নাকফুল পরা মেয়ে আমার একদম অপছন্দ । আপনার নাকফুলটা খুলে ফেলুন তো । পাশের চেয়ারে বসে থাকা আমায় দেখতে আসা ছেলেটা বললো।আমি শাড়ির আঁচলটা টেনে মাথা থেকে পড়ে যাওয়া ঘোমটা তুলে দিয়ে ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললাম,
–বিয়ের আগেই অধিকার দেখাচ্ছেন ?
–যাকে বিয়ে করবো, তার উপর অধিকার দেখাবো না ?
কপালের চামড়া কুচকে লোকটা আমায় উত্তর দিলেন।উনার ভঙিমা দেখে মনে হচ্ছে উনার সাথে আমার কয়েক বছরের সংসার । লোকটাকে কিছুই বললাম না।রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে বসা একাধিক ব্যক্তির সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
–আমি বিয়ে করবো না । আমার কথা শুনে বাবা চোখ বড় করে তাকালেন।মা পাত্রপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে কাকুতিমিনতি করে বললো,
–আপনারা আমার মেয়ের কথায় কিছু মনে করবেন না।না বুঝে বলে ফেলেছে ।
–এমন বেয়াদব মেয়েকে আমরা ছেলের বউ বানাবো না।চলো সবাই ।
কি বিচ্ছিরি ভাবে ছেলের বাবা কথাটা বললো ! কথা বলার সময় মুখ থেকে থু থু বেরিয়ে আসছিলো। কিছুক্ষণ পর ছেলেসহ সবাই আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেলো।মা রাগের চোখে আমায় দেখছে আর বলছে,
–মেয়ে হয়ে জন্মেছিস কি জন্য ? ছেলে হয়ে জন্মাতে পারলি না ?
–মা, লোকটার কথাবার্তা আমার ভালো লাগেনি ।
–মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছিস, তখন মানিয়ে গুঁছিয়ে চলতে হবে।কিছুই করার নাই।
মায়ের তীক্ষ্ণ কথাগুলো খুব লেগেছিলো বুকের বাম পাশে।ভাগ্যের উপর রাগ হতে লাগলো ! কেন বিধাতা ছেলে বানিয়ে পাঠালেন না ? তারপর প্রায় দেড় বছর কেটে গেলো। সেদিন ভার্সিটি থেকে আসার পথে খেয়াল করলাম, রাস্তার ডান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বলছিলো,
–এই যে শুনুন ।
–জ্বী, আমাকে বলছেন ?
আমি মাথা তুলে তাকাতেই ছেলেটাকে দেখলাম।একটা নীল পাঞ্জাবি পরনে ছিলো।তাছাড়া সাথে একটা ট্রলি ব্যাগ ছিলো।চোখে চশমা, হাতে বেশ সুন্দর একটা হাতঘড়ি ছিলো। গালে চাপদাড়ি ছিলো।দেখতে মোটামোটি ভালোই লাগছিলো।কিন্তু এই ছেলেটাকে আগে কখনো আমাদের গ্রামে দেখেছি বলে মনে হচ্ছেনা।
–জ্বী। আপনাকেই বলছি । এখানে মায়াদের বাড়িটা কোনদিকে বলতে পারেন ?
–মায়া !
কিছুটা অবাক হয়ে অস্পষ্টভাবে মায়া নামটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসলো। আজব তো ! লোকটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকেই, আমার বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করছে !
–জ্বী । একটু বলতে পারবেন উনাদের বাড়িটা কোথায় ?
–জ্বী, অবশ্যই।
তারপর আমি লোকটাকে যথাযথ রাস্তাটা বলে দিয়ে আড়ালে অনুসরণ করতে লাগলাম।বুঝতে পারছিনা,এই লোকটা আমার বাড়ি কেন খুঁজছেন ? কিছুক্ষণ পর উনি বাড়ি গিয়ে সচরাচর ঘরে ঢুকে গেলেন। আমিও পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই মা বললো,
–মায়া , কে এসেছে জানিস ?
–কে ? মা’কে এমনভাবে প্রশ্নটা করেছি যেনো আমি কিছুই জানিনা। মা ফিসফিস করে বললো,
–পারভেজ এসেছে ।
–পারভেজ ! উনি হঠাৎ ?
গায়ের বোরখাটা খুলতে খুলতেই মা’কে প্রশ্ন করলাম। অবশ্য মা প্রশ্নের উত্তরে কি বলেছে সেদিকে আমার মোটেও খেয়াল নেই।পারভেজের কথা শুনে, স্মৃতির পাতাগুলো মনের অজান্তেই উল্টে গিয়ে সাতবছর আগের জায়গায় থেমেছে।
তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। আর পারভেজ ছিলেন দশম শ্রেণীর।বাবার খুব পছন্দের একটা ছাত্র ছিলো পারভেজ । সেই সুবাদে প্রায় বাবার কাছে আসতো।তখন থেকেই পারভেজকে একটু একটু ভালো লাগতে শুরু করে আমার। প্রায় বছর কেটে গেলো।পারভেজের পরীক্ষা শুরু হয়ে তখন শেষের পথে ছিলো।আর আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কিভাবে পারভেজকে সব বলবো ? অতঃপর পারভেজের পরীক্ষা শেষ হয়ে যায় এবং ও এখান থেকে অনেক দূরে চলে যায় লেখাপড়া করার জন্য তারপর থেকে আর পারভেজের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি।মনের কথাটি মনেই থেকে যায়। ও অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে।ওকে দেখে আমি নিজেই চিনতে পারিনি, যে ও পারভেজ ! হঠাৎ মা বললো,
–মায়া, যাতো। তোর বাবাকে গিয়ে বল যে, আমি ডাকছি। আমি ড্রয়িংরুমে এসে বাবাকে বললাম, মা ডাকছে।বাবা আমাকে পারভেজের সামনে বসিয়ে বললো,
–তোরা গল্প কর।আমি তোর মায়ের কথা শুনে আসছি।
বাবা যাওয়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করেই ওর সামনে বসেছিলাম।কিন্তু আমার হাত পা কেমন জানি কাঁপছিলো ! মনের ভিতর কেমন ধুকধুক শব্দ হচ্ছিলো।নীরবতা কাটিয়ে ও বললো,
–কেমন আছো মায়া ?
–জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো।আপনি ?
–মায়া, তোমার কন্ঠস্বরটা একমিনিট ! তুমি তো সেই যাকে আমি রাস্তায় দেখেছি।তাইতো ?
–জ্বী ।
–মাই গড ! বোরখা পরা ছিলো তাই হয়তো চিনি নাই।কিন্তু তুমি আমাকে চিনতে পারো নাই ?
–হঠাৎ আমাদের এখানে আসলেন যে ? উনার করা প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলাম।
–আসলাম একটা কাজে ।
–কি কাজ ?
–কোন কাজের কথা বললে তুমি খুশি হবে ?
–আজব তো ! আপনার কাজের কথা শুনে আমি কেন খুশি হবো ?
–সেটাই ! নাকফুল টা তো খুব সুন্দর ! জানো,মেয়েদের নাকফুল পরলে, দেখতে বেশ মিষ্টি লাগে ।
–আমাকেও ? অবাক হয়ে ওকে প্রশ্নটা করলাম।
–পাগলী । কেমন যাচ্ছে তোমার দিনকাল ?
–ভালোই…
বাবা চলে আসাতেই আমরা দু’জনে চুপ হয়ে গেলাম। আমি বসা থেকে উঠে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।মা আমার জায়গাটাতে বসেছেন।তখন পারভেজ ট্রলি ব্যাগ থেকে কয়েকটা ছোট ব্যাগ বের করলো,বাবার হাতে ব্যাগগুলো দিয়ে বললো,
–স্যার, এগুলো আপনার আর আন্টির জন্য নিয়ে আসা।
–এসবের কি দরকার ছিলো !
বাবা পারভেজের হাত থেকে উপহারগুলো নিতে নিতেই বললো। আমি পারভেজের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।উপহারগুলো দেওয়ার পর ও আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেলো। ও আমার দিকে একটি বারও তাকায় নি।আমার জন্য কিছু আনে নি, ঠিক আছে।কিন্তু এভাবে আমায় কিছু না বলেই ও চলে গেলো ? সপ্তাহখানেক চলে গেলো। আজ ভার্সিটি থেকে এসে দেখি বাড়িতে অনেক মানুষ ! এদের মধ্যে কাউকেই আমি চিনিনা । আমি সোজা নিজের রুমে চলে গেলাম। গায়ের বোরখা খুলছিলাম।হঠাৎ কারও গলার আওয়াজ পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম,
–আসতে পারি ?
–জ্বী, আসুন ।
–মিস্ মায়া , দরজা খোলা রেখেই ড্রেস চেঞ্জ করা হচ্ছে ? পারভেজ কথাটা বলতে বলতেই আমার পাশে খাটে বসলো।
–আপনি এখানে ? অনেকটা অবাক হয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম।
–হ্যাঁ।আসতে পারি না ?
–তা নয়।কিন্তু আমার রুমে ?
–শ্বশুরের অনুমতি নিয়েই এসেছি জনাবা।
–মানে ?
–সেদিন আপনার উপহারটা দেওয়া হয়নি তো।তাই সেটা দিতে আসলাম।
–আমার উপহার ?
–জ্বী। আপনার জন্য একটা সুন্দর নাকফুল নিয়ে এসেছি।দেখুন তো পছন্দ হয় কিনা ?
–আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন ? নাকফুল টা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই পারভেজ বলে উঠলো,
–নাহ্।
এখন নয়।এটাতো আপনাকে দেখানোর জন্য নিয়ে আসছি।বিয়েতে এটা পরে আমার ঘরে প্রবেশ করবেন।বুঝলেন ? আর আপনির ব্যাপারটা ! আসলে আপনি যদি তুমি করে বলেন তাহলে আমিও আপনাকে তুমি করেই বলবো।
–বিয়ে !
–কেন ? পাত্র হিসেবে আমি অযোগ্য ?
–ইয়ে মানে …
–পাগলী মেয়ে। ভালবাসো, আর সেটা বলতে পারো না ?
–আপনি কিভাবে বুঝলেন ?
–সেটা না হয় গোপন ই থাক।
পারভেজ রুম থেকে কথাটি বলে বেরিয়ে গেলো।পারভেজ কিভাবে জানলো, আমি তো সব ডায়েরিতে লিখতাম।তার মানে পারভেজ ডায়েরিটা পড়েছে ! টেবিলে গিয়ে দেখলাম, ডায়েরিটা নেই। হঠাৎ মা বললো,
–মায়া, তৈরি হয়ে নে। পারভেজের মা তোকে আংটি পরিয়ে যাবে।
–চোখে কাজল দিতে গিয়ে মনে পড়লো ,
পারভেজ সাতবছর আগে একদিন বলেছিলো, আমাকে নাকি হালকা কাজলে বেশ লাগে ! তাই চোখে হালকা করে কাজল পরে তৈরি হয়ে নিলাম।বিয়ের জন্য আংটি পরেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়ে গেলো।