‘আমায় পছন্দ করেন?’ ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো তূর্য। হুট করে পিছন থেকে কথাটা কেউ একজন বলল। সবাই পিছনে তাকালো। হৈমন্তি অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তূর্যের দিকে। তূর্য বড় করে একটা ঢোক গিললো। সবাই তূর্যের দিকে তাকালো। হৈমন্তি আবার বলল….
–কি হলো আপনি আমায় পছন্দ করেন?
তূর্য কি বলবে বুঝতে পারছিনা। এতক্ষণ বন্ধুদের সাথে হেসে হেসেই কথা বলছিলো ও। কিন্তু হৈমন্তির কথায় রীতিমত ঘামা শুরু করলো সে। ও কোন কথা বলতে পারছেনা। সবাই তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। এতে করে তূর্য একটু বেশিই ঘাবড়ে গেলো। হৈমন্তি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আস্তে করে বলল….
–একটু শুনুন…? তূর্য আগের মতই বসে আছে। যাবে কি যাবেনা বুঝতে পারছেনা। হৈমন্তি এবার একটু রেগেই বলল….
-কি হলো উঠবেন নাকি আমি টেনে তুলব?
তূর্য ভয় পেয়ে বসা থেকে উঠলো। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হৈমন্তির দিকে তাকিয়ে ওর সাথে একটু দূরে গেলো। হৈমন্তি বলল….
–এতক্ষণ তো হাসছিলেন, এখন এরকম গোমড়ামুখো কেনো?
-উহু এমনিইই….কি…কিছু বলবেন?
–বিরক্ত হচ্ছেন?
-না, বন্ধুরা রাগ করবে।
–আর আমি রাগ করলে?
-জানিনা।
–আপনি আমায় পছন্দ করেন?
-মা মা মানে?
–এত মানে মানে করবেন না। কালকে আপনি ফাহিমের (হৈমন্তির ক্লাসমেট) সাথে মাইডেতে পিক দেওয়াতে সেখানে এংরি রিয়েক্ট দিয়েছেন কেন? আবার লিখেছেন আজাইরা। কেনো বলুনতো…?
তূর্য হৈমন্তির এমন প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে গতকাল রাতে তূর্য যখন হৈমন্তির মাইডেতে ফাহিমের সাথে পিক দেখে তখন সে এংরি রিয়েক্ট দেয়। আবার আজাইরাও লিখেছে। কিন্তু পরক্ষণেই মেসেজটা ডিলেট দেয়। কিন্তু সেই মেসেজটা নোটিফিকেশন আকারে যাওয়ার কারণে হৈমন্তি দেখে ফেলে। তূর্য মাথা নিচু করে আছে। হৈমন্তি বলল….
–ফাহিম আমার ফ্রেন্ড। আর ওর কথাতেই পিকটা মাইডেতে দিছিলাম। এতে আপনি কেনো রাগলেন হু?
-আচ্ছা আমি সরি। আর কখনো এংরি রিয়েক্ট দিবনা।
–আপনি এত বোকা সোকা কেনো?
-হু?
–কিছুনা।
-আচ্ছা।
–এরপর থেকে প্রাক্টিস করবেন।
-কিসের প্রাক্টিস?
–এইযে কথা বলার প্রাক্টিস।
-কেনো?
–তবুও যাতে এমন বোবার মতন না থাকতে হয়।
-আমি কথা বলিতো, বোবা না।
–কচু আপনি।
-মানে?
–কিছুনা।
-আচ্ছা।
তূর্য এবং হৈমন্তি দুজনেই অনার্স থার্ড ইয়ারে। কিন্তু আলাদা ডিপার্টমেন্ট। তূর্য বেশ শান্তশিষ্ট, চোখে সবসময় একটা মোটা ফ্রেমের চশমা থাকবে। আবার মাঝেমাঝে কাঁধে গীটার দেখা যাবে। গানের গলা বেশ, ভার্সিটির সবাই তার ফ্যান বলা চলে। অপরদিকে হৈমন্তি বেশ চঞ্চল। ডিপার্টমেন্টের সেরা সুন্দরীদের তালিকায় আছে বললেও ভুল হবেনা। কোন এক অজানা কারণে তূর্যর হৈমন্তিকে ভালো লাগে। ব্যাপারটা ভালো লাগা নাকি ভালোবাসা তূর্য ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। হৈমন্তির মাইডেতে ফাহিমের সাথে হৈমন্তির পিক দেখে হুট করে রাগ ওঠে তুর্যর। আর সাথেসাথে সেখানে এংরি রিয়েক্ট দেয়, সাথে আজাইরা লিখে মন্তব্য করে। পরক্ষণেই আবার রিমুভ করে দেয়। তূর্য আমতাআমতা করে বলল….
–আমি যাব?
-আঁটকিয়ে রেখেছি?
–ডেকেছিলেন যে….
-উত্তরতো দিলেননা। পছন্দ করেন আমায়?
–আচ্ছা আমি যাই ওরা রাগ করবে?
-বন্ধুরা?
–হু, পরে ক্ষেপাবে আবার।
-ক্ষেপবেন, সমস্যা কি। বন্ধুরা ক্ষেপালে যদি একটু ভালো লাগার সৃষ্টি হয় তাহলে মন্দ কি?
–বুঝিনি?
-আপনার গানের গলা বেশ, একটা গান শোনাবেন?
–আমি নার্ভাস পারবনা এখন।
-নার্ভাস কেন?
–জানিনা, আমি চলি।
বলেই চলে যায় তূর্য। পিছন থেকে আরো একবার ডাক দেয় হৈমন্তি, কিন্তু তূর্য না শোনার ভান করেই চলে যায়। হৈমন্তি হাসে, ভুবন ভোলা সেই হাসি। তবে সেই হাসিটা সে তূর্যর জন্যই হাসে। মানুষের হাসি অনেকরকম হয়। খেয়াল করলে দেখা যায় কেউ কাঁদতেছে অথচ তার মুখে হাসি। আবার কেউ নতুন প্রেমে পরলে অন্যররকম হাসে। অনেকদিন পর কোন হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পেলে হাসে। একেক হাসি একেকরকম। হৈমন্তি ঠোঁট চেপে হাসে। কেনো হাসে সে জানেনা। তবে মোটা ফ্রেমের চশমা ওয়ালা ছেলেটাকে তার খারাপ লাগেনা। তার স্বপ্নে বিভোর হতে কখনো বিরক্ত বোধ হয়না। তবে মাঝেমাঝে হুট করে ছেলেটার চোখে চোখ পরলে হৈমন্তির বুকটা কেঁপে ওঠে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। কেন এমন হয়? কোন উত্তর খুজে পায়না হৈমন্তি। ভাবতে থাকে আনমনে….কি আছে ওর মাঝে? হু…
শিমুল বিছানার উপর দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। শিমুলের মন খারাপ। বড্ড বেশিই খারাপ। আবারো তিথির সাথে ঝগড়া হয়েছে তার। তিথি শিমুলকে ব্লক করে রেখেছে। তার আগে বলে দিয়েছে আর কখনো যাতে যোগাযোগ না করে। তূর্য রুমে প্রবেশ করে। শিমুলের কালো মুখ দেখে বুঝে যায় সবকিছু। চোখ থেকে চশমাটা খুলে রোমাল দিয়ে মুছতে মুছতে বলে….
–আবার তিথির সাথে ঝগড়া করেছিস?
-হুম, ব্লক করে রেখেছে। এবার মনে হয় আর খুলবেনা।
–হা হা, বারবার তো এরকমই হয়। ঝগড়া করে ব্লক করে পরে ঠিকই খোলে।
-এবার বেশিই হয়েছেরে, বলেছে আমাকে আর চায়না। আমি কি করব বল? আমার কষ্ট হয়।
–আরে পাগল টেনশন নিসনা। দেখবি ঠিক আগের মতন হবে।
-তুই একটু বোঝা। আমাকে সব জায়গা থেকে ব্লক করেছে।
–এখন-ই?
-না থাক, এখন রেগে আছে, পরে বলিস।
–তোরা পারিসও বটে…..
বলেই তূর্য ফ্রেস হতে যায়। ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে গীটার নিয়ে বারান্দায় যায় সে। টুংটাং গীটার বাঁজানোর চেষ্টা করে। গীটারটা একপাশে রেখে ডাটা অন করে ফেসবুকে যায়। তারপর নোটিফিকেশন মেসেজ চেক করে ছোট একটা পোস্ট করে ‘আচ্ছা, কেমন হবে বলোতো? যদি আমরা পূরণ করি,আমাদের ছোট ছোট আশা। শেষ বিকেলে দু’জনের লেকের পারে বসা। তুমি আমার জন্য নিয়ে আসবে টিফিন বাটি মন্দতো নয়তো, আমি তখন হাসবো। ভেংচি কাঁটবে তুমি, বলব আমি এই চলো একটু হাঁটি। সেদিন তোমার পরনে থাকবে জলপাই রঙগা শাড়ি আমি দেখব, তবুও তোমায় বুঝতে দিবনা, করবনা প্রশংসা। তুমি রাগ করবে ঠিক মিষ্টি অভিমানে, গাল ফুলিয়ে বলবে তোমার সাথে আড়ি।
ছন্দ মিলাতে বলব আমি, ইশশশ তুমি খুব ভারী। রাগ করবে কি তখন? আমি সত্যি সত্যিই এই কথা বলব তোমায় যখন।’ তুর্যর পোস্টে অনেক মেয়েই লাভ, ওয়াও, রিয়াক্ট দিচ্ছে। সেগুলোই এক এক করে চেক করে দেখছে হৈমন্তি। কেউ বেশি প্রশংসা করে মন্তব্য করলে হৈমন্তি সেখানে এংরি রিয়াক্ট দিচ্ছে। শেষে সে নিজেই কমেন্ট করলো উহু রাগ করবনা, আপনাকে কোলে নিয়ে বসে থাকবো যত্তসব।’
কমেন্টটা করেই যেন হৈমন্তি কিছুটা শান্তি পেলো। আবার নিজেই ভাবলো, ‘আচ্ছা আমার কি এরকম কমেন্ট করা ঠিক আছে? কেউ কিছু বলবেনাতো আবার? বললে বলুক আমার কি? আমার জিনিসে হাত দিবে আর আমি বসে থাকব? কখনো না। নো নেভার! কুচিকুচি করে কাঁটব।’ সবার মাঝখানে হৈমন্তির এমন মন্তব্য দেখে থতমত খেয়ে যায় তূর্য। পরক্ষণেই হো হো করে হেসে ওঠে। তূর্যর এমন হাসি দেখে শিমুল অবাক হয়ে যায়। অথচ তূর্যকে কখনো এভাবে হাসতে দেখেনি সে। বলল….
–পাগলের মতন হাসছিস যে?
-একটা কমেন্ট দেখে।
–ধুর শালা কমেন্ট দেখে কারো হাসি পায়?
-মাঝেমাঝে পায়রে মাম্মো হাসি পায়।
–বাব্বাহ হৈমন্তি কমেন্ট করেছে নাকিরে? কাহিনী কি মাম্মা?
-চুপ শালা…তুই তিথির ব্লক লিস্টেই থাক, কথা কম বল।
–হ শালা আর তুই থাক তোর অনুভূতির প্রেম নিয়া।
শিমুলের কথার জবাব দেয়না তূর্য। মুচকি হেসে বারবার হৈমন্তির করা কমেন্ট দেখে আর ভাবে হৈমন্তি কেন এমন কমেন্ট করলো। ভেবে পায়না, হৈমন্তিকে মেসেজ দিতে গিয়েও দেয়না। পাছে যদি ছ্যাঁচড়া ভাবে সেই ভয়ে। এদিকে হৈমন্তিও চাচ্ছে তূর্যকে মেসেজ দিতে। কিন্তু মেসেজ দিয়ে কি বলবে, কিভাবে কথা শুরু করবে ভেবে পায়না হৈমন্তি। সব ভয়ভীতি কাটিয়ে তূর্যই ছোট করে মেসেজ দেয়….
–উহুম…
তৎখনাত তূর্যর আইডি থেকে মেসেজ পেয়ে অবাক হয়ে যায় হৈমন্তি। চিল্লানী দিয়ে বলে ‘ইয়েসসসসসসস…।’ হৈমন্তির চিল্লানী শুনে পাশের রুম থেকে ওর মা বলে….
–কিরে রাত্রি বেলা চিল্লাচ্ছিস যে?
-একটা পিংক কালারের তেলাপোকা দেখলাম তাই খুশিতে চিল্লানি দিছি আম্মু। হি হি হি….
–এত বড় হয়েছিস তাও ফাজলামো গেলোনা তোর?
-উলে উলে তুতু আম্মা।
মা কিছুক্ষণ বকে তার কাজে মন দিলো। হৈমন্তি তূর্যর মেসেজ সিন করেছে অনেক আগেই। ঠিক কি বলে রিপ্লে দিবে ভেবে পাচ্ছে না। হৈমন্তিও তূর্যর দেখাদেখি রিপ্লে দিলো….
–উহুম..২ এমন রিপ্লে পেয়ে হেসে ওঠে তূর্য। তারপর কথা বলার শুরু….
–আচ্ছা আপনার কি প্রচুর শক্তি?
-কেনো?
–না মানে কমেন্টে দেখলাম আপনি আমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকবেন বলছেন।
লজ্জা পায় হৈমন্তি। জিহ্বায় কামড় দিয়ে মনেমনে বলে, ‘ধ্যাত কেন যে অমন কমেন্ট করতে গেছিলাম। তাই বলে হাদারামটা সত্যি সত্যি কোলে উঠবে নাকি? ও আল্লাহরে!’ হৈমন্তি বলল….
–সত্যি সত্যিই কোলে উঠবেন?
-আরেনা, মজা করে বলছি।
–কমেন্ট কিন্তু মজা ছিলনা।
-তারমানে কোলে নেওয়ার চিন্তা আছে?
–ধ্যাত…আপনিনা। কথা বোঝেননা হু?
-বুঝিতো….
–কচু বোঝেন আপনি কচু কচু।
-আচ্ছা।
কথা খুজে পায়না কেউ। এদিকে কথা বলতে না পেরে ভালো লাগছেনা হৈমন্তির। নীরবতা ভেঙ্গে সেই মেসেজ দেয়…..
–কি করছিলেন?
-বিছানায় আধশোয়া, আপনি?
–আমিও, তা কবি সাহেব শুনুন…..
-জি শুনছিতো।
–আপনি বেশ লুচি টাইপ নাকি?
-লুচি টাইপ?
–আরে লুচু টাইপ বলছি, ঐযে মেয়েদের সাথে ইটিশপিটিশ করে।
-আমি?
–না মানে কবি লেখকরাতো এমন হয় শুনেছি।
-আমি কবি না, মনের তাগিদে টুকটাক মন চাইলে লিখি। আর আমি অতটা বাজেওনা বুজলেন মিস হৈমন্তি?
তূর্যর হৈমন্তি ডাক শুনে গা শিউরে উঠলো হৈমন্তির। কেনো উঠলো সে জানেনা। তবে কোথাও যেন একটা ভালো লাগা কাজ করছে। হৈমন্তি বলল…..
–একটা কথা রাখবেন?
-কি কথা?
–আমাকে নাম ধরে ডাকবেন? আমার ভালো লাগে।
-কিন্তু!
–উহু প্লিজ না করবেন না আপনি। ডাকবেন, আমি শুনতে চাই। ভালো লাগে ভীষণ।
-আচ্ছা চেষ্টা করব তবে মিস হৈমন্তি।
–ইসসস এত ভালো লাগে কেন কবি?
-এই আমি মোটেও কবিনা।
–আমি ডাকলেতো সমস্যা নেই? আমি নাহয় বিনিময়ে ডাকবো?
-কিসের বিনিময়ে?
–এই যে আপনি আমাকে হৈমন্তি বলে ডাকবেন আর আমি কবি বলে….
-কিন্তু আমারতো নাম আছে।
–বেশি বুঝবেন না।
-আচ্ছা….
–হিহিহি….বায়। আম্মা ডাকছে…..
-আচ্ছা।
অফলাইন হয় তূর্য। গতদিনের চেয়ে আজকে মনটা বেশ ফুরফুরা লাগছে তূর্যর। হয়তো প্রিয় মানুষটার সাথে একটু হেসে কথা বলাই তার কারণ। হৈমন্তিও বেশ ড্যাংড্যাং করে নেচে বেড়াচ্ছে বাসায়। হৈমন্তির মা অবাক হয়ে খেয়াল করছে ব্যাপারটা। কিন্তু হৈমন্তির সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নিজের স্বপ্ন নিয়ে বিভোর। বাকিসন গোল্লায় যাক। হৈমন্তি ডোন্ট কেয়ার।
শিমুল জানালার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মনটা বেশ খারাপ। তিথি এখনও আনব্লক করেনি। সব জায়গা থেকে ব্লক করে রেখেছে। যোগাযোগ করার কোন উপায় রাখেনি। চাইলে শিমুল তূর্যর ফোন দিয়ে কল দিতে পারে কিন্তু দেয়না। কেন সে বারবার কল দিবে। এত ইগো কেন দেখাতে হবে তার সাথে? আমি কি মানুষ না? আমি কি ভালোবাসিনা? নাহয় সময়মত একটু দেখা করতে পারিনা তাই বলে ব্লক করতে হবে? আমিও দিবনা কল। নিজের জেদ নিয়েই জানালার দারে দাঁড়িয়ে থাকে শিমুল। ঠিক তখন-ই তিথির নাম্বার থেকে কল আসে শিমুলের ফোনে। শিমুল ফোন কেঁটে দেয়। আবার ফোন দেয় আবার কেঁটে দেয়। এভাবে তিনবার ফোন কেঁটে দেয় শিমুল। অপরপাশে তিথির কান্না পায়। চতুর্থ বারের পর শিমুল ফোন রিসিভ করে ঠাণ্ডা গলায় বলে….
-কেমন আছো তিথি?
–ভালো রেখেছো?
-ব্লকতো তুমিই দিয়েছো।
–রাগটা বেশিই জানোইতো।
-সবার সাথে রাগ দেখাতে হয়না তিথি। আমিও মানুষ, আমার কান্না পায়, কষ্ট হয়, বুকটা ছিরে যায়। ২ টা দিন কথা বলতে পারিনি, কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। সব অফ করে রাখছো।
-ফোনটা সারাক্ষণ হাতে ছিলো, এই বুঝি ফোন দিলে, এই বুঝি তূর্য ভাইয়া ফোন দিয়ে বলল তোমরা আগের মতন হও। কেউ ফোন দেয়না, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো। ভাবছিলাম এই বুঝি হারালে,
–হারালেই বা কি?
-খুন করব তোকে…..
বলেই হুহু করে ফোনের অপরপাশে কেঁদে দেয় তিথি। শিমুল কি বলবে বুঝতে পারছেনা। ওর চোখেও পানি। ভালোবাসা জিনিসটাই এমন। দূরে থাকলে বোঝা যায় কে কত আপন। তিথি কাঁদছে, শব্দ করেই কাঁদছে। শিমুল সেই কান্না শুনছে শুধু, কিছু বলতে পারছেনা। ওর দম আঁটকে আসছে। কিছু বলতে গেলেই বুকটা ফেটে যাবে। মাঝেমাঝে চুপ থাকাটাই শ্রেয়। ‘মাঝরাতে কবি জেগে জেগে কারজন্য কবিতা লেখে জানতে পারি?’ হুট করে হৈমন্তির এমন মেসেজ আশা করেনি তূর্য। এই এত রাতে মেয়েটি জেগে আছে দেখে অবাক হয়ে যায় সে। মেসেজ দেয়….
–গীটারের স্বুর তোলার চেষ্টা করছিলাম।
-তুলতে পেরেছেন?
–জানিনা….
-একটা গান শোনাবেন? (হৈমন্তি)
–উহু আমি পারবনা, আমি নার্ভাস।
-নার্ভাস কেনো?
–জানিনা।
-ঘুমাবেন কখন?
–যখন দু’চোখের পাতা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাবে।
-মানে?
–সহজ কথা কঠিন করে ভাবেন কেনো?
-আমি অতকিছু বুঝিনা বাপু, ঘুমিয়ে পরুন।
–আপনার ঘুম পাচ্ছে?
-ভীষণ, ভাবছিলাম আপনি গান শোনাবেন কিন্তু সেটা আর হলো না! হি হি হি….
–হাসছেন যে?
-এমনি, হি হি হি… শুভ রাত্রি।
হৈমন্তি ঘুমিয়ে পরে। তূর্যও মুচকি হেসে রুমে চলে আসে। রুমে এসে দেখে শিমুল ফ্লোরে বসে ফোনে কথা বলছে। শিমুলের কোলে বালিশ। শিমুল হেসে কথা বলছে। ফোনের অপরপাশে আর কেউনা, তিথি। তূর্য ওদের কাণ্ড দেখে হাসে। শব্দ করে নয়, মুচকি হাসি। একটু আগেই যারা এতটা দূরত্বে ছিলো অথচ এখন কতটা কাছে। ভালোবাসা জিনিসটা আসলে কি? এটার সঠিক সংজ্ঞা কি? ভাবে তূর্য। পরক্ষণেই চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখে। বিছানার উপর গা এলিয়ে দিয়ে হারিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। কিন্তু কথা শেষ হয়না শিমুল-তিথির।
ঘাসের উপর বসে আছে তূর্য। তূর্যর পাশে শিরিন। শিরিন তূর্যর ক্লাসমেট। এমনিই বসে আড্ডা দিচ্ছে ওরা। ওদের থেকে একটু দূরে বসে আছে শিমুল আর তিথি। এই মুহূর্তে ক্যাম্পাসে হ্যাপি কাপল বলতে শিমুল তিথি। সেটা ওদের মুচকি হেসে কথা বলা দেখেই যে কেউ টের পাবে।
শিরিনের সাথে ক্লাসের একটা টপিক নিয়ে হেসে কথা বলছে তূর্য। দূর থেকে রাগে ফুসছে হৈমন্তি। ওর মন চাচ্ছে শিরিনকে ঠাটিয়ে চড় মারতে। আর তূর্যকে ধরে কিলাতে। কি এত হাসাহাসি ঐ মেয়ের সাথে। এত কথা কিসের। তুই আসলেই লুচু, তোর চৌদ্দ গুষ্টি লুচু। এগুলো বলেই মনেমনে ইচ্ছেমত বকছিলো তূর্যকে হৈমন্তি। কিন্তু না পারছে কিছু বলতে না পারছে সহ্য করতে। মেয়েদের এই এক সমস্যা। ওরা প্রিয় মানুষটার পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারেনা। সেটা যেই হোকনা কেন। আর যদি হয় কোন ক্লাসমেট তাহলেতো কথাই নেই।
শিরিন উঠে চলে গেছে। তূর্য একাই আনমনে বসে আছে। পাশে আস্তে করে হৈমন্তি বসে পরে। তূর্য বেখেয়ালী ভাবে বসে আছে। ওর চোখ ঠিক দু’টো মানুষকে পর্যবেক্ষণ করছে, শিমুল আর তিথি। ওর ভালো লাগছে ওদেরকে দেখে। কি সুন্দর ঝগড়াঝাঁটি, খুনসুটি দিনশেষে দুজনের আবার এক হওয়া। আপন মনেই হেসে ওঠে তূর্য। পাশে হুট করে হৈমন্তিকে দেখে থতমত খেয়ে যায় তূর্য। আমতাআমতা করে বলে….
–আ আ আপনি?
-হুম আমি, দেখছিলাম আপনাকে।
–মা মা মানে? কে কে কেমন আছেন?
-হুম ভালো আপনি। ওভাবে দেখছিলেন কাকে?
–উহু এমনিতেই, কিছুনা।
-বিরক্ত হচ্ছেন?
–আরে নানা, বসুন।
-ক্লাস না করি চলুন যাই….
–কোথায়?
-একটু হাঁটবো। যাবেন?
–আচ্ছা।
বসা থেকে ওঠে তূর্য। তূর্যর অনেক ভালো লাগছে। আজকে হৈমন্তি নিজ থেকে কথা বলতে এসেছে। আচ্ছা হৈমন্তিও কি আমাকে ভালোবাসে? নাকি এমনিতেই কথা বলে। আমিতো ওকে ভালোবাসি। বলতেতো পারিনা, আচ্ছা হৈমন্তিকি সেটা বোঝে? থাক বাবা ওসবের দরকার নাই। পরে উল্টাপাল্টা শুনলে চড় মারবে, যেই রাগি মেয়ে। ‘রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ? নাকি নজরুলগীতি?’ তূর্যর প্রশ্ন শুনে তাকায় হৈমন্তি। মুচকি হেসে জবাব দেয়….
–উহু, লালনগীত, আপনার?
-আমি রবীন্দ্রসংগীত শুনি প্রতি রাতেই। ভালো লাগে একাএকা শুনতে।
–আমি লালনগীতি শুনি, আমার কাছে এটা ভাল্লাগে।
-আকাশ ভালো লাগে?
–উহু এলোমেলো ছুটে বেড়ানো মেঘ ভালো লাগে।
-মেঘেদের মতন ছুটতে ইচ্ছে হয়?
–হয় তো, হবেনা কেন? কারো হাত হাত ধরে হাঁটতে ইচ্ছে করে। তার হাত ধরেই ছুটে বেড়াতে ইচ্ছে করে। তারহাতে হাত রেখে চলতে ভালো লাগে। কিন্তু হাতটা এখনো ধরতে পারিনি।
তূর্যর মনটা খারাপ হয়ে যায়। ও ভাবে হৈমন্তি হয়তো অন্য একজনকে ভালোবাসে। কিন্তু সে জানেনা, হৈমন্তির মনে মোটা ফ্রেমের চশমা ওয়ালা ছেলের জন্য একটা জায়গা আছে। ছোট একটা বাগান আছে। আর সেখানে একটা ফুল ফুটে আছে, তূর্য। হৈমন্তি তূর্যর দিকে তাকায়। দেখে তূর্যর কিছুটা মন খারাপ। ও বুঝতে পারে। অন্তরালের অনুভূতি গুলো বড্ড খারাপ। অনেক জ্বালাতন করে। হৈমন্তি বলল….
-আপনি রোজ সকালে কি করেন?
–কি আর করব ঘুমাই।
-ও আচ্ছা। জানেন আমার ইচ্ছে হয় রোজ সকালে ঠিক ভোরে কারো হাত ধরে হাঁটব। ভেজা ঘাসের উপর বসে পরব। মাঝেমাঝে শীতের প্রচণ্ড কুয়াশার মাঝে টুকিটুকি খেলব। দারুণ না?
–হু অনেক দারুণ। আপনি বেশ রোমান্টিক কিন্তু।
-থাক পাম দিতে হবেনা। ফুলে যাব, হি হি হি….
হৈমন্তি হাসছে, তূর্য সেই হাসির দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্যর ভালো লাগছে ভীষণ ভালো লাগছে। ওর ইচ্ছে করছে এই হাসি মুখটাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরতে। গাল দু’টো টেনে দিতে। তূর্যর মনে হচ্ছে এই হাসিটার জন্য ও সবকিছু করতে পারবে, সব পারবে। হৈমন্তি বলল….
–আপনাকে একদিন আমি চা করে খাওয়াবো। আম্মা বলে আমার হাতের চা নাকি অনেক সুস্বাদু।
-একদিন খাওয়াবেন?
–সারাজীবনের জন্য চান বুঝি?
-না মানে….
–বলুননা প্লিজ?
-এই আমি নার্ভাস, আমাকে ওভাবে বলবেন না।
–হি হি হি….
হৈমন্তি আবারো হাসো। তূর্য মন্ত্রমুগ্ধের মতন সেদিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটাকে সে হারাতে চায়না। তার সবকিছুর মূল্যে হলেও এই মেয়েটাকে চাই। সন্ধ্যে নেমে এসেছে। হৈমন্তি বলল….
–সময়গুলো বেঁধে রাখা গেলে কত ভালো হতো তাইনা?
-আজকের দিনটা আমার কাছে বেঁধে রাখার মতন।
–আমরা প্রতিটা দিনকি এভাবে সেলিব্রেট করতে পারিনা কবি?
-ঠিক বুঝলামনা।
–ভাবুননা একটু, ক্ষতি কি। তূর্য হৈমন্তির কথার আগামাথা খুজে পায়না। সেই চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দিয়ে বলে….
—বাসায় যাবেননা? সন্ধ্যে হয়ে এলো যে..?
-যাবতো, আচ্ছা চলুন যাওয়া যাক।
দু’জন দুজনের গন্তব্যে চলে যায়। রুমে এসে ফ্রেস হয় তূর্য। চোখের সামনে শুধু হৈমন্তির হাসিমুখের ছবিই ভেসে উঠছে। শিমুল বিছানার উপর বসেবসে চ্যাটিং করছে। নিশ্চই লাইনে তিথি। তিথি ছাড়া কার সাথেই বা কথা বলবে ও। তূর্য শিমুলকে কাছে ডাকে। তারপর সব বলে। সবশুনে আহাম্মক হয়ে যায় শিমুল। পরক্ষণেই মুচকি হেসে বলে….
–সকালে প্রপোজ কর।
-কিইইইইই।
–অবাক হওয়ার কিছুই নেই। মেয়েটিও তোকে ভালোবাসে।
-ভোরে প্রপোজ করব? ওর ভোর পছন্দ।
–একরম বাচ্চামো কথাবার্তা কই থেকে শিখলি।
-ধুরররর….
–শালা আমাদের ব্রেকাপ হলে নিজে জোরা লাগাই দিতা আর এখন আইছো সাজেশন নিতে?
-লাগবনা বাপ সাজেশন।
–হা হা হা….ভোরেই করে দেখ কি বলে। তবে নিরাশ হবিনা সিরিয়াসলি।
‘নিরাশ হবিনা সিরিয়াসলি’ কথাটা শুনে একটু সাহস পায় তূর্য। হৈমন্তিকে কি বলবে বুঝতে পারেনা। অতঃপর শেষ সাহস সঞ্চায় করে মেসেজ দেয় ‘আচ্ছা আসবে কি ভোরে? হয়তো কিছু অপূর্ণ চাওয়া হয়তো কিছু কথা, নাহয় কি অব্যক্ত কথা নিব হরণ করে।’ কিছুক্ষণ পর ফিরতি মেসেজ আসে ‘উহু আমি রোজই থাকতে চাই সেখানে বলবে তুমি, চাইবে তুমি তোমার অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো যেখানে।’
তূর্য কিছু বলেনা। মুচকি মুচকি হাসে। ওর মন বলছে কিছু একটা হবে। যেটা হবে সেটা তূর্যকে নিরাশ করবেনা। তূর্য বিছানায় গা এলিয়ে দেয়, কিন্তু ঘুম আসেনা। ভাবতে থাকে সকাল বেলা। সকাল হতে এখনো বাকি, ঠিক ভোর বেলা। চারদিকে হালকা কুয়াশা। তূর্য দাঁড়িয়ে আছে উল্টো দিক ঘুরে। নিজেকে বেশ নার্ভাস লাগছে তূর্যর। বুকটা ধুকধুক করছে। ‘এই কবি শুনো?’ আচমকা মেয়েলি কণ্ঠ শুনে পিছনে তাকায় তূর্য।
জলপাই রঙা শাড়ি পরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। হাতে টিফিন বাটি, হয়তো পছন্দেরর মানুষের জন্য কিছু রান্না করে এনেছে। আশ্চর্য মেয়েটার চোখে পানি। কাজল গুলোও লেপ্টে গেছে, কপালের টিপটাও বাঁকা। তূর্য আগায়, মেয়েটির চোখের পানি মুছে নেয়। মেয়েটার চোখ থেকে অনবরত শ্রাবণের জলধারা পরতেই থাকে। আলতো করে কপালের টিপটা সোজা করে পরিয়ে দেয়। তারপর হাটু ঘেরে বসে পরে….মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। মেয়েটি কিছু বলতে পারেনা। শব্দ করে কেঁদে দেয়। তারপর দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ছেলেটাকে। পূর্ণতা পায় একটি অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প।