রেমের ব্যাপারটাই আমার ক্ষ্যাত লাগে,রাশেদ ভাইয়ের মত আরো কিছু ক্ষ্যাত জিনিস আছে যা আমি দুইচোখে দেখতে পারিনা,যেমন যার না তার সাথেই খুব ভাব জমানো,কি দরকার এমন আজাইরা ভাব জমানের?

১৮-২৫বছরের মেয়েদের খলনায়ক হলো ঘটক,আমার সাথে এখন তাই ঘটতে চলেছে, বিয়ে নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই, আজকে নাকি ছেলেপক্ষ আসবে আমায় দেখতে, মা বলল, “একটু মুখ ফোটাস,তুই তো আবার বোবার মতন সব জায়গায় হন্য হয়ে তাকিয়েই থাকিস,কথা বলার প্রয়োজন হলেও বলিস না”

“শোনো মা,এত কথা বলোনা,বেশি কথা পছন্দ না,তাই নিজেও বলিনা আর শুনতেও চাইনা,ছেলেপক্ষ আসলে আসবে,আবার তাদের মত চলে যাবে,যা দরকার হবে তাই বলবো” মা চুপ করে গেলো,আজ সারাদিনে মনে হয় এই আমার সবচেয়ে বেশি কথা বলা,মা আমাকে তিনটে শাড়ি এনে দিয়েছে, ছোট বোন অরু এই নিয়ে খুব আপ্লুত,যেন তাকে দেখতে আসছে। আমি শাড়ির ভাঁজ দিতে পারিনা,আমার গায়ের সাথে কি রঙ মানাবে,চুল কিভাবে বাঁধলে আকর্ষণীয় লাগবে এসব আমি ভাবিইনা,আমার কাছে আজাইরা লাগে। মা খুব শান্ত চোখে মিশমিশিয়ে বলল,

“পারু, জানিস? বেশিরভাগ মেয়েদের দেখতে আসলে মেয়েরা কি রঙয়ের শাড়ি পরে?”

“না”

“তীব্র লাল”

“তীব্র লাল কেন পরে? দুনিয়াতে কি আর কোন রঙ নেই?”

“তীব্র লালে একটা প্রেম ভাব আছে,পৃথিবীতে যত রঙই থাকুক না কেন,তীব্র লাল ছেলেদের চোখে লাগে”

“সেতো আমিও জানি,তাইতো বিভিন্ন সিগন্যালে লাল বাতি জ্বালানো হয়”

“তুই লাল শাড়ি পরিস না, লাল শাড়ি পরলে আমার নজর লাগবে”

“আবোলতাবোল বকছো কেন মা? রাতে ঘুম কম হয়েছিল? নাকি বাবার সাথে ঝগড়া করে পুরো রাত বারান্দায় বসে কাটিয়েছো? ” মা একটা ঘোর থেকে বেরিয়ে এসেছে, আমার মায়ের বোধহয় অসুখ হয়েছে,আজকাল অরুর সাথেও আবোলতাবোল কথা বলে, অরু নাকি বড় হয়ে গেছে,আমাকে বিয়ে দেয়ার পরপরই তার জন্য বিয়ের ঘর আসবে,পিচকু একটা মেয়ে,সবে ক্লাস সেভেনে, ওর কিসের বিয়ে?

সন্ধ্যার পর ছেলের মা,দুই বোন,ছেলে আর তার কোন কাজিন যেন এসেছে, আমি লাল শাড়ি পরিনি, রাশেদ ভাইয়ের মত লাল রঙটাও আমার কাছে ক্ষ্যাত লাগে, আগের দিনের একটা জর্জেট সফট হলুদ রঙের শাড়ি ছিল বাসায়,এর পারটা সবুজ-হলদে,আর পুরো জমিনটাই যেন শর্ষে ফুলের মাঠ। হলুদ শাড়ি আর সেই ঘন কাজলই ছিলো আমার সাজপোশাক। আমার যে চার ফুট চুল এ কথা রাশেদ ভাই জানেইনা, জানলে হয়ত ছ’বারোটি কবিতা রটিয়ে ফেলতো,ক্ষ্যাত মানুষদের আর কোন কাজ আছে নাকি?

ছেলেটি ছিল ফর্সা,কালো ফ্রেমের চশমা পরে,প্রেমে পরার মতই,স্মার্ট, অথচ আমার চোখ তাকে দেখে দপ করে নিভে গেল,সে লাল চেকের শার্টের সাথে কালো টাই পরেছে,হয়ত ভেবেছিল আমিও লাল রঙের শাড়ি পরবো,কিন্তু তাকে যদি আগেই বলতাম লাল রঙ আমার একদম পছন্দ না,তবে হয়ত এটা পরতোনা। ওহ হ্যাঁ, তার নামও ‘র’ দিয়ে,রুহাশ শাফায়েত, সুন্দর না?

আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো, রাশেদ ভাই এখন আর বলে না, “পারু! বাইরে বেশি ঘোরাফেরা করোনা, চোখে ঘন কাজল একদম দেবেনা, চুল সবসময় স্টিলের স্টিক দিয়ে কেন বাঁধো? বেনুনি করতে পারোনা?” বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত রুহাশ সপ্তাহে ৩/৪দিন আমার সাথে দেখা করতো,সহজ হওয়ার চেষ্টা করত আমার সাথে, অথচ আমি যে তূষ্ণীভাব মেয়ে সে বোঝেনি,সে ভেবেছিল আমি লাজুক।

-তোমার নাম কি?
-পারমিতা
-শুধু পারমিতা?
-হ্যাঁ
-দুই ঘন্টা হয়ে গেলো ঘুরলাম ফিরলাম,তুমি নিজে থেকে একটা প্রশ্নও করলে না যে!
-আগ্রহ নেই
-আমার দিকে তাকালেও না?
– এই যে তাকিয়েছি, আপনি কি ভেবেছেন? আমি লজ্জা পাই? ইতস্তত ভাব নিয়ে সে প্রশ্ন করলো আমায়-

-এমন ঘন করে চোখে কাজল দিয়েছো কেন? দূর থেকে দেখলে মনে হয় কেউ চোখগুলোকে তুলি দিয়ে এঁকে দিয়েছে। এর উত্তর আমার আর দিতে ইচ্ছে করেনি, আমার সুন্দর গল্পটা আমি কাউকেই বলবোনা। সেদিন বাসায় ফিরে দেখি রাশেদ ভাই বসে আছে, ঢিলে একটা পাঞ্জাবী পরেছে,চুলও বোধহয় আচঁড়ায়নি, মানুষ কতটা ক্ষ্যাত হলে চুলগুলো পর্যন্ত উষ্কখুষ্ক থাকে তা আমার জানা নেই।

-কেমন আছো পারমিতা?
-ভালো
-আমি দেড় ঘন্টা ধরে বসে আছি তোমার সাথে দেখা করার জন্য, খালা বাইরে গেছেন,বলে গেছেন তুমি এলে রাতের খাবার গরম করতে।
-কেন এসেছেন?
-তোমাকে দেখতে
-অরু কোথায়?
-খালার সাথে বাইরে গেছে,বাসায় তুমি আর আমিই
-যা বলার বলে,বিদেয় হোন
-তোমায় সুন্দর লাগছে
-আর?
-আর কিছুনা

ঠিকাছে,এবার আসুন, রাশেদ ভাই চলে গেছে, আমি জানি সে কি বলবে! মানুষটাকে আমি কেন দেখতে পারিনা জানিনা, তার সাথে সুন্দর কথাও বলতে পারিনা। মানুষের বৈশিষ্ট্য অদ্ভুত! এই বলেই চুপ করে রইলাম,

-মা,থামলে কেন? বলো!! বলোনা….
-আমার আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা রে সোনা
-কেন মা?

এই আমার মেয়ে রিহাম, সাম্নেই ১৮তে পরবে তার বয়স, আমি উঠে চলে আসি,আমার চোখ ভেজা,মেয়ে দেখে ফেললে সর্বনাশ, যথেষ্ট বয়স হয়েছে রিহামের, এটা প্রেমের বয়স,খুব খারাপ,আমার ভেজা চোখ দেখলেই সে বুঝে যাবে আমি আসলে রাশেদ ভাইয়ের প্রেমে পরেছিলাম।

বাকি গল্পটা রিহামকে আমি আর বলিনি,আমার সেই ঘন কাজল দেয়ার সুন্দর ব্যক্তিগত গল্পটা বলেছিলাম, সে যেন আমার সেই তারুণ্যে চলে গিয়েছিল, ঘন কাজল দেয়ার কারণ হলো আমার মা, আমার চোখের রঙ গাড় নীল, জন্মের পর ডক্টর আমাকে দত্তক নিতে চেয়েছিল,বাবা দিতে দেয়নি, এরপর আমাকে এতটাই খেয়াল রাখতো বাবা মা, তাদের দ্বিতীয় সন্তান নেয়ার কথা মাথায়ই ছিলনা, আমার বারো বছর বয়সে অরুণিতা মায়ের কোলে এসেছে।সে আমার মতন সুন্দরি হয়নি, অথচ প্রায় বলতো, “মা! পারু আপুর চোখ কোত্থেকে সার্জারি করে এনেছো?” আর এই শুনেই মা বাচ্চাদের মত হেসে কুটিকুটি হত। আমার চোখ ছিলো হুরের চোখ,চোখের পাপঁড়িও ঘন,আর বড় চোখের মেয়েদের প্রেমে দেবতারাও পরে, মায়ের আদেশ, চোখে ঘন কাজল দিয়ে রাখবি, যেন চোখ ছোট দেখায়।এই হলো আমার সুন্দর গল্প।

সব মানুষের জীবনে নিজেদের সুন্দর একটা গল্প থাকে,সে গল্পটার ভাগ কাউকে দিতে চায়না, বড্ড একা লাগার সময় তারা এই গল্প নিয়ে ভাবে, আর নিজেকে ভালোবাসতে থাকে তখন। শিক্ষাজীবনে কত প্রেম আঘাত হেনেছিলো আমায়, অবশেষে রুহাশ নামের এই ভাল মানুষটির কপালেই জুটলাম,রুহাশ আর পারমিতার হুরপরী এই রিহাম। রাশেদ ভাই সেদিন বাসা থেকে ঠিকই চলে যায়,তবে যেভাবে এসেছিল সেভাবে আর নিজের বাসায় ফিরতে পারেনি, আমাদের জীবনে আস্তে আস্তে কোন কিছুই হয়না,সবকিছুই হুট করে হয়ে যায়, যেমন মানুষ হুট করেই প্রেমে পরে,হুট করেই মরে যায়, আবার হুট করে আঘাতের তীর ঢুকে এপার থেকে ওপারে বেরিয়ে যায়।

এই হুট করেই রাশেদ ভাই এর জীবন অন্য রকম হয়ে গেলো, ধানমন্ডি -২ এর রাজারবাগ থানার সামনে দিয়ে গিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময়ই তার জীবন তছনছ হয়ে গেলো। আমার ক্ষ্যাত মানুষটা হাসপাতালে আর আমি হবু জামাই রুহাশের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত তখন,সেই রাত ২টার সময় বাসায় কল আসে খালার,হাসপাতালে যাওয়ার জন্য,বাবা,মা আর অরু গিয়েছিল,আমিই যাইনি, তাকে আমি দেখতে পারতাম না ভাবছেন? অথচ তাকে ক্ষ্যাত বলতে বলতে এক সময় মানুষটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম,বড্ড দেরি ছিল,আমি অন্যের জীবনে পা রাখতে যাব,এখন এমন আবেগাপ্লুত হলে চলে? রুহাশের ফোন রেখে দিলাম,বাসা থেকে সবাই চলে যাওয়ার পর পুরো ঘর ফাটিয়ে চিৎকার করেছিলাম আমি। আমার ঘরের দেয়াল জানে,আমার চিৎকারে কি পরিমাণ যন্ত্রণা ছিল! আমার নখের আঁচড় জানে ফ্লোরে খামচে ধরে কত ক্যালোরি শক্তি ব্যয় করেছিলাম।

সকালে মা এসেছে,অরু আর বাবা হাসপাতালেই, মা এসে ভেবেছিল আমি ঘুমোচ্ছি,তাই ডাকেনি, নাস্তা বানিয়ে আমার জন্য রেখে চলে গেছে, আমি সন্ধ্যায় চোখ খুলেছি,সবকিছু মনে পরতেই বুঝলাম,আসলে আমি সেন্সলেস ছিলাম, ঠিক যেই কারণে আমি কাউকে ভালোবাসিনি,যেই কারণে কারো চোখে নিজেকে প্রকাশ করিনি,আজ তার চেয়েও খারাপ কিছু কেন ঘটলো? আমাদের মন,প্রেম সবকিছুই অদ্ভুত! “মা!! তুমি কাঁদছো??” এমন সজোর কন্ঠে আমার হুশ ফিরলো, রিহাম দেখে ফেলেছে, মেয়েটা খুব কষ্ট পেয়েছে। রাশেদ ভাই এখনো বিয়ে করেনি, আপ্নিই বলুন তো! একজন পঙ্গু লেখকে কেউ বিয়ে করবে? হ্যাঁ সে এখন বিরাট লেখক…কোন কিছুরই কম নেই,শুধু ভালোবাসার কেউ নেই,মা ছাড়া। রাশেদ ভাই জানতোনা আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম, জানবেও না।

আমার মেয়ে এমন কষ্ট না পাক, যেদিন রিহাম হয়েছে,সেদিনই তাকে কোলে নিয়ে আমি ঠিক করেছিলাম,তাকে যে ভালোবাসবে খুব,তার হাতেই তুলে দেব। আমার মেয়েটার আজ বিয়ে,রাশেদ ভাই এসেছে, টকটকে এক লাল পাঞ্জাবি পরেছে সে, যাক! আজকে চুল আঁচড়ানো, আমি আজকেও ঘন কাজল দিয়েছি, রুহাশ মেয়ের কাছে,রাশেদ ভাই আজকেও আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, “পারমিতা! তুমি ঘন করে কাজল দাও কেন? খুব সুন্দর লাগে তোমাকে”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত