মেসের দিকে আসছি। একটা পাগলি মেয়ে কে দেখলাম রাস্তায় বসে আছে। কোলের মধ্যে একটা শিশু। মনে হয় ১ মাস আগে জন্ম হয়েছে। খুব খারাপ লাগল। মানুষ এতো খারাপ হতে পারে কোনো দিন ভাবতে পারি নি । মেসের ভিতরে ঢুকতেই আবির ভাই বললেন ” ছোট আজ তো কিছু রান্না হয় নি। খাবে কি? “আমি ব্যাগ টা টেবিলে রাখতে রাখতে বললাম ” কি আর করব ভাই। নিজে রান্না করতে হবে। ” আমি খুব ভালো রান্না করতে পারি। মায়ের কাছ থেকে শিখেছিলাম। ভাই কাছে এসে বললেন ” চল বাহির থেকে খেয়ে আসি। আমি আজ বেতন পেয়েছি। “আমি মন মরা হয়ে বললাম ” ভাই আজ টাকা নেই। মা টাকা পাঠান নি। আর ভাই আন্টিও বেতন দেন নি। ভাই এতো কষ্ট করে টিউশনি পড়াতে যাই কিন্তু ঠিক টাইমে টাকা দেন না। খুব কষ্ট হয় ভাই। ” আবির ভাই প্যান্ট পড়ে বললেন ” চল। আজ আমি তোকে খাওয়াব। ”
আমি না করতে পারি নি। চলে গেলাম খেতে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে ছিলাম। সামনে দেখি বাড়িওয়ালার মেয়ে। মেয়েটার নাম অতিথি। খুব অহংকারী। আমার দিকে চোখ মোটা করে তাকিয়ে আছে। আমার বাড়িওয়ালার চাচার কাছে অতিথির নামে বিচার দিয়েছিলাম। আমার সব কাপড় নিচে ফেলে রেখে ছিল। আমার কাছে এসে বলে ” আমার বাসা। আমার ছাদ। আমার সব কিছু তুই আমার বাপের কাছে বিচার দিলি কেন? ” আবির ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ” অতিথি তামিম তোমার থেকে ৪ বছরের বড়। তুমি তাকে তুই করে বলো কেন? “অতিথি আবির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে ” না ভাই না। ও তো আমার নামে নালিশ দিয়েছে তাই তুই করে বললাম। আমি একটু অপমানবোধ করলাম। সত্যি মানুষ আমাকে নিয়ে শুধু হাসি মশকারা করে। আমি বললাম ” তুমি আমার শার্ট ছাদের ফেলে দিলে কেন? তাই বিচার দিয়েছি। ”
অতিথি নাকের ঢকার মধ্যে হাত দিয়ে কষে চলে গেল। আমি বুঝতে পারছি। মেয়েটা অনেক রেগে গেছে। আবির ভাই হাঁটতে হাঁটতে বললেন ” তুই ঝগড়া করতে পারিস না। মেয়েটার সাথে প্রচুর ঝগড়া করবি। ” আমি হাসতে হাসতে বললাম ” ঝগড়া করলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। ” আবির ভাই বকা দিয়ে বললেন ” দূর গাধা। কে কাকে বের করে দেয় সেটা পরে বুঝা যাবে আগে ঝগড়া করবি। “সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাব। একটা মেয়ে কে দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে উঠছে। আমি চিনতে পারছি এই মেয়েটাও সেদিন ছিল যেদিন অতিথি আমার সব কাপড় মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। আমি মিনমিন করে বললাম ” শয়তানির বন্ধু শয়তানি ঐ হয়। ” মেয়েটা আমার দিকে বিড়ালের চোখের মতো করে তাকিয়ে আছে।
একদম নিচে চলে গেলাম। একটা কুকুর আমাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। এটাও শয়তানিটার কুকুর।
একটা ফুল গাছের কাছে সুভাস নিতে লাগলাম। অস্ট্রেলিয়ান ভাইয়ের ভাবি দেখি আমার দিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে আছেন। আমি ভয় ভয় ভাব নিয়ে বললাম ” সুভাস নিচ্ছি। খুব ভালো লাগতাছে। ” ভাবি মুচকি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন ” তোমার ভাই কাল অস্ট্রেলিয়া থেকে চলে আসবে। ” ভাবি মুচকি মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেলেন। ভাবি আমাকে দেখলেই ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে তাকেন। মাঝে মাঝে বলেন ” ছোট খাওয়াদাওয়া করো না বুঝি। অনেক শুকিয়ে গেছো। ” আমি রিক্সায় উঠতে যাব। অতিথি ডাক দিয়ে বলে ” দাঁড়াও। ” আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার কাছে এসে বলে ” আমি কোন দিক থেকে শয়তানি? আমার মাঝে কি শয়তানি রূপ আছে? আমার বন্ধুকে কি বলছ? “আমি তিনবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম ” তুমি মানেই ভেজাল। “এ কথা টা বলে রিক্সায় উঠলাম। অতিথি বলে ” কাতলা মাছ। বেশি কথা বলবে না। নইলে বাবা কে বলে বাসা থেকে বের করে দিব।
আমি রিক্সা মামার দিকে চেয়ে চেয়ে বললাম ” মামা এই শহরে যেমন আর কারো বাসা নেই শুধু এদের বাসা আছে। প্রতিদিন বাসার কথা বলে ভয় দেখায়। চলেন তো মামা চলেন। ” ভাবি আমাদের রুমে কলিংবেল দিয়ে বললেন ” তামিম তোমার জন্য একটা ঘড়ি। নেও। তোমার ভাই পছন্দ করে এনেছেন। “আমি ভাবি কে ধন্যবাদ দিলাম। ভাবি আমাকে খুব মায়া করেন। ভাবি কে কয়েকদিন পর পর ফ্রেক্সি দিতাম। তাই হয়তো মায়া করেন। আবির ভাই ডাক দিয়ে বললেন ” তোকে অতিথি ডাকছে। ” আমি অতিথির কাছে গিয়ে বললাম ” কি? কি জন্য ডাকছ? ” অতিথি শয়তানি হাসি দিয়ে বলে ” বাবা কে আজ কিছু বলো না বাবা আজ খুব রাগের মধ্যে আছেন। যদি তুমি কিছু বলো তাইলে বাবা রাগ করে আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবেন।
আমি দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে বললাম ” তাইলে চুপচাপ ভালো মেয়ের মতো করে সরি বলো তাইলে সব মাফ করে দিব। অতিথি বিস্মিত হাসি দিয়ে বলল ” সরি। হনহন পনপন করে চলে গেল। আমি আবার চলে আসলাম রুমের মধ্যে। আসরের নামাজ পড়ে। বাহিরে বের হতে গেলাম। মা কল দিয়ে বললেন ” টাকা পাঠিয়েছি তোর মামার কাছে। টাকা নিয়ে আয়। মামা এই শহরে থাকেন। একটা জব করেন। আমি উনাদের বাসায় থাকি না। মামি আমাকে দেখলে মনে মনে ইঁদুরের জন্য গর্ত করেন। আমি নাকি উনাদের জন্য একটা বুঝা। আমি নাকি এদের পরিবারের তাকলে তাদের কোনো উন্নতি হবে না। কত রকমের কথা। এসব মনের মধ্যে রেখে দিলাম। মামার কাছে আসতেই মামা বললেন ” তোর মা তিন হাজার টাকা দিয়েছেন। আমি তোকে দুই হাজার টাকা দিলাম। মোট পাঁচ হাজার টাকা। এই নে। এখন কিছু খেয়ে যা।
আমি মামার দুই হাজার টাকা শুনে অবাক হলাম। কি দরকার ছিল। মামা আমাকে দুই হাজার টাকা দেওয়ার।
আমি মুখে মুখে লজ্জা লজ্জা হাসি দিয়ে বললাম ” মামা আপনার টাকা লাগবে না। আমার তিন হাজার টাকা দিয়ে হয়ে যাবে এই মাস টা। ” মা ধমক দিয়ে বললেন ” চুপ। থাপ্পড় খাবি এই টাকা টা রাখ। কাল বাসায় যাবি। ” মামা একটা স্পিড দিয়ে আমাকে চলে আসতে বললেন। আমি চলে আসলাম। একটা বটগাছে নিচে অতিথি কে বসে তাকতে দেখলাম। অতিথি ইদানীং আমার দিকে খুব মায়া মায়া ভাব নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলতে চায় আগের মতো করে ঝগড়া করে না। খুব ভালো হয়ে গেছে। একটা বাচ্চা মেয়ে এসে বলে ” ভাইয়া খাব টাকা দেন। ”
বাচ্চা টার প্রতি অনেক মায়া হলো। কি করব পকেটে হাত দিয়ে দেখি ১০ টাকা আছে। ১০ টাকা দিয়ে দিলাম। অনেক সময় টাকা থাকে না তখন বলি মাফ করে দেও। বাচ্চা টা কে বললাম ” তোমার মা – বাবা কোথায়? ” মেয়ে টা দৌঁড় দিতে দিতে বলল ” আমার মা বাবা নাই। আমি অসহায়। আমি এতিম। ” চোখের কোণে পানি চলে আসল। সত্যি যাদের মা – বাবা আছেন তারা পৃথিবীর সুখি মানুষ। আমার এক বন্ধু ছিল আমাদের পাশের মেসের। সেও এতিম ছিল। তার এক ভাই ছিল। ভাইয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ভাবি তার সাথে খারাপ ব্যবহার করত। ভাইও এক সময় খারাপ ব্যবহার করতে থাকে। তাকে মাঝে মাঝে দেখতাম ছাদের এক কোণে বসে কান্না করত। খুব কষ্ট লাগত। অতিথি আমার কাছে এসে বলে ” বাসায় যাবে? ” আমি এসব ভাবতে ভাবতে বললাম ” যাব। ” অতিথি মিটমিট হাসি দিয়ে বলল ” দু’ জন একসাথে যাই চলো। ”
আমি রিক্সার দিকে চেয়ে বললাম ” আমি তোমার সাথে যাব না। তোমার ছাদে উঠি বলে তুমি আমাকে যা ইচ্ছা বকতে তাকো। তুমি স্বার্থ ছাড়া কোনো কথা বলো না। এখনও অবশ্যই স্বার্থ আছে। ” অতিথি এবার রেগে নাক টা চোকা করে বলে ” আমাদের বাসায় যা। তোকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব। তুই যাইস। ” আমিও বললাম ” যাও যাও। তোমাদের বাসায় আর তাকব না। নতুন বাসায় উঠব। বাড়িওয়ালার মেয়ে দেখে কিছু বলতে পারি না। ” একটা আম গাছের নিচে বসলাম। একটা বন্ধু কাছে এসে বলে ” বন্ধু কি চলের? ” আমি আবেগহীন চোখে তাকিয়ে বললাম ” কি বলার তা সরাসরি বল এতো জিলাপির মতো প্যাঁচিয়ে কথা বলিস কেন? এমনিতেই রাগের মধ্যে আছি। ” বন্ধু আমার হাতের উপর হাত টা রেখে বলে ” অতিথি কে তুই ভালবাসিস? মেয়েটা কিন্তু খুব ভালো। ”
আমি হাত টা সরিয়ে বললাম ” শালা কি যে বলস? রাক্ষসী চিনিস? তা চিনবে কোথায় থেকে? পেত্নী চিনস? তাও চিনবে কোথায় থেকে? কিন্তু আমাদের ক্লাসের বাংলা ম্যাম কে চিনস? পড়া না পারলে যে ভাবে খারাপ ব্যবহার করে তার চাইতে বেশি খারাপ ব্যবহার করে এই মেয়েটা। একদম সহ্য করতে পারি না। মনে হয় মাঝে মাঝে বিশ লিটার পানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখি। ” বন্ধু হাসতে হাসতে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলল ” সাবাস বেটা সাবাস। এই না হলে তুই বেটা। বেটার মতো করে কথা বলেছিস। ” সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাব। অতিথি লাফ দিয়ে বলে ” তুমি তোমার বন্ধু কে আমার নামে কি আজেবাজে কথা বলছ? আমি বাংলা ম্যাম থেকে খারাপ ব্যবহার করি? তোমার মন টা পাথর থেকে শক্ত। একটা মেয়ে তোমার সাথে করে বাসায় আসতে চায় আর তুমি কিনা না করে দিলে। এই তোমার মন টা আমাকে দেও তো ইস্ত্রি করে ফিটফাট করে দেই। ”
আমি ভয় পেয়ে পেয়ে বললাম ” দূর। তুমি কি যে বলো না। মন কি ইস্ত্রি করা যায় ? ” অতিথি পাগলামি হাসি দিয়ে বলে ” যায়। যায়। দেও একবার। ” আমি এসব আজেবাজে কথা না শুনে রুমে চলে আসলাম। এই মেসে আর তাকতে পারব না। নতুন একটা মেস দেখতে হবে। সকালবেলা উঠে নতুন একটা মেস ঠিক করলাম আগামী মাসে চলে যাব। ভাবি দেখলাম দরজা টা খুলে বাহিরে আসলেন। মনে হয় কোথাও বের হবেন। আমি ভাবির কাছে গিয়ে বললাম ” ভাবি আমি এই মেস থেকে চলে যাব। নতুন একটা মেস ঠিক করছি। ” ভাবি অবাক হওয়ার মতো কালো চেহারা করে বললেন ” কেন? তুমি কেন চলে যাবে? কেউ কিছু বলছে? আমাকে বলো। সব কিছু সমাধান করে দিব। তুমি চলে গেলে এই বাসা টাই এতিম হয়ে যাবে। ”
আমিও মনমরা চেহারা নিয়ে বললাম ” কি করব ভাবি। এটা তো আমাদের নিজের বাসা না। অন্যর বাসায় মেস নিয়ে থাকি। মানুষ জন্য রাস্তায় কিংবা যে কোনো জায়গায় পেলে অপমান করে। ভাবি বুঝে গেলেন। ভাবি ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বললেন ” অতিথি মেয়েটা খুব খারাপ। দাঁড়াও অতিথির বাবার কাছে বিচার দিব। তুমি চিন্তা কইর না। দরকার হলে এই মেয়ে কে বিদায় করে দিব। ঢং পাইছে ভাড়াটিয়াদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় মেয়েটা জানে না। অসভ্য একটা মেয়ে। মেসে বসে বসে গল্পেই বই পড়তে ছিলাম। আবির ভাই ঢুকেই বললেন ” তুই নাকি বাসা থেকে বের হয়ে যাবি। তোকে আমরা বিদায় করতে দিব না। ” ভাবিও আসলেন। ভাবির পিছনে অতিথি দাঁড়িয়ে আছে। অতিথি খুব লজ্জা পাচ্ছে। ভাবি বললেন ” অতিথি চেয়ারে বসো।
অতিথি বসে আছে। আড়চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি হাত পা এক জায়গায় করে চুপচাপ হয়ে বসে থাকলাম। অতিথি বলল ” এতো রাগ করো কেন? আমি তোমাকে পছন্দ করি। তাই একটু ফাজলামি করি। আমি অন্য কারো সাথে ফাজলামি করি কি? শুধু তোমার সাথে করি। তোমার সাথে ফাজলামি করতে আমার ভালো লাগে। আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। আমি জিহ্বার মধ্যে কামড় দিলাম। মেয়েটার লজ্জাশরম বলতে কিছু নাই। ভাবি আমার দিকে চেয়ে হাত দিয়ে মুখ টা লুকিয়ে মিটমিট করে হাসতে থাকলেন। আবির ভাই লজ্জা পেয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি ঘামবার মতো করে বসে থাকলাম।
” সত্যি তোমাকে খুব ভালবাসি। ” এ কথা বলে আমার দিকে আবেগহীন চোখে তাকিয়ে থাকল। আমি মিনমিন করে বললাম ” তোমার ভালোবাসা আমার দরকার নেই। রাস্তাঘাটে পাইলে অপমান করো আর এখন ভালো মেয়ে হয়ে যাচ্ছ। অবশ্যই কোনো মতলব আছে। ” অতিথি আমার হাত টা ধরে বলল ” কোনো দিন ছেড়ে যাব না। ” আমি বললাম ” কথা টা যেন মনে থাকে। নইলে তোমার বাবার কাছে বিচার দিব প্রেমের নামে। ” অতিথি সব দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলে ” আচ্ছা দিও। দিও। ”
সমাপ্ত