জীবনযাত্রা

জীবনযাত্রা

— নো ওয়ান্ডার, তোমাকে একাই জার্নি করতে হচ্ছে! তাও আবার এই অবস্থায়!

মেয়েলী কণ্ঠস্বর শুনে পিছন ফিরে তাকায় লিজা।শায়লা দাঁড়িয়ে আছে।সানগ্লাস কপালের উপর তুলতে তুলতে লিজার পাশে বেঞ্চে এসে বসে শায়লা।চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করে,কয়মাস চলে? লিজা যদিও এই প্রশ্ন শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে,তবুও শায়লার কাছ থেকে শুনে ও কিছুটা বিব্রত বোধ করে,নিচুস্বরে উত্তর দেয়,সাড়ে সাত মাস।

— ও! তা বাবা বাড়ি যাচ্ছো বুঝি?

লিজা কিছু বলে না।ওর চোখের কোনায় পানি জমে।সে শুধু মাথা উপরনিচ করে সম্মতি জানায়।তার ভেতরের অতিথির অস্তিত্ব টের পাওয়ার পর থেকে তার এই এক রোগ হয়েছে।অকারনেই কান্না পায়,অল্পতেই রাগ হয়,আবার সামান্যতেই অসামান্য খুশি হয়ে যায়।

— আমি জানতাম, সোহান একটা ইররেস্পন্সিবল ছেলে।কিন্তু ও এত নিচে নামবে ভাবিনি! যাইহোক, এমন তো হওয়ারই ছিল।

লিজার খুব রাগ লাগছে এই মুহুর্তে।কেন যে প্ল্যাটফর্মে বসতে গেল! ট্রেন আসার আরো ঘন্টাখানেক বাকি,ভেতরে ওয়েটিংরুমে গিয়ে বসলে হয়ত শায়লার সাথে দেখা হতো না! সে আস্তে আস্তে বলল, না আপু।আসলে ব্যাপারটা সেরকম না সোহান আসলে….

— ঝগড়া হয়েছে?তাই একা চলে যাচ্ছো?
— আসলে…
— যে ছেলে তিনমাসের পরিচয়ের জন্য তিনবছরের ফ্রেন্ডশিপ ভুলতে পারে, তার কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি আশা করা ভুল।
— আপু,আসলে আপনি ভুল….
— হ্যা, আমিই ভুল করেছি।

যে ছেলে তিনবছরেও আমার ভালোবাসার মূল্যায়ন করেনি,তার জন্য সময় নষ্ট করে ভুলই করেছি।দেখ আমার হাসবেন্ডকে! আমি কত ভালো আছি। শায়লার তাক করা আঙুল বরাবর তাকায় লিজা।স্যুট-প্যান্ট পড়া এক ভদ্রলোক একটু দূরে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।সাথে বিশাল বড় ৪/৫টা লাগেজ।

শায়লা হাসিমুখে বললো, এই মাসে আমার ননদের বিয়ে।তাই কিছু শপিং করলাম কলকাতা থেকে।এই মাত্র যে ট্রেনটা কলকাতা থেকে এলো,ওটাতেই এলাম।প্রতি মাসেই এদিক ওদিক ঘুরতে যাই।যখন যা চাই তাই কিনে দেয়! এনিথিং এন্ড এভ্রিথিং!! ভাগ্যিস সোহানকে বিয়ে করিনি, তা হলে তোমার মত এমন শরীর নিয়ে একা একা বাপের বাড়ি যাওয়া লাগতো! সো প্যাথেটিক! লিজার চোখ থেকে দুইফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে।মনটা তিতা হয়ে আছে।কিছুই বলতে ইচ্ছা করছে না ওর। শায়লা একটু তাচ্ছিল্যের স্বরেই বলে, এই জন্যই মানা করেছিলাম সোহানকে বিয়ে করো না।আমার ভালোবাসা যেহেতু ও বোঝেনি, ও আসলে ভালোবাসার যোগ্যই না!বলেছিলাম আমি,কিন্তু তখন শুনলে না! এখন তোমার লাইফ,তুমিই সামলাও!বুঝলে!

এমন সময় হুট করেই শায়লার চোখ চলে যায় রেলস্টেশনের গেটের দিকে।চোখ আটকে যায় পরিচিত এক যুবকের মুখে।কতদিন পর দেখলো সোহানকে? চারবছর?হ্যা তাই হবে! এই চারবছরেই চঞ্চল এক তরুণ যেন ভীষণ মায়াময় এক যুবকে পরিণত হয়েছে।সানগ্লাসটা চোখে নামিয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠে বলে,এবার আমি যাই।নাহলে শফিক আবার মন খারাপ করবে! এই বলে উঠে দাঁড়ায় ও, হাইহিলের খটখট আওয়াজ তুলে স্যুট পড়া বিরক্ত ভদ্রলোকটির দিকে হেঁটে যায়।

এই সময়ে লিজাও দেখতে পায় সোহানকে।উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে যায় ওর দিকে।কাছাকাছি আসতেই কিছুটা যেন আছড়েই পড়ে সোহানের বুকের উপর।গলার কাছে কান্না যেন দলা পাকিয়ে আছে।কোনরকমে বললো, এতক্ষন লাগে আসতে? কোথায় ছিলে তুমি? সোহান হাসতে হাসতে বলে,এখন তুমি যদি এই ভর দুপুরে আমাকে বলো পরোটা আর ঝাল করে ডিমভাজি খাবে,তাহলে সেটা ম্যানেজ করতে তো দেরী হবেই! পুরি-সিংগারার দোকান থেকে অনেক বলে কয়ে পুরির আটা দিয়ে পরোটা বানিয়ে আনলাম! আর সাথে ডিমভাজি।

– এত কষ্ট করার কি দরকার ছিল? না আনলে কি আমি তোমাকে খেয়ে ফেলতাম?
– তা হয়ত খেতে না,কিন্তু এখন যেমন আবেগে আপ্লুত হয়ে, আহ্লাদে গদগদ করছো, না আনলে প্যাঁচার মত মুখ করে বসে থাকতে! এতদিনে তোমার এই “মুড সুইং” আমার চেনা হয়ে গেছে বাবা, এটাকে আমি খুব ভয় পাই!

– হ্যা, কচু! মাইর দিব কিন্তু!চুপ থাকো!
– এ আর নতুন কি! তোমাকে তো বিয়ে করেছিই মাইর খাওয়ার জন্য! আল্লাহ তো এই রেখেছে কপালে! কি আর করা!
– খুব ভালো হয়েছে।এখন খাইয়ে দাও! ক্ষিদায় জান বের হয়ে যাচ্ছে! তোমার মেয়ে আমাকে জলহস্তী বানিয়ে ছাড়বে!
– আমার মেয়ের দোষ দিবে না খবরদার। জানোনা ছেলেরা খায় বেশি? কেমন মা তুমি! সব তোমার ছেলের দোষ!
– এই শোন,টুইন হলে কেমন হয় বলোতো?
– কি আর হবে, চুলগুলো ২০ বছর আগে পাকবে আর কি!হা হা হা

তাদের খুনসুটির গল্প চলে সাথে সোহান টুকটুক করে খাইয়ে দেয় লিজাকে। কিন্ত তারা কেউই খেয়াল করেনা, তাদের থেকে ২০ফিট দূরে একটি পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে একজোড়া ভেজা চোখ আচ্ছা,ভালোবাসায় কি এমন পাগলামি থাকে?ভালোবাসা কি খুব সাধারণভাবে অসাধারণ হতে পারে?কি জানি! এর উত্তরের সাথে তো শায়লা পরিচিত না…

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত