নীলরঙা

নীলরঙা

– আসসালামুয়ালাইকুম ভাইয়া, ভাল আছেন?
– হুম!
– হুম আবার কি? কেও সালাম দিলে উত্তর দিতে হয়।
– আচ্ছা!
– যাই হোক, আম্মুকে বলেছি, ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে। তাই আমি আপনার সাথে যাব। নাহলে আম্মু নিজে নিয়ে যেত। কিন্ত আমি যাব আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে! আজ আমাদের অ্যানিভারসারি তো। কিন্ত আপনি আম্মুকে বলবেন না প্লিজ প্লিজ প্লিজ।

– আজব তো! এইসবে আমাকে টেনে আনছ কেন?
– আম্মু আপনাকে অনেক পছন্দ করে, বিশ্বাসও করে। আপনার সাথে এভাবে গেলে সন্দেহ করবে না।
– আর তোমার মতে আমি আন্টিকে মিথ্যা বলে তোমাকে হেল্প করব? ননসেন্স!
– আহা ভাইয়া এমন করেন কেন? প্রেম করলে একটু আকটু মিথ্যা বলাই যায়। আপনাকে তো আর কাবাব মে হাড্ডি হতে বলিনি। আপনি ছেলে মানুষ। আমি যতক্ষণ থাকব আমি এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াবেন। মেয়ে ফ্রেন্ড হলে তো এটা পারত না, তাই ওদের বলি নাই। আর অন্য ছেলের সাথে আম্মু যেতেই দিবে না।
– হিন্দী সিরিয়াল কি খুব বেশি দেখ? কষে একটা চড় দিলেই ঠিক হয়ে যাবা। যাও বাসায় যাও।
– আপনি হেল্প না করলে কি আর করার। ঠিক আছে।

আমি ভেবেছিলাম আপনি এত সিনিয়র, আমার সমস্যা  বুঝবেন, হেল্প করবেন। কিন্ত আপনি বুঝবেন কেমনে? কাওকে খুব বেশি ভালবাসলে ঠিকই বুঝতেন। ছোট মুখে এত বড় অপবাদ শুনে আরিয়ান আর কথা না বাড়িয়ে সোজা রিক্সা ঠিক করে সানজানাকে নিয়ে উঠে পড়ে। রিক্সায় বসে রাগে ফোঁসফোঁস করছে সে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা নিয়ে যতটা না রাগ লাগছে, তার থেকেও এখন বেশি রাগ লাগছে সানজানার বকবক শুনে। একটু পরপর “ভাইয়া এই, ভাইয়া সেই”

– ভাইয়া ভাইয়া আমাকে দেখেন তো। কেমন লাগছে?
– হুম!
– আবার হুম? আমি জানতে চেয়েছি আমাকে কেমন লাগছে? ভাল, খারাপ, চলে?
– ভাল
– শুধু ভাল? আচ্ছা. তাও ভাল। খারাপ তো আর না। তাড়াহুড়া করে সেজেছি তো।
– তোমার না অ্যানিভারসারি? নীল পরেছ কেন? এটা তো কষ্টের রঙ।
– ধুর ওগুলা কোন কথা না। নীল সবথেকে সুন্দর কালার। আর তারও প্রিয় রঙ নীল। দুইজনের পছন্দের রঙ্গই যখন নীল, তখন আমাদের ভালবাসার রঙ্গও নীল।
– ভাল! কিন্ত শাড়ির সাথে চুড়ি পর নাই কেন?
– ওহ! আমার না নীল চুরি নাই। আমি ভেবেছিলাম ও কিনে দিবে আজকের আগে। দিল না। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। থাক ব্যাপার না…

– আচ্ছা তার না…
– এই এই মামা রাখেন রাখেন। এইখানেই নামব
– ভাইয়া আমি এখানেই নামব। কাজ আছে। আপনি রিক্সা নিয়ে কোথায় গেলে যান। আমি পরে ফোন দিব। বেশি দেরি করব না।
– আচ্ছা শুন, একটু ওয়েট কর।
– না না, টাইম নাই আমার। এখনি যেত হবে।

আবার বাসায়ও যেতে হবে। দেখেন না বৃষ্টিও আসছে? আপনি যান। ফোন দিলেই চলে এসেন। টাটা আরিয়ান আরেকটু সামনে গিয়েই রিক্সা ছেড়ে দেয়। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছে। হুহু করে ঠান্ডা বাতাস বইছে। যেকোন সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামবে। রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা। ফুটপাথ ধরে একা একা হাটতে ভালই লাগছে। কিছুক্ষণ পর নাকের উপর দুই এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি এসে পড়তেই, আরিয়ান পাশের এক মুদির দোকান থেকে একটা পলি প্যাকেট নিয়ে তাতে মোবাইল ভালমত পেঁচিয়ে নিয়ে পকেটে রাখে। দোকান থেকে বের হয়ে সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিতে না দিতেই ঝুম বৃষ্টি সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। একদম হঠাতই নগর কোলাহলময় হয়ে ওঠে। সবাই এদিক সেদিক দৌড়িয়ে শেডের নিচে আশ্রয় নিচ্ছে। আবার মুহূর্তের মধ্যেই সব শান্ত হয়ে গেল। চারদিকে শুধুমাত্র বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ।

আরিয়ান ফুটপাথের উপর বসে চুপচাপ বৃষ্টিতে ভিজছে। হঠাত ফোন বেজে ওঠে। সে জানে এটা সানজানার কল। প্রথমে রিসিভ করতে চেয়েও পরে আর করেনি। থাক আর কিছুক্ষণ। আজকে মেয়েটার স্পেশাল একটা দিন। আর এত বৃষ্টিতে ওকে বাসায়ও নিয়ে যেতে পারবে না। সানজানার মা-কে পরে বিষয়টা বুঝিয়ে দিলেই হবে। এসব ভেবে আবার আগের মত চুপচাপ বসে থাকে আরিয়ান। অনেকক্ষণ পর সানজানার চিৎকারে চমকে উঠে পাশে তাকিয়ে দেখে সানজানা একদম ভিজে একাকার হয়ে আছে।

– এই মিয়া আপনার সমস্যা কি? ফোন ধরেন না কেন? ফোন কি তামাশা দেখতে ব্যবহার করেন? নাকি কানে শোনেন না?

– তুমি এত তাড়াতাড়ি? আমি তো ভবলাম বৃষ্টিতে তো বাসায় যেতে পারবা না, আরো কিছুক্ষণ থাকবা এই সুযোগে।
– ওই আপনি এত পাকনা কেন? ফোন দিসি, ফোন ধরবেন আপনি। এত আজাইড়া বুঝেন কেন? পড়াশোনা ছাড়া তো আর কোন কিছুই ঠিকমত বুঝেন না। বিরক্তিকর পাবলিক। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল

– তুমি কি ঝগড়া করে এসেছ?
– না! কিন্ত এখন করব। যতসব ফালতু কাজ কারবার
– আরেকজনের রাগ আমার উপর ঝারছ কেন? আজব তো! উমম….আচ্ছা সরি। কিন্ত এত তাড়াতাড়ি কেন? আর একা কেন? তোমার বয়ফ্রেন্ড কই?।

– আছে তো
– কই? এখনো আসে নাই?
– আসছে তো
– অদ্ভুত তো! আরে বাবা আসছে তাহলে কই সে?
– এই যে পাশে! হ্যাপি অ্যানিভারসারি!

সানজানা আরিয়ানের দিকে কদম ফুল বাড়িয়ে দিয়ে, মুচকি হাসি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আরিয়ানের মাথা এখন কাজ করছে না। হার্ট বিট বেড়ে গিয়েছে। বৃষ্টির শব্দও কানে আসছে না। অথচ এখনো ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। চোখের সামনে সব ঘোলা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এখনি সে মারা যাবে। নিজেকে কোনরকম সামলে নিয়ে, নিজের ভাবসাব ঠিক রেখে গম্ভীর গলায় সানজানাকে জিজ্ঞেস অরে,

– সানজানা, এসব কি হচ্ছে?
– যেটা আপনার দ্বারা হয় না!
– মানে?
– আরিয়ান সাহেব! আপনি আসলে বলদ নাকি বিচ্ছু? গন্ডারের চামড়াও আপনারটা থেকে পাতলা। এত এত করে ভাইয়া ডাকলাম, আন্দাজে একটা বয়ফ্রেন্ড বানায় নিলাম, তার সাথে ঘুরতে আসলাম, রাগে সাপের মত ফোঁসফোঁস করেন, তাও কিছু বলতে পারেন না।

– সিনিয়রকে ভাইয়া ডাকবা নাতো কি নাম ধরে ডাকবা? বেআদব কোথাকার
– ওহ এখন আমি বেআদব!

আর নিজে যখন এই বেআদবকে নিয়ে ঠিক এক বছর আগে ফেসবুকে অনলি মি দিয়ে লিখেছিলেন, “সানজানা, আজ যদি বলে দেই ভালবাসি, তাহলে হয়ত ঠিক এক বছর পর তুমি থাকবে আমার পাশে নীল শাড়ি পরে। আমার দেয়া হাতের নীল চুরিগুলা কানের কাছে ঝঞ্ঝন করে বাজবে। আর তোমার দেয়া কদম ফুল গুলা আপনি খুব যত্নে পকেটে রাখে দিব। সেদিন যদি বৃষ্টি হয়, একসাথে বৃষ্টিস্নান করব। আর কনকনে রোদ থাকলে, সূর্যস্নান হবে। ভাল থাকার জন্য কি এর থেকে বেশি কিছু চাই? কিন্ত…থাক! কিছু কথা না জানাই ভাল” তখন আর আমাকে বেআদব লাগে নাই, না? এই বেআদবটা না থাকলে, সবকিছু ফেইসবুকেই থেকে যেত, পাশে আসত না। এই নেন অনেক গুলা দোকান খুজে কদম ফুলও পেয়ে গিয়েছি। আপনার তো ষোল আনা পূর্ণ।

– হু?! এই ওয়েট ওয়েট! তুমি এইসব জান কেমনে?! আমার ফেইবুক হ্যাক করেছ? চোরের মত তাকায় আছ কেন? বল!

– ইয়ে মানে… আসলে আমি আপনাকে আগে থেকেই অনেক বেশি পছন্দ করতাম, একটু বেশিই। কিন্তু সবাই বলত আপনারা গারলফ্রেন্ড আছে। একদিন রিপোর্ট প্রিন্ট করাতে গিয়ে আপনি স্টাডি হলে ভুলে আপনার ফোন ফেলে গিয়েছিলেন। তখন জেলাসি থেকে চেক করতে নিয়েছিলাম যে মেয়েটা আসলে কে। পুরানো পোস্ট ঘেটে অনেক কিছু পেয়েছিলাম, যা জানার জেনে গিয়েছিলাম। সেদিন থেকে আপনার আর আমার জার্নি সেইম এবং এক সাথেই। এই পোস্টের তারিখটা খুব ভালমত মনে রেখেছিলাম। এক বছর পর ঠিক আপনার কল্পনার মত করে এভাবেই সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম এর মধ্যে ঠিকই আপনি বলবেন। কিন্ত আপনার এত ইগো। আসলে ইগো না, বলদামি।

– হু?!
– ইগো হলে তো কিছু করতেন না। আপনি বলদ দেখেই তো নীল চুরিগুলা কিনে ব্যাগে রেখে দিয়েছেন সেই কবে। আবার সেই ব্যাগ সবসময় সাথে নিয়েও ঘুরেন, কিন্ত দেয়ার আর সাহস হয় না।
– তুমি আমাকে ফলোও করতা?!
– না, ছিঃ! আমি আপনাকে ফলো করব কেন?

আপনি টম ক্রুজ না ডেভিড বেকহাম যে ফলো করব? আজাইড়া! আরিয়ান দুই হাতে নিজের মুখ চেপে হোহো করে হেসে উঠে। সানজানা মাথা নিচু করে বসে আছে। এবার আরিয়ান নিজেই সানজানার হাত টেনে নিয়ে তার ব্যাগে এতদিন যত্নে রেখে দেয়া নীলরঙ্গা চুরিগুলা পরিয়ে দিয়ে ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বসে থাকে। নগরীর ফুটপাথের ধারে দুইজনেই চুপচাপ বসে বসে বৃষ্টিতে কাকভেজা হচ্ছে। আর কিছু বলার দরকারও হয়ত নেই। বৃষ্টি হচ্ছে, নীলরঙা বৃষ্টি, ভালবাসার রঙ যে নীলও হয়!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত