আত্নহত্যার সিদ্ধান্তটা খুব ভেবে চিন্তে ঠান্ডা মাথায় নিলাম। আয়ানের সাথে তিন বছরের ভালাবাসার সম্পর্ক ছিন্ন কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছি না। ব্রেকআপের ছয় মাস পরেও সব কিছুই অসহ্য লাগছে ! ক্যাম্পাসে প্রতিদিন তার মুখখানা দেখে আমার আরও বেশি কষ্ট হয়।
পৃথিবীতে আয়ানকে ছাড়া বেঁচে থাকার কোন মানেই খুঁজে পাই না । আব্বু-আম্মুকেও যেন বিষের মতো মনে হয় ! তাদের সাথে ছয় মাস যাবত তেমন কোনো যোগাযোগ রাখছি না। প্রায়ই হোস্টেলের সামনে এসে আব্বু টাকা দিয়ে যায় কিন্তু আমি তার চোখের সাথে চোখ মিলাতে পারি না। বুঝতে পারি আব্বুর চোখ থেকে পানি পরছে, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দেয়। আম্মু ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে, হোষ্টেল ছেড়ে দিয়ে বাসায় চলে যেতে বলে। কিন্তু তাদের এ মায়াকে বড় বেশি ঝামেলা মনে হয় !
ছয় মাস যাবত একটা একটা করে ঘুমের ওষুধ যোগাড় করছি বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে। খুব ধারালো একটা চাকুও কিনেছি । আজ রাতেই আত্মহত্যা করতে হবে যে কোন উপায়ে ! রুমডেট নামক নোংরামি করতে না পারায় আয়ান আমার জীবন থেকে সরে গেছে। মরে গেলেই হয়তো আয়ানের স্মৃতি আমার মন থেকে উধাও হবে তাছাড়া নয় !
আজ রুমমেট নীলা তার বাসায় গেছে, দুইদিন পরে ফিরবে। আমার জন্য আত্মহত্যা করতে সুবিধাই হবে ! ঘুমের ঔষুধ একসাথে ২৫ টা খাবো নাকি হাতের রগ কাটবো নাকি গলায় ফাসঁ লাগাবো সেটাই চিন্তা করছি ! মৃত্যুই সবচেয়ে সহজ পন্থাই অবলম্বন করতে হবে যাতে মৃত্যু যন্ত্রণা টের না পাই। বুঝতে পারছি খুবই ভীরু প্রকৃতির মেয়ে আমি না হলে কবেই জীবন নামক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নিতাম। আব্বুর নাম্বার থেকে অবিরত ফোন আসছে । ফোনটা বার বার কেটে দিচ্ছি। ভাবছি কি হবে আর মায়া বাড়িয়ে শুধু শেষ বার কথা বলার জন্য ফোনটা রিসিভ করলাম।
– কি ব্যাপার এতো দেরি করলি কেনো ফোন রিসিভ করতে ? কতটা টেনশন হচ্ছিল আমাদের।
– না এমনি ঘুমিয়ে পরেছিলাম তাই টের পাইনি।
– আজ ছয়মাস যাবত তোমার জন্য আমাদের নাওয়া-খাওয়া হারাম হয়ে গেছে। সারাদিন টেনশনের মধ্যে থাকি কখন না তুমি আবার কিছু করে বসো ! আমাদের সাথে ঠিক মতো কথা বলো না। তোমার আম্মু সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে, নামাজ পরে তোমার জন্য দোয়া করে।
– এখন এসব শুনতে ভালো লাগছে না আমার। আমাকে নিয়ে আর টেনশন করতে হবে না তোমাদের। এখন রাখি…
– অন্তি শুনো, একজন মা নয় মাস ধরে তার সন্তানকে পেটে রাখে। সন্তানের যাতে কষ্ট না হয় তাই খুব সাবধানে থাকে। একজন মানুষ সর্বোচ্চ পয়তাল্লিশ ইউনিট ব্যথা সহ্য করতে পারে। সেখানে একজন মা সাতান্ন ইউনিউ ব্যথা সহ্য করে তার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখায়। সন্তানের মুখ দেখে একজন মায়ের সব কষ্ট এক নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। সেই মায়ের কান্নার কি কোনো দাম নেই তোমার কাছে ? আব্বুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছি। কথা গুলো শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। গলা ভারী হয়ে আসছে।
– কারো অবহেলা পেলেই যদি মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করতো তাহলে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আত্নহত্যা করতো সন্তানের বাবা-মা ! কারন কি জানো অন্তি ? সন্তানের জন্য বাবা-মা সব কষ্ট সহ্য করে বড় করতে করতে এক সময় সেই সন্তানের কাছ থেকেই অবহেলা পেতে শুরু করে। এখন যেমন তুমি আমাদের অবহেলা করছ ! তাহলে কি আমাদেরও আত্মহত্যা করা উচিত ?
আব্বুর মুখে এমন কথা শোনা মাত্রই চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলাম। আব্বু তুমি কি সব পাগলের মত কথা বলছো ? কিছুক্ষণ নিরবতা, ওপাশের নিস্তঃব্দতাই বলে দিচ্ছে আব্বুর চোখ থেকেও হয়তো পানি ঝরছে, পাশে থাকা আম্মুর কান্নার আওয়াজও আজ আমার কানে খুব বেশি বাজছে।
– জীবনটা খুব সুন্দর অন্তি। মানুষ মাত্রই ভুল করে। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই পরবর্তীতে জীবনটাকে সাজায়। আজ যে তোমাকে অবহেলা করছে তাকে দেখিয়ে দাও তাকে ছাড়া তুমি ভালো আছো নিজের ভুল শুধরে।
তোমার মা আর আমি তো সব সময় পাশে আছি তোমার। কখনো আত্মহত্যার কথা মাথায়ও আনবা না। না পাবে ইহকাল না পাবে পরকাল।
– পৃথিবীর সব বাবা-মায়ের মতোই আমি আর তোমার মা খুবই স্বার্থপর। যতক্ষণ না আমাদের সন্তানকে আবার হাসি-খুশি দেখতে পাবো ততক্ষণ আল্লাহর দরবারে দোয়া করে যাবো। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার জন্য দোয়া করবো স্বার্থপরের মতো। যদি পারো আমাদেরকে ক্ষমা করে দিস মা ফোনটা কেটে গেছে। চোখের কোন বেয়ে অঝোরে পানি ঝরছে আমার। গলার কাছে যেনো সবকিছু আটকে গেছে। সত্যিই তো ! আল্লাহ বাবা-মাকে সন্তানের বিপদ আগে থেকেই বোঝার অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়েছে। তা না হলে তারা কিভাবে বুঝলো আমি আত্মহত্যা করতে পারি ! ঘুমের ওষুধগুলো ঝুড়িতে ফেললাম আর চাকুটা ব্যাগে রেখে দিলাম বাসায় নিয়ে যাবো।আম্মু চাকু দিয়ে সবজি কাটতে পারবে।
বাবা-মার ভালোবাসার কাছে আত্মহত্যা নামক জঘন্য অপরাধ পরাজিত হলো। স্বার্থপর বাবা-মাগুলোর জন্যই পৃথিবী এখনো এতো সুন্দর। অতীতকে ভুলে আপনজনের জন্য হাসি-খুশি থাকার নামই জীবন। মরিচীকার পিছনে নয় সত্যি ভালোবাসাগুলোর জন্য বেঁচে থাকার সুখ অনাবিল আব্বু আম্মু সত্যিই তোমাদের অনেক ভালোবাসে এই স্বার্থপর মেয়েটা।