কিছুদিন আগে আমি আর আমার হাজবেন্ড টিভি দেখছিলাম। টিভির দিকে নজর থাকলেও দুইজনে ফেইসবুকেও ক্রল করছিলাম। হঠাৎ ও আমায় বলে-
– এই পোষ্ট টা পড়ে দেখ!
ওর কথা শুনে ওর আইডিতে পোষ্ট টা পড়ি। যেখানে একজন নারী তার স্বামীর কাছে দৈনন্দিন জীবনের রুটিন থেকে কয়দিনের জন্য ছুটি চেয়ে চিঠি লিখেছে। আপাত দৃষ্টিতে ভাবতে গেলে ব্যাপারটা সবার কাছে হয়তো হাস্যকর শুনাবে! কিন্তু আমি যখন পোষ্ট টা পড়ি, জানিনা কেন যেন অজান্তেই চোখে পানি চলে আসে! হয়তো নিজের প্রতিচ্ছবি টা দেখলাম বলেই! আমার মনে হয় কথাগুলি শুধু একজন নারীর কথা না। খোঁজ নিলে জানা যাবে প্রতিটা নারী এই কথা গুলি হয়তো মনে মনে ভাবে। কিন্তু জীবন আমাদের এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে যে কথাগুলি মন থেকে মুখে আনার অবকাশ পাইনা! সংসারের তেল নুনের হিসাব করতে করতে জীবনের কত গুলি দিন যে কেটে গেছে খেয়াল-ই করা হয়না যেন!
আর খেয়াল করবো-ই বা কেমনে! যেখানে সকাল শুরুই হয়, বাচ্চার হোম-ওয়ার্ক, নাস্তা,স্কুল, স্কুলের টিফিন, স্কুলে দিয়ে আবার নিয়ে আসা! এসবের মাঝে আবার ভাবতে হয় দুপুর, আর রাতের রান্নার মেনু কি হবে! এতকিছুর মাঝে একসময় ভুলতেই বসি, কোন এক সময় ঘুম ভেঙে খোলা পায়ে শিশিরভেজা ঘাসের উপরে হেটেছিলাম! বা হঠাৎ মাঝ রাতে চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য পাগলামি করে ছাদে ছুটে গেছিলাম। সবকিছু এখন কেবলমাত্র ইতিহাস। শেষ কবে যে আয়নার সামনে ভালভাবে নিজের দিকে তাকিয়েছি ঠিক মনে পড়েনা। এটাই বাস্তবতা!এসব ভাবতে ভাবতে হয়তো কিছুটা আনমনা হয়ে গেছিলাম। হঠাৎ পাশ থেকে ও আমার হাত ধরে পরম মমতায় বললো-
– মন খারাপ হয়ে গেছে তাইনা? সামনে তো ছেলের পরিক্ষা শেষ, পরিক্ষা শেষে বাড়ি গিয়ে কিছুদিন রেস্ট করে এসো। আমি বললাম,
— না যাবোনা, আমি গেলে তুমি একা একা কিভাবে থাকবে, কি খাবে। বাচ্চাদের ছাড়া তো তুমি থাকতেই পারোনা। ও তখন একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বললো,
– ধুর পাগলি, আমায় নিয়ে ভেবোনা, আমি কখনও অফিসে থাকবো,কখনও বাসায় থাকবো সময় ঠিক কেটে যাবে। তুমি বরং যাও গিয়ে ঘুরে আসো। সময় পেলে আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।
ওর কথা শুনে ভাবলাম ঠিক আছে, ছেলের পরিক্ষা শেষ হলে সেই সুজোগে ঘুরে আসবো না হলেতো আবার পুরো বছর যেতে পারবো না! ওকেও বললাম যাওয়ার জন্য কিন্তু ওর নাকি অফিস আপাতত ছুটি হবেনা। হলেও দেরি হবে। বললো দেখি পরে আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। ছেলের পরিক্ষা শেষ হবার পর আম্মুও বারবার ফোন দিচ্ছে যাওয়ার জন্য। আমার বাচ্চাদের দেখার জন্যেও তারা অস্থির হয়ে গেছেন। আর আমারও বার বার মনে হচ্ছে কবে সবাইকে দেখবো। কতদিন সবাইকে দেখিনা!
তারপর যাওয়ার জন্য ব্যাগপত্র গুছানো শেষে, দুইদিন হল ও টিকিট কেটে এনেছে। আমারতো খুশি হওয়ার কথা, কয়টা দিন আরাম করে, বিনা ঝামেলায় আম্মুর রান্না করা খাবার বসে বসে খাব। কোন চিন্তা থাকবেনা। ভাবনা থাকবেনা।বিন্দাস ঘুরবো, ফিরবো। যা অনেকদিন হয়না।কিন্তু মনের মাঝে এমন খারাপ লাগা কেন কাজ করছে বুঝছিনা। অথচ দুইদিন আগেও আম্মুকে দেখবো বা ফ্যামিলির মানুষ জনকে দেখবো বলে কতটা খুশি ছিলাম! আর খুশি হওয়ার-ই কথা।কিন্তু টিকিট কেটে নিয়ে আসার পর কেন জানিনা খুশি হতে পারছিনা। বারবার মনের মাঝে একটা অজানা কষ্ট অনুভব হচ্ছে!
এর আগে একবার ওকে রেখে গেছিলাম। ও আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে যায়। ট্রেনটা চলতে লাগলে ও বাসার দিকে হাটতে লাগে। আমার কেন যেন সেসময়ে খুব কান্না পাচ্ছিলো। এত মায়া হচ্ছিল, মনে হইতেছিল, ট্রেন থেকে নেমে ওর সাথে ফিরে যাই। আর একবার ওকে রেখে ঈদে বাড়ি গেছিলাম।ওর ছূটি কিছুদিন পর হবে বলে আমাকে আগেই পাঠিয়ে দেয়। আমিও চলে যাই। কিন্তু যাওয়ার পর এটা চিন্তা ওটা চিন্তা। প্রতিটা মিনিটে মিনিটে চিন্তা আর ছুটে না। কি খাচ্ছে। কি করছে এসব যেন মাথা থেকে বের হতে চাইনা! বাড়ি গেছি কোথায় একটু হাসি আনন্দ করব তা নয় বারবার ওর চিন্তায় মন খারাপ করে থাকি!
আজকে আমি ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। অবশ্য ও সকালে অফিস চলে গেছে। ওর জাহাজ ও কয়দিনের জন্য সাগরে যাচ্ছে। সেদিক থেকে ভাল, যে কয়দিন সাগরে থেকে আসবে কিন্তু আমি জানি বাসায় ফিরে এসে আমাদের কে দেখতে না পেয়ে খুব মিস করবে। আর এটা ভেবেই হয়তো খারাপ লাগাটা কাজ করছে। অথচ এই কয়েক বছর আগেও আমার অন্যরকম মনে হত। ওকে ভালবাসি এটা ঠিক তবে বাবা মা আত্বীয়স্বজন ছেড়ে ওর কাছে এত দুরে কিভাবে থাকবো সেই ভাবনাতে বাঁচি না যেন! প্রথমবার যখন ও আমাকে ঢাকা নিয়ে যায়, আমি এক সপ্তাহ শুধু কান্না করেছি আব্বু আম্মুর কথা মনে করে। এমনকি বারবার শুধু বলতাম আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই, আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসো। ও তখন বারবার বলতো,
– একটু সবুর কর সব ঠিক হয়ে যাবে।
চিটাগাং যাওয়ার পর ও অনেক কেঁদেছি। সে সময়েও ও পরম মমতায় আমায় আগলিয়ে আগলিয়ে রেখেছে। এখানে ওখানে নিয়ে গেছে যেন আমার মন ভাল থাকে। ও শুধু বলতো,
– দেখো একদিন তুমি এই সংসার এর মায়ায় আর যেতে চাইবে না।
আজকে সত্যিই হয়তো সেই দিনটাই আমার এসেছে। যেখানে এক অদৃশ্য বাঁধনে আমি আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়েছি, এই বাঁধন সংসার, ছেলে মেয়ের বাঁধন। হ্যাঁ আমি ওর ভালবাসাতেও বাধা পড়েছি। ওর মায়ায় বাধা পড়েছি। যেখানে কোন রাগ নেই, অভিমান নেই। অনুতাপ নেই। আছে শুধু মায়া মমতা আর নির্মল ভালবাসা। এক জীবনে এর চেয়ে বেশি কি চাই!
আম্মু হয়তো সত্যিই বলেন, তাদের মেয়ে আর আগের মত নেই। বদলে গেছে। আম্মুকে কেমনে বোঝায়, আম্মু তোমার মেয়ে তার সংসারের মায়ায় পড়েছে! আমি জানি, প্রতিটা নারী বা মেয়ে আমার মতই সংসার সামলাতে সামলাতে একসময় বিরক্ত হয়, আরাম চায়, ছুটি চায়, কিন্তু দিনশেষে সবাই সেই সংসারে ফিরতে চায়। আমরা যতই বলিনা কেন, এই মায়া আমাদের কে আমাদের সংসার থেকে ছুটি দেয়না। যতক্ষন না উপর ওয়ালা ডাক দেন, এটাই চিরন্তন সত্য। এই সত্যকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা হয়তো আমাদের কারর নেই!