ভালোবাসার মূল্যায়ন

ভালোবাসার মূল্যায়ন

ভালোবেসে সবাই ঘর বাঁধতে পারে না। তবে আমি বেঁধেছিলাম আমার ভালোবাসার ঘর,সংসার। আজ আবিরকে ডিভোর্স দিয়ে সেই ভালোবাসার ঘর ভেঙ্গে চলে এলাম। আর কত সহ্য করব আমি? সম্পর্কের প্রথম থেকেই সহ্য করে এসেছি। রুমের দরজা লাগিয়ে অনেক্ষন কাঁদলাম, কাঁদলে নাকি হাল্কা লাগে। তবে আমার চোখের জল আমারি ভুলের মাশুল। আমার পাপের শাস্তি আমাকেই মাথা পেতে নিতে হবে। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। এস এস সি পরীক্ষার খুব সম্ভবত চার মাসের মত বাকি। তখনই আমি আবিষ্কার করলাম আমাকে একটি ছেলে অনুসরন করে।

ছেলেটিকে আমি ভালো করে চিনিওনা। তবে আমাদের ক্লাসেরই ছাত্র সেটা জানি। অনিয়মিত ছাত্র, ঠিকমত স্কুলে না আসলে কাউকে চেনা যায় নাকি? আমি প্রতিদিন স্কুলে গিয়েই দেখতাম ছেলেটি মেহগনি গাছ বেয়ে স্কুলের ছাদে উঠে বসে আছে। আর আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। শুধুই কি তাই? প্রতিটি ক্লাসে প্রতিটি সময় সে আমারই দিকে তাকিয়ে থাকে। এমনকি এর কারণে ক্লাসে অমনোযোগী হওয়ায় স্যারের হাতে দুদিন পিটুনিও খেয়েছে। তবুও তাকিয়ে থাকে। যে ছেলেকে সারা বছরে দুদিন স্কুলে দেখিনি সে ছেলে এখন প্রতিদিন স্কুলে আসে। আর তার কাজই হল আমার দিকে তাকিয়ে থাকা।

তবে ছেলেটার চেহারা, চাহনী আমার ভালোই লাগত। আমিও কিন্তু মাঝেমধ্যে আড়চোখে তাকিয়ে তার তাকিয়ে থাকাটা দেখে নিতাম। চেহারায় কেমন একটা মায়া মায়া ভাব। আমি আবার এত রুপের বর্ণনা দিতে পারব না। বড় বড় কবি সাহিত্যিকরাও মেয়েদের রুপ বর্ণনা করতে করতে উপন্যাস লিখেছেন। সেই তুলনায় ছেলেদের নিয়ে কিছুই লেখা হয়নি। মোট কথা আমারো ছেলেটিকে ভালো লাগত। ইচ্ছে করেই একটু বেশি পরিপাটি হয়ে স্কুলে যেতাম। মাথায় একটা বিষয় কাজ করত যে, ছেলেটা আমাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।

টিফিনের সময় ছেলেটি আমার কাছে এসে তার একটি ডায়রী এগিয়ে দিয়ে বলল, ” সোমা, আমার ডায়রীতে একটুু স্যারের পড়াগুলো লিখে দাও না। আমি তো কিছুই পারি না” ডায়রিটি হাতে নিয়ে প্রথম পৃষ্টা উল্টিয়ে দেখি খুব সুন্দর করে ডিজাইন করে “আবির” লিখা। পরের পৃষ্টা খালি পেয়ে পড়া লিখলাম। এর মধ্যে আবির তাড়াতাড়ি করে ডায়রী নিয়ে গেল। বুঝলাম না, এত আগ্রহ নিয়ে ডায়রী এগিয়ে দিয়ে আবার কেড়ে নিল কেন? সেটা বুঝেছি আরো দু’দিন পর। আমার এক বান্ধবীকে দিয়ে ওর ডায়রী দিয়েছে আমাকে। ডায়রী খুলে পড়তে গিয়ে হতবাক হয়েছি। পৃষ্টায় পৃষ্টায় আমার কথা লেখা। কবে আমাকে প্রথম দেখেছে, কবে কখন আমাকে সুন্দর লাগছিল। আমার সাথে দু চারটে কথা বলার সবও লিখেছে। আমাকে নিয়ে লিখেছে ছড়া কবিতা। পড়ার নামে ঠনঠন, আর আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। শেষের দিকে একটি পৃষ্টায় মোটা কালিতে লিখা, ” সোমা, আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি, I love you.” আমি ডায়রীটি বাড়িতে নিয়ে এলাম। সেদিন কি আর কোন কিছু ভালো লাগে? ডায়রীটি আরো দুইবার পড়লাম।

অযথাই একটু পরপর আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখছি। সত্যিই কী আমি অনেক সুন্দর? রাতেও ঘুমাতে ইচ্ছে করে না, কেমন যেন লাগছে। ইচ্ছে হচ্ছে আবিরকে গিয়ে বলি, আবির আমিও তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। কিন্তু , আমি সেটা পারবনা। তাই আবিরের ডায়রীর সেই শেষের পাতায় লিখে দিয়েছি, i love you too. এস. এস. সি পাশ করে দু’জন একই কলেজে ভর্তি হয়েছি। লেখাপড়ার পাশাপাশি আমাদের প্রেম ভালোবাসাও চলছে দুর্দান্ত গতিতে। কতবার যে ঝগড়া লেগেছি আবিরের সাথে তার কোনো হিসেব নেই। সামান্যতম বিষয় নিয়ে ঝগড়া হত। দুই তিনদিন কথা হত না। আবার কান্নাকাটি করে কথা বলতাম।

একমাত্র মনে হয় ভালোবাসার মানুষের সাথেই ঝগড়া করেও আবার কাঁদতে হয়, কষ্ট পেতে হয়। মাঝে মধ্যে খুব ভয় হয়, এই ঝগড়া বা মান অভিমান আবিরকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবেনা তো? শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করেই ফেললাম। প্রতিদিনই সেও বলত তোমার বাবা মা আমাকে মেনে নেবেন তো? আমিও বলতাম ঝগড়া লেগে আবার আমাকে ভুলে যাবেনা তো? দুজনের মধ্যেই কেমন যেন একটা হারানোর ভয় কাজ করছিল। তাই দুজনেই বলেছি, চলো বিয়ে করে ফেলি। কিন্তু আমি তো আমার বাবা মা’কে কিছুতেই বলতে পারব না। হয়তো আমাকে বাড়ি থেকেই বের করে দেবে।

শেষ অবধি আবিরের মা আর আবিরের মামাত ভাইয়ের সাহায্যে আমরা কাজি অফিসে বিয়ে করি। যা আমার পরিবারের বা আশেপাশের মানুষজন কেউ জানে না। আবির খুবই দরিদ্র পরিবারের ছেলে। ওর বাবা কেন্সারে মারা গিয়েছিল। তখনই ওদের ঘড় বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে আবিরের বাবার চিকিৎসা করেছিল। শেষ পর্যন্ত আর বাঁচানো যায়নি। কিছুদিন পর থেকে সংসার চালানোর জন্য বাধ্য হয়ে চাকরি করতে শুরু করেন আবিরের মা। ওরা টঙ্গীতেই ভাড়া থাকে। অনেক সময় আবিরের কলেজ আসার জন্য বাস ভাড়াও থাকত না। আমিই দিতাম, এক প্রকার জোড় করেই দিতাম। আমার জমানো টাকা থেকে ওকে কাপড় কিনে দিতাম। তবুও আবির সামান্য বিষয় নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করত। বরিশাল পল্লীগ্রামে বাড়ি থাকায় লেখাপড়ার সুবিধার্থে বাবা অনেক আগেই টঙ্গীতে বাড়ি করেছিলেন। আমরাও এখানেই থাকি, বছরে দুয়েকবার গ্রামের বাড়ি যাই।

বাবা মা কান্না করছে, আমি পাশের রুমে বসে আছি। এখন নিজেকে বড্ড বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে। তখন তো আবেগের মোহে অন্ধ হয়ে বিয়ে করে ফেলেছিলাম। এখন তো মানুষের সামনে বাবা মা’কে ছোট হতে হচ্ছে। এলাকার প্রায় সবাই জেনে গেছে আমি গোপনে একজনকে বিয়ে করেছি। এলাকার মানুষ কিভাবে জানল মাথায় আসছে না। নিশ্চয় আবিরের পরিবারের কাছ থেকেই জেনে গেছে। বাবা মায়ের পায়ে ধরে অনেকক্ষন কান্নাকাটি করেছি। ওনারা ক্ষমা করেছেন আমাকে, কিন্তু কান্না করছেন। আমার কোনো ভাই নেই, একটি মাত্র ছোট বোন। আর আমি বড় হয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছি, সেটাও এলাকার মানুষ জানে। বাবা মা সেজন্যই কাঁদছেন। এখন বুঝতে পারছি আমি কত বড় অন্যায় করেছি। আবিরকে জানানোর পর আবির তার এক মামা আর মামাত ভাইকে পাঠিয়েছে আমার বাবার কাছে। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বাবাকে রাজী করিয়েছে ওরা।

বাবা বলেছে, আবির তো এখনো পড়ছে, সোমাও লেখাপড়া করছে। আপাতত মেয়ে আমাদের বাড়ি থেকেই লেখাপড়া করুক। আবির কিছু একটা করলে তখন না হয় আপনাদের বাড়ি যাবে। ওরাও রাজী , আমাদের সামাজিকভাবে আবার বিয়ে পড়ানো হল। বিয়ের পর থেকে আবির সম্পূর্ণ বদলাতে শুরু করল। দুজনেই ইন্টার পাশ করেছি। আমি আরো পড়তে চাই, বাবা মা’ও সেটাই চান। আর আবির সামান্য বিষয় নিয়েই আমার সাথে ঝগড়া করত। বিয়ের আগেও সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া করত। তখন ভাবতাম, প্রেম ভালোবাসায় সামান্য খুনসুটি থাকবেই। কিন্তু বিয়ের পর আবির দুই তিনদিন আমার গায়েও হাত তুলেছে। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, এটাই আমার ভালোবাসার আবির কিনা।

যে আবির ঘন্টার পর ঘন্টা আমার দিকে তাকিয়ে থাকত, কত প্রেম ভালোবাসার বাণী শোনাত। ছড়া কবিতা লিখত আমাকে নিয়ে। আর সেই আবির এখন একটু ঝগড়া হলেই আমার গায়ে হাত তুলে, ভাবতেই পারি না। একদিন তো আমাদের বাড়িতেই আমার গায়ে হাত তুলেছে, আর সেটা মা দেখে ফেলেছে। মা বাবা’কে বলে দিয়েছে। কোনো বাবা মা’ই চায় না তার মেয়েকে তাদের মেয়ের স্বামী মারধোর করুক। বাবা মা কাঁদত, আমিও কাঁদতাম। এটাই বুঝি ভালোবাসা। একদিন মায়ের সাথে আমার রাগারাগি হয়, আর সেটাও আবিরকে নিয়েই। তারপর রাগ করে চলে গেলাম আবিরের বাড়ি। মা বলছে আমি কেন একজন চাল চূলাহীন ছেলেকে বিয়ে করলাম? আমার খারাপ লাগছিল কথাগুলো, তাই চলে এসেছিলাম। আবার চারদিন পরেই বাবার বাড়ি রওয়ানা দিলাম।

আবারো ঝগড়া আবিরের সাথে, সে আমাকে আবার মেরেছে। এমনকি গলা টিপে ধরেছে, শ্বাস নিতে যখন কষ্ট হচ্ছিল, তখন ছেড়ে দিয়েছে। আর বলছে, আশেপাশে মানুষ না থাকলে তোকে মেরেই ফেলতাম। হায়রে আমার ভালোবাসা, হায়রে ভালোবাসার ঘর। অনার্সে ভর্তি হয়েছি আমি। আমাকে আমার জীবন নিয়ে আরো এগিয়ে যেতে হবে, থেমে গেলে চলবে না। বাবা মা’কে বলেছি, আমি আর পারব না আবিরের ঘর করতে। বাবা মা আমাকে সমর্থন করেছে। আমি ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছি আবিরকে। আমার বাবা মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা মা। এতকিছুর পরও আমাকে তারা বুকে আগলে রেখেছে। আমি কিছুতেই বাবা মায়ের চোখের পানির দাম দিতে পারব না। কতটা কাঁদিয়েছি তাদের, তারপরও সবসময় আমার পাশে থেকেছে, বুকে জড়িয়ে নিয়েছে।

মাঝরাতে কখনো ঘুম ভেঙ্গে যায় আবিরকে স্বপ্নে দেখে। সে আবির না, যে আবির আমার গলা টিপে ধরেছিল।
সেই আবিরকে ভালোবাসি আমি, যে আবির আমার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকত। আমার মুখের একটু হাসির জন্য পাগল হয়ে যেত। কোথায় সেই ভালোবাসা? আমার মনে হয় মানুষ ভালোবাসতে জানে, তবে ভালোবাসা পাওয়ার পর সবাই সঠিক মূল্যায়ন করতে পারে না। ভালোবাসা, সেতো স্পর্শের বাইরে। হৃদয়ের গহীন কোণে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত