-নাম কি?
-রনি।
-রনি!
নামটা শুনে রফিক সাহেব আমার দিকে বেশ অবাক চোখেই তাকালেন।হয়তো কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন কিন্তু আমি চাচ্ছি না।রফিক সাহেবের অবাক চাহনীর ভেতরের কাহিনীটা আমি বুঝতে চাচ্ছি না।একটু চুপ থেকে আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম,
-পুরো নাম? আমার প্রশ্নে মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিল,
-জ্বী, ফাতেমা কুলসুম রনি।
পুরো নামটা শুনে রফিক সাহেব একটু স্থির হলেন।এতক্ষন তার চোখে মুখে যে কৌতুহল টা ছিল সেটা আর দেখতে পাচ্ছি না।আমি রফিক সাহেবের এরকম হুট হাট পরিবর্তনে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
-কি,এবার ঠিক আছে তো? রফিক সাহেব আমার কথায় মুচকি হেসে বললেন,
-হু,তবে ভেজালটা কিন্তু রয়েই গেলো।
রফিক সাহেবের কথায় আমি আর কিছু বললাম না।এই লোকটার কাজই শুধু ভেজাল খুজে বের করা।আজ সকালে যখন ইন্টারভিউ বোর্ডের সবকিছু ঠিকঠাক তখনি রফিক সাহেব এসে বললেন,
-আজ এটা না করলে হয় না? রফিক সাহেবের কথায় আমি অবাক চোখে জিজ্ঞেস করলাম,
-কেন?
-আমার মনে হচ্ছে আজ এটা হলে কোন একটা ভেজাল হতে পারে।
রফিক সাহেবের কথায় আমি ওনার দিকে একটু রাগি চোখেই তাকালাম।এই লোকটা এর আগেও এসব ফালতু কথা বলে অফিসের অনেক কাজ আটকে দিয়েছে।আর ওনার ফাদে যে পা দিয়েছে সে ও আটকে গেছে।আমি একটু চুপ থেকে রফিক সাহেবকে বললাম,
-আজকেই হবে।এক্ষুনি হবে। আমার কথায় রফিক সাহেবের মুখটা শুকিয়ে গেলেও আমার কেমন যেন হাসি পেলো।মুচকি হাসি। পাচজনের পর যে মেয়েটা ইন্টারভিউ দিতে ভেতরে আসলো তার নামই রনি।মেয়েদের নাম যে রনি হতে পারে এটা রফিক সাহেব কেমন যেন এখনও মানতে পারছেন না।প্রথম দিকে আমার কাছেও কেমন যেন লেগেছে তবে যখন পুরো নামটা বললো তখন বুঝতে আর সমস্যা হয়নি।
-আপনার এই নামটা কে রেখেছে?
হঠাৎ রফিক সাহেবের প্রশ্নে মেয়েটার সাথে আমিও কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।উনি যে এরকম একটা প্রশ্ন করে বসবেন সেটা আমার সাথে মেয়েটাও হয়তো ভাবতে পারেনি।মেয়েটা একটু চুপ থেকে বললো,
-জ্বী আমার দাদু।ওনার ইচ্ছে ছিল আমার নাম রনি রাখবে।তাই রেখেছে। মেয়েটার কথা শুনে রফিক সাহেব বললেন,
-বাহ বাহ।বেশ ভাল ইচ্ছে।
রফিক সাহেবকে আমি এবার থামিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে কিছু প্রশ্ন করলাম।এই লোকটাকে আজ সাথে নেওয়াই ভুল হয়েছে।ভেজাল লোক সবসময় ভেজাল করবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি। “স্যার আসবো? আমি মিস রনির কথায় মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললাম, জ্বী আসুন।মেয়েটা আমার সামনে এসে দাড়াতেই বসতে বললাম।উনিও মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,
-স্যার এই ফাইলটা যদি একটু দেখতেন।
-হুম,দেখছি তো, বেশ সুন্দর দেখতে।
-স্যার এই ফাইলটা।
মেয়েটার কথায় আমার ধ্যান ভাঙলো।তারমানে আমি এতক্ষন ওনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম,ওনাকে দেখছিলাম।ভাবতেই কেমন যেন লজ্জা লাগছে।অবশ্য মেয়েটাকে যে আমার ভাল লাগে এটা ও এমনিতেই বুঝতে পারে।কিন্তু আমাকে ওনার কেমন লাগে সেটা আজও বুঝলাম না। আমি ফাইলটাতে একবার চোখ বুলিয়ে বললাম, আমি দেখে আপনাকে জানাবো।
-জ্বী স্যার।আসি স্যার।
কথাটি বলে মিস রনি আর দাড়ালেন না।চলে গেলেন।ওনার সাথে সাথে আমিও চলে গেলাম।কল্পনার জগতে।সেদিন মেয়েটাকে আমার বেশ লেগেছিল।সেই সুবাদে আজ ওনার চাকরীর বয়স মাস ছয়েক হবে। আজ দুপুর থেকে আকাশ বেশ মেঘলা।যে কোম সময় বৃষ্টিও হতে পারে।সেই সুবাদে আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বের হতে চেয়েছিলাম।কিন্তু হলো উলটোটা। অফিস থেকে বের হতে হতে বৃষ্টি আপু চলে এলেন।সাথে ছাতা নেই,তাছাড়া এই বৃষ্টিতে রিক্সা পাওয়াটাও বেশ মুশকিল।এদিকে সন্ধ্যা হতে চললো বলে।তবুও অপেক্ষা করতে হবে।বৃষ্টি থামার অপেক্ষা। ” এই যে আহাদ সাহেব,এদিকে। এই বৃষ্টিতে ফেসবুকিং করতে ভালই লাগে।আসলে বৃষ্টির সাথে ফেসবুকের কি সম্পর্ক এইটা আমার জানা নেই।তবুও ভাল্লাগে।তবে হঠাৎ কারও ডাকে আর স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।মাথা তুলে সামনের দিকে তাকালাম। একটা রিক্সা দাঁড়িয়ে।রিক্সার হুড তুলে দেওয়া।আবার ছাতাও দেখা যাচ্ছে।আমি উঠে দাঁড়িয়ে একটু ভালভাবে লক্ষ করতেই দেখি মিস রনি। মেয়েটা আমাকে নাম ধরে ডাকলো!নাকি অন্যকিছু আমি শুনতে পাইনি।মেয়েটা এবার জোর গলায় বললো,
-চলে আসুন,এই বৃষ্টিতে রিক্সা পাবেন না।
রনির কথায় আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না।আসলে ওর সাথে যাওয়াটা কি ঠিক হবে।যদি কেও দেখে ফেলে।অবশ্য ওর বাসায় যেতে আমার বাসা ক্রস করেই যেতে হয়।সেই সুবাদে একসাথে যাওয়া যেতেই পারে।আমি আর কিছু ভাবলাম না।অন্তত এই বিপদের হাত থেকে তো আগে রক্ষা পাই। রিক্সায় রনির পাশে চেপে বসতে বসতে যতটুকু ভেজার ঠিক ততটুকুই ভিজে গেলাম।অবশ্য এটাতে কোন সমস্যা হবে না।আর হওয়ার কথাও না।রিক্সা এগুতেই আমি বললাম,
-আপনি তো বের হয়েছেন বেশ আগে,এতক্ষন কোই ছিলেন?
-পাশের গলিতে একটা কাজ ছিল।কিন্তু আপনার এত লেইট কেন?
-সবকিছু গুছিয়ে আসতে হয়ে গেলো,লেট হয়ে গেলো।
-ও আচ্ছা।
রনির ও আচ্ছার বিপরীতে কি বলবো সেটা আর খুজে পেলাম না।তবে মাথায় আসলো অন্য কিছু।এই বৃষ্টিতে চা খেতে আমার ভালই লাগে।তাই আজ আর এটা মিস করতে চাচ্ছিনা।এসব ভাবতে ভাবতেই রিক্সাটা এসে থেমে গেলো।তারমানে আমার গন্তব্যে আমি চলে এসেছি।আর রনির গন্তব্য সামনের দিকে।আমি রিক্সা থেকে নামতে নামতে বাসার সামনে টং দোকানের পিচ্চিটাকে বললাম,
-এই রনি চা দে। কথাটা বলে ঘুরে আমি রিক্সা ভাড়া দিতেই রনি বেশ রাগি গলায়,
-লাগবে না।এই যে ভাই,চলুন।
রনির হুট করে এরকম রাগের কারনটা আমি যতক্ষনে বুঝতে পারলাম ততক্ষনে রিক্সাটা প্রায় অনেকটা দূর চলে গেছে।বুঝানোর সময়টুকুও দিল না মেয়েটা।আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে পিচ্চিটাকে বললাম,
-দেখ তোর নামও রনি ওদিকে তোর ভাবির নামও রনি।এক রনিকে ডাকতে গিয়ে আরেক রনিকে রাগিয়ে দিলাম।
আমার কথায় পিচ্চি ছেলেটা কি বুঝলো বুঝলাম না।তবে মুচকি হাসলো।তবে ওর মুচকি হাসিতে ওর দাতগুলা আমার চোখ এড়ালো না।
আজ তিনদিন।এই মেয়েটা আমার সাথে কথা বলে না।রনির এরকম রাগ দেখে আমার মাঝে মাঝে হাসি পায়।তবে আমি হাসি না।হাসলে এই মেয়েটা আরও রেগে যাবে। অফিস থেকে আজ একটু আগেই বের হলাম।সেদিন যেরকম রনি রিক্সাতে বসে ছিল আজ রিক্সাতে বসে আমি।তবে আজ সেদিনের মত বৃষ্টি নেই।হাতে ছাতাও নেই।তবে রনির মুখটা দেখে মনে হচ্ছে আজও ওর আকাশের মেঘ কাটেনি।মেয়েটা রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করছে।তবে একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে না।রনির এরকম রাগি মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম,
-এই যে মিস মেঘাদ্রীতা।আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন।
আমার কথায় মেয়েটার কোন রেসপন্স দেখতে পেলাম না।তাহলে কি ও যাবে না আমার সাথে।কথাটা ভাবতেই কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গেলে।আমি রিক্সাওয়ালাকে যেতে বলতেই পাশ থেকে কেও একজন বললো,
-আমাকে রেখেই যাবেন? মেয়েটার কথায় আমি ওর দিকে তাকালাম না।এটা যে রনি সেটা আমি ওর কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারলাম।আমি কিছু না বলে রিক্সার একপাশে চেপে বসতেই মেয়েটা ঠিক আমার পাশে বসতে বসতে বললো,
-কি নামে ডাকলেন আমাকে? আমি আস্তে করে বললাম,
-মেঘাদ্রীতা।ভেবেছি এই নামেই ডাকবো। আমার কথায় মেয়েটা মুচকি হেসে বললো,
-কেন,রনি নামটা ভাল না?
-ভাল।কিন্তু এই নামটাতে শুধু আমি ডাকবো, ভালবেসে ডাকবো।যাকে বলে ভালবাসার নাম। আমার কথায় মেয়েটা কপাল কুচকে বললো,
-ভালবেসে ডাকবেন মানে?
এই রে,কি বলতে কি বলে ফেলছি।মান সন্মান দেখি এখন সব যাবে।তবে সেটা আর হলো না।বাসার সামনে আসতেই আমি নামার জন্যে পা বাড়ালাম। কিন্তু মেয়েটা আমার হাত শক্ত করে ধরে ফেললো।আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না। রনি এবার একটু আস্তে করে বললো,
-আমি সারাজীবন তোমার ভালবাসার নাম শুনতে চাই।আমি চাই তুমি তোমার ভালবাসার নামেই ডাকো।
রনির কথায় আমার মলিন মুখে হাসি ফুটে উঠলো।যেই হাসিটার জন্যে অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন।তবে এই হাসিটার একটা নাম দেওয়া দরকার।এটা ভাবতে ভাবতেই পাশ থেকে মেয়েটা বেশ জোর গলায় বললো, “এই রনি,দু কাপ চা দে তো” রনির হুট করে এমন কথায় আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম।পাশে তাকিয়ে দেখি পিচ্চি রনিটাও হাসছে।আমার পাশের রনিটাও হাসছে।যাকে বলে আনন্দের হাসি।আনন্দের হাসি।