অপ্রত্যাশিত পাওয়া

অপ্রত্যাশিত পাওয়া

অফিস না থাকায় আজকে সারাদিন ই বাড়িতে। তার উপর দুপুরে খাওয়ার পর ফোন টিপতে টিপতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি টের ই পেলাম না। ঘুম থেকে উঠার পর মাথাটা কেমন ধরে আছে। সারাদিন বাড়িতে থাকায় একটু বোরিং ই লাগতেছে। তাই ভাবলাম, একটু বাহির থেকে হেটে আসলে মন্দ হতো না।

ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে গেলাম হাটার উদ্দেশ্যে। বিকেলটা কেমন থমথমে? একটা মানুষ অনেক পরিশ্রম করার পর যেমন ভীষণরকমের ক্লান্ত হয়ে যায়। তেমনি বিকেলটাও যেন সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে নিরিবিলিতে হেলিয়ে দিচ্ছে। সারাদিনের রোদের তীব্রতা এখনও কিছু অনুভব করতে পারছি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরপর খনখনে বাতাসের কারণে সেই অনুভুতি লাঘব হয়ে যাচ্ছে।

এই বাতাসকে কী বাতাস বলে? আমার ঠিক জানা নেই, তবে আমার মনে হয় এটাকে অপূর্ণ মৃদু বাতাস বলা উচিত। বাতাসের স্থায়িত্ব সর্বক্ষণ না থাকায় পুরোপুরি মৃদু বাতাস বলা যাচ্ছে না বিধায় অপূর্ণ মৃদু বাতাস ই বলা পারফেক্ট।

বাসার সামনে ই ডান দিকে একটা টং দোকান আছে। মামাটা বেশ ভালো চা বানাতে পারে। যেহেতু ঘুমানোর কারণে মাথা বেশ ধরে আছে। সেহেতু আদা মিশ্রিত একটা লেবু চায়ে চুমুক দেওয়াই যায়। দোকানে সামনে গিয়ে মামাকে বললাম, ‘মামা, চিনি কম দিয়ে একটা লেবু চা দিন তো!’ দোকানদারকে সবাই মামা ডাকে কেন আমার ঠিক জানা নেই? কিন্তু ঢাকা শহরে মায়ের ভাই হোক বা না হোক, অপরিচিত মানেই হচ্ছে মামা। কী অদ্ভুত আমরা তাই না!

চা হাতে নিয়ে প্রথম চুমুক দিতেই শরীরে যেন সজীবতা ফিরে এসেছে। চায়ে চুমুক দিকে সামনে তাকাতেই একটি মেয়ে নজরে পড়ে। এতো সুন্দর হাসি! যেন একটি পরী আমার সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছে।

তামিল সিনেমায় নায়ক যখন তার নায়িকার প্রথম দর্শন পায়। তখন যে একটা সিন দেখায় অনেকটা সেরকম ই বলতে পারেন। মেয়েটি আমার দৃষ্টির আড়াল হওয়ার পরও আমি সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম। অনুভুতিটা অদ্ভুত ছিলো! যা বুঝানো সম্ভব না।

মেয়েটিকে আমাদের এলাকায় ইতোপূর্বে আমি কখনোই দেখেনি। আজকে ই প্রথম দেখলাম। মেয়েটি যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনি তার হাসিটাও মুগ্ধকর। হাসলে মুখে হালকা টোলও পড়ে। যা মেয়েটির হাসিকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলে। একটি মেয়ের হাসি কতোটা সুন্দর হয়, তা এই মেয়েকে না দেখলে জানতে পারতাম না।

মেয়েটি দেখার পর মেয়েটি যেন মাথায় একবারে চড়ে বসেছে। মাথা থেকে ফেলতেই পারছি না। শুধু মেয়েটির হাসিটাই চোখে ভাসতেছে। আসলে এটা কী মেয়ে ছিলো নাকি অন্যকিছু? আমি তো এই প্রথম কোনো মেয়ে দেখছি না। আরো তো অনেক মেয়ে দেখেছি। কারো প্রতি তো এমন অনুভুতি আসেনি।

প্রতিদিন সকালে অফিস যাওয়া আসার পথে চারিদিকে তাকিয়ে মেয়েটিকে খুঁজি কিন্তু মেয়েটিকে দেখা তো দূরে থাক, মেয়েটির ছায়াও আর দেখতে পাই না। কয়েকদিন যেতেই মেয়েটির ভূত মাথা থেকে নেমে গেলো। ভেবে নিলাম, মেয়েটি আমার স্বপ্ন ছিলো যা ঘুম ভাঙ্গলেই হারিয়ে যায়। মেয়েটির চিন্তা বাদ দিয়ে অফিসের কাজেই মন বসালাম।

অফিসের কাজের চাপ ইদানীং একটু বেড়ে গেছে। সকালের তাড়াতাড়ি বের হতে হয়, আবার রাতে ফিরতে হয় দেরী করে। ব্যাপারটা মায়ের চোখকে এড়িয়ে পারেনি। মা খুব ভালোভাবে খেয়াল করেছেন। প্রায় প্রতিদিন ই আমি বিষন্ন হয়ে বাসায় ফিরি। অফিস থেকে ফিরে ই ফ্রেশ হবার বদলে কাধে ব্যাগসহ ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিই।

এমনটা আমার শেষ চাকরি খোঁজার সময় হয়েছিলো। বেশ কয়েকটি চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে আমার এই চাকরি হয়েছিলো। প্রায় ১৩টি ইন্টারভিউ দিতে হয়েছে আমার চাকরির জন্য। প্রথম প্রথম ইন্টারভিউতে একটু নার্ভাস ফিল হতো যার জন্য এক্সমিনারদের সাথে ঠিক মতো কথা বলতে পারতাম না গলা শুকিয়ে যেতো।

প্রত্যেক ইন্টারভিউ দেওয়া শেষে বাসায় এসে এমন ই শুয়ে থাকতাম। আর মায়ের বকুনি খেয়ে ফ্রেশ হতে যেতাম। কিন্তু এখন আর মা বকে না। কেন বকে না? কারণ, আমার ছোট্ট বেলা থেকেই আমার এই অভ্যাস। স্কুল পেরিয়ে কলেজ, কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটি কিন্তু আমার এই অভ্যাস পাল্টেনি। বকতে বকতে হয়ত মা নিজেও ক্লান্ত হয়ে গেছে।

সকালে উঠে অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হলাম। মা নাস্তা দিলো, নাস্তাও করে নিলাম। নাস্তা শেষ করতেই মা এসে বললো, ‘আজকে অফিস যাওয়ার দরকার নেই। আমরা একটা জায়গা যাবো।’ মায়ের কথায় অবাক হলাম বললাম! অবাক হওয়ার কারণ হলো, অফিসে কাজের চাপ বেশ জেনেও মা অফিস যেতে বারণ করলেন। তাই মা’কে বললাম, ‘হঠাৎ কোথায় যাবে! তুমি জানো না অফিসে কাজের চাপ একটু বেশি। এখন অফিস বাদ দেওয়া যাবে না।’ মা একটু রাগান্বিত হয়ে বললো, ‘একদিন অফিসে না গেলে কিছু হবে না। তুই বসকে কল দে আমি কথা বলে আজকে ছুটি নিয়ে নিচ্ছি।’ আমি বুঝতেছিলাম না মা কোথায় যাবে আর কেন ছুটি নিতে বলছে? আমিও একটু ভারাক্রান্ত হয়ে মা’কে বললাম, ‘কোথায় যাবে? আর কেন ছুটি নিবো? এটা তো বলো! বসকে তোমাকে দিয়ে কল দিলে কী ভাববে জানো? আমি কাজে ফাঁকি দিই আর অফিসের কাজের প্রেসার বেশি তাই নিজে তো ছুটি নিতে পারবো না, এজন্য তোমাকে দিয়ে ছুটি নিতে চাইছি।’ মা আরও রাগান্বিত হয়ে বললো, ‘তুই এতো বেশি বুঝিস কেন? এতো কাজ কাজ করিস না। আমি যেটা বলছি ঐটা কর।’

আমি মা’কে কীভাবে বুঝাবো বুঝতেছিলাম না। তারপরও বৃথা চেষ্টা করলাম, ‘মা কেন বুঝতেছো না? আমাদের কোম্পনীর একটা নতুন প্রজেক্ট চালু হয়েছে। প্রজেক্টের কাজ ভালো হলে আমার প্রমোশনও হবে।’ মা একপ্রকার বেশি ই বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে তোর যেতে হবে না। আমি একা ই যাবো।’ মা’কে বুঝাতে না পেরে বললাম, ‘আমি অফিসের গাড়ি পাঠিয়ে দিবো, তুমি একটা বের হইও না।’ মা আরও রেগে গেলেন, ‘আমাকে নিয়ে তোকে এতো ভাবতে হবে না।’ মা’কে একটু শান্ত করার জন্য বললাম, ‘লক্ষীসোনা আমার, আমার পৃথিবী, তোমার রাজপুত্র কাজে যাচ্ছে এখন কপালে আদর করে দাও।’ মা আমার কপালে চুমু দিয়ে বললো, ‘পাগল ছেলে।’ আমি মা’কে বললাম, ‘তুমি কখন বের হবে? আমি ঐসময় গাড়ি পাঠিয়ে দিবো।’ ‘তিনটার দিকে বের হবো।’ ‘ঠিক আছে আমি তাহলে ড্রাইভারকে বলে রাখবো। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। অফিস যাচ্ছি, তুমি সাবধানে যেও।’

মা’কে কথাটা বলেই অফিসের জন্য বের হয়ে গেলাম। অফিসে পৌঁছে ড্রাইভারকে বলে রাখলাম তিনটায় যেন মা’কে যেখানে যাবে সেখানে নামিয়ে দেয়, আবার বাসায়ও নিয়ে আসে। প্রতিদিনের মতোই অফিসেই কাজে ব্যস্ত। কাজের চাপও অনেক কমে গেছে। কোম্পনীর নতুন একটি প্রজেক্ট চালু হওয়ায় মাস খানেক কাজের চাপ বেশি ই ছিলো। প্রজেক্টের পুরো দায়িত্বটা আমার উপর ই ছিলো। এজন্য পুরো প্রজেক্টের কাজ আমাকেই হ্যান্ডেল করতে হয়েছে। কাজের চাপ কমলেও ব্যস্ত সময় ই পার হচ্ছে।

হঠাৎ ই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি মা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই মা বললো, ‘বাবা, তাড়াতাড়ি বাসায় আয় তো।’ আমার অফিস শেষ হয় পাঁচটায় কিন্তু এখন বাজে সাড়ে তিনটা। মায়ের আচমকা কল একটু ভাবাচ্ছে। তাই কোনো কিছু না ভেবে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন কী হয়েছে? তুমি ঠিক আছো তো?’ মা বিরক্তকর সুরে বললেন, ‘আরেহ, আমি ঠিক আছি। তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।’ ফ্যামিলিতে মা ছাড়া আর কেউ নেই। মা ছাড়া অন্য কেউ ফোন দিলে একটু বেশি ই চিন্তা হতো। যেহেতু মা নিজেই ফোন দিয়েছে তাই একটু চিন্তা কম ই হচ্ছে। কিন্তু তাড়াতাড়ি যেতে কেন বললো? এটাই ভেবে বুঝে উঠতে পারছি না। বসকে বলেই বাসার উদ্দেশ্য বের হয়ে গেলাম। অফিস শেষ হবারও বেশি সময় বাকি নেই, ঘণ্টাখানেক আছে মাত্র। তাই আজকে অফিস না আসলেও চলবে। বাসায় এসে কলিং বেল চাপতেই মা দরজা খুললো আর বললো,

‘এসছিস?’
‘কী হয়েছে? এতো তাড়াতাড়ি আসতে বললে কেন?’
‘কিছু হয়নি, তুই যা ফ্রেশ হয়ে নে তাড়াতাড়া।’

‘আরেহ!’ কথাটা বলে বাসায় ঢুকে ড্রয়িংরুমে নজর পড়তেই দেখি চার পাঁচজন অপরিচিত লোক, একটি মেয়েও আছে। বাবার বয়সী দু’জন পুরুষ তাই কোনো কিছু না ভেবেই সালাম দিয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এনারা কারা?’ মা যেন আমায় খেয়ে ফেলবে এমন ভাবে তাকালো আর বললো, ‘ফ্রেশ হয়ে আয়, বলছি।’ কী আর করার? মায়ের বাধ্য ছেলে তাই সুপারম্যানের মতো গেলাম আবার সুপারম্যানের মতো চলেও আসলাম। ফ্রেশ হয়ে মায়ের পাশে বসতেই একজন ভদ্র মহিলা বলে উঠলেন, ‘বাহ! ছেলে তো অনেক ফাস্ট।’ ওনার কথা জবাবে মা মুচকি হেসে বললো,

‘জ্বি, এটার জন্য আমার ছেলের অফিসে বেশ সুনাম আছে।’ ভদ্রমহিলাটি মায়ের জবাবের পাশাপাশি আমাকেও বললো,
‘ও আচ্ছা, বাবা তোমার নাম কী?’
‘জ্বি, আমার নাম আরিফ।’
‘তা বাবা, কী করছো তুমি?’
‘এই তো, একটি কোম্পানীতে জব করছি।’

তারপর ভদ্রমহিলা পাশের দু’জন ভদ্রলোকের সাথে কী জানি ফিসফাস করে মা’কে লক্ষ করে বললো, ‘আজকে তাহলে আমরা উঠি। একা মানুষ আপনি, আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম।’ ‘না না, কীসের কষ্ট?’ ‘আমরা তাহলে আমাদের সিদ্ধান্তটা পরে জানাই? বুঝেন ই তো বিয়েশাদীর ব্যাপার।’ ‘ঠিক আছে, আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’  ওনারা যাওয়া মাত্র আমি ঘূর্ণিঝড় ফণীর মতো মায়ের সামনে এসে ডাগর ডাগর চোখ নিয়ে দাঁড়ালাম। মা বুঝতে পারছেন আমি খুব রেগে আছি। তবুও তিনি মুচকি হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন…

‘কী হয়েছে? এভাবে চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?’
‘এটা কী হলো মা?’
‘কী হলো?’
‘এই যে, আমাকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় আনিয়ে এমন একটা অদ্ভুত সারপ্রাইজ দিলে।’
‘ফোনে এতোসব বলা যায় নাকি? তাই তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলছি।’ ‘ঠিক আছে এটা নাহয় মানলাম। কিন্তু মেয়েদের মতো ছেলে দেখতে আসা এটা কোনো রীতিতে পড়ে? মেয়েদের মতো আবার আমাকে প্রশ্নও করছিলো একটার পর একটা।’ ‘তুই তো সেদিন ওনাদের বাসায় যাসনি গেলে তো সেদিনই জিজ্ঞেস করতো। আজকে আমাদের বাসায় আসছে। ওনারা তো জানে না তুই কী করিস না করিস! তাই জিজ্ঞেস করছে।’

‘হুম, এটাও ঠিক আছে। কিন্তু আমি কী তোমাকে বলেছি যে, আমি এখন বিয়ে করবো আমার জন্য মেয়ে দেখো?’
‘বোকা ছেলে, ছেলেমেয়েরা কখনো বলে নাকি যে, আমার বিয়ে দাও। গার্ডিয়ানরাই সময় বুঝে তারপর বিয়ে দেয়। আর আমারও তো দিন দিন বয়স বাড়তেছে। বয়সের বাড়ে নুয়ে পড়ছি। কখন জানি তোর বাবার মতো আমিও মরে যাই। তখন কী আর নাতিনাতকুরের মুখ দেখা হবে?’

‘তোমার যা ভালো মনে হয়, তাই করো।’
‘ওহ! তুই তো মেয়েকে দেখিসনি। তুই দাঁড়া আমি অর্ণির ফটো নিয়ে আসছি।’
‘দেখা লাগবে না। তোমার পছন্দ হলেই আমার পছন্দ।’

মা মেয়েটার ফটো আনতে গেছে। আর আমি তার অপেক্ষা না করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। কিছুটা রাগ হয়েছে। বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করেই বিয়ের কথাবার্তা বলা। মায়ের ছেলে মা দেখতেই পারে। কিন্তু ছেলেকে দেখতে আসা এটা কোন রীতিতে পড়ে আমার জানা নেই। দেখতে তো আসছেই নানাবিধ প্রশ্ন করাও শুরু করে দিলো।

বাসা থেকে বের হয়ে হাটতে লাগলাম। ঐদিকে মা হয়ত ফটো নিয়ে এসে আমাকে খুঁজতেছে। মা মেয়ের নামটা কী যে বলেছিলো? অর্ণি! নামটা তো বেশ সুন্দর। মেয়েটা কেমন হবে কে জানে? হয়ত সুন্দরইই হবে। আমার মায়ের পছন্দ আবার খারাপ হতে পারে না। কারণ মা যখন আমাকে নিয়ে শপিং করতে যেতো অনেক দেখে আমার জন্য জামা কিনতো। ভালো করে দেখতো ওনার ছেলেকে দেখতে কেমন লাগবে? সে অভিজ্ঞতা থেকে বললাম আর কী? ছেলের বউ, নিশ্চয় সেরকম মেয়েই খুঁজে বের করেছে। বাহিরে হাটতেও ভালো লাগছে না। তাই আর বাহিরে না থেকে বাসার দিকে রওনা দিলাম। বাসায় যেতেই মা এসে সামনে হাজির। এসেই জিজ্ঞেস করলো,

‘কীরে কোথায় চলে গেছিস? আমি ফটো এনে দেখি তুই নাই।’
‘কোথায় আর যাবো? বাহিরে গেছি। ভালো লাগছে না দেখে বাসায় চলে আসলাম।’
‘ওহ, ভালো কথা। মেয়েদের তোকে পছন্দ হয়েছে। আগামী মাসেই বিয়ে সেরে পেলতে চান তাঁরা।’
‘তোমার যা ভালো মনে হয় তুমি তাই করো।’
‘তাহলে সামনের ৫তারিখ দিনক্ষণ ঠিক করি?’
‘ দুবাই থেকে মামা আসতে পারবে?’

‘তোর মামাকে যদি বলি এখন আসতে তো এখনই আসতে হবে। আমি যেমন তার একটা বোন, তুইও তার একটা ভাগনে।’
‘হুম হুম, তুমি তো রাণী। আর মামা হলো সেনাপতি। রাণীর কথা তো শুনতেই হবে।’
‘আর তুই হলি আমাদের রাজ্যের রাজপুত্র। বউমা হবে রাজপুত্রের বউ।’
‘হইছে হইছে, খিদা লাগছে নুডুলস বানিয়ে দাও, খাবো।’
‘আচ্ছা দিচ্ছি।’

পুরো বাড়ি আলোকবাতিতে সাঁজানো হয়েছে। সারা বাড়ি আত্মীয়স্বজনে ভরে গেছে। বাচ্চারা দুষ্টামিতে মেতে রেখেছে সবাইকে। বিয়ে বাড়িতে যা যা দরকার সবই আছে। নেই শুধু আমার বাবা। বাবা নামক বটবৃক্ষটাকে সেই ছোট্টবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। তারপর মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমেই আজকের এই আমি। মা’কে কখনো কষ্ট দিতে চাই না। তাই মায়ের পছন্দের মেয়েই বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলাম। হঠাৎ মা এসে ডাক দিলো।

‘কীরে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’ ‘নাহ মা এমনিতেই দাঁড়িয়ে আছি।’ ‘কিরে কী হয়েছে বাবা? তোর চোখে পানি কেন?’ ‘কিছু হয়নি। বাবাকে মনে পড়তেছিলো।’ ‘তোর বাবা থাকলে আজকে হয়ত অনেক খুশি হতেন। আচ্ছা, নিচে চল। এমন দিনে কাঁদতে নেই।’ বাবার কথা মনে পড়তে কখন যে চোখের কোণে পানি এসে জমাট বেঁধেছে বুঝতেই পারিনি। বাবা থাকলে আজকের দিনটা পূর্ণতা পেতো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছের উপর তো কারো হাত নেই।

সারাদিনের ব্যস্ততায় এখন অবধি নববিবাহিতা বউয়ের মুখ দেখা হয়নি। বাসর ঘরে ঢুকে দেখি আমার রুমটা খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাঁজানো হয়েছে। খাটের উপর বসায় নববধূ বসে আছে। আমি ধীর পায়ে গিয়ে বসলাম। বসে বসে ভাবছিলাম। কী বলবো? কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। ছোটবেলায় মুভিতে দেখছিলাম। নতুন বর, নতুন বউয়ের ঘোমটা সরিয়ে থুতনিতে হাত দিয়ে দেখে। ভাবলাম, এমনটা করলে একটু বেশি ন্যাকামো হয়ে যায়। তাই আগেই পারমিশন নিতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কী আপনার ঘোমটা সরাতে পারি?’

ওদিকে থেকে কোনো জবাব আসেনি। কিন্তু মাথা নাড়ানো সাড়া পেয়েছি। ভয়ে ভয়ে কাঁপা হাতে ঘোমটা সরাতেই আমি পুরা শকড। অবাক হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম! আমি কাকে দেখছি? এই মেয়েটা সেই মেয়েটা। যাকে একবার দেখেই আমার অনেক ভালো লেগেছিলো।

আমার অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকায় অর্ণি একটু লজ্জা পেয়েছে। কী বলবো? কী বলবো? ভাবতে ভাবতেই অর্ণিকে বললাম। ‘জানেন, পৃথিবীর সব থেকে ভাগ ব্যক্তিটি মনে হয় আমি?’ অর্ণি হয়ত আমার কথা বুঝে উঠতে পারেনি। হয়ত ভাবছে এই লোকটা আবোলতাবোল কী বলতেছে? তার ভাবনা কাটাতে আমি তাকে পূর্বের সব কাহিনী খুলে বললাম। শেষে একটা কথা বললাম, ‘আর দেখুন, যাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছিলো। আবার তাকে হারিয়েও পেলেছিলাম। যার আশা ছেড়ে দিয়ে মায়ের পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করলাম। আর সে মেয়েটাই হয়ে গেলেস আপনি।’ আমার কথা শুনে অর্ণি মুচকি হাসলো। হুমায়ূন আহম্মেদ ঠিকই বলেছেন, ছেলেদের কাছে প্রিয় মানুষটির হাসির চাইতে মূল্যবান আর কিছু হতে পারে না। অর্ণির এই হাসিই আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। আর আজ সেই মুচকি হাসিটাই আমাকে পাগল বানানোর জন্য যথেষ্ট।

অর্ণি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা, আমি যদি সে মেয়েটা না হতাম। এরপর হঠাৎ যদি কোনোদিন আপনি আবার আমাকে দেখতেন তবে কী সেদিন আমার প্রতি আপনার ভালো লাগা কাজ করতো?’ কী বলবো বুঝতেছিলাম না। তার এই প্রশ্ন আমাকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছি। কিছু না ভেবেই বললাম, ‘ভালো লাগা কাজ করতো কিনা জানি না। কিন্তু এটা কোনোদিন চাইতাম না। আপনি আবার আমার সামনে পড়েন।’ অর্ণি একটু অবাক হয়েছে হয়ত! তাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘কেন! চাইতেন না কেন?’ ‘কারণটা খুবই স্বাভাবিক। আপনাকে দেখার পর আমার কোনো কিছুই ভালো লাগতো না। কিছুদিন হয়ত ভাবনাতে আপনিই থাকতেন। আর তখন আপনার জায়গায় অন্যকেউ থাকলে সে ব্যাপারটা লক্ষ করতো। তাকে তো এটা বলা যেতো না। তখন সে হয়ত এমনটা ভাবতো আমি তার থেকে কিছু লুকাচ্ছি।’ ‘ও আচ্ছা। কিন্তু আপনি যে আমাকে আপনি আমাকে আপনি আপনি করে বলছেন, এটা শুনতে আমার ভালো লাগছে না।’ ‘কেন?’ ‘জানি না, তবে আপনি না বলে তুমি বললেই আমি খুশি হবো।’ ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুমিই বললো।’

আমি আসলে কল্পনাও করতে পারিনি। অর্ণিকে আমার জীবনসঙ্গিনী হিসেবে আমার জীবনে পাবো। জীবনে অপ্রত্যাশিত কিছু পেয়ে গেলে তা ভালোলাগাটা ভাষায় প্রকাশ করা যেমন কষ্টসাধ্য তেমনি প্রিয় কোনো কিছু পেয়ে গেলে তার আনন্দটাও অপ্রকাশ্য থেকে যায়। আমি পেয়েছি অর্ণিকে। সে আমার সামনে এসেছিলো ভেসে যাওয়া মেঘের মতোই। যা চোখের পলক ফেলতেই অদূরে হারিয়ে যায়। কিন্তু এখন আমার এই পাওয়া কখনোই হারাতে চাই না।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত