ভার্সিটি আসাটা এক প্রকার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার৷ আমার এমনও ইচ্ছে হয় যে শুক্রবারেও আসি৷ ইশ! যদি শুক্রবারেও ক্লাস হতো! কতো ভালোই না হতো। অন্তত এক পলকের জন্যে হলেও উর্মিকে দেখতে পেতাম৷ এই অনুভূতিটা একদম কমন৷ সবার ক্ষেত্রেই এমন হয়৷ যারা মন থেকে কাউকে ভালোবেসে ফেলে তাদের এই অনুভূতিটা খুব হয়৷ আমারো হয়৷ কারণ আমি উর্মিকে ভালোবাসি৷ মন থেকে ভালোবাসি৷ যেদিন ওকে প্রথম দেখি! সেই প্রথম দেখায় আমার বুক কাঁপিয়ে দেয় মেয়েটা৷
সমস্ত গা শিরশির করে উঠে৷ এক অদ্ভুত আনন্দ আমায় গ্রাস করে নেয়৷ আমি কেবল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে৷ মেয়েটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়৷ আড় চোখে আমায় দেখে৷ আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়৷ মুখের সামনে চলে আশা অবাধ্য চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দেয়৷ আমি বোকার মতো চেয়ে থাকি৷ আমার বুক কাঁপে তখনও৷ অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়৷ মনে হয় আমি এই মেয়ের জন্যে সব করতে পারব৷ সব৷ আমার সমস্ত পৃথিবী ত্যাগ করতে পারব ওর জন্যে৷ রোজ ভার্সিটি আসি৷ ক্লাস করি৷ ওকে দেখি৷ লুকিয়ে লুকিয়ে৷ যাতে সে টের না পায়৷ কিন্তু মেয়েটা কীভাবে জানি টের পেয়ে যায়৷ সে বুঝতে পেরে যায় আমি তাকে দেখছি৷ সে আমার দিকে ফিরে৷ রাগি দৃষ্টিতে তাকায়৷
আমি ভয় পাই৷ চোখ নামিয়ে নেই৷ মেয়েটাও দৃষ্টি ফেরায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমি আবারও তাকে দেখি৷ নিজের প্রতি খুব অবাক হই। এই শিশির আমি? আমি? আমি মেয়েদের এভাবে দেখছি? আমি ভাবতেও পারিনি এমন কিছু হবে; আমি কাউকে এভাবেও দেখবে৷ মনের প্রতি আমার ইগো জোর দেয়৷ কিন্তু উর্মির প্রতি আমার এই অনুভূতিটা হয়তো বেশ স্ট্রোং৷ তাই আমার ইগো আর জোর খাটাতে পারেনি৷ আমি তাকে দেখেই যাই। দিন যায়! আমি তাকে দেখেই যাই৷ কিন্তু হঠাৎই আমার মন বিদ্রোহ করে৷ সে কথা বলতে চায়৷ মনের উন্মাদনা শুরু হয়৷ সারাদিন মাথায় ঘুরতে থাকে৷ কিভাবে কথা বলব ওর সাথে৷ কিভাবে? আমার খুব ইচ্ছে হয় কথা বলার৷ কিন্তু মনে জোর পাই না৷ সাহস হয় না৷ এদিকে মন পাগলপারা হয়ে উঠে কথা বলার জন্যে৷
আমি ফেসবুকে ওর নাম সার্স করি৷ ওর পুরো নাম সাদিয়া আক্তার উর্মি। ওর আইডি পেতে খানিকটা বেগ পেতে হয়৷ কত সাদিয়া আক্তার উর্মি আছে৷ এর মাঝে নির্দিষ্ট কাউকে খুঁজে পাওয়াটা আসলেই কষ্টকর। আমি লেগে থাকি। এক সময় পেয়েও যাই৷ প্রোফাইলে তার হাসি মাখা একটা ছবি; আমার মন কাড়ে খুব। আমি তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষন সেই ছবির দিকে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাব কি পাঠাব না এই নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এক সময় মন বেশ জোর দেয়৷ রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই দেই৷ আমি অপেক্ষা করি৷ কখন ও একচেপ্ট করবে৷ প্রথম দিন পার হয়ে গেল। ও একচেপ্ট করেনি। আমি অপেক্ষা করি। ওর আইডিতেই পড়ে থাকি সারাদিন৷ ফেসবুকে ঢুকি৷ বের হই৷ কেবল তার জন্যেই ফেসবুক টানে আমায়। মেয়েটা আমার রিকোয়েস্ট একচেপ্ট করেনি৷ আমার বেশ মন খারাপ হয়। ওর প্রতি অভিমান জাগে৷ প্রথম দশ দিন চলে গেল।
রিকোয়েস্ট একচেপ্ট হয়নি৷ আমার মন আরো খারাপ হতে থাকে৷ আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। রিকোয়েস্ট একচেপ্ট করলে কী হয়? কী এমন ক্ষতি হয়? আমার কান্না পায়৷ কাঁদতে ইচ্ছে হয়৷ চোখে জল জমে৷ তা গড়িয়ে পড়তে দেই না আমি৷ আগেই মুছে ফেলি৷ ক্লাসে দেখা হয়৷ কথা হয় না৷ বুকের কাঁপনটা ঠিকই থাকে। তাকে ঠিকই দেখি। কিন্তু কাছে গিয়ে কথা বলতে পারি না৷ ভয় হয়৷ গিয়ে কী বলব ওকে? প্রায় এক মাস পর সে আমার রিকোয়েস্ট একচেপ্ট করে৷ আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। মন হালকা হয়৷ যেন বেশ বড়সড় পাথর সরে গেল বুকের উপর থেকে৷ আমার আনন্দ হতে থাকে। আমি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থেকে শব্দ হীন ভাবে হাসি৷ আমার রুমমেটরা অবাক দৃষ্টিতে তাকায়৷ সুমন বলে উঠে,
-কিরে হাসছিস কে? কী হয়েছে?
আমি কিছু বলিনি৷ মোবাইল হাত থেকে রেখে দিয়ে উচ্চস্বরে হাসতে থাকি। ওরা আমার দিকে বোকার মতো চেয়ে থাকে। ভাবে হয়তো আমি পাগল হয়ে গিয়েছি৷ সত্যি বলতে আমি পাগলই হয়ে গিয়েছি৷ এই মেয়ে আমার সমস্ত মস্তিষ্ক নিজের করে নিয়েছে৷ আমার মনের ভেতর ঢুকে পড়েছে। ওখানে বসে সে নিজেই আমাকে শাসন করছে৷ আমাকে কন্ট্রোল করছে৷ আমি প্রতিটি মূহুর্ত তাকে অনুভব করি। খুব অনুভব করি৷
প্রথম মেসেজ আমাকেই দিতে হয়৷ আমি কখনই কোনো মেয়েকে নক করিনি। রিকোয়েস্ট পর্যন্ত দেইনি৷ নিজের ইগোকে মূল্যায়ন করেছি সব সময়। কিন্তু আজকাল আমার ইগো বেশ অসহায় হয়ে পড়েছে৷ উর্মি নামটা আমার ইগোর চেয়েও বেশ মূল্যায়ন হয়ে গিয়েছে৷ আমাদের কথা হতে থাকে ধীরে ধীরে৷ অল্প অল্প করে সামনে এগোয়৷ সে জানায়,ফেসবুকে বেশি আসে না। মেসেঞ্জারে থাকে৷ আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখতে পায়নি৷ তাই রিকোয়েস্ট একচেপ্ট করতে দেরি হয়৷ সে ক্ষমা চায়৷ দুঃখিত হয়৷ আমার ভালো লাগে তখন৷ কেমন জানি শান্তি শান্তি লাগে৷ আমি আরো গভীর ভাবে ভাবতে থাকি তাকে। ততদিনে সে আমার সমস্ত নিজের করে নেয়৷ আমার ভেতর নতুন এক আমিকে টের পাই৷ আমার সব কিছুতেই আনন্দ হতে থাকে৷ আগ্রহ জাগে৷ উর্মির প্রতি এক প্রগাঢ় টান অনুভব করি৷ মনে হয় এই মেয়েটা ছাড়া আমি অপূর্ণ। আমি কিছুই না৷ ও ছাড়া আমি কিছুতেই থাকতে পারব না৷ আমার দম বন্ধ হয়ে আসে৷ ক্লাসে দেখা দেখি এবং ফেসবুকে একটু একটু কথা যেন আমার জন্যে মহামূল্যবান হয়ে দাঁড়ায়৷ আমিও যেন এতেই মহাখুশি।
আমার মন দ্বিতীয়বারের জান্যে আবার বিদ্রোহ শুরু করল৷ তাকে মনের কথা গুলো বলার জন্যে উতালা হয়ে উঠল এই প্রেমিকের হৃদয়। তাকে বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। খুব। আমি সময়ের অপেক্ষা করলাম৷ একদিন একটা রিক্স নিয়েই নিলাম। সত্যি বলতে আমি আর পারছিলাম না৷ মাথায় যেন বোঝা হয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল কথা গুলো না বললে আমি মারা যাবো৷ আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে৷ ক্যাম্পাসে আমরা প্রথম দেখা করলাম৷ আমাদের প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ এবং কথা সেখানেই হলো৷ তাকে খুব কাছ থেকে দেখা হলো সেদিনই৷ যদিও বুকের ভেতর সেই নিয়মিত কাঁপনটা রয়েই গেল৷ সমস্ত শরীরে অদ্ভুত এক শীতল শিহরণ বয়ে গেল৷ আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-তোমাকে একটা কথা বলার ছিল আমার৷ ও আমার দিকে তাকালো না৷ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
-বলো কী বলবে। আমি খানিকটা চুপ থাকলাম। খানিক প্রস্তুতি নিয়ে বললাম,
-সেই প্রথম দিন তোমায় দেখার পর তোমাকে আমার ভালো লেগে যায়৷ কেবল স্বাভাবিক ভালো লাগা নয়৷ তুমি একদম আমার মনের ভেতর গেঁথে গিয়েছো উর্মি৷ তুমি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে৷ আমি সারা বেলা শুধু তোমাকেই ভেবে যাই৷ বিশ্বাস করো আমার সাথে এমন আগে কখনই হয়নি। আমি কখনই কোনো মেয়েকে এভাবে দেখিনি৷ ফিল করিনি৷ তোমার প্রতি আমি কেমন জানি একটা টান অনুভব করি৷ মনে হয় যেন তোমার জন্য আমি সব করতে পারব। সব৷ উর্মি আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি৷ তোমাকে ভালোবেসে তোমার পাশে থাকতে চাই। আজীবন তোমার সঙ্গ দিতে চাই আমি৷ তোমার মনে কি আমার জন্যে জায়গা হবে? আমার এই ভালোবাসা কি একটা সুযোগ পাবে তোমাকে নিজের করে নেওয়ার? সে অনেকটা সময় চুপ থাকল৷ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কেবল৷ কিছু একটা ভাবল যেন৷ তারপর বলল,
-দেখো, ভাগ্যে কি আছে জানি না৷ ভাগ্য ভালো হলে হয়তো ভালো কিছুই হবে। সত্যি বলতে আমিও তোমাকে ফিল করি৷ তোমাকে আমারও ভালো লাগে৷ কিন্তু আমি কখনই আমার বাবা মায়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে পারবোনা। তারা যদি মেনে নেয় তাহলেই হবে৷ না নিলে আমার কিছুই করার থাকবে না৷ আমি খানিকটা আহত হলাম যেন৷ বুকটা কেঁপে উঠল। মন খারাপ হলো৷ বললাম,
-এভাবে বলো না প্লীজ৷ আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করে যাবো৷ দেখো তোমার বাবা মা ঠিকই মেনে নিবেন। তার আগ পর্যন্ত তো আমার তোমাকে চাই৷ অন্তত সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে হলেও তোমাকে চাই আমি৷ তুমিই আমার সাহস! আমার স্বপ্ন৷ তুমি যদি পাশে থাকো তাহলে আমি ভালো কিছু করতে পারব৷ আমার শুধু তোমাকেই প্রয়োজন উর্মি।
ও কিছু বলল না৷ হাসল খানিকটা। তারপর চলে গেল। তার এই হাসিটাই আমাকে অনেক কিছু বলে দিল৷ অনেক আজানা কথা আমার জানা হয়ে গেল৷ আমার মনটা হালকা হলো যেন৷ অদ্ভুত এক আনন্দ আমায় চারদিক থেকে ঘিরে ধরতে থাকল৷ আমার খুব ভালো লাগতে থাকল৷ পৃথিবীটাকে বেশ রঙিন মনে হতে থাকল আমার৷ সেদিনের পর থেকে আমাদের কথা আরেকটু বাড়তে থাকল৷ একটু একটু করে আমি উর্মি নামক মায়ায় ডুব দিতে থাকলাম৷ আমি তার প্রেমে অনেকটা অন্ধই হয়ে গিয়েছিলাম৷ ওর ফ্যামিলি সত্যিই অনেক স্ট্রেইট ছিল৷ ওকে অনেক কড়াকড়ি দিত৷ ক্লাস থেকে বাসা। বাসা থেকে ক্লাস! মেয়েটা এই অল্প সময়টাতেই কেবল বাইরে থাকতে পারে। এর মাঝে আমরা এতটা সময়ও পাই না কথা বলার৷ দেখা করার৷ তবুও প্রেম কি মানে বাধা? উর্মি মাঝে মাঝে রিক্স নিয়েই নিতো৷ বান্ধুবিদের সাথে বই কিনবে বলে বের হতো। এর জন্যে তাকে অনেক গল্পও বানাতে হতো৷ আহা! কত সুন্দর দিন ছিল তখন৷ আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতাম।
এদিক সেদিক হাঁটতাম৷ মেয়েটা ফুসকা খেতো বেশ মজা করে৷ আমি কেবল তার খাওয়াই দেখে যেতাম৷ নিজে খাওয়ার খেয়াল থাকত না৷ খুঁজে খুঁজে তার জন্যে কাঠগোলাপ আনতাম৷ তার খুবই প্রিয় ছিল এই ফুল৷ রক্তিম গৌধুলি দেখতাম তাকে নিয়ে৷ লাল আলো তার ফর্সা চেহারায় পড়লে তাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাতো৷ এতো মায়া লাগত যা বলার মতো না৷ আমি কেবল বোকার মতো তাকে দেখে যেতাম। সে লজ্জা পেত৷ মুখ লাল হতো৷ তাকে আরো বেশি সুন্দর লাগত তখন৷ এভাবে সময়টা বেশ ভালোই যাচ্ছিল৷ কিন্তু সময় তো আর সব সময় ভালো যায় না৷ খারাপ সময় এসেই পড়ে৷ আমাদের স্বপ্নের দিন গুলোতে হঠাৎই একটা ব্যাঘাত ঘটে৷ মারাত্মক ব্যাঘাত। যে ভয়টা আমি বেশ গভীর রাতে পেতাম তাকে ভেবে; সে ভয়টাই সত্যি হতে চলল৷ আমার সমস্ত পৃথিবী থমকে দাঁড়ালো৷ আমি নিজের বাক শক্তি যেন হারিয়ে ফেললাম৷ তার একটা ফোন কল আমার পৃথিবীটাই ধ্বংস করে দিল৷
-শিশির?
-হু।
ও থেমে গেল৷ আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল হঠাৎই। কেমন জানি লাগতে থাকল৷ মনে হলো খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে আমার সাথে। সত্যিই খুব খারাপ কিছু৷ বললাম,
-কী ব্যাপার? তোমার কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?
-আ’ম সরি শিশির। ওর কণ্ঠটা কেমন জানি গম্ভীর শোনালো৷ মনে হলো ও যেন কান্না করে দিবে৷ আমি বললাম,
-কী হয়েছে?
-আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে।
-কীহ? ও কিছু বলল না৷ চুপ করে থাকল৷ আমি বললাম,
-সত্যি করে বল। তুমি মজা করছো তাই না?
-আমি সত্যিই বলছি৷ কাল ওরা দেখে গিয়েছে৷ ওদের আমাকে পছন্দ হয়েছে৷
-তোমাকে ওর দেখতে এসেছে আর তুমি আমাকে একবারও বলার প্রয়োজন বোধ করোনি?
-এমন তো অনেকেই আসে৷ তাই মনে হল বলে আর লাভ কী৷ কিন্তু কালকের ব্যাপারটা নিয়ে বাবাকে খুব সিরিয়াস দেখলাম৷ তিনি রাজি আছেন৷
আমি চুপ করে থাকলাম অনেকক্ষণ। আমার কথা বলার ইচ্ছে হলো না মোটেও৷ আমি মোবাইলটা কানের কাছে ধরে রাখলাম৷ উর্মি বলল,
-আ’ম সরি শিশির।
-তোমার ইচ্ছে কী?
-আমি বাবা মায়ের বিপরীতে যেতে পারব না৷ আমি অনেকটা সময় চুপ থাকলাম৷ কোনো কথা বললাম না৷ ও নিজেও বলল না৷ শেষে আমি বললাম,
-ভালো থেকো৷
আমি ফোন কেটে দিলাম৷ তারপর বন্ধ করে বিছানার উপর রাখলাম৷ দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকলাম আমি৷ বেশ চুপচাপ। মনটা একদম নির্জিব হয়ে গেল। চুপচাপ থাকল। কিন্তু ভেতরে তার কী চরম হাহাকার। আমার ভেতরে তখন কাল বৈশাখের ঝড় বইছিল। আমার সমস্ত কিছু উলোটপালোট পায়ে হয়ে গেল। আমি মুখ কালো করে বসে থাকলাম। মন খারাপ যেন দ্রুতই হতে থাকল৷ আমার কান্না আসছিল। কিন্তু আমি কান্না করতে পারছিলাম না৷ পাথরের মতো পড়ে থাকলাম৷ পাগলের মতো হয়ে গেলাম আমি। ফোন নিলাম দ্রুত৷ অন করে ফেসবুকে গেলাম৷ উর্মিকে ব্লক করে দিলাম৷ ফেসবুকে একটা পোষ্টও করে দিয়েছিলাম৷ আসলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷ পাগল পাগল লাগছিল আমার নিজের কাছে৷ অদ্ভুত এক বেদনা আমায় আছন্ন করতে থাকল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। বারান্দায় গেলাম৷ সেখানেও ভালো লাগছিল না৷ দম বন্ধ বন্ধ লাগছিল৷ আমার মনে হচ্ছিল আমি মারা যাবো৷ আমি কিছু একটাকে মিস করছিলাম।
ভীষণ মিস করছিলাম। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। এদিক ওদিক উদ্দ্যেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে থাকলাম৷ চারদিকে তখন কোরবানির ঈদের আমেজ। সকলের মাঝে কেমন জানি এক প্রকার আনন্দের ছাপ দেখা যাচ্ছিলা। কেবল আমি ছাড়া৷ আমি পার্কে গিয়ে বসলাম। ভাবলাম আমার ভাগ্য হয়তো খারাপ৷ উর্মি আমার কপালে নেই৷ আমি শত চেষ্টা করেও তাকে নিজের করে নিতে পারিনি৷ হঠাৎই আমার কান্না পেল। দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকলাম আমি৷ ভালো লাগছিল না বসে থাকতে৷ সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম সেই ফুস্কার দোকানে৷ এক প্লেট ফুস্কা খেলাম৷ ভালো লাগেনি একদম। আমার মনে হলো এতো বাজে ফুস্কা আমি এর আগে খাইনি। সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরলাম। রুমে ঢুকতেই দেখলাম সুমন ব্যাগ গোছাচ্ছে। সকলেই ঈদের ছুটিতে যার যার বাড়ি চলে গিয়েছিল। কেবল আমি আর সুমন বাকি ছিলাম৷ আজ সুমনও চলে যাবে। আমাকে দেখতেই সুমন দৌড়ে এল।
-কিরে? কী হয়েছে তোর? ফোন বন্ধ কেন? জানিস তোকে কতবার ফোন দিয়েছি? কী হয়েছে তোর? কথা বলিস না কেন? আমি সুমনের দিকে চেয়ে থাকলাম কেবল। সুমন আবার বলল,
-কী হয়েছে? উর্মির সাথে ঝগড়া হয়েছে?
আমি কিছু বলতে পারলাম না আর৷ হুট করেই সুমনকে জড়িয়ে ধরলাম৷ পাগলের মতো কান্না করতে থাকলাম আমি৷ ভেজা গলায় বললাম,
-ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে রে!
আমি বাচ্চাদের মতো কান্না করছিলাম৷ সুমন হতভম্ব হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। সে রাতেই সুমন এবং আমি বাসার পথে রওনা হই। বাড়িতে কাউকেই জানাইনি৷ সবাই আমাকে দেখে খানিকটা অবাকই হয়েছে। খুশিও হয়েছে। কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না। আমার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। দম বন্ধকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল৷ লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে হতো আমায়৷ জীবনে সবচে বাজে ঈদ কাটল এই বার৷
বুকের ভেতর সেই ঝড়টা নিয়েই ফিরে এলাম সেই জঘন্য শহরটায়৷ যে শহর আমার সকল সুখ, আনন্দ কেড়ে নিয়েছিল। আমায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল অপ্রয়োজনীয় বস্তুর মতো। সবার আগে আমিই আসলাম বাসায় ভালো লাগছিল না আর৷ এখানে যাও একা একা কান্না করতে পারব। বাসায় তো তাও করা যায় না৷ মাত্র রুমে ঢুকলাম ঠিক তখনই সুমনের ফোন এল। রিসিভ করতেই ও বলল,
-তুই কি শিওর উর্মির বিয়ে ঠিক হয়েছিল?
-হ্যাঁ। ও নিজেই বলেছিল।
-এরপরে আর খবর নিস নি?
-আর কী খবর নিব আমি? আর কিছু কি বাকি আছে?
-তোর অন্তত একবার হলেও খবর নেয়া উচিৎ ছিল৷
-কেন? নিলে কী এমন হবে?
-রুমার সাথে আমার কথা হয়েছিল। ও বলেছে উর্মির বিয়ে হয়নি৷ উর্মি বাসায় অনেক রাগারাগি করেছিল এই ব্যাপারটা নিয়ে। সে বলেছে এখন বিয়ে করবে না।
-কিহ? কী বলছিস তুই?
-ওকে ফোন দিয়ে কথা বল৷ মেয়েটা তোর একটা কলের জন্যে এতদিন অপেক্ষা করছিল। কি বোকামীটাই না তুই করলি।
আমি সুমনের কল কেটে দিলাম। কী করব ভেবে পেলাম না৷ হাত পাঁ কাঁপা শুরু করছিল। আমি মেজেতে বসে পড়লাম। উর্মিকে কল দিলাম। সে ধরল না৷ ফেসবুকে ব্লক খুলে মেসেজ দিলাম। রিপ্লে দিল না৷ আবার ফোন দিলাম। সে কেটে দেয় এবার। আমি আবার ফোন দেই ওকে। ও আবারও কেটে দেয়৷ আমি মেসেজ পাঠাই। ও সীন করে তবে রিপ্লে দেয় না৷ আবার ফোন দিলাম। ও ধরল না৷ আমি আবারও দিলাম। ও কল ধরল এবার৷ কল ধরতেই কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম,
-আমায় ক্ষমা করে দাও প্লিজ! মাপ করে দাও আমায়। ও কোনো কথাই বলল না৷ চুপ থাকল। আমি আবার বললাম,
-উর্মি?
-এই উর্মি?
-হু
-রেগে আছ তাই না?
-না
-আমি জানি তুমি রেগে আছো৷ ও কোনো উত্তর দিল না এবারেও। আমি আবার বললাম,
-আমি কী করব বলো৷ কথাটা শুনার পরই আমার মন ভেঙ্গে গিয়েছিল৷
-তোমার কী আমার উপর একটুও বিশ্বাস ছিল না? তুমি ভাবলে কী করে যে আমি এমন করব? এটাই ছিল তোমার ভালোবাসা? আমার গলাটা ধরে এল যেন। ভেজা গলায় বললাম,
-প্লিজ! আমি ভুল করেছি। বিশ্বাস করো আমি একদমই ভালো ছিলাম না৷ প্রতিটি মূহুর্ত কী পরিমাণ কষ্টে কেটেছে সেটা যদি তোমাকে বোঝাতে পারতাম!
-আমি মনে হয় খুব ভালো ছিলাম! সুখে ছিলাম আমি?
-আমার সাথে দেখা করবে একটু?
-উহু! না৷
-আসো না। দেখা করব৷ তোমায় কতদিন দেখি না৷
-না আমি আসব না৷
-আমি অপেক্ষা করব পার্কে৷ যত তাড়াতাড়ি পারো আসো।
এই বলে ফোন কেটে দিলাম। দ্রুত হাঁটা ধরলাম পার্কের দিকে। কিছু পথ দৌড়ালামও। এক প্রকার উত্তেজনা কাজ করছিল মনের ভেতর। অদ্ভুত এক আনন্দময় উত্তেজনা। আমি পার্কে গিয়ে পৌঁছালাম। বেঞ্জিতে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম তার জন্যে। কিছু সময় পরই আমি সেই মুখটা দেখলাম। কী ভীষণ মলিন দেখাচ্ছিল সেটা! চোখের নিচে কালি জমেছে অনেক। মেয়েটা কেমন জানি রোগাপাতলা হয়ে গেল৷ আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। কেবল তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। আমি এবার হাঁটা শুরু করলাম। আমার মনে হলো এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে দেরি হয়ে যাবে৷ আমার এগিয়ে যাওয়া উচিৎ। হাঁটতে হাঁটতে এক প্রকার দৌড়াতে থাকলাম আমি৷ উর্মির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর হুট করেই ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ও নিজেও আমাকে জড়িয়ে ধরল৷ কান্না করতে থাকল সে৷ আমিও কান্না করে দিলাম৷ অনেকটা সময় কাঁদলাম আমি।
বুকটা হালকা হলো যেন। যেন কিছু একটা সরে গেছে বুকের উপর থেকে। আমি উর্মিকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম৷ কোনো কথা বললাম না। ও নিজেও ছাড়াতে চাইলো না আমায়৷ জড়িয়ে ধরে রাখল আমায়। আমিও তাই করলাম৷ থাক না এভাবে কিছুক্ষণ। বুকের বাঁ পাশের ব্যাথাটা একটু কমুক না৷ কষ্ট ঝরুক কিছু৷ প্রেম তো এমনই হয়৷ যত বাধাই থাকুক না কেন, প্রেম যদি সত্যিকারের হয় তাহলে সেই প্রেম সকল বাধা ভেঙ্গে পরিপূর্ণতা পেতে পারে৷ অবশ্যই পারে৷