নিরামিষ জামাই

নিরামিষ জামাই

বিয়ের পর না কি ছেলেরা বদলে যায়। প্রায় নব্বই ভাগ মেয়েদের এটাই ধারণা। ধারণা বললে ভুল হবে এটা তাদের বিশ্বাস। কথাটি যতটা স্বাভাবিক ভাবে বলা যায় বেপারটি মোটেও ততটা স্বাভাবিক নয়। এই বদলে যাওয়া নিয়ে কারো কারো তো সংসার ভাঙ্গার মত অবস্থা। সংসার না ভাঙ্গলেও তারা যে খুব ভাল আছে তা কিন্তু বলা যায় না। রোগ হলে যেমন ওষুধ খেতে হয় ঠিক তেমনি দু’বেলা ক্যাপসুলের মত শুনতে হয় তুমি আমাকে আগের মত আর ভালবাসো না, তুমি বদলে গেছো। এই সমাজে এমন ছেলে মানুষ হয়তো পাওয়া যাবে না যে তার স্ত্রীর মুখে এমন কথা একবারও শুনে নাই। হয়তো এই কথাটির মধ্যে থাকে অনেক আবেগ অথবা থাকে ভাঙ্গনের করুন সুর।

– বিয়ের আগে তো খুব গান গাইতে, ফোন দিলেই ওপাশ থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসতো। সারারাত না ঘুমিয়ে গান শুনাতে। যতই বলতাম গভীর রাত হয়ে গেছে এখন ঘুমাও ততই তোমার গানের ফুল ফুঁটতো। এখন এসব কোথায় গেছে শুনি?

– শায়রা বোঝার চেষ্টা করো, সকালে আমার অফিস আছে। সারাদিন ক্লান্তির পর বিছানায় শুয়ে পরলে এমনিতেই ঘুম চলে আসে।

– ওহ! বিয়ে করার আগে বুঝি তোমার অফিস ছিল না তাই না! এই ওঠো, ওঠো বলছি। এখনই তুমি আমাকে গান শোনাবে।
– প্লিজ জেদ করো না। তুমি না ভাল, আসো ঘুমিয়ে পরি।
– না আমি ভাল না, তুমি এখনই আমাকে গান শুনাবে।
– ওরে কি জ্বালায় পরলাম!
– আমি কিন্তু এখন কান্না শুরু করবো। তুমি গান গাইবে কি না বলো?
– তোমার যা খুশি তাই করো, আমি ঘুমালাম।

কেউ মনের দুঃখে ওপাশ ফিরে বালিশ ভিজিয়ে কাঁদে আরেক পাশে কেউ ক্লান্তিতে গভীর ঘুমে। একপাশ হওয়া মানুষগুলা দিন বাড়তেই এভাবে অভিমানের ফাঁদে পরে দুই পাশে চলে যায়। কিন্তু ভালবাসা যেখানে অসীম সেখানে মান অভিমানটা খুব একটা বেশি সময় থাকে না। ভালবাসা ক্লান্তিকেও হার মানায়। আর তাই ক্লান্তিতে মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গানোর গান চলতে থাকে। ওপাশ ফিরে থাকা মানুষগুলো একপাশে চলে আসে। বেঁচে থাকে, এভাবেই ভালবাসা বেঁচে থাকে।

– এই শোনও।
– হুম বলো।
– আগামীকাল আমার সব বান্ধবীরা টিএসসি যাবে। আমিও যাব।
– আমার অফিস আছে। আমি যেতে পারবো না।
– আরে তুমি না আমি যাব ওদের সাথে।
– না গেলে হয় না।
– আচ্ছা তুমি এমন কেনো বলো তো! বিয়ের আগেও তুমি আমাকে কোথাও যেতে দিতে না। বিয়ের পরেও কোথাও যেতে দাও না। এমন কেনো করো?

– কারনটা হাজার বার বলেছি। সকাল সকাল অযথা জেদ করো না।
– আমি যাব। তুমি অনুমতি দাও।
– দিবো না।
– প্লিজ, এমন করো না। অনেক পুরোন বান্ধবীরা ওখানে এক সাথে হবে। কত দিন পর সবার সাথে দেখা হবে। প্লিজ যেতে দাও।

– দেখো শায়রা, টিএসসি এখান থেকে অনেক দূর। তুমি ভাল করে জানো তুমি বাহিরে থাকলে আমি শান্তি পাই না। যখন কলেজ হোস্টেলে ছিলে তখন হোস্টেল থেকে কলেজে গেলেও আমি কেমন জানি একটা অশান্তিতে থাকতাম যতখন না পর্যন্ত তুমি হোস্টেলে না ফিরতে। তুমি বাহিরে থাকলে আমার ভয় হয়। বেশি ভালবাসি তাই ভয়টাও বেশি।

– এসব তোমার সব অযুহাত, ভালবাসা না ছাই। তুমি আমাকে যেতে দিবে না এটাই হচ্ছে তোমার মূল কথা।
– কেনো এমন ভাবছো। তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি। এতো দূরের পথ, তাছাড়া ঢাকা শহর তুমি ভাল করে তেমন চেনো না। আল্লাহ না করুক একটা দূর্ঘটনা যদি ঘটে যায় তখন আমি কি নিয়ে থাকবো বলো?
– সে জন্য তুমি আমাকে ঘরের ভিতর আটকে রাখবে সারাক্ষণ!
– তাও ভাল, আমি তো নিশ্চিত থাকবো আমার বউটা নিরাপদে আছে। অফিসের সময় হয়ে গেছে, আমি চললাম।
– তুমি আসলেই একটা নিরামিষ। নিজেতো বুড়ো হচ্ছো আমাকেও বুড়ি বানিয়ে দিচ্ছো।

কারো কাছে ভালবাসা মানেই নিজের পৃথিবীতে শুধুমাত্র দুটি মানুষ। আর করো কাছে ভালবাসা মানেই পায়ে শক্ত শিকল। সারাদিন ছুঁটে চলা মানুষগুলো ভালবাসার কাঙ্গাল হয় আর যখন সে ভালবাসা দুয়ারে কড়া নাড়ে তখন ভেতর থেকে কেউ বলে উঠে বাড়িতে কেউ নেই। মানুষের বড় ভিন্ন স্বভাব। চায় কারো বাহু ডোরে বাঁধা পরতে, আবার সেই মানুষটাই চায় মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে। কারো কাছে ভালবাসা মানেই তুমি শুধু আমার, কারো কাছে ভালবাসা মানেই আমি তোমারও আবার সবারও। দোটানার এই মানুষগুলা হায়তো নিজেও জানে না আসলে তারা কি সে সুখি। সুখ বড় আপেক্ষিক জিনিস। আর এই আপেক্ষিকতা পরিমাপ করার কোন মানদণ্ড নেই।

– আমি আগামীকাল বাবার বাড়িতে যাব।
– আচ্ছা, তা কখন যাবে?
– সকালে।
– বিকালে গেলে হয় না? সকালে তো অফিস আছে। বিকালে দিয়ে আসবোনি কেমন।
– তোমার লাগবে না। আমি একাই যেতে পারবো।
– ক’দিন থাকবে?
– জানি না।
– তুমি জানো আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না।
– একদম বাজে বকবে না।

আমার কাছে নিজের জীবনটা এখন একটা জেলখানা মনে হয়। আমি তো বিয়ে বসিনি যেন জেলখানার আসামি হয়েছি। এখানে যাওয়া যাবে না, ওইটা করা যাবে না। যা করবো সব কিছুতে তোমাকে থাকতে হবে। দিনে তুমি রাতে তুমি। সব কিছুতে তুমি! আজব, আমার নিজের বলে কি কিছুই নেই।

– তুমি বেপারটা ভুল বুঝতেছো শায়রা।
– মোটেও না। আসলে তুমি একটা ব্যাকডেটেট পারসন। নিজের সখ আহ্লাদ বলে তো কিছু নেই আমার গুলাও সব মাটি করছো। আস্ত একটা নিরামিষের কাছে বিয়ে বসেছি। ভাল লাগে না আমার আর এসব।

শায়রা সেদিন রাতেই বাড়ি ছাড়লো। উদ্দেশ্য বাবার বাড়ি। চোখ মুখে একরাশ বিষাদ আর অতৃপ্তির ছায়া হয়ে ভালবাসার শহরটাকে ছেড়ে পারি জমালো বাবার সংসারে। মনের মাঝে খোব আর অপূর্নতাগুলা নিয়মিত চর্চা করায় তার স্বামীর প্রতি ক্রমেই তার ঘৃণার পরিমাণ বাড়তে থাকে। দিন বারতেই স্বামী নামের সেই মানুষটি শায়রার চোখের বিষ হয়ে দাঁড়ালো। দু’কানে গলে দেয়ার মত হাজার কথা চারপাশ থেকে তার কানে ঢেলে দিতে থাকলো তার আশেপাশের মানুষগুলা। জ্বলন্ত অগ্নির মত পোড়া মনটা নিয়ে দিশাহীন এক জীবন তাকে প্রতি নিয়ত ছুঁয়ে যেতে লাগলো। এ ছুঁয়ে যাওয়ার শেষ স্তরে সিদ্ধান্ত হলো সে আর কখনই তার স্বামী নামের মানুষটার কাছে ফিরে যাবে না।

কেউ তার ভুলটা বোঝাবে কিংবা নিজেই সে তার ভুল বুঝবে এমন ধারণা নিয়ে কাটতে থাকে দিনের পর দিন শায়রার রেখে আসা সেই মানুষটির। কারন বিশ্বাস একটাই, আর তা হলো ভালবাসা। কিন্তু তার ভালবাসার মানুষটি যে আর ফিরবে না সে খবরটি তার অজানাই রয়ে গেলো। প্রতি মূহুর্তে যে মানুষটিকে নিয়ে কাটতো আজ দিনের পর দিন তাকে রেখেই দিনগুলা পার করা কি সত্যিই বড় সহজ! আর যদি সহজই হয় তবে বুঝতে হবে সেখানে ভালবাসা নামের কোন বাসা ছিল না, ছিল ভুলের কিছু খড়খুটো। দিন যায়, রাত যায়, কেটে যায় বছর। কিন্তু শায়রা আজও ফিরে না। ওই দিকে ধুমধামে চলছে শায়রার জন্মদিনের আয়োজন। এবার যেন বেশ ঘটা করেই এই আয়োজন চলছে। তবে এতো বড় আয়োজনের পিছনে কোন না কোন কারন তো থেকেই যায়। সে কানটা না হয় আন্দাজ করেই নেয়া যাক।

– কি বেপার তুমি! তুমি এখানে কেন?
– শুভ জন্মদিন। তোমার পছন্দের গোলাপ, নাও।
– আমি তোমার কাছ থেকে কিছু নিতে চাই না। তুমি চলে যাও।
– হুম চলে যাব, তবে যাওয়ার আগে তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল।
– তোমার সাথে আমি কোন কথা বলতে চাই না।
– তোমার কোন কথা বলতে হবে না।

আমি বলবো তুমি শুধু শুনবে। হ্যা, তুমি সত্যি বলেছো। আমি নিরামিষ। নিরামিষ টাইপের মানুষ। সকালে ঘুম থেকে উঠি তোমার মুখ দেখে। অফিসে যেতে যত দেরিই হোক না কেন তোমার হাতের বানানো নাস্তা না খেয়ে বিয়ের পর কোন দিনই অফিসে যাইনি। অফিসে পৌঁচ্ছে তোমাকে ফোন করা, সারাদিনে কয়েকবার কানে ফোন গুজে তোমার সাথে কথা বলা আর কাজ করা। অফিস থেকে রওনা দেয়ার আগে তোমাকে ফোন করা।

– এসব আমি জানি।
– আমাকে শেষ করতে দাও।

বাড়ি ফিরে তোমার হাতের রান্না খাওয়া, বিকালে চুটিয়ে দু’জনে আড্ডা দেয়া কিংবা কোথাও থেকে ঘুরে আসা। রাতে এক সাথে খাবার খাওয়া তারপর বিছানায় শুয়ে গল্প করা গান গাওয়া। একসময় ঘুমিয়ে যাওয়া। হুম, সত্যিই আমি বড় বেশি নিরামিষ। কারন আমার নেই কোন বন্ধুবান্ধব, নেই কোন বাহিরের আড্ডা। কাজের দোহাই দিয়ে তোমার থেকে দূরে থাকার নেই কোন বাহানা। বাড়ি ফিরে বাকিটা সময়ে হ্যাটসএপ, ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে সারাক্ষণ পরে থাকি না। আমি নিরামিষ না তো কি! যে মানুষটার চব্বিশটা ঘন্টা কাটে তোমাকে নিয়ে সে মানুষটা নিরামিষ না তো কি আমিষ হবে! শায়রা, আমি চাইলেই পারি আমার ছাব্বিশ ঘন্টা সময়টা এই পৃথিবীর রং তামাশায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে। চাইলেই পারি পৃথিবীর গতিতে নিজের গা ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু আমি তা কখনই চাইনি। আমি সবটা সময় চেয়েছি আমার প্রতিটি মিনিট নয়, আমার প্রতিটি মিনিটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশটাতেও যেনও তুমি জড়িয়ে থাকো। কারন আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। অনেক বললে ভুল হবে, এতোটাই ভালবাসি যে আমার পৃথিবী বলতে শুধু তুমি।

আর তাই চেয়ে ছিলাম তোমার পৃথিবীতেও শুধু আমিই থাকতে। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি আমি এই নিরামিষ মানুষটা তোমার কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়াবো। ভাল থেকো, আমি আসি। বাড়িতে ঘটা করে জন্মদিনের আয়োজন যে শুধু জন্মদিন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে না তা শায়রার স্বামী বেশ বুঝতে পেরেছে। তাই সেখানে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেলো। মানুষ যখন শূন্যতায় ভোগে তখন সে মামুষ এ ধরণের অসারতায় ভোগে। সেই অসারতা তাকে বুঝতে দেয় না কষ্টটা আসলে কোথায় হচ্ছে। পুরুষ মানুষ বড় বিচিত্র। তারা প্রকাশ্যে নয়, রাতের আঁধারে নিরিবিলিতে নিজের কষ্ট নিজের কাছে প্রকাশ করতে সাচ্ছন্দ বোধ করে। এদের দুঃখ মানুষ দেখলে কেটে পরে। কিংবা কারো একটু আওয়াজে চোখের পানি শুকিয়ে যায়।

দুপুরের ক্লান্তিতে অফিস থেকে এসেই বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটি প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভব করে। কিন্তু পেটের সেই ক্ষুধাটাও মনের ক্ষুধাটাকে হার মানাতে পারে না। পাঁচ ফিট আট ইঞ্চি দেহটা বিছানাতেই পরে থাকে। নিস্তব্ধ ভালবাসা বড় নিষ্ঠুর, এই ভালবাসা শুধু নিজেকেই কষ্ট দিতে জানে। পৃথিবীর দেয়ালের কোন প্রান্তেও এই ভালবাসার কোন লিখনি থাকে না। শুধু পুঁড়তে থাকা ধুয়াহীন এক গন্ধ ছড়াতে থাকে যা না পায় কেউ শুকতে না পায় কেউ জানতে।

– এই টেবিলে খাবার দিয়েছি।
– তুমি!
– আমি না তো কে! হাত মুখ ধুয়ে আসো। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে।
– তা কি রান্না করেছো?
– নিরামিষ।
– আমি তো ভাবলাম আমিষ।
– আর লজ্জা দিয়ো না। প্রতিটা মেয়েই চায় তোমার মত একজন নিরামিষ স্বামী। আমি ঠিক কতটা ভাগ্যবতী আমি নিজেও জানি না। আর জানি না বলেই ভুলে করে বসে ছিলাম। এমন নিরামিষ স্বামী কয়জনের ভাগ্যে জোটে শুনি!

– যাক, তাহলে নিরামিষই এখন ভরসা।
– শোনও, তোমাকে কিন্তু বারো মাস নিরামিষ খেতে হবে।
– কি কি কি বললে! বারো মাস?
– জী বারো মাস, তুমি না আমার লক্ষী নিরামিষ জামাই।
– ঠিক আছে চলো, তাহলে নিরামিষই খাই।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত