পিছুটান

পিছুটান

কর্তা সাহেবকে অফিসের জন্য তৈরি করে পাঠিয়ে ৫ বছরের মেয়ে পূর্ণতাকে যখন স্কুলের পোশাক পরাচ্ছি তখন একটানা ফোন বেজেই চলেছে৷ ১৫ মিনিটের মধ্যে মেয়েকে নিয়ে বেরুতে না পারলে স্কুলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে৷ এমন সময় ফোন ধরাটা বোকামি৷ ফোনে দিকে তাকানোর সময়ও নেই বলে কে এমন করে ফোন করছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না৷ মেয়েটাও হয়েছে দুষ্টু৷ একটা কেডস পরিয়েছি তো আরেকটাকে বাটি চালান দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে৷ ফোনটা হাতে নিয়ে মেয়ে বললো

‘মা কথা বলো৷’ ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখলাম আননোন নম্বর৷ এক প্রকার বিরক্তি নিয়েই ফোনটা রিসিভ করলাম৷
‘কে বলছেন?’
‘আমি শুকতারা৷’
‘সরি রং নম্বার৷ এ নামে আমার পরিচিত কেউ নেই৷’
‘প্লিজ ফোনটা কাটবেন না৷ আমি জানি আপনি শ্রাবণী৷ আমাকে আপনি চিনবেন না৷ শুভ্রকে তো চেনেন৷ আমি ওর স্ত্রী৷’ থমকে গেলাম আমি৷

“শুভ্র? মানে শুভ্রদা? এত বছর পর শুভ্রদা এলো কোথা থেকে? আর তার স্ত্রীই বা আমার নম্বর কোথা থেকে যোগাড় করবে? কী এমন খবর দিতে আজ ফোন করলো ও এমন সাত পাঁচ ভাবছি এর মধ্যে শুকতারা তাড়া দিলো ‘কি হলো? চিনতে পেরেছেন?’ ‘হ্যাঁ কিন্তু এখন আমি ব্যস্ত আছি, সময় নেই৷ পরে কখনো কথা বলে নেবো আপনার সাথে৷’ ‘আপনার বেশি সময় আমি নেবো না৷ আপনি শুধু আজ বিকেল পাঁচটায় রবীন্দ্র সরোবরে আসতে পারবেন?’ ‘কেন?’ ‘জরুরী কিছু কথা ছিলো৷ প্লিজ না করবেন না৷’ ‘ঠিক আছে এখন রাখছি৷’ বলেই ফোনটা রেখে দিলাম৷ বিচ্ছু মেয়েটা আরেকটা কেডস খুঁজে এনে ঠিক পরে নিয়েছে৷ ‘মাম্মাম ওয়াটার বটলে পানি দাও৷’ ওয়াটার বটল হাতে নিয়ে ফিল্টার থেকে পানি ভরছি আর ভাবছি শুকতারার ফোনের কথা৷ কখন যে পানি উপচে পরেছে খেয়ালই করিনি৷ বড্ড আনমনে হয়ে গিয়েছিলাম৷ মেয়ের ডাকে হুশ ফিরলো৷ ‘মাম্মাম সব পানি পরে গেলো তো৷’

হুশ ফিরতেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সময় প্রায় শেষ হতে চলেছে৷ এখুনি বের হতে হবে৷ কিচেনে গিয়ে একটা ডিম অমলেট করে টিফিন বক্সে পুরে দিলাম, সাথে একটা রুটি৷ মেয়েকে নামতে বলে কোনরকমে নিজের পোশাকটা বদলে চাবি আর মেয়ের স্কুল ব্যাগ নিয়ে বেরুলাম৷ দরজা লক করতেই মনে পরলো আইডি কার্ডটা মেয়ের গলায় পরানো হয়নি৷ বসার ঘরের কর্ণারের সাথে ঝুলছে সেটা৷ আবার তালা খুলে আইডি কার্ড নিয়ে এলাম৷ লিফটের কাছে যেতে দেখি লিফট উপরে উঠছে৷ অপেক্ষা করে লাভ নেই৷ সিড়ি বেয়ে নেমে গেলাম৷ নিচে এসে দেখি মেয়ে ঠিকই একটা খালি রিক্সা দাঁড় করিয়েছে৷ রিক্সায় উঠে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় আসছি আর শুকতারার কথা ভাবছি৷ সকাল থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি দেখে কফি এনে বারান্দায় বসলাম৷ কফিতে চুমুক দিতে দিতে মনে পরলো অতীতের কথা৷ ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসরুম খুঁজতে গিয়ে দেখা হয়েছিলো শুভ্রদার সাথে৷ শুভ্রদাই দেখিয়ে দিলো আমাদের ক্লাসরুম৷ ক্লাসরুমে ঢুকতে গিয়েই জুতো ছিড়ে গেলো৷ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে৷ তিনিও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে ফেললো৷

এবার আমার চোখের কোণে জল ভীড় করলো৷ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ তিনি বললেন ‘জুতোটা আমাকে দিন৷ সামনেই মুচি আছে৷ সেলাই করিয়ে আনছি৷’ ‘কিন্তু আপনি অপরিচিত সিনিয়র৷ আপনাকে জুতো নিয়ে কিভাবে পাঠাই৷’ ‘অতো সাতপাঁচ ভাবতে হবে না৷ আপনি জুতোটা দিন৷ আমি সারিয়ে আনছি৷’ বলেই এক প্রকার জোর করেই জুতোটা নিয়ে আমার চোখের আড়ালে চলে গেলো৷ আমি অন্য জুতোটাও খুলে রেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম৷ কিছুক্ষণ পর শুভ্রদা জুতা সারিয়ে আনলো৷ ‘দেখুন তো ঠিক আছে কিনা৷’ ‘ঠিক থাকতে হবে না৷ কাজ সারলেই হবে৷ ধন্যবাদ দিলে আপনাকে ছোট করা হবে৷ তাই ধন্যবাদ আর দিলাম না৷ আমি শ্রাবণী৷ ফ্রেশার৷’ ‘শুভ্র তৃতীয় বর্ষ৷

সেই পরিচয় থেকে এক পা দু পা করে সম্পর্কের গাড়ি চলছে৷ বন্ধুত্বের ধাতটাই বেশি ছিলো৷ একদিন শুভ্রদা আর আমি গল্প করছি বসে৷ পরনে আমার কচুপাতা রঙের জামদানী শাড়ি৷ কপালে কালো ছোট্ট টিপ৷ হাতে হাফ ডজন কাচের চুড়ি৷ কথা বলার ফাঁকে অসাবধানতাবশত আঁচলটা কাঁধ থেকে সরে গিয়েছিলো৷ ঠিক তখনই একটা বখাটে এসে বললো ‘ভারি খাসা মাল৷ এরপর আমার সিরিয়ালটা যেন থাকে৷’ শুভ্রদার দিকে তাকাতেই দেখলাম চোখদু’টো অগ্নিবর্ণ ধারণ করেছে৷ ডান হাতটাকে মুষ্টিবদ্ধ করলো৷ হাতের পিঠে থাকা নিলচে রগগুলো স্বরুপ দেখাতে ব্যস্ত হলো৷ মনে হচ্ছে এখনই চামড়া ফেটে বেরিয়ে পরবে ওরা৷ চোয়ালটা শক্ত করে মুষ্টিটাকে ছেলেটির নাক বরাবর মারলো৷ ছেলেটি মাটিতে পরে গেলো৷ আর কিছুর সুযোগ হলো না৷ ছেলেমেয়েদের এগিয়ে আসতে দেখে আমি ওকে নিয়ে সরে গেলাম৷ কিছু বুঝে উঠার আগেই শুভ্রদা একটা চড় মারলো আমার গালে৷

‘যা সামলাতে পারিস না তা পরিস কেন? এত টাকা দিয়ে শাড়ি চুড়ি কিনিস সেফটিপিন কিনতে পারিস না?’ আমি কিছু বলার আগেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো শুভ্র৷ কিছুক্ষণ পর এক বক্স সেফটিপিন নিয়ে ফিরে এলো৷ এসেই বললো  ‘শাড়িটা ধর ঠিকভাবে৷’ মাঠে বসেই সেফটিপিন এটে দিলো শাড়িতে৷ ‘আর কখনো যেন এমন না হয়৷’ ‘আমাকেই তো খারাপ বলেছিলো তাতে তুমি এত ক্ষেপলে কেন?’ ‘তুই বুঝবি না৷ বুঝলে… থাক চল বাসায় পৌঁছে দেই৷’ ‘বুঝলে কী শুভ্রদা?’ তারপর থেকেই দুই কথা চার কথায় ফুলঝুড়ি তৈরি হলো৷ সম্পর্কের ঘুড়ি উড়লো মনের আকাশে৷ উড়তে উড়তে কোথায় গিয়ে ঠেকেছিলো আজ আর মনে পরে না৷ হঠাৎ টান পরেছিলো সুতোতে৷ সে এমনই টান যে একেবারে ছিড়েই গেলো সম্পর্কের সুতোটা৷

হঠাৎ আমার অভিভাবকরা ব্যস্ত হয়ে পরলেন আমার বিয়ে নিয়ে৷ অনেক বুঝিয়েছিলাম লেখাপড়াটা শেষ করে নেই কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি ছিলেন না৷ উপায় না পেয়ে শুভ্রদাকে জানালাম সবকিছু৷ শুভ্রদা বললেন বিয়ের আগের দিন আমায় নিয়ে পালিয়ে যাবেন৷ আমিও জরুরী কাজে কলেজে যাবার নাম করে বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে৷ সকাল গড়িয়ে দুপুর আর দুপুর গড়িয়ে বিকেল৷ একসময় বিকেলও গড়িয়ে গিয়ে সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে এলো৷ মনের মধ্যে ভয় ডানা ঝাপটাচ্ছিলো৷ রাত নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম৷ পুরো বারো ঘন্টা কিন্তু শুভ্রদা আর এলো না৷

যাওয়ার আর কোন স্থান ছিলো না তাই বাসায় ফিরে এলাম৷ বাবা-মা অনেক বকলেন৷ আমি শুধু নিরবে চোখের পানি ফেললাম৷ পরেরদিন গায়ে হলুদ আর তার পরেরদিন বিয়ে হয়ে গেলো৷ প্রথম প্রথম স্বামীর সাথে দূরত্ব থাকলেও আস্তে আস্তে সেটা মিটিয়ে নিয়েছি৷ কয়েকমাস পর বাবার বাড়ি আসতেই মা একখানা খাম হাতে ধরিয়ে দিলেন৷ উপরের ঠিকানা লেখাটা দেখেই বুঝলাম চিঠিটা শুভ্রদার৷ বুকে কালবৈশাখী ঝড় উঠলো৷ উথাল পাতাল মনের সাগর৷ পূর্ণতার বাবা আমার বাবার সাথে গল্পে মেতেছিলেন চায়ের টেবিলে৷ আমি ছুটে গেলাম আমার রুমে৷ দরজা আটকে চিঠিটা খুললাম৷

আমার শ্রাবণ, জানি তুই আর আমার সেই শ্রাবণ নেই৷ তুই এখন অন্য কারো৷ অন্য কারো বুকের লোমে আজ তোর চুল বাঁধা পরে৷ সেই বুকে কান পেতে তুই তোর নাম শুনিস সেখানে এখন আমি অস্তিত্বহীন৷ শুনেছি ভালো আছিস৷ আমিও কামনা করি তুই ভালো থাক৷ তুই আমাকে ভুল বুঝিস না শ্রাবণ৷ যেদিন তোকে নিয়ে আমার পালানোর কথা তার আগের রাতে বাবা হার্ট এট্যাক করে৷ চিকিৎসার সুযোগ আমরা পেয়েছিলাম৷ বাবাকে নিয়ে রাতেই ভর্তি করা হলো৷ তারপর হাজারটা পরীক্ষা-নীরিক্ষা, অপারেশন৷ সব করতে গিয়ে কয়েকদিন পেরিয়ে গেলো৷ সত্যি বলছি এ কদিনে তোর কথা মনে করার সুযোগ হয়নি আমার৷ ততদিনে তুই অন্য কাউকে স্বামী করে নিয়েছিস৷ দোষটা যেমনি তোরও নয় তেমনি আমারও নয়৷ দোষটা আমাদের ভাগ্যের৷ ভাগ্যটা আমাদের এক হতে দিলো না৷

আমি ভাগ্যটাকে মেনে নিয়েছি৷ তুইও মেনে নে৷ তোর স্বামী সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জেনেছি খুব ভালো ছেলে ও৷ ভালো থাকিস৷ তোর শুভ্রদাকে ভুলে যাস৷ আজকের পর আর কোনদিন আমার নাম, আমার সাথে হয়ে যাওয়া খুনসুটি সব দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবি৷ ইতি তোর শুভ্রদা সেদিন খুব কেঁদেছিলাম৷ মনে আষাঢ়ের বর্ষণের মতো বর্ষেছে দু’চোখ৷ যত স্মৃতি ছিলো সবগুলোকে সেই বর্ষণে ধুয়ে দিয়ে নতুন জীবন শুরু করলাম পূর্ণতার বাবার সাথে৷ ছয়টি বছর পেরিয়ে সপ্তম বছরে পরলো আমাদের বিবাহিত জীবন৷

এসব কথা ভাবতে ভাবতে সময় পেরিয়ে গেলো তাই ডালে চালে খিচুরি বসিয়ে দিলাম৷ দুপুরে পূর্ণতার বাবা বাসায় ফেরে না৷ মেয়েকে স্কুল থেকে এনে ওকে খাইয়ে শুইয়ে দিলাম৷ মেয়ের পাশে শুয়ে ভাবছি “শুভ্রদার স্ত্রী শুকতারা৷ কি সুন্দর নাম ওর৷ শুকতারা দেখতেও কী ওর নামের মতো সুন্দর? শুভ্রদার স্ত্রী সে তো অবশ্যই পরমা সুন্দরী হবে৷ আমি ঠিক থাকতে পারব তো শুকতারার সামনে?” সাড়ে তিনটায় উঠে তৈরি হলাম৷ একটা আকাশী রঙের সিল্কের শাড়ির সাথে ম্যাচিং টিপ, কানে ছোট দুল, এক হাতে সোনার ব্রেসলেট আর অন্য হাতে কয়েকগাছি রেশমী চুড়ি৷ ঠোটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক৷ চোখে সুন্দর করে কাজল টেনে নিলাম৷ সাজ কমপ্লিট করে মেয়েকে উঠিয়ে হাতমুখ ধুইয়ে জামা পরিয়ে বেরিয়ে পরলাম৷ যাওয়ার আগে পূর্ণতার বাবাকে ফোনে জানিয়ে নিলাম৷

রবীন্দ্র সরোবর যেতে আমার বাবার বাসা সামনে পরে৷ ওখানে মেয়েকে রেখে রবীন্দ্র সরোবর পৌঁছালাম ঠিক ৪:৫০ মিনিটে৷ লেকের পাশেই একটা টেবিলে বসে কফি অর্ডার করলাম৷ “পনেরো মিনিট পর একটা মেয়েকে আসতে দেখলাম৷ মেয়েটা ঠিক আমার টেবিল বরাবরই হেঁটে আসছে৷ তারমানে মেয়েটা আমাকে দেখেছে৷ তারচেয়েও বড় কথা মেয়েটা আমায় চেনে৷ কিন্তু চিনলো কি করে?” ভ্রু কুঞ্চিত করে ভাবতে লাগলাম৷ এরমধ্যেই মেয়েটা এসে আমার সামনের চেয়ারটা টেনে বসলো৷ ‘আসতে কোন সমস্যা হয়নি তো আপনার?’ ‘না৷ আমি ছোটবেলা থেকেই ঢাকাতে থাকি৷ আমার সমস্যা হবার কথা নয়৷’ ‘ও আচ্ছা৷ আমি মফস্বলের মেয়ে৷ শৈশব কৈশোর আর যৌবন পুরোটাই কুষ্টিয়াতে কেটেছে৷ ঢাকা শহরে বলতে গেলো হাতে গোণা মাত্র কয়েকটি স্থানই আমি চিনি৷ তাই আপনাকেও আমার মতো ভেবেছিলাম৷ যাই হোক ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ৷ তুমি? তুমিই বললাম৷ তোমাকে আমার চেয়ে বেশ ছোট মনে হচ্ছে৷’ ‘জ্বী ভালো৷ আপনি আমাকে তুমিই বলতে পারেন৷ আমি মাত্র অনার্স ফাইনাল দেবো৷’ ‘আচ্ছা৷ তা তুমি আমার নম্বর পেলে কোথা থেকে? আর আমাকেই বা কেন ফোন করে ডাকলে?’ ‘আমি আপনাকে সব বলব কিন্তু প্লিজ শুভ্রকে কিছু বলবেন না৷ তাহলে শুভ্র খুব রাগ করবে আর ও রাগ করলে আমি ওকে সামলাতে পারি না৷ আগে কথা দিন কিছু বলবেন না?’ অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে শুকতারা৷

আমি এবার মেয়েটাকে ভালো করে দেখলাম৷ বেগুনি রঙের জামদানীতে বেশ মানিয়েছে ওকে৷ কপালে ছোট্ট কালো তিলের মতো একটা টিপ পরেছে৷ চোখে পুরোনো কাজল দেয়া৷ বোঝাই যাচ্ছে খুব কেঁদেছে৷ কাজল যে ধুয়ে গেছে সেদিকে মেয়েটার খেয়াল নেই৷ নাকের অগ্রবিন্দুতে কিছু ঘাম মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে৷ নাকে মেবি ডায়মন্ডের ছোট্ট পাথর৷ কানে আর গলায়ও ডায়মন্ডের ছোঁয়া পেলাম৷ হাতে দু’গাছি চিকন চুড়ি৷ স্বর্ণেরই হবে৷ নখগুলো ছোট আর তাতে লাল নেইলপলিশ৷ শাড়ির সাথে একদম ভালো লাগছে না৷ মেয়েটা হয়ত খেয়াল করেনি৷ চুল আচড়িয়েছে বলে মনে হয় না৷ এলোমেলো চুলগুলোকে ছোট পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে কোনরকমে আটকে রেখেছে৷ ঠোটে ক্রিম কালারের লিপস্টিক৷ এটাও একেবারেই বেমানান৷ যা হোক সবকিছু মিলিয়ে খারাপ লাগছে না ওকে৷ কোনকারণে মেয়েটা একটু অগোছালো আছে৷ এমনিতে মনে হয় না এত অগোছালো৷ চেহারার মধ্যে চিন্তার ছাপ৷ আমি ওকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছি৷ শুভ্রদা তার যোগ্য মেয়েকেই স্ত্রী হিসেবে পেয়েছে৷ ‘কথা দেবেন না?’ ‘তুমি আমাকে কিভাবে চেনো? আর কতটুকুই বা জানো আমার সম্পর্কে৷’ ‘কথা না দিলে কিছু বলব না৷’

অবাক হলাম মেয়েটির কথায়৷ মেয়েটি এত ভয় পাচ্ছে কেন? যা হোক কথা দিয়েই দেই৷ তাছাড়া শুভ্রদার সাথে আমার বিয়ের পর আর কোন যোগাযোগ হয়নি৷ এমনকি আমার জীবন থেকে তাকে আমি মুছেই দিয়েছিলাম৷ তাই বলার কোন প্রশ্নই আসে না৷ ‘কথা দিলাম৷ নির্ভয়ে বলো৷’ শুকতারা মাথা নিচু করলো৷ চোখ দু’টো আরো নামিয়ে গলাটাকে যথাসম্ভব নরম করে বললো ‘আপনি আর ও দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতেন৷ কোন কারণে আপনাদের বিয়েটা হয়নি৷ ও আজও আপনাকে ভুলতে পারেনি আর আমাকেও আপন করে নিতে পারেনি৷ আপনার নম্বরটা ওর মোবাইল থেকেই পেয়েছি৷’ আমার শিরদাঁড়া যেন ঠান্ডা হয়ে এলো৷

”কী বলছে এ মেয়ে?” একটু থেমে শুকতারা আবার বললো ‘ও আপনাকে এখনও ভালোবাসে৷ ওর জীবনে আমার কোন স্থান নেই৷ দেড় বছর হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে৷ টাকা পয়সার কোন অভাব নেই আমার কিন্তু আমার স্বামীটাকেই আমি পূর্ণরূপে পাচ্ছি না৷ সব থেকেও আমার যেন কিছুই নেই৷ ওর রাত কাটে আপনার ছবি দেখে৷ ফেইক আইডি দিয়ে আপনার সাথে এড আছে ও৷ আপনার প্রতিমূহুর্তের খবর ওর কাছে থাকে৷ আপনি জামদানী পরতে ভালোবাসতেন বলে আমার ওয়্যারড্রোব জামদানীতে ভরা৷ আপনি যেমন সাজেন আমিও তেমনি সেজে ওর মন ভোলাতে চাই কিন্তু পারি না৷ আপনি প্লিজ আমায় বলবেন কি করলে আমার স্বামীকে আমি ফেরত পাবো?’

‘আমার সাথে শুভ্রদার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে আমার বিয়ের আগেই৷ বিয়ের পর আমি আমার জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছি৷ সেখানে কোথাও শুভ্রদা নেই৷ শুভ্রদা যে আমার সাথে এড আছে আমি তাও জানতাম না৷ আমি আজই সব ফেক আইডি রিমুভ করে দেবো৷ তাকে নিয়ে আলাদা কোথাও বেড়াতে যাও৷ পারলে শিঘ্রই একটা বাচ্চা নিয়ে নাও তাহলে হয়তো তার মতি ফিরবে৷ এছাড়া আমার করার কিছু নেই৷ বিয়ে করেছে স্ত্রীর প্রতি তার দায়িত্ব আছে সেগুলো পালন করতে হবে৷ তোমার মতো একটা মেয়েকে ভালো না বেসে পারা যায় না৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷ শুভ্রদা খুব ভালো৷ তুমি শুকতারা, তুমি তার জীবনে শুকতারা হয়ে জ্বলতে থাকো এই আশির্বাদ করি৷’

আমি উঠে গেলাম৷ আরেকবার শুকতারার দিকে তাকালাম৷ ওর চোখ দু’টো ছলছল করছে হয়তো এখুনি কেঁদে ফেলবে৷ রিকশা নিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাসায় পৌঁছালাম৷ পূর্ণতার বাবা ফোনে জানিয়েছে আজ বাসায় আসবে না৷ অফিসের কাজে চট্টগ্রাম যাচ্ছে৷ রাত্রি নেমেছে৷ ঘুটঘুটে অন্ধকার অমাবস্যার রাত্রি৷ পূর্ণতা ঘুমাচ্ছে৷ আমি সব ফেক আইডি রিমুভ করলাম৷ অতঃপর আমি একটি ফেক আইডি খুললাম৷ শুভ্রদার মেইন আইডি খুঁজে রিকোয়েষ্ট সেন্ড করলাম৷ শুভ্রদাকে দেখতে খুব লোভ হচ্ছে৷ এ যে বড্ড খারাপ লোভ৷ এ যে ভালোবাসার লোভ৷ এ যে কঠিন পিছুটান৷
ভুলতে চেয়েও যায় না ভোলা প্রিয় সেই মুখ হঠাৎ করে সামনে এসে বাড়ায় বুকের দুখ…

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত