ঝগড়া

ঝগড়া

-“কোথায় তুমি ?”

রান্নাঘর থেকে বউ এর চিৎকার। বেডরুমে শুয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম।তাড়াতাড়ি উঠেই দিলাম দৌড় ।

-“তোমার সমস্যা কি ?” সামনে দাঁড়াতেই চিৎকার করে বলে উঠল।

-“আমার তো কোনো সমস্যা নাই।” নরম গলায় উত্তর দিলাম।

-“আমারে কি বান্দী পাইছো ? আমি কি এই সংসারে শুধু গাধার মতো কাজই করে যাব।”

বুঝলাম না সমস্যা কি । কিন্তু এটা বুঝলাম যে, আজ ঘরের আবহাওয়া ভাল যাবে না। কিছু শ্রুতিমধুর (!) বাক্য শোনার জন্য কান ও মনকে বললাম তৈরি হতে।

-“তুমি বান্দী ! প্রশ্নই আসে না ।কেনো কি হইছে ?

-“কেন, বুঝনা ?”

-“বুঝলে তো আর প্রশ্ন করে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতাম না আপা।”

-“আমার সাথে চালাকি করবে না।”

-“আমার কি মাথায় সমস্যা আছে যে তোমার সঙ্গে চালাকি করবো ? আচ্ছা কি হয়েছে বলো।

-“বলছি। তার আগে আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। তুমি কি নবাবের বংশধর ?”

-“ মানে কি ?”

-“মানে, আমি জানতে চাচ্ছি তুমি কি নবাব ফ্যামিলির সন্তান ?”

-“জটিল একটা প্রশ্ন করে ফেললা। আসলে আমি ঠিক সিওর না। আমার মনে হয় না আমার শরীরে নবাবি রক্ত  বহমান। হলেতো তুমি অবশ্যই জানতে।কারণ তা হলে তো তোমাকে রাণীমা হিসাবেই ডাকা হতো। আর তা ছাড়া আমি যদি সিরাজ-উদ-দৌলা আংকেলের কিছু হতাম,তাহলে তো আমার নাম ইমদাদ বাবু না হয়ে ইমদাদ-উদ-দৌলা হতো, ঠিক না ?

-“ আর কিছু ? আর কোনো পয়েন্ট ? থাকলে সব একবারেই বলে ফেলো।কিছুই বাকি রেখো না।” টিটকারির সুরে বলল।

: ও আরেকটা পয়েন্ট,একটু আগে আমি নাশতা করেছি পরোটা, ডিম ও সবজি ভাজি দিয়ে।যদি নবাব হতাম তাহলে মোগলাই পরোটা ও কাবাব খেতাম।যেহেতু খাইনি, তারমানে আমি নবাব ফ্যামিলির কেউ না। তারপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে, নবাবদের অনেকগুলো করে বউ থাকে।আফসোস আমার একটা মাত্র বউ।তারমানে আমার বংশ নবাব বংশ না। তুমি চাইলে আমি আরও কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে তোমাকে প্রমাণ করে দিতে পারব যে আমি নবাবের বংশধর নই।

: মাইগড এই পোলা এতো কথা বলে কিভাবে ?

: কেন,মুখ দিয়ে । আচ্ছা অন্য কোনো জায়গা দিয়ে কথা বলার কোনো সিস্টেম কি তোমার জানা আছে ? থাকলে বল চেষ্টা করে দেখি।

আসলে এই মুহূর্তে আমি ঝগড়া করার মুডে নেই। তাই পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা করছি। যাতে ঝগড়া এড়ানো যায়। কারণ আমি মোস্তাফিজের বোলিংটা মিস করতে চাচ্ছিনা ।

-“এই তুমি কি গোপাল ভাঁড় ? আমার সাথে ফাজলামী করছো ?”

-“শোনো একবার বলছ নবাব, আবার বলছ গোপাল ভাঁড় । আমি কে , তুমি তো দেখি এইটা নিয়েই কনফিউজড । আগে ঠিক করো আমি কে,তারপর আমারে ডাক দিও। এসে ঝগড়া করে যাব।” বলেই ড্রইংরুমের দিকে রওয়ানা দিলাম।পিছন থেকে চিৎকার করে উঠল,

-“এই তুমি কোথায় যাও ? আমার কথা তো শেষ হয়নি।”

-“বল কি বলবে।আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে ব্যস্ত। তোমাকে বেশি সময় দিতে পারব না।”

-“কি কাজে ব্যস্ত তুমি ? শুয়ে শুয়ে তো খেলা দেখতেছ।”

-“ঐ খেলা নিয়েই ব্যস্ত।”

-“কেন তুমি কি বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ? তুমি কি টিভির সামনে বসে দল পরিচালনা করতেছ ? তুমি টিভির সামনে না থাকলে কি দল হেরে যাবে ?”

-“আমি বুঝলাম না, তুমি মূল পয়েন্টে আসছ না কেন ? খামাকা উল্টা-পাল্টা কথা বলতেছ কেন ?”

-“ওকে মূল পয়েন্টেই আসছি।তুমি নিজেই বলেছ তুমি নবাবের বংশধর না।তাহলে নবাবের মতো নাশতা খেয়ে উঠে গেলে কেন ? তোমার প্লেট ধোবে কে ?”মনে মনে বললাম,যাক বাবা ছোট বিষয়।আশা করছি দ্রুত শেষ করা যাবে।

-” যেহেতু এটা আমেরিকা ,নিয়ম অনুযায়ী আমারই ধোয়ার কথা । কিন্তু ….?”

-“কিন্তু কি ?”

-“ভাবলাম এই সপ্তাহে যেহেতু আমাদের বিবাহবার্ষিকী,সেহেতু এই এক সপ্তাহ একটু বাংলাদেশি স্বামী হয়ে যাই।তাই।” লাইনটি শেষ করতে দিলো না। দেখলাম ভুরু কুঁচকে , মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-“স্বা-মী ? তুমি স্বামী ! তুমি স্বামী !

-“এভাবে বলার কি আছে।কেন আমি স্বামী না ?”

-“না তুমি স্বামী না।”

-“তাহলে আমি কেডা ?”

-“তুমি স্বামী না, তুমি কিছু একটা।আচ্ছা স্বামী কাকে বলে তুমি জানো ?”

-“কেন জানব না ? কোন মেয়েকে যে ছেলে বিয়ে করে তাকেই স্বামী বলে।”

-“তোমার কাছ থেকে আমি এর থেকে ভালো উত্তর আশা করিনি ।আর একটা কথা,তুমি বলতে চাও বাংলাদেশের স্বামীরা কেউ স্ত্রীকে সাহায্য করে না।”

-“তা আমি কি করে জানব।আমি কি কারও বাসার ভিতরে যেয়ে দেখেছি, যে তারা কি করে।”

-“দেখতে হবে না।বাংলাদেশের স্বামীরা তোমার মতো বদ না।তারা অবশ্যই স্ত্রী কে সাহায্য করে।শোনো সংসারের প্রতি স্বামীর কিছুটা দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে।সেটা কি তুমি জানো ?”

-“অবশ্যই জানি ।”

-“তুমি জানো ! ঠিক আছে তাহলে বলো স্বামী হিসেবে কোন দায়িত্বটা তুমি পালন করতেছ ?

-“সব দায়িত্বই পালন করতেছি।তুমি চাইলে আমি এক এক করে পয়েন্ট আকারে সবগুলি ব্যাখ্যা করতে পারি ।”

-“বলো শুনি ।”

সমস্যায় পড়ে গেলাম। ঝগড়ার সময় আমার কোনো পয়েন্টই মাথায় আসে না।স্বাভাবিক সময় যখন ঝগড়া থাকে না, তখন কত পয়েন্ট মাথায় আসে । মনের মাঝে সব সাজিয়ে রাখি ,ভাবি ভবিষৎ এ ঝগড়া লাগলে এ পয়েন্ট গুলো প্রয়োগ করব।কিন্তু ঝগড়ার সময় একটাও খুঁজে পাই না। যে দু-একটা মনে আসে, সেটাকেও মনে হয় ঝগড়ার বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক না।অথচ আমার স্ত্রীর সব পয়েন্ট তৈরী করাই থাকে। হয়তো যে পয়েন্টটা আমি মনে করেছি এই ঝগড়ার বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক নয়, সেটাকেও এমন সুন্দর ভাবে প্রয়োগ করবে, মনে হবে এর থেকে প্রাসঙ্গিক বিষয় এই দুনিয়াতেও নেই। কোথা থেকে যে বের করে এক একটা তীর ছুঁড়ে মারে আল্লাহ মালুম। সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে অনেক আগের কোন বাক্য বা কথা বা ঘটনা হুবুহু মেরে দিচ্ছে।হয়তো ঐ বিষয়ের কোনো কিছুই আমার মনে নেই। যার কারণে কখনো আমার ঝগড়ায় জেতা হয় না। আমার ধারণা আল্লাহ মেয়েদের মাথায় ঝগড়া বিষয়ক কোনো স্পেশাল চিপ বা আ্যপস ঢুকিয়ে দিয়েছে। যা ছেলেদের দেয়নি।

-“চুপ করে আছ কেনো ? বলো স্বামী হিসেবে কি দায়িত্বটা তুমি পালন কর।”

-“আমি ইনকাম করি।আমার টাকায় সংসার চলে।”

-“কি ! এটা কি বললা ? তুমি আমারে টাকার খোটা দিলা।আমি তোমার টাকায় খাই ? ছি, তোমার মন এতো ছোট।তুমি কি ভুলে গেলে, আমি কোন ফ্যামিলির মেয়ে ?”

বুঝলাম ধরা খেয়ে গেছি। ভেবেছিলাম বিষয়টা তাড়াতাড়ি শেষ করে খেলা দেখব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার খেলা দেখা আজ আর হবে না। কারণ ভুল পয়েন্ট বলে ফেলেছি। কিন্তু কথা তো আর ফেরত নেওয়া যাবেনা। আত্মসমর্পণই এখন একমাত্র পথ।

-“ভাইরে আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি এই ভাবে বলতে চাইনি । কোনো কিছু মিন করেও বলিনি। কোনো পয়েন্ট না পেয়ে , যেটা মনে আসছে ছাইড়া দিছি।”

-“এখন বুঝছো তো স্বামীর কোন দায়িত্বই তুমি পালন করো না। আর করো না বলেই ,কোন পয়েন্ট খুঁজে পাচ্ছ না।”

চুপ করে থাকি । কারণ এটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কি বলতে আবার কি বলে ফেলব। কিন্তু আমার মুখ বন্ধ হলে কি হবে, গিন্নির মুখ তো চলমান।

-“সংসারের একটা কাজও তুমি করো না।রান্না,বাজার,বাচ্চা স্কুলে নেওয়া সব কাজ কেন একা আমাকে করতে হবে।”

-“এখানে তো আমার কোনো দোষ নেই।শোনো এদেশে তো আর কাজের লোক পাওয়া যাবে না। তবে তুমি যদি চাও তবে আমি তোমার কাজের সুবিধার জন্য আরেকটা বিয়ে করতে পারি।”

-“কি ! বদমাস ব্যাটা তুই আবার বিয়ে করবি ? তোর আবার বিয়ের শখ হইছে ?” চিৎকার করে উঠল।

-“চিৎকার করতেছ কেনো ? আমি তো বিয়ে করতে চাইনি।আমি তো তোমাকে একটা সমাধানের পথ দেখালাম। তোমার পচ্ছন্দ হলে রাখবা, না হলে রাখবা না।এখানে চেতার তো দরকার নাই।আসো আমরা ঝগড়ার মুডে কথা না বলে, আলোচনার মুডে কথা বলি। যে কোনো সমস্যার সমাধান আলোচনা করেই করা উচিত।সব সময় ঝগড়া করা ভালো না।”

-“কি, তারমানে আমি সব সময় ঝগড়া করি ? আমি ঝগড়াটে ? বজ্জাত ব্যাটা তোর এতো বড় সাহস।”

বুঝলাম আজ আমার খেলা দেখা শেষ। মোস্তাফিজের না এখন বউ এর আগুন ঝরা বোলিং দেখতে হবে। হে মাবুদ আমারে এই বিপদ থেকে রক্ষা করো। কথায় আছে বান্দা বিপদে পড়লে আল্লাহই রক্ষা করে। বউ এর মুখ থেকে যখন একের পর এক গোলা বের হচ্ছে, তখন হঠাৎ করে বাসার ল্যান্ডলাইন ফোন বেজে উঠল। মেয়ে স্কুল থেকে ফোন করেছে। বউ ফোন ধরে মেয়ের সাথে মিষ্টি করে কথা বলা শুরু করল।

-“মা কি করো ?”

-” যেহেতু ঐ পাশের কথা শুনতে পারছি না তাই ডট ডট দিলাম।

-“কিছু খেয়েছো ?”

-” তোমার আব্বু ? সে এখন নবাবের মতো শুয়ে শুয়ে টিভিতে খেলা দেখছে ।”

মাইগড, এ তো দেখি ডেঞ্জারাস মহিলা। কি ডাহা মিথ্যা কথা।আমার খেলা দেখা বন্ধ করে,এখন মেয়ের কাছে মিথ্যে বলছে।মনে হচ্ছে চিৎকার করে বলি,মারে তোর মা মিথ্যা বলছে। তুই এসে আমারে বাঁচা। জানি এটা বলা সম্ভব না। তবে মনে মনে মেয়েকে ধন্যবাদ দিলাম, সময় মতো ফোন করার জন্য।কারণ বউ এখন অনেক সময় ধরে মেয়ের সাথে কথা বলবে।যাক আপাতত বাঁচা গেল।এখন একটু খেলা দেখা যাবে।দৌড়ে গেলাম টিভির সামনে । যেয়ে দেখি মোস্তাফিজের বোলিং শেষ। শালার কপালটাই খারাপ।মনটায় চায়।

আমরা কিন্তু সবসময় ঝগড়া করিনা। শুধু মাত্র যখন জেগে থাকি, তখন করি। Tom and jerry . হা হা হা। আমাদের ঝগড়া গুলিকে আমি ঝগড়া বলিনা। এগুলি আসলে ভালোবাসায় মোড়ানো একটু উচ্চ স্বরে ঝাঁঝালো আলোচনা মাত্র।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত