টিকিট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন। প্রায় পনেরো জনের পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। ওদিকে ট্রেন ছাড়ার মাত্র সাত মিনিটের মতো বাকী। অনেক প্রতীক্ষার পর একটা টিকিট ক্রয় করে কোনো রকমে দৌড়ে ট্রেনে উঠলাম। আর একটু হলেই ট্রেন চলে যেতো। ব্যাগ থেকে একটা কবিতার বই বের করতে করতে সিটে বসলাম। হঠাৎ সামনের দিকে চোখ যেতেই কিছুক্ষণেন জন্য থ হয়ে রইলাম। আমার সামনের সিটে বসে আছে আমার প্রাক্তন। আমি কোনভাবেই এই দৃশ্যটা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এখন কি করবো বুঝতে পারছি না। বহু দিন পর আজ তার সাথে দেখা। কিন্তু এভাবে দেখা হবে কখনো ভাবি নি।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। জানালার পাশের সিটে ধূসর বাদামী রঙের একটা চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে সে। জানালায় রাখা দু’হাতের উপর থুতনি রেখে বাহির পানে তাকিয়ে আছে। আর গোধূলি লগ্নে আধ- ডোবা সূর্যের লালচে আলো এসে পড়ছে তার সম্মুখভাগে। সেই আলোই তার মুখখানা স্বর্ণের ন্যায় ঝলঝল করছে। আলো রা নিজেদের তার গায়ে মাখাতে পেরে স্বার্থকতার ছোঁয়া পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কখনো মৃদু বাতাসে তার চুলগুলো গালে, নাকে এসে পড়ছে। তখন খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো উঠে গিয়ে হাত দিয়ে তার গাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিই। সে বাইরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সন্ধ্যা উপভোগ করছে।
আর আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকে দেখছি। আগে ওকে অনেকবার, অনেক সাজে, অনেক ভাবে দেখেছি। কিন্তু, চোখে অল্প একটু কাজল আর নাকে ছোট্ট একটা নাকফুলে যে তাকে এতটা সুন্দর দেখায় তা এর আগে কখনো উপলব্ধি করি নি। আসলে ভারি সাজের চে’ হালকা সাজেই মেয়েদের বেশি সুন্দর দেখায়। আজ বহুদিন পর আবার তাকে নতুন রূপে দেখছি। মাতালের মতো এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েই আছি। শীতের সন্ধ্যা এতটা সুন্দর হতে পারে, সন্ধ্যালগ্নে তাকে এভাবে না দেখলে কখনো জানতাম ই না। ওর দিকে তাকিয়ে ওর সাথে কাটানো সব স্মৃতিরা পুনঃরায় মাথায় এসে ভীড় জমাচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ছেলেবেলার দুষ্টুমি, স্কুল ফেরত গলিপথের রেল লাইনে হাতে হাত ধরে হাঁটা, কলেজ ক্যাম্পাসের বটতলায় বসে আইসক্রিস খাওয়া ইত্যাদি।
এবার আর সহ্য হচ্ছে না। তার সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। এক পর্যায়ে তার পাশে বসে থাকা লোকটাকে আমার সিটে এসে বসতে বললাম। তারপর আমি তার পাশে বসতে বসতে বললাম,
-কেমন আছিস রে বুড়ি? (আমি সবসময় আদর করে তাকে বুড়ি বলে ডাকতাম)
-একি তুই? এখানে? কোথায় যাচ্ছিস?
আমাকে দেখে তনয়া এমন ভাবে রিয়েক্ট করলো, মনে হলো যেন আকাশ থেকে পড়েছে। আর এমনটাই হওয়ার কথা। এত দিন পর দেখা। তাও এভাবে। একটু চমকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। তারপর প্রায় বেশ খানিকক্ষণ কথা হলো ওর সাথে। কথা বলার এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-সংসার কেমন চলছে তোর?
-আর সংসার (কথাটা বলেই নিচের দিকে তাকিয়ে জোরে শ্বাস নিলো)
-কেনো কি হয়েছে?
-যেখানে বিয়ে ই হয় নি, সেখানে সংসার কেমন চলছে এ প্রশ্নের উত্তর আসবে কোত্থেকে?
-মানে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে বলবি?
-মানে আমার বিয়ে হয় নি।
-বিয়ে হয় নি মানে? কি বলছিস এসব? তবে যে আমাকে বলা হয়েছিলো তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সেটা?
-আসলে প্ল্যান টা ভাইয়ার ছিলো।
সেদিন তোর আর আমার ব্যাপার টা জানাজানি হবার পর ভাইয়া সেটা মেনে নিতে পারে নি। তারপর আমাদের আলাদা করার জন্য ভাইয়া তোর কাছে মিথ্যে সংবাদ পাঠায় যে, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আর আমি যাতে তোর সাথে কোনভাবে যোগাযোগ না করতে পারি সেজন্য আমার ফোন থেকে তোর নাম্বারটা ডিলিট করে দেয় এবং আমার ফোন নিয়ে নেয়। পরবর্তীতে তোর সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি আমি। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পাইনি। কিন্তু দেখ, আজ হঠাৎ তোর সাথে দেখা হয়ে গেলো।
-আমিও অনেক চেষ্টা করেছি।
-আচ্ছা এখন বাদ দে এসব। আজ কতদিন পর আমাদের দেখা হলো বলতো?
-এক বছর, তিন মাস, ঊনিশ দিন।
-যেদিন ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি রেখে বলেছিলি ‘ভালোবাসি’… সেই দিনটার কথা কি তোর এখনো মনে আছে?
-হ্যাঁ। ১৩ ই এপ্রিল, সোমবার, বিকেল পাঁচটা সাতাশ মিনিট।
-আর তার পরের দিন ছিলো পহেলা বৈশাখ। সেই দিনের প্রত্যকটা মুহূর্ত এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আচ্ছা, এখনো কি সেই আগের মতোই রাত জাগিস? রাত জেগে কবিতা লিখিস কারো জন্য?
-হ্যাঁ। তবে রাত জাগার কারণটা বদলে গেছে শুধু।
-আমার দেয়া নীল ডায়েরি টা কি এখনো আছে তোর কাছে?
-হু.. সেই ডায়েরিতে লিখে রেখেছি মনের সব অবক্তব্য কথা। বুনে রেখেছি হাজারো কবিতার পাহাড়। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো তনয়া। তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-চশমা বদলেছিস কবে? এই মোটা কালো ফ্রেমের চশমায় তোকে বুড়ো বুড়ো লাগছে। আর আগের চেয়ে অনেকটা রোগা হয়ে গেছিস। আমি তার এই কথাগুলো না শুনার ভান করে বললাম,
-একটা সময় তোকে বুড়ি বলে না খেপালে আমার পেটের ভাত হজম হতো না। কিন্তু এই ধূসর বাদামী চাদরে সত্যিই তোকেও বুড়ি লাগছে। আবার তোর ওই কাজল রাঙা চোখে তোকে অসম্ভব সুন্দরী লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো এক হরিণী একরাশ মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সে কিছু না বলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
-এমন করে তাকিয়ে থাকিস না, প্লিজ! তাহলে আমি আর বেশিক্ষণ এখানে বসে থাকতে পারবো না। তোর এই চাহনী বরাবরের মতোই মাতাল করে দিচ্ছে আমায়।
-হাহাহা… পাগল। তুই এখনো সেই আগের মতোই আছিস। (হাসি মাখা মুখে বললো সে) আমি নিশ্চুপ হয়ে তার হাসি দেখছি। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললো,
-জানিস, আজ অনেক দিন পর মন খুলে হাসলাম। তুই একদিন সাদাত ভাইয়ার লিখা একটা লাইন বলেছিলি আমায় মনে আছে তোর? ‘আমাকে হারাতে দিলে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে যাবে তোমার শহর’ তোকে হারাতে দিয়ে সত্যিই নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে গিয়েছিলো আমার শহর। সেদিনের পর থেকে আমি মন খুলে হাসি নি কখনো।
-তনয়া…
-হু…
-সাদাত ভাইয়ার আরো একটা লাইন মনে আছে তোর?
-কোনটা?
-ঐ যে, ‘আমাদের অপেক্ষায় রয়ে গেছে পথ, রয়ে গেছে ভুলে যাওয়া পুরোনো শপথ।আমরাই শুধু নেই আমাদের মতো, সেই পথ, শপথের সবটাই ক্ষত’।
-কে বললো আমরা আর আমাদের মতো নেই?
তারপর হঠাৎ সে আমার হাত চেপে ধরে, বাইরের দিকে তাকিয়ে রবী ঠাকুরের ভাষায় বলে উঠলো- ‘আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকী?’ আমি তখনও চুপ করে রইলাম। কিছুই বলতে পারলাম না। তখন চোখের সামনে রবীন্দ্রনাথের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার লাইন গুলো ভেসে উঠলো “রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা, ভাবিনি সম্ভব হবে কোনোদিন। আগে ওকে বারবার দেখেছি লাল রঙের শাড়িতে- ডালিম-ফুলের মতো রাঙা; আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়, আঁচল তুলেছে মাথায়, দোলন-চাঁপার মতো চিকন-গৌর মুখখানি ঘিরে। মনে হলো, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে, যে দূরত্ব সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায়, শালবনের নীলাঞ্জনে। থমকে গেলো আমার সমস্ত মনটা: চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে, আমাকে করলে নমস্কার। সমাজবিধির পথ গেলো খুলে, আলাপ করলেম শুরু- ‘কেমন আছো’, ‘কেমন চলছে সংসার’ ইত্যাদি। সে রইলো জানালার বাইরের দিকে চেয়ে যেনো কাছের-দিনের-ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে। দিলে অত্যন্ত ছোট দুটো-একটা জবাব,কোনোটা বা দিলেই না। বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায়- কেনো এ-সব কথা? আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে ওর সাথিদের সঙ্গে। এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে। মনে হলো কম সাহস নয়- বসলুম ওর এক বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে, বললে মৃদুস্বরে , ‘কিছু মনে করো না, সময় কোথা সময় নষ্ট করবার? আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই; দূরে যাবে তুমি, দেখা হবে না আর কোনোদিনই। তাই, যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে, শুনবো তোমার মুখে। সত্য করে বলবে তো?’ আমি বললেম ,’বলবো’। বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোলো, ‘আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে- কিছুই কি নেই বাকি?’ একটুকু রইলেম চুপ করে; তারপর বললেম, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’ । খটকা লাগলো,কী জানি বানিয়ে বললেম নাকি। ও বললে, ‘থাক এখন যাও ও দিকে’ সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে। আমি চললেম একা”।
আমার হাতে রেখে হাত, কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে তনয়া। আমিও অন্য আরেকটা হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে বসে আছি। এই মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি জীবনের সব আশা পূরণ হতে চললো। আসলে যে আপন, সে শত বাধা-বিপত্তি’র পরেও আপনই থাকে। আর যে কখনো আপন ছিলোই না, তাকে শত চেষ্টায়ও আগলে রাখা যায় না, ধরে রাখা যায় না। একটা সময় কোনো না কোনো অজুহাতে সে চলে যাবেই। হঠাৎ ফোন বাজার শব্দে ঘোর কাটলো। হাতে রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই। কবিতা পড়তে পড়তে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম। মায়ের ফোন….
-হ্যালো,
-কিরে আর কতদূর? কোথায় আছিস এখন?
-এইতো মা, নরসিংদী ছাড়লো। প্রায় আর ২০-২৫ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাবো।
-আচ্ছা ঠিক আছে।