অবশেষে দু’জনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। বাকি পথটুকু যে যার মতো একাই পেড়িয়ে যাবো। পরস্পরকে দেওয়া সব কথা ফিরিয়ে নিয়েছি। আকাশ বাতাস চাঁদ জোছনা বা বৃষ্টি; যা কিছু সাক্ষি রেখেছিলাম ভালবাসার নামতা খাতায় সেই সাক্ষি গুলোকেও মুক্তি দিয়ে দিলাম। সিদ্ধান্ত হলো- যে যার মতো থাকবো। কেউ কারো জীবনে আর কোন ছায়া ফেলতে আসবো না। যোগাযোগের সব পথ নিজেদের হাতেই রোধ করে নিলাম। তবে আমরা কেউ কাউকেই কোন দোষারোপ কিংবা অভিষাপ দেইনি। শুভ কামনা প্রত্যাশা করেই বিদায় নিয়েছি।
আমি যখন ওকে ছেড়ে চলে আসছি তখন একবার দাঁড়িয়ে গেলাম। খুব করে ইচ্ছে করছে একবার পিছনে ফিরে তাকাই। হয়তো ও আমার দিকে চেয়ে আছে। কিংবা ও হয়তো হেঁটে চলে যাচ্ছে। হয়তো যাওয়ার সময় আমায় পিছন ফিরে দেখছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছিনা। বুকের ভিতরে হৃৎপিন্ডটা যেন বলেই যাচ্ছে ধুকধুক করে, “একবার পিছনে তাকা গাধা। ঐ মেয়ে তোর সাথে দেখা করে একা একা কখনো বাসায় গেছে? যা ওকে রিক্সা ঠিক করে দিয়ে আয়।”
আমি হাঁটা দিলাম আবার। পিছন ফিরে যদি দেখি ও আমার দিকে তাকিয়ে নেই। হেঁটে যাচ্ছে গটগট করে। সেটা সহ্য করার সাহস আমার নাই। হাঁটতে হাঁটতে জিইসি মোড় ক্রাস করলাম। স্যানমারের সামনে থেকে দু’জনে বিদায় নিয়েছি। ও চান্দগাঁও আবাসিক যাবে। উদ্দেশ্যহীনের মতো হাঁটছি। বুকের ভিতরে ক্রমাগত দুঃশ্চিন্তা জমছে- ও একা একা বাসায় ফিরতে পারবে তো। রিক্সা ঠিক করতে পারবে তো। বাসায় ফিরতে কোন সমস্যা হবে নাতো। ইচ্ছে করছে এখনই আবার দৌড়ে ওর কাছে চলে যাই। কিন্তু কি করে যাবো। কিসের আশায় কিসের অধিকারে। আমরা তো আলাদা হয়ে গেছি। আমরা এখন আর কেউ কারো নই। সিগারেট নিলাম এক প্যাকেট। সাথে পাঁচটা প্রাণ ম্যাঙ্গো চকলেট- কাঁচা খেয়ে ফেলবো। সিগারেট ধরিয়ে চকলেট মুখে দিতেই হাসি চলে এলো। ও প্রাণের এই এডটা দেখার পর থেকেই আমায় হুমকি দিতো।
: বিয়ের পরে বেশি জ্বালালে একদম কাঁচা খেয়ে ফেলবো।
: এখন কি খেয়ে একটু প্রাকটিস করবে। প্লিজ খাও না একটু। বিয়ের পরে যদি আবার খেতে না পারো…
: এই এই খবরদার কাছে আসবে না একদম। কাঁচা খেয়ে ফেলবো কিন্তু।
: আরে আমিও তো সেটাই চাইছি। আসো সুন্দরি…
এরপরের ইতিহাস ভাল হয়নি কখনোই। ইতিহাসের সাক্ষি এখনো আমার হাত রয়ে গেছে। খামচি গুলোর দাগ মিলিয়ে যেতে আরো সময় লাগবে। এই খামচির দাগই এখন ওর একমাত্র স্মৃতি। সেলফোনটা একটু পর পরই হাতে নিয়ে দেখছি। যদি ওর কোন কল আসে। বা একটা ম্যাসেজ। ডায়াললিস্টে ওর নামের উপর দিয়ে কতোবার যে আংগুল গিয়েও সরে যাচ্ছে। কেন কল দিবো আমি। ও আমার কে? ও আমার কেউ না। আমরা তো আলাদা হয়ে গেছি।
টাইগারপাসের রাস্তা ধরে হাঁটছি। আমার অনেক প্রিয় রাস্তা। সি আর বি যাবো কি যাবো না বুঝতে পারছিনা। গগন শিরিষের তলায় অনেক আবেগ অনুভূতি পরে আছে আমাদের। সেখানে গেলে যদি আবেগ গুলো বুকে এসে গাঁথে? এমন সময় ফোনে কল আসলো। বের করে দেখি সীম অপারেট থেকে কল আসছে। মেজাজ গেল খিঁচে। কল রিসিভ করলেই দুনিয়ার হাবিজাবি অফার বয়ান করবে।
খুব ইচ্ছে করছে একবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে ও বাসায় ঠিক মতো পৌঁছেছে কিনা। কিন্তু ওকে মুক্তি দেয়ার পরে আমার হাত পা এখন বাঁধা। ও তো এখন আমার কেউ না। ওকে তো আর ভালবাসি না আমি। আর কি কখনো বাসবো। না না না আর ভালবাসবো না। আমার কিসের এতো ঠ্যাকা। ওকে ছাড়া ঠিকই আমার চলে যাবে। ও আমার কে? কেউ না। এরচেয়ে বাসায় গিয়ে ঘুম দেই সেটাও অনেক ভাল। ফিরতি পথ ধরলাম। আমার বাসাও ওর বাসার কাছেই।
হাঁটতে হাঁটতে আবার সেই স্যানমারের সামনে আসতেই কেন জানিনা আমার চোখ ওকেই খুঁজে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? ও কে যে ওকে আমার খুঁজতেই হবে। সিগারেট ধরিয়ে ওর সব চিন্তা মাথা থেকে দূর করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওর ফুটফুটে মুখটা চোখে ভেসে উঠতেই বুকের ভিতরে ঝড় উঠলো। মানুষটা ঠিক মতো বাসায় গেছে তো। কোন সমস্যা হয়নি তো। ওকে প্রথম দেখেছিলাম শিল্পকলা একাডেমীতে। রফিকের চায়ের দোকানের সামনে। বান্ধবীদের সাথে দাঁড়িয়ে আদা চা খাচ্ছিলো। আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম। ধোঁয়াটা ওদের দিকে যাচ্ছিলো। হঠাৎ ও বলে উঠলো।
: এই যে ভাইজান একটু ওদিকে সরে সিগারেট খান। ধোঁয়া আসছে এইদিকে।
মনে মনে ভাবলাম কি ফাজিল মেয়েরে বাবা। কেমন ফাইজলামি সুরে কথা বলছে। বললাম, “হয় ভাই ডাকেন না হলে জান। যে কোন একটা।” আমার কথা শুনে ও ওর বান্ধবীদের নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। যাওয়ার আগে ওর মনের ঘৃণার ডাস্টবিন উল্টে দিয়ে গেল কড়া চাহনি দিয়ে। আমি সেই ডাস্টবিনের গন্ধ নিলাম। কেমন জানি ভালবাসা ভালবাসা একটা গন্ধ পেলাম। ঘৃণার ডাস্টবিনে ভালবাসার গন্ধ। অদ্ভুত লাগলো। তবে আমার নাক ভুল করেনি। ঠিক বুঝতে পেরেছিলো। এখন পেপসির সামনে চলে এসেছি। ফুটপাতের চা সিগারেটের দোকানে বসে চায়ের অর্ডার দিলাম। মনের ভিতরে খচখচানি বেড়ে চলেছে। বাসার প্রায় কাছেই চলে আসছি। মনের সাথে যুদ্ধ করে পারছিনা। ফোন দেয়ার জন্য হাত নিশপিশ করছে। কিন্তু ওর সাথে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। আমাদের পথ আজ থেকে আলাদা।
চা সিগারেট খেতে খেতে কখন যে ওকে আনমনে কল দিয়ে ফোন কানে নিয়েছি টেরও পাইনি। একটা রিং পরতেই ও কল রিসিভ করলো। হ্যালো বলেই কান্না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমার বুকে হাতুড়ি পেটানোর স্পন্দন হচ্ছে। ওর কোন সমস্যা হয়নি তো বাসায় যেতে। জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে?” কোন কথা নেই। শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।
চা সিগারেটের বিল দিয়ে ওর বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। তখনো কেঁদেই যাচ্ছে ও। অনেকক্ষণ পরে শুধু বলতে পারলো, “আমাদের বাসার নিচে আসো এক্ষুনি। তোমায় দেখবো আমি। এক্ষুনি আসো।” বলেই কল কেটে দিলো। আমার গলা শুকিয়ে আছে। ওর বাসার নিচে গিয়ে কল দিতেই কল রিসিভ করলো। সাথে সাথেই ওকে ওদের ৩ তলা বাসার বারান্দায় দেখলাম। পাগলী হয়ে আছে। চুল এলোমেলো। এখনো কাঁদছে।
: কি হইছে তোমার কান্না করছো কেন?
: কিছু হয়নি। তুমি দুপুরে খাইছো। তোমার মুখ এতো শুকনা লাগছে কেন?
: না খাইনি।
: কেন খাওনি। তোমায় বলছিনা উপস না দিতে। কেনো আমার কথা শুনো না।
: তুমি খাইছো?
: না।
: কেন?
: তুমি আমাকে ছেড়ে যাইয়ো না প্লিজ। আমি থাকতে পারবো না তোমাকে ছাড়া।
লাইনটা কেটে গেল। নিচ থেকে ওর কান্নার শব্দ পাচ্ছি। এই মানুষটাকে ছাড়া আমি থাকবো কি করে। এই মানুষটা ছাড়া এই পৃথিবীতে আমি কোথায়?