নিশির বয়স আঠাশ পেরিয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত এবং দেখতে সাধারণ বলেই এখনও অবিবাহিতা। মাকে নিয়ে তার সংসার। স্কুল জীবন থেকে একজন বন্ধু অবশ্য তার আছে কিন্তু সে এখন দেশের বাইরে। নিশি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রোজ নটা পাঁচটা অফিস করে। তারপর সোজা বাড়ি। এই তার সহজ জীবন। তবে সহজ জীবনেও একদিন টুইস্ট আসে।যেদিন তার রবির সাথে দেখা হয়।
রবির সাথে নিশির প্রথম দেখার ঘটনাটা কিছুটা ফিল্মী। নিশি সেদিন ফুলের দোকানে গেছিলো ফুল কিনে নিজেকেই উপহার দিতে। কারণ তার মন খারাপ। মন খারাপ হলে এরকম কাজ সে প্রায়ই করে। আর রবি ফিরছিলো মিউজিক ক্লাস থেকে। তো নিশি ফুল কিনে দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামতেই পেছন থেকে রবির সাথে ধাক্কা লাগে। ধাক্কা খেয়ে রাগে জ্বলে ওঠে নিশি। ঘুরেই কষে চড় লাগায় রবির গালে। চিৎকার করে বলে, “অন্ধ নাকি! চোখে দেখতে পান না?” রবি শান্ত নির্বিকার ভাবে জবাব দেয়, “হ্যাঁ! আমি অন্ধ। চোখে দেখতে পাই না।
নিশি এতক্ষণে খেয়াল করে সত্যিই ছেলেটা অন্ধ! সে লজ্জা পায়। রবিকে সরি বলে। বাড়িতে পৌছে দিতে চায়। রবি অস্বীকার করে। নিশি আবারো সরি বলে। রবি জানায়, এরকম ঘটনা তারসাথে অহরহ ঘটে এসব সে মনে নেয়না। নিশি সাফাই দেওয়ার জন্য জানায়, আসলে সে তার বেস্ট ফ্রেন্ডকে মিস করছে বলে তার মুড অফ ছিলো, সে বুঝতে পারেনি। রবি বলে, যেহেতু তার কোন বন্ধুই নেই, তাই বন্ধুকে মিস করা বিষয়টা সে জানে না। নিশি রবিকে তার নিজের জন্য কেনা ফুলগুলি উপহার দেয়। রবিকে বন্ধুত্বের আহ্বান করে। রবি খুশি মনে সাড়া দেয়। এভাবেই শুরু তাদের বন্ধুত্বের। হঠাৎ বৃষ্টির মতো আসা নিশি রবির অন্ধকার জীবনে আলো হয়ে ঢুকে পড়ে। দিনে দিনে দুজনের প্রতি দুজনার ভালোলাগা বাড়তে থাকে। ভালোলাগা হয়তো ভালোবাসা অবদি পৌছেও যায় কিন্তু কেউই সেটা মুখে আনে না।
নিশি প্রায় রোজই রবির সাথে দেখা করতে তার বাড়িতে আসে। রবির মা ও নিশিকে পছন্দ করতে শুরু করে। নিশির মতো রবিরও মাকে নিয়েই সংসার। ওদের সম্বোধন আপনি থেকে তুমি তে পৌছায়। নিশি জানতে পারে দু বছর আগে একটা অ্যাকসিডেন্টে রবি চোখের দৃষ্টি হারায়। তার চাকরি চলে যায়। রবি গান পছন্দ করে। এক সময়ে শখের বশে গান করতো। এখন সে একটা গানের স্কুল গান শেখায়। নিশি গানের গ ও জানে না। রবি কবিতা ভালোবাসে। দারুণ আবৃত্তি করে। নিশি আগে কখনও কবিতা না পড়লেও এখন পড়ে। রবির জন্য। তারা একসাথে নদীর ধারে ঘুরতে যায়। গান শোনে। অতি তুচ্ছ বিষয়েও ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে কাটিয়ে দেয়। নিশি রবিকে কবি বলে ডাকে। রবিও নিশিকে দেবী বলে ডাকে। রবি জিজ্ঞাসা করে,
– তুমি আমাকে কবি ডাকো কেন?
– বাহ! তুমি যে কবিতা লেখো। কিন্তু তুমি কেন আমাকে দেবী বলো? রবি হাসে,
– তুমি দেবী হয়েই এসেছো এই অভিশপ্ত অন্ধকার জীবনে। অ্যাকসিডেন্টে চোখ হারানোর পর আমিও কোথাও হারিয়ে গেছিলাম। বেঁচে তো আমি ছিলাম কিন্তু জীবন তুমি দিয়েছো। তুমি আসার পর আমি নিজেকে আবার ফিরে পেয়েছি। আমার জীবনে ঈশ্বরের দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি। নিশি টের পায় গত আঠাশ বছরে যে সর্বনাশের আশঙ্কাও সে করেনি তা সত্যিই ঘটে গেছে। প্রেম! রবি বলতে থাকে,
– আমি পূজা করি তোমার। তুমিই আমার মন মন্দিরের দেবী।
– তুমি ভুল ভাবছো। আমি কোন দেবী নই। আমি অতি সাধারণ। আমি নিশি।
– নিশি মানে তো রাত। রাত মানে, আকাশ ভরা তারা! জোছনা! জোনাকি! আর চাঁদ। চাঁদ মানে কবিতা। কবিতা মানে জীবন! জীবন মানে প্রেম। নিশির চোখে জল এসে যায়। এভাবে সে কখনও ভাবেনি। এতোদিন “নিশি” নামটিকেও নিজের মতন অসুন্দর মনে হতো তার। ভেজা গলায় প্রশ্ন করলো,
– আর প্রেম মানে কি?
– যত দুষ্টু দুষ্টু ব্যাপার! রবি হাসতে থাকে। নিশি লজ্জা পায়। রবি দেখতে পায় না। নিশির আবার মন খারাপ হয়।
– কিন্তু আমাকে দেখলে তোমার ভালো লাগবে না। রবি হাত বাড়ায়। নিশির চোখ, নাক, ঠোঁট যত্নে ছুয়ে দেখে।
– আমি তোমাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি। বুকের ভেতর ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ো তুমি। তুমি সুন্দর। সব থেকে সুন্দর। তোমার চে সুন্দর আর কিছু হতেই পারে না। তুমি যে দেবী। তুমি কখনও আমাকে ছেড়ে যেও না। যাবে না তো?
– যাবো না।
– মাঝে মাঝে মনে হয় যদি শুধুমাত্র একবারের জন্য আমি আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতাম। আমি দুচোখ ভরে দেখতাম আমার দেবীকে ! যদি একবার শুধু দেখতে পারতাম… জীবনের কাছে আর কিছু চাইতাম না। রবির হাহাকার নিশিকে ভেঙেচুরে দেয়। নিশির কান্না পায়। পরদিন নিশি রবিকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায়। ডাক্তার আশ্বাস দেয় অপারেশন হলে রবি দৃষ্টি ফিরে পাবে। কিন্তু তার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। রবি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে তার কাছে এত টাকা নেই। নিশি তার বিয়ের জন্য রাখা গয়না জমানো টাকা খরচ করার সিদ্ধান্ত নেয়। নিশির মা বাঁধা দেয়।
– এটা তোর সারাজীবনের পরিশ্রমের টাকা। তোর বিয়ের খরচ। যখন অন্য ছেলেমেয়েরা ঈদে পূজায় আনন্দ করে বেড়াতো তখন তুই সারামাস সেলসগার্লের কাজ করে কখনও টিউশনি করে কখনও কল সেন্টারে খেটে এই টাকা জমিয়েছিস।ধুমধাম করে বিয়ে করবি বলে! শহরের সবচে বড় কমিউনিটি সেন্টারে। আলো ঝলমল করবে। অ্যালবাম ভর্তি ঝকঝকে ছবি। বুড়ো বয়সে তোর নাতি নাতনিরাও সেই ছবি দেখে তাক লেগে যাবে! এতোটাই চোখ ধাঁধানো বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। এই একটাই তো স্বপ্ন তোর!
– রবির জন্য এমন হাজারটা স্বপ্ন আমি খরচ ফেলতে পারি মা। তাছাড়া আমার স্বপ্নের চাইতে ওর দেখতে পাওয়াটা বেশি জরুরি। মা বুঝে যায় নিশি বুঝবে না। এদিকে রবিও আপত্তি তোলে। সে কিছুতেই টাকা নেবে না। নিশি তাকে বোঝায়। শেষ পর্যন্ত রবি রাজি হয়। অপারেশন ভালোভাবেই হয়ে যায়। খুব শীঘ্রই রবির ব্যান্ডেজ খোলা হবে। সে আবার দেখতে পাবে। নিশি রোজ হাসপাতালে রবিকে দেখতে যায়। হাত ধরে বসে থাকে। রবির উচ্ছ্বাস তাকে উন্মাদ করে সেই সাথে একটা অকারণ অজানা ভয় বুকের মধ্য তোলপাড় করে।
নিশি পাত্তা দেয় না। এরমধ্যে রবির মা একদিন এসে নিশিকে একজোড়া কাঁকন পরিয়ে বিয়ের কথা পাকাপাকি করে যায়। কথা হয় রবির চোখের ব্যন্ডেজ খোলার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা হয়ে যাবে। নিশির স্বপ্নের বিয়েটা হয়তো হবে না। কিন্তু নিশি আর ও নিয়ে ভাবে না। স্বপ্নের চেয়েও ভালোবাসা যে বেশি দামী। তাই সে পেয়েছে। তার চে সুখী আর কে আছে পৃথিবীতে। আজ রবির ব্যান্ডেজ খোলা হবে। রবি দেখতে পাবে। নিশির বেস্ট ফ্রেন্ড সুকন্যাও সেদিনই দেশে ফিরে নিশিকে ফোন করে। নিশি সুকন্যাকে হাসপাতালে আসতে বলে। প্রিয় বন্ধুকে ভালোবাসার মানুষটির সাথে আলাপ করাবে। ফোনে সে অনেকবার বলেছে রবির কথা। রবিকেও তো কতবার বলেছে সুকন্যার কথা। বলেছে সুকন্যাও তারই মতন গান কবিতা ভীষণ ভালোবাসে। সুকন্যা নিশ্চিত করে বলে সে আসছে। নিশি ভীষণ খুশি হয়। মনে মনে ভাবে আজকের দিনটা খুব শুভ।
সব ভালো ভালো ঘটনা ঘটে চলেছে আজ। নিশি কখনও না সাজলেও আজ খুব যত্ন করে সাজে। এইদিনটা যে আলাদা। আজ প্রথমবার রবি দেখবে তাকে। নিশি নীল শাড়ি পরেছে, কপালে নীল টিপ, হাত ভর্তি নীল চুড়ি! এতো নীল কেন! কারণ পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিকদের মতোই রবির প্রিয় রঙ নীল। রবির কেবিনের দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিশি। উদ্বেগ, আগ্রহ, প্রত্যাশা, লজ্জা, আর অকারণ এক ভয়ে সে জড়োসড়ো। ব্যান্ডেজ খোলার ঠিক আগে সুকন্যা আসে। নিশির পাশে দাড়ায়। রবি চোখ খুলে সামনে দুজনকে দেখতে পায়। আসলে শুধু একজনকেই দেখতে পায়। সুকন্যা! দেখার আর কি দোষ! মন যেমন প্রেমের পূজারী, চোখ তেমন সৌন্দর্যের পূজারী। সুকন্যা এমনই রূপবতী তার পাশে বাকী সব ফিকে ঝাপসা দেখায় যে। রবি অবাক বিস্ময়ে বলে,
– তুমি দেবীইহ!!
– না। ও। সুকন্যা নিশিকে দেখিয়ে দেয়। রবি নিশির দিকে ফিরেও দেখে না। পারে না সুকন্যার দিক থেকে চোখ ফেরাতে।
– তুমি কে?
– আমি সুকন্যা! নিশির বন্ধু!
– ওওহ! তুমিই সুকন্যা! কত যে ভেবেছি তোমার কথা।
সুকন্যা হেসে ফেলে। বাইরে বিজলী চমকায়। হঠাৎ বিনা নোটিশে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। রবির বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এতো সুন্দর হতে পারে কোন মানবীর হাসি! রবি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। নিশি কতবার বলেছে সুকন্যা কত সুন্দর। কথাগুলো শব্দ হয়ে কানে গেছে শুধু। কিন্তু আজ সেই শব্দগুলোর মর্মার্থ হৃদয়ে পৌছালো। থমকে দাঁড়িয়ে থাকে নিশি। ভালোবাসার মানুষটির চোখে যে মুগ্ধ দৃষ্টি দেখার জন্য এতগুলোদিন সে অপেক্ষা করেছিলো শেষ পর্যন্ত তা সে দেখলো তবে নিজের জন্য না।
সুকন্যার জন্য। রবি একটি বারের জন্য ফিরে দেখেনি তার দিকে। একটা কথাও বলেনি। নিশিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সুকন্যার কাছে নিজের ভালোলাগা জাহির করে চলেছে রবি। বড্ড বিব্রত লাগে তার। অপমানে কুঁকড়ে যায় নিশি। বুঝে গেল এখন এখানে সে অনাহুত। মিছে ব্যাস্ততার ভান করে সরে এলো নিশি। ভান না করলেও চলতো। রবির মা ছাড়া কেউ তার কথা শোনেই নি। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে রইলো নিশি। ভেজা শাড়ি বদলালো না, খেতে গেল না, মায়ের ডাকে সাড়া দিলো না। শুধু কাঁদলো। প্রত্যাখ্যান তাও সহ্য করা যায়। কিন্তু প্রিয়জনের উপেক্ষা বড় কঠিন! বাইরে তখনও উথালপাথাল বৃষ্টি।
যেন প্রকৃতিও তাকে ধমকায়, কেন তুই বুঝিসনি বোকা মেয়ে! রবি যখন জ্বলে ওঠে, আলোকিত হয়, তখনই নিশির সমাপ্তি ঘটে! বিকেলে সুকন্যা দেখা করতে আসে। নিশি তখন কেন ওভাবে চলে এসেছিলো জানতে চায় সে। নিশি বাহানা বানায়। সুকন্যাকে এড়িয়ে যায়। মনে মনে সুকন্যার ওপর প্রচণ্ড রাগ করতেও চায় সে। কিন্তু নিশি সুকন্যার মতো সুন্দর না, এতে সুকন্যার তো কোন অপরাধ নেই!! নিজের নিয়তিকেই দোষারোপ করে সান্ত্বনা খোঁজে নিশি। রাতে রবি ফোন করে। উঁহু! নিশির সাথে নিশির ব্যাপারে কথা বলতে সে মোটেও আগ্রহী না। সে জানতেও চায় না সারাদিন নিশি কেমন ছিলো! কোথায় ছিলো! কেন ছিলো! সে ফোন করেছে কারণ সে সুকন্যার বিষয়ে জানতে চায়। সুকন্যার পছন্দ অপছন্দ ভালোলাগা। এখন একমাত্র নিশিই তো তাকে সাহায্য করতে পারে। নিশি ম্লান হেসে জিজ্ঞাসা করে,
– আমিই কেন?
– কারণ তুমি আমার ভালো বন্ধু।
– শুধুই ভালো বন্ধু? আর কিছু না?
– আর তুমি খুব ভালো..
– কারণ আমার জন্য তোমার সুকন্যার সাথে দেখা হয়েছে? নিশির বুকটা মুচড়ে ওঠে। কান্না পায়।
রবি কিছু বলার আগেই সে ফোন কেটে দেয়। পরদিন নিশি সুকন্যার সাথে দেখা করে জানায় রবি কত ভালো ছেলে। রবি তাকে কত পছন্দ করে। যে সত্য প্রেমের প্রতীক্ষায় সুকন্যা রূপ গুণে অর্থে পরিপূর্ণ থাকার পরও আজও বিয়ে করেনি সে প্রেম রবি নিশ্চয়ই তাকে দিতে পারবে। সুকন্যা কোন প্রশ্ন করে না, কোন উত্তর দেয় না, শুধু শুনে যায়। সেদিনের পর থেকে নিশি ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। অন্যদিকে রবি সুকন্যার মন জয় করার জন্য নানান ছেলেমানুষি কাজকর্ম করতে থাকে। রবির মায়ের চোখে বিষয়টা ঠিক লাগে না। তিনি ছেলেকে বোঝাতে যান যে এটা ভুল, অন্যায়। রবি কিছুতেই নিশির প্রতি অবহেলা করতে পারে না। রবি আকাশ থেকে পড়ে। সুকন্যাকে রবির ভালোলাগে এর মধ্যে নিশির প্রসঙ্গ কোত্থেকে আসছে! কেন! সে কিছুতেই ধরতে পারে না। রবি এও বলে যে নিশিকে সে শুধুই বন্ধু হিসেবে দেখে। এর বেশি কিছু না। মা রবিকে মনে করিয়ে দেন যে, নিশি শুধুই রবির বন্ধু নয়, তার হবু স্ত্রী। রবি নির্দ্বিধায় বলে,
– মানা করে দাও।
– তখন কেন নিষেধ করিসনি যখন আমি নিজে কথা পাকা করতে গেছিলাম? জবাবে রবি সাফ বলে দেয়,
– তখন আমি সুকন্যাকে জানতাম না।
মা বিস্ময়ে বোবা হয়ে যান। ছেলেকে তিনি চিনতে পারেন না। তিনি ভেবে পান না কোন মুখে তিনি নিশি সামনে দাঁড়াবেন! মাকে তর্কে হারিয়ে সেজেগুজে একগুচ্ছ গোলাপ হাতে রবি সুকন্যার বাড়িতে হাজির হয়। আর কোন বাঁধা বিপত্তি আসার আগেই সে সুকন্যাকে তার ভালোবাসার কথা জানাবে। সুকন্যার আলিশান বাড়ির ছবির মতন সাজানো ড্রয়ং রুমে বসে সে অপেক্ষা করে। বেশ কিছুক্ষণ পর সুকন্যা সিড়ি বেয়ে নেমে আসে যেন সর্গের পরি! যেন আগুনের দেবী! কি অপরূপ সুন্দর! রবি চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়। সুকন্যা মুচকি হাসে। রবি মোহিত হয়ে বলে,
– তুমি খুব সুন্দর।
– জানি। সুকন্যা শব্দ করে হেসে ফেলে। সুকন্যার কাঁচ ভাঙা হাসিতে ঘর ঝলমল করে। রবির সাজানো সব কথা গুলিয়ে যায়। সুকন্যা আবার বলে,
– আমি এও জানি তুমি কেন এসেছো। আমাকে ঠিক কি বলতে চাও!
– কি?
– এটাই যে আমাকে দেখার পর থেকে তোমার শুধু আমাকেই দেখতে ইচ্ছে করে। আমার পাশে পাশে থাকতে ইচ্ছে করে। তুমি প্রেমে পড়ে গেছো আমার। ভালোবাসো আমাকে। বাসো তো? না?
– অনেক ভালোবাসি।
– আমারো তোমাকে ভালোলাগে। আর ভালোবাসাহ… জানো! এ পর্যন্ত কত জন আমাকে এ কথা বলেছে। সেই স্কুল লাইফ থেকে শুনছি। একজন তো বিষ খেয়ে মরেই গেল! সিলি না? রবি হঠাৎ কোন উত্তর দিতে পারলো না। সুকন্যা নিজের মনেই বলে গেলো,
– তবে আমার মন বলেছে তুমি আলাদা! তুমি অন্যরকম! তোমাকে বিশ্বাস করা যায়। আমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যে কোন কিছু করতে পারো তুমি। সত্যিই পারো তো?
– পারি।
– কিন্তু আমি যে প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করতে পারি না!
– একবার বলে তো দেখো! পৃথিবীর সব সুখ, আনন্দ, হাসি তোমার পায়ে এনে রেখে দেবো।
– আমি চাই তুমি অন্য কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। রবি হেসে ফেললো,
– কখনও তাকাবো না।
– পৃথিবীর আর কোন সৌন্দর্য তুমি দেখবে না। আমিই তোমার দেখা শেষ সুন্দর হবো।
– তুমিই আমার দেখা সবচে সুন্দর। বিশ্বাস করো..
– মুখের কথায় আমি বিশ্বাস করি না। আমার প্রমাণ চাই।
– আমি যে কোন প্রমাণ দিতে প্রস্তুত।
– তাহলে এই নাও ছুড়ি তোমার চোখ দুটো এই মুহূর্তে নষ্ট করে ফেলো! রবি স্তম্ভিত হয়ে গেলো।
– মানে!
– মানে খুব সহজ, আমি চাইনা তুমি তোমার এই চোখ দিয়ে আর কিছু দেখো। আমাকে দেখেছো তোমার দু’চোখ সার্থক আর কিছু দেখার দরকার তোমার নেই!
– তুমি পাগল!
– না।
কিন্তু তোমার চোখ দুটো বিশ্বাসঘাতক! সে শুধুই সুন্দর খোঁজে। তাই আজ তুমি নিশিকে ছেড়ে আমার কাছে এসেছো, কাল যখন তোমার চোখে অন্য কাউকে সুন্দর লাগবে আমাকে ছেড়ে তার কাছে চলে যাবে। আমি শুধু সেই পথটা চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে চাইছি। আমি প্রচণ্ড বুদ্ধিমতী কিনা তাই একটু বেশিই সাবধানী! রবি স্তব্ধ হয়ে যায়। সুকন্যা বলতে থাকে,
– বিশ্বাস করো তুমি তোমার চোখ দুটোকে একটুও মিস করবে না। কেন বলো তো!? কারণ আমি শুধু সুন্দরীই নই অনেক বেশি ধনীও! একেই বলে রাজকন্যা রাজত্ব একসাথে… রবি এক পা পিছিয়ে যায়,
– সুকন্যা! তুমি…
– ভয় পেও না। আমি কথা দিচ্ছি সারাজীবন আমি তোমার খেয়াল রাখবো। পাশে থাকবো। শুধু তোমার চোখ দুটো আমার চাই… তারপর আমি তোমার।
– না।
– না?
যদি না ই পারো তাহলে দরজাটা কোন দিকে তুমি জানো। আমি অবশ্য ভণ্ড,মিথ্যেবাদীদের দাড়োয়ান ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পছন্দ করি। কিন্তু তুমি অন্যরকম! তুমি প্রথমে বিশ্বাস করতে শেখাও তারপর সব ভেঙে দাও! সবাই পারেনা। তুমি পারো। তুমি সত্যিই আলাদা! চুড়ান্ত অপমানিত হয়ে বাড়িতে ফিরে রবি জানতে পারে তার মতন অকৃতজ্ঞ, বেঈমান ছেলের সাথে থাকতে মার ঘেন্না হচ্ছে তাই সে চলে গেছে, গ্রামের বাড়িতে। অপমানে, ক্রোধে রবি ফুঁসতে থাকে। ঠিক তক্ষুনি সামনে এসে দাঁড়ায় নিশি। রবির মায়ের দেওয়া কঙ্কন জোড়া ফেরত দিতে। নিশির কাছে ওগুলোকে আর ভালোবাসার উপহার মনে হয়না। নিয়তির উপহাস মনে হয়। পরাজয়ের চিহ্ন মনে হয়। নিশি রোজ ভাবে আজ ফেরত দেবে। কিন্তু রবি বা তার মায়ের সামনে পড়ার সাহস করতে পারতো না, সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারতো না। বেছে বেছে আজকেই সে ফেরত দিতে আসে। নিশিকে দেখেই রবি রাগে ফেঁটে পড়ে। সুকন্যাকে না পাওয়ার জন্য এবং মাকে হারানোর জন্য নিশিকেই দোষারোপ করতে থাকে। চিৎকার করে বলে,
– আমি কোনওদিনও বিয়ের কথা বলেছি? কোনদিন বলেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি?
– আমিই একাই ভালোবেসেছি।
– সেটা কি আমার দায়?
– না। রবি শুনেও শোনে না।
– অথচ সবাই আমাকেই ভুল বুঝছে! অপারেশন করিয়েছো বলেই তোমাকে আমার বিয়ে করতে হবে? তাহলে তো সেই ডাক্তারকেও বিয়ে করতে হয় যিনি অপারেশন করলেন! নার্সগুলোকেও! ওভাবে ভাবলে তো পুরো হাসপাতালটাকেই বিয়ে করতে হয়। তাই কি কখনও সম্ভব!
– ঠিকই তো।
– হ্যাঁ! মানছি তুমি আমাকে অনেক সাহায্য করেছো কিন্তু তাই বলে আমার জীবনের মালিক হয়ে যাওনি তুমি।
– জানি।
– সবাই আমাকে অকৃতজ্ঞ বলছে কিন্ত আমি অকৃতজ্ঞ না। আমি তোমার পাওনা টাকা সব ফেরত দিয়ে দিবো।
– সেই ভালো। ফেরত দিয়ে দিও। আমার হৃদয়টাও ফেরত দিও, যেটা তোমার হয়ে গেছে। যত রাত তোমাকে ভেবে না ঘুমিয়ে কেটেছে, যত অশ্রু ঝরেছে.. ফেরত দিয়ে দিও। যত স্মৃতি আছে, যত স্বপ্ন বুনেছি তোমাকে ঘিরে সব হিসেব করে ফেরত দিয়ে দিও। রবি হঠাৎ কোন উত্তর দিতে পারে না। নিশি বলে,
– পারবে না তো? জানি। আমি প্রতিদানের আশায় কখনও কিছু করিওনি। যা করেছি ভালোবেসে করেছি। তোমাকে ঋনী করতে না। তবু যদি কোন ঋণ থেকে থাকে, আজ আমি তোমাকে সেই দায় থেকে মুক্তি দিলাম। নিশি কাঁকন জোড়া টেবিলি রেখে ফিরে আসে। আজ আর সে কাঁদে না। সে আর কখনওই কাঁদে না। হয়তো চোখের জল ফুরিয়ে গেছে। তবু মা সান্ত্বনা দেয়, সুকন্যা বোঝায়,
– রবি তোর যোগ্য ছিলো না।
– উঁহু আমি নিজেই কারো ভালোবাসার যোগ্য নই।
– পৃথিবীর সবচে শুদ্ধতম মানুষটিকেও হাজার বছর সাধনা করে তোকে পেতে হবে।
সুকন্যা জোর দিয়ে বলে। নিশি জানে এসব কথার কথা। বলতে হয় তাই বলা। এই ঘটনার ছয় মাস পর ধুমধাম করে সুকন্যার বিয়ে হয়ে যায়, ঠিক যেমনটি নিজের জন্য ভেবে রেখেছিলো নিশি তেমন জমকালো বিয়ে। সুকন্যা বরাবরই বুদ্ধিমতি। সে নিজে কখনও ঠকে না, অন্যকে ঠেকতে দেখে শিক্ষা নেয়। নিশিকে দেখে সে বুঝে যায় প্রেম জিনিসটাই একটা মস্ত ফাঁকি। সকলে আসলে রূপের পূজারী। তাই সে প্রেমের জন্য আর অপেক্ষা না করে বাবা মার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে নেয়, যে কিনা শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত, সুদর্শন এবং অবশ্যই ধনী। রবিও ভালোই আছে।
সে বাস্তববাদী ছেলে যে কোন পরিস্থিতিতে সে ঘুরে দাড়াতে জানে! আর নিশি… মা নিশির বিয়ের অনেক চেষ্টা করেন। আত্মীয়রা বেশ কিছু বড় ঘরের সম্বন্ধও আনে। বেশিরভাগই অবশ্য ডিভোর্সি বা বিপত্নীক। কারো হয়তো একটা দুটো বাচ্চাও আছে। কিন্তু মেয়ের বয়সটাও যে বেশি। দেখতেও আহামরি কিছু না। আর্থিক সামর্থ্যও তেমন নেই। এই মেয়ের জন্য এরচে ভালো পাত্র এই বাজারে শুধু মুস্কিল না, অসম্ভব। কিন্তু নিশি রাজি হয় না। একজনকে মন দিয়ে আরেকজনের সংসার করা মানে তো মানুষটাকে ঠকানো! নিশি ঠকতে জানে ঠকাতে জানে না। যা বলছিলাম নিশিদের মতো ইমোশনাল ফুলদের জীবনে আসলে কিছু হয়না।