‘মা সময়মতো খাবার খেয়ো’_ এই কথা শেষ না হতেই ফোনের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। রাফি আর কথা বলতে পারল না। সে আবার কল করলো মায়ের মোবাইলে। কিন্তু ফোন বন্ধ। রাফি ভাবল হয়তো ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। এত রাতে মাকে না জাগিয়ে কাল কল করবো। পরের দিন অফিসে যাওয়ার সময় সে আবার কল করলো মায়ের ফোনে কিন্তু ফোনটা এখনো বন্ধ বলছে।
মায়ের আবার কিছু হলোনা তো! ভাবতেই রাফির বুকটা কেঁপে ওঠে। দুশ্চিন্তা করতে করতে রাফি অফিসে গেল। একটু পর রাফির ফোনে একটা কল আসে। রাফির বন্ধু রনি কল করেছে। রনি জানায় রাফির মায়ের নাকি অসুখ সে যেন খুব দ্রুত বাড়িতে চলে আসে। রাফির দুশ্চিন্তাটা আরও বেড়ে গেল। রাফি তার অফিসের স্যারকে বলে ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাসের ছিটে বসে রাফি ভাবতে থাকে তাদের পুরনো দিনের কথা। রাফির বাবা ছিলেন একজন দিনমজুর।তবুও বাবা-মার আদরের ছেলে রাফি।
হঠাৎ করেই হার্ট এ্যাটাক করে মারা যান রাফির বাবা।সেই থেকে রাফির আর তার মায়ের জীবনে শুরু হয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম। গ্রামের মানুষ বলেন, ‘ও রাপির মাও, নিজে এত কাম না কইরা পোলাডারে কামে লাগাও।’ রাফির মা বলেন, ‘ক্যান, মোর পোলা কাম করব ক্যান? মোর পোলায় চাকরি করব। চাকরি কইরা মোরে ঢাকায় নিয়া যাইব তহন মুই আর কাম করমু না।’ রাফির মা মানুষের বাসায় কাজ করে যা পান তা মা-ছেলে ভাগ করে খান। রাফি এভাবে কষ্ট করেই পড়ালেখা করে আর শপথ করে যত দ্রুত সম্ভব পড়ালেখা শেষ করে চাকুরি নিয়ে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে। পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় পাড়ি জমায় রাফি। ছোট্ট একটা চাকুরি পেয়ে যায় সে। এই ছোট চাকুরির বেতন দিয়ে চলা সম্ভব নয়। তাই রাফি অপেক্ষা করে যদি প্রমোশন হয়ে যায় তখন মাকে ঢাকায় নিয়ে আসবে। অনেক কষ্ট করেছে মা।
বাবা মারা যাওয়ার পর বিশটা বছর অনেক পরিশ্রম করেছে মা। এবার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে গ্রামে চলে আসে রাফি। বাড়ির কাছে আসতেই বাড়ির উঠোনে অনেক মানুষের ভিড় দেখতে পায় রাফি। অজানা এক ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে রাফির। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতেই কিছু একটা দেখে থমকে যায় রাফি। রাফির সামনে এখন খাটের ওপর শোয়ানো একটা লাশ, রাফির মমতাময়ী মায়ের লাশ। বুক ফেঁটে চাপা কান্না আর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ে রাফির। কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় সে। রাফি যখন ঢাকায় ছিলো তখন তার মা তাকে বলেন, ‘বাপজান আমার লাইগা একটা সুয়েটার নিয়া আসবি?, অনেক শীত পড়তাছে রে বাপ তাই আমার শীত লাগে।’ মায়ের সেই কথা মনে পড়তেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে রাফি। রাফি মায়ের জন্য চাঁদর আর একটা সুয়েটার এনেছে।
রাফি সুয়েটারটা বের করে মায়ের লাশের উপর রাখে আর বলে, ‘মা তুমি কেন চলে গেলে আমাকে একা রেখে, দেখো মা তোমার ছেলে ফিরে এসেছে, তোমার আর ঠান্ডা লাগবেনা মা আমি তোমার জন্য সুয়েটার আর চাঁদর এনেছি, এই যে দেখো। তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পারলাম না মা।’ রাফির এমন কথা শুনে বাড়ির উঠোনের সব লোকজন বলতে থাক- ‘পোলাডা মনে হয় পাগল হইয়া গেছে মায়ের মরণের কারনে।’ রাফি মায়ের মৃত্যশোকে কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রাফিকে গ্রামের মুরব্বী লোকেরা বুঝিয়ে শান্ত করে। তারপর শুরু হয় লাশ দাফনের প্রস্তুতি। এক মমতাময়ী মাকে কবরে রাখার জন্য কবর প্রস্তুত করা হচ্ছে। রাফি সেই কবরের পাশে গিয়েও একবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। মাকে সুন্দর করে গোসল করানো হলো, আতর সুরমা দিয়ে সাদা কাপড়ে মোরানো হলো।
বাঁশ কাঁটা হলো এবং কবরের সব রকম প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। রাফির মায়ের লাশ জানাযা করার জন্য ওদের বাড়ির পাশের স্কুল মাঠে নেওয়া হলো। জানাযা সম্পন্ন করে খাঁটিয়ায় করে কবরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রাফির মায়ের লাশ। রাফি সহ চারজন ঘাড়ে করে নিয়ে যাচ্ছে লাশ। মায়ের লাশ রাফির ঘাড়ে এটা যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছেনা। তাইতো কষ্টে বার বার কেঁদে উঠছে সে। লাশ যখন কবরে রাখা হলো তখন রাফি চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। সে আবার বলে, ‘মা কেন একা রেখে গেলে। মা তোমার তো এই মাটির ঘরে একা একা ঠান্ডা লাগবে গো।’ সবাই আবার বুঝিয়ে শান্ত করে রাফিকে। মাকে কবরে রেখে আসে রাফি।
সেই সাথে রেখে আসে এক মমতাময়ী মায়ের স্বপ্নকে। মাকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে যায় রাফি। রাফির মায়ের মতো হাজারো মমতাময়ী মায়ের স্বপ্ন এভাবেই বিলীন হয়ে যায়। সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে শেষে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয় এইসব মমতাময়ী মহীয়সীদের। সারাজীবনের কষ্টগুলো ঘোঁচানোর আগেই নিভে যায় জীবন প্রদীপ। সারাজীবনের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায় এইসব মমতাময়ী মা দের। মমতাময়ী মার ভালবাসা আর উৎসাহের কারনেই একটা ছেলে তার স্বপ্ন পূরণের লক্ষে ছুটতে থাকে। স্বপ্ন একদিন ঠিক পূরণ হয়ে যায় কিন্তু ততদিনে স্বপ্ন দেখানো মানুষটা আর থাকেনা। চলে যায় না ফেরার দেশে।
এমন সব মমতাময়ী মা দের পায়ের জুতা আমরা যদি নিজের শরীরের চামড়া দিয়ে তৈরি করে দিই তবুও ঋণ শোধ হবেনা। আল্লাহ্ প্রত্যেকটা মহীয়সী মমতাময়ী মা কে বেহেশত নসীব করুন। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি মমতাময়ী মা দের। মমতাময়ী মায়েরা সারাজীবন অমর হয়ে থাকবে ছেলেদের হৃদয়ে।
“সমাপ্ত”