ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় শব্দে মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরছে। ফ্যানের শব্দটার সাথে নয়নের বহুদিনের পরিচয়। সে কারনে তার খুব একটা অসুবিধা হয়না। তবে মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে। ফ্যানটা বয়সে নয়নের ছয় মাসের বড়। এখনো যে ফ্যানটা চলছে সেটাই অনেক বড় ব্যাপার।
নয়নের ঘুমানো দরকার কিন্তু ঘুম আসছেনা। অথচ একটু আগে যখন সে বই পড়ছিলো, তখন ঘুমে তার চোখের পাতা যেন ভারি হয়ে আসছিলো। ঘুম না আসলেও নয়ন এক ধরনের অলসতা অনুভব করেছে। ঘুমিয়ে পরার আগ মুহূর্তে যেরকম অলসতা আসে কিছুটা সেরকম। এই সময়টায় কল্পনা করতে ভালো লাগে। নিজেকে পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন মনে হয়। কল্পনার জগৎটাকেই এসময় সত্য বলে মনে হয়। কল্পনার এই জগতে অসম্ভব বলে কিছুই থাকেনা। কল্পনার জগতে সব সম্ভব। শুধু নিজের ইচ্ছেগুলো, চাওয়াগুলো কল্পনা করে নিলেই হয়। এসময় তৃপ্তিতে বুক ভরে যায়। নয়ন চোখ বন্ধ করে এখন সেই কল্পনার জগৎ নিয়ে ভাবছে। কল্পনায় নয়ন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। বিল্ডিং ঘেসে দাঁড়িয়ে থাকা রক্তজবার একটা ডাল ব্যালকনিতে উঁকি দিচ্ছে। নয়ন কল্পনায় রুমিকে ডাকলো। রুমি চুল বাঁধতে বাঁধতে নয়নের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো, “কি হয়েছে ডাকছো কেন?”
নয়ন মুগ্ধ দৃষ্টিতে রুমির দিকে তাকিয়ে আছে। রুমি আহামরি কোন সুন্দরী নয়। গায়ের রঙ শ্যামলা, খাঁড়া নাক, পাতলা ঠোট। শীর্ণ দেহের কারনে রুমিকে কিশোরীদের মতো দেখাচ্ছে। নয়নকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুমি হাতের তুড়ি বাজিয়ে বললো, “এই যে, কি জন্য ডাকলেন। সারাদিন এভাবে ডাকাডাকি করেন। আমি সামনে আসলেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। ঘটনা কি বলুন তো।” রুমির কথায় নয়নের কোন ভাবান্তার হলোনা। সে আগেই মতোই তাকিয়ে আছে। বুঝতে চেষ্টা করছে কি আছে এই মেয়ের মাঝে। কেন সে তাকে এতো মুগ্ধ করে। কেন যে যতোবার তাকায় আরও মায়ায় জড়িয়ে যায়। রুমি নয়নের সামনে থেকে চলে যাচ্ছিলো ঠিক সেসময় নয়ন রুমির হাত চেপে ধরলো।
কল্পনা করতে করতে নয়ন ঘুমিয়ে পড়েছিলো। যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন তার পুরো শরীর ঘামে ভিজে জবজব করছে। ফ্যানটা চলছেনা। তারমানে ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। পাশের বাসার ছোট বাচ্চাটার কান্না শোনা যাচ্ছে। বাচ্চাটা প্রতিদিন ভোরে কান্না শুরু করে। নয়ন বিছানা থেকে নেমে ফোনের টর্চ অন করলো। টেবিলের উপর থেকে গ্লাসটা নিয়ে পানি খেলো। বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট জ্বালালো। আজ খুব করে রুমির কথা মনে পড়ছে। আচ্ছা কাল যদি সে রুমির সাথে দেখা করতে চায়, রুমি কি তার সাথে দেখা করবে?
কিন্তু রুমিকে কিভাবে জানাবে যে সে যাচ্ছে। রুমির ফোন নাম্বারটা রাগের মাথায় ডিলিট করে দিয়েছিলো। ভেবেছিলো আর কখনো রুমির সাথে কথা বলবেনা। সেকারনে পরে আর রুমির নাম্বারটা নেয়া হয়নি। উঠান থেকে বাবার কাশির শব্দ শুনে নয়ন দ্রুত সিগারেটটা পানির গ্লাসে ডুবিয়ে দিলো। নয়নের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। একটাই মাত্র সিগারেট ছিলো। বাকির দোকানদার বাকি না দেয়ার নতুন উপায় বের করেছে। সিগারেট চাইলে বলে, “মামা আপনি যেটা খান সেটার সাপ্লাই নাই।”
সিগারেটটা যদি সে নাও নেভাতো কোন সমস্যা হতোনা। বাসার সবাই জানে সে ঘরে সিগারেট খায়। এ বাসায় কেউ কাউকে কিছু বলেনা। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। বাবা কিভাবে দুটো টাকা বেশি উপার্জন করবেন, মা কিভাবে কম টাকায় সংসার চালাবেন, নয়ন কিভাবে একটা চাকরি পাবে সেটা নিয়ে ব্যস্ত। দারিদ্রতা সবাইকে এতোটা ব্যস্ত করে রেখেছে যে মানুষগুলো অধিকার খাটানোর সময় পায়না। নয়নের ছোট বোন নুসরাত সারাক্ষন পড়ার টেবিলে বসে থাকে। নয়ন খেয়াল করেছে নুসরাত পড়ার টেবিলে বসে থাকলেও বই পড়েনা। এক দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। নয়ন ঘামে ভেজা গেঞ্জিটা খুলে রেখে শুয়ে পড়লো। ইলেকট্রিসিটি এসেছে। ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় শব্দে ফ্যানটা ঘুরতে শুরু করছে। নয়নের ঘুম পাচ্ছে।
সকালে বাবা বাসা থেকে বের হবার সময় নয়ন বললো, “বাবা দুশত টাকা দরকার ছিলো। ইন্টারভিউ আছে। হাজিপাড়া যেতে হবে।”ছেলের কথা শুনে ফজলু সাহেব সঙ্কোচের সাথে মানিব্যাগ খুললেন। সঙ্কোচ বোধ করার কারন হলো তার মানিব্যাগে সম্ভবত দুশত টাকা নেই। তার ধারণাই সঠিক হলো। একশত টাকার একটা নোট আর দশ বিশ টাকার নোট মিলিয়ে একশত সত্তুর টাকা আছে। ফজলু সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর কি দুশত টাকা পুরো লাগবে?” নয়ন বিষয়টা বুঝতে পেরে বললো, “দেড়শ দিলেই হবে। আমার কাছে আছে কিছু।” নয়ন একবার ভাবলো ক্লিন শেভ করবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আর শেভ করলোনা। শেভ করলে খুব বাজে দেখা যাবে। গালে দাড়ি থাকলে তাও ভাঙ্গা চাপা লুকানো যায়। নয়ন বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে জাহিদের জন্য অপেক্ষা করছে। জাহিদের ও যাওয়ার কথা তার সাথে। ঘড়িতে আটটা বাঁজে। সাড়ে নয়টার মধ্যে পৌঁছাতে হবে কিন্তু জাহিদের কোন খোঁজ নেই।
রান্নাঘর থেকে খুটখুট শব্দ আসছে। জাহিদ ঘর থেকে বের হয়ে দেখলো তার বাবা রান্না করছেন। জাহিদ বাথরুমের দিকে চলে গেলো। এ বাড়িতে জাহিদ আর তার বাবা দুটো মানুষ থাকে। এতোদিন রান্নাবান্নার কাজ জাহিদ করতো। বাবার সাথে ঝগড়া হওয়ার পর থেকে সে রান্নাঘরের দিকে যায়না। আজিম সাহেব অফিস যাওয়ার সময় রান্না করে টিফিন নিয়ে যান। ঝগড়ার পর থেকে দুজনের মাঝে কথা বন্ধ। সকালে বাবা যখন রান্না করেন তখন শুয়ে আরাম করতে জাহিদের বিবেকে বাঁধে। জাহিদ বাথরুম থেকে বের হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো নয়ন বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। জাহিদ দ্রুত কাপড় পাল্টে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।
নয়ন ভেবে রেখেছিলো জাহিদ আসা মাত্র বেশ কিছু কথা শুনাবে। আজকের দিনেও কেউ লেট করে। কিন্তু জাহিদকে দেখে নয়নের হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি বের হবার উপক্রম। জাহিদ ক্লিন শেভ করেছে। জাহিদের চেহারা সুন্দর। তাকে দেখতে খারাপ না লাগলেও খুব অদ্ভুত দেখাচ্ছে। নয়নকে হাসতে দেখে জাহিদ বললো,
“কিরে এভাবে হাসছিস কেন?” “দোস্ত তোরে তো পুরাই হনুমানের মতো দেখাচ্ছে।” কথাটা শেষ করে নয়ন আবার হাসতে শুরু করলো। নয়নের হাসি দেখে জাহিদ ধমক দিলো, “চুপ কর এভাবে হাসিস না।” জাহিদ বেশিক্ষন মুখে রাগি ভাবটা ধরে রাখতে পারলোনা। নয়নের হাসি দেখে সেও মুচকি মুচকি হাসছে। গাড়ি আসতেই দুজনে গাড়িতে উঠে পড়লো।
নয়ন আর জাহিদ দুজনে মুখ ঘোমড়া করে চায়ের দোকানে বসে আছে। তাদের বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু দুজনেরই কেন যেন মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে কেউ চাকরিটা পাবেনা। আকাশে বেশ মেঘ করেছে, ঠান্ডা বাতাস বইছে। চায়ের দোকানে বসে থাকতে খারাপ লাগছেনা কিন্তু এক কাপ চা খেয়ে দোকানের বেঞ্চের জায়গা দখল করে রাখা যায়না। নতুন কাস্টমার আসলেই দোকানদার তাদের দিকে তাকাচ্ছে। নয়ন চায়ের বিল দিয়ে বললো, “পাশেই একটা পার্ক আছে। বিকাল পর্যন্ত সেখানেই বসে থাকি।”
পার্কে যারা এসেছে তাদের অধিকাংশই কাপল। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরাও বন্ধুদের সাথে এসেছে। জাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “এ জীবনে আর প্রেম হলোনা রে। পুচ্চি পুচ্চি বাচ্চারা দেখ কেমন প্রেমিকা নিয়ে ঘুরছে।” নয়ন কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে। হেডফোনের একটা বাঁজছে, একটা বাঁজছেনা। পার্কে যেই বিষয়টা খারাপ লাগলো সেটা হলো এখানে প্রচুর ভিক্ষুক। বয়সে বড় ভিক্ষুকদের চেয়ে ছোট বাচ্চাগুলো বেশি সুবিধা করতে পারছে। কাপল দেখলেই পা জড়িয়ে ধরছে। কাপলরা আসে কিছুক্ষন মন খুলে প্রেমের দুটো কথা বলবে বলে। কিন্তু এদের অত্যাচারে সেটাও পারছেনা। নয়নের সামনে দুটো ছোট বাচ্চা এসে দাঁড়ালো। বয়স পাঁচ ছয় হবে। একটার প্যান্ট খুলে পরছে বারবার, এতে করে তার পেছন দেখা যাচ্ছে। সে একটু পরপর প্যান্ট টেনে টেনে তুলছে। নয়নের কাছে টাকা চাইতেই নয়ন বললো, “সামনে যারা বসে আছে তাদের গিয়ে ধর।” ছেলেটা মাথা নেড়ে বললো,
–“না, টাকা দে।”
-তুই এমন ভাবে চাইছিস যেন মনে হচ্ছে আমার কাছে জমা রেখেছিস। বিরক্ত করিসনা তো।
–টাকা দে না।
ছেলেটা এবার নয়নকে জাড়িয়ে ধরলো। ছেলেগুলোর ভিক্ষায় খুব ভালো ট্রেনিং হয়েছে বুঝা যাচ্ছে। যেভাবেই হোক টাকা তারা নিবেই। নয়ন ও চুপচাপ বসে আছে। কতোক্ষন জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে পারে সেও দেখতে চায়। পাঁচ মিনিট এভাবে বসে থাকার পরে নয়ন বললো, “এবার তো ছেড়ে দে। আমি তো তোর বিয়ে করা বউ না যে সারাদিন এভাবে জড়িয়ে ধরে বসে থাকবি।” ছেলেটার মুখে একটাই কথা, “টাকা দে।”টাকা না দেয়া পর্যন্ত এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবেনা এটুকু নিশ্চিত হয়ে নয়ন মানিব্যাগ থেকে দশটাকার নোটটা বের করতেই ছেলেটা টাকাটা ছোঁ মেরে নিয়ে দৌঁড় দিলো। তার সাথে যেই আরেকটা ছেলে এসেছিলো এবার সে বললো, “ওরে দিছেন আমারেও দেন।”
-“কি মুসিবত। তোরা এক গ্রুপ না। ওরে দশ টাকা দিছি যা ওর কাছ থেকে পাঁচ টাকা নিস।”
–“অয় দিবোনা। আপনি দেন।”
জাহিদ এতোক্ষন চুপ ছিলো। এবার বিরক্ত হয়ে ধমক দিলো, “ব্যাটা প্যান্ট খুলে নিয়ে ল্যাংটা করে ছেড়ে দিবো। যা ভাগ।” জাহিদের ধমকে কাজ হলো। ছেলেটা দৌঁড়ে চলে গেলো। কিন্তু যাওয়ার আগে এক মুঠ বালি জাহিদের গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে গেলো। জাহিদ রাগে কাঁপছে। নয়ন বললো, “পাশেই মসজিদ আছে, যা হাত মুখ ধুয়ে আয়।” “আপনি এখানে কি করছেন। কারো সাথে দেখা করতে এসেছেন নাকি?” নারীকণ্ঠ শুনে নয়ন পাশ ফিরে তাকালো। নয়ন অবাক হয়ে দেখলো রুমি দাঁড়িয়ে আছে। বহুদিন পরে দেখা। নয়নকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
–কারো সাথে দেখা করতে এসেছেন বুঝি?
-না, চাকরির ইন্টারভিউ ছিলো।
–এখানে?
-আসলে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছে সেজন্য এখানে বসে আছি।
–ও আচ্ছা।
রুমি নয়নের পাশে বসলো। নয়নের কাছে বিষয়টা ঘোরের মতো লাগছে। সত্যিই কি রুমি তার পাশে বসে আছে, নাকি এসব কল্পনা। নয়ন রুমির দিকে তাকালো। রুমিকে আগের চেয়েও সুন্দর লাগছে। রুমি নয়নের দিকে তাকাতেই নয়ন দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। রুমি বললো,
–কেমন আছেন?
-ভালো। আপনি?
–আমিও ভালো। এদিকে আসলেন একবার ফোন করলেন না যে।
নয়ন যে রাগের মাথায় রুমির ফোন নাম্বার ডিলিট করে দিয়েছে সেটা বলা ঠিক হবেনা। নয়ন বললো,
-আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।
–বিরক্ত করার কি হলো। ফোন দিতেই পারতেন।
-হুম… আপনি এখানে কি করছেন?
–রুমমেটদের সাথে এসেছিলাম। ওই যে ফুচকার দোকানে যেই দুজন দাঁড়িয়ে আছে তারা আমার রুমমেট। দূর থেকে দেখে মনে হলো আপনি। তাই ভাবলাম গিয়ে দেখা করে আসি।
-ভালো করেছেন।
নয়ন কি বলবে বুঝতে পারছেনা। এর আগে শেষ যেদিন দেখা হয়েছিলো সেদিন নয়ন রুমিকে তার ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলো। রুমি স্পষ্ট ভাবে না করে দিয়েছিলো। রুমি বলেছিলো, “আমাদের মাঝে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু সম্ভব নয়। ভালোবাসা দুপক্ষের ভালোলাগা থেকে হয়। অনুভূতিটা দুজনের থাকলেই তবে ভালোবাসা হয়।”
সেই ঘটনার প্রায় একবছর হয়ে গেছে। রুমির কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে পুরোনো কথা নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছেনা। কিন্তু নয়নের সংকোচ বোধ হচ্ছে। তাছাড়া রুমিকে দেখার পর থেকে এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করছে। বুকের মধ্যে ধক্ধক্ শব্দ হচ্ছে।
এক ধরনের ভালো লাগা আচ্ছন্ন করে ফেলেছে তাকে। নয়ন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুমির দিকে। এই মেয়েটাকে নিয়ে সে রোজ কল্পনায় হারিয়ে যায়। অবসর সময়টুকু কেটে যায় এই মেয়েটার কথা ভেবে। রুমি জানেনা নয়ন কল্পনায় তাকে নিয়ে একটা সংসার পেতেছে। সেখানে দুজনের খুনসুটিতে সারাটা বেলা কেটে যায়। নয়নের কল্পনার সংসারটা রুমি খুব যত্নে আগলে রাখে। নয়ন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রক্তজবা গুঁজে দেয় রুমির খোপায়। দুজনে রাত জেগে কতো গল্প করে। সেই সংসারে নয়ন রুমির রাগ দেখে মুগ্ধ হয়, মুগ্ধ হয় রুমির হাসি, কান্না, অভিমানী মুখটা দেখে। নয়নের আজকেও বলতে ইচ্ছে করছে, “রুমি আমি তোমাকে আজও ভালোবাসি।” মন যে কথাগুলো বারবার বলে, মুখে সে কথাগুলো কেন যেন বলা যায়না। এই বলতে না পারার কারনগুলো খুব কষ্ট দেয়।
“হারামজাদাটাকে পেলে এবার তুলে আছাড় মারবো। ধূলোবালি দিয়ে চুলে কি অবস্থা করেছে।” জাহিদ হাতমুখ ধুয়ে ফিরে এসেছে। জাহিদ নয়নকে সাইডে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কিরে ভাবি নাকি?” নয়ন বললো, “আরে না কি বলিস। এমনি পরিচিত, ফ্রেন্ড।” জাহিদ কনফার্ম হওয়ার জন্য সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “সত্যি করে বল।” নয়ন হেসে বললো, “আজব সত্যিই তো বললাম।” নয়ন জাহিদের সাথে রুমির পরিচয় করিয়ে দিলো। জাহিদ ঠাট্টার ছলে রুমিকে বললো, “আপনার হাসিটা কিন্তু খুব সুন্দর।” জাহিদের কথা শুনে রুমি মিষ্টি করে হেসে বললো, “ধন্যবাদ।” তারপর নয়নের দিকে তাকিয়ে বললো, “চলুন সামনের দিকে যাই।”
নয়নের কেন যেন ঈর্ষা হচ্ছে। রুমি তার পাশাপাশি না হেঁটে জাহিদের পাশাপাশি হাঁটছে। নয়ন হাঁটার সময় কৌশলে দুজনের মাঝখানে চলে আসলো। জাহিদ খুব মজা করে কথা বলতে পারে। বন্ধুদের আড্ডায় জাহিদ থাকে কেন্দ্রবিন্দু। খুব সিরিয়াস মুহুর্তেও সে মানুষকে হাসাতে পারে। জাহিদের কথা শুনে রুমি খিলখিল করে হেসে উঠছে। তারা হাঁটতে হাঁটতে ফুচকার দোকানের সামনে চলে আসলো। রুমি আর জাহিদ দুজনে আবারো পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে। নয়ন যেন সেখানে থেকেও অনুপস্থিত। তার দিকে কারো তেমন খেয়াল নেই। কিছুক্ষন পরে রুমি যেন নয়নের দিকে খেয়াল করলো। নয়নের দিকে তাকিয়ে বললো, “কি হলো আপনি খাচ্ছেন না কেন?” নয়ন একটা ফুচকা তুলে মুখে দিলো। তার কেমন যেন অস্থির লাগছে। হুট করে বুকের ভেতরে একরাশ শূণ্যতা অনুভব করছে। রুমি আবারো বললো, “ওমা আপনি দেখি খাচ্ছেন না। এজন্যই শরীরের এ অবস্থা।”
নয়ন তাকিয়ে আছে জাহিদ আর রুমির দিকে। দুজনের চোখে সে মুগ্ধতা দেখতে পাচ্ছে। তাদের দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে তারা বহুদিনের পরিচিত। নয়ন বুকের মধ্যে এক ধরনের চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে। তার এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছা করছেনা। নয়ন রুমির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমাদের যেতে হবে।”বিদায় নেয়ার সময় জাহিদ রুমির ফোন নাম্বার চাইলো। রুমি আপত্তি করলোনা। অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো দুজনকেই সিলেক্ট করা হয়নি। বাসের সিটে পাশাপাশি বসে আছে নয়ন আর জাহিদ। জাহিদ ফোনে চ্যাটিং করছে। জাহিদের ঠোটের কোনে হাসির রেখা। এই হাসি নয়নের পরিচিত। একসময় সেও এই হাসি হেসেছিলো। এই হাসির অর্থ একরাশ মুগ্ধতা। নয়নের কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাসায় ফিরে সন্ধ্যা থেকে ঘরের লাইট অফ করে শুয়ে আছে নয়ন। ফজলু সাহেব রাতে খেতে বসে স্ত্রীকে বললেন,
-“নয়ন খেয়েছে?”
–নাহ্… আসার পর থেকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে। খেতে ডাকলাম বললো, ক্ষিদে নেই।
-চাকরি হয়নি বলে খাওয়া বন্ধ করতে হবে কেন। এখানে হয়নি অন্য কোথাও হবে।
এতোক্ষন নয়ন একটার পরে একটা সিগারেট খেয়েছে। বাকির দোকানদার যখন বললো, “মামা আপনি যেটা খান সেই সিগারেট তো নাই”। নয়ন তখন বাকিতে এক প্যাকেট ব্যানসন নিয়ে এসেছে। একের পর এক সিগারেট খাওয়ার কারনে নয়নের বেশ তৃষ্ণা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। নয়নের চোখ ভেজা। নাহ্ সে কান্না করেনি। কিন্তু কেন যেন চোখগুলো অকারনে ভিজে যাচ্ছে। নয়ন নিজেকে প্রশ্ন করলো, “কাঁদছিস কেন? তুই যেমন রুমিকে পছন্দ করিস। রুমিও ঠিক তেমনি জাহিদকে পছন্দ করেছে। তুই তাকে পছন্দ করিস বলে তোকেই তার পছন্দ করতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। পছন্দ হলো মনের ব্যাপার। এসব ব্যাপারে জোর খাটেনা। মুহূর্তেই হয়ে যায়।”
রাতটা নয়ন ঘুমাতে পারলোনা। নির্ঘুম কাটিয়ে দিলো। আজ আর কল্পনা করতে ইচ্ছা করছেনা তার। জাহিদ আর নয়ন দুজনে মাঠে বসে আছে। জাহিদের ফোন বাঁজছে। জাহিদ হাতের সিগারেটটা নয়নের দিকে বাড়িয়ে দিলো। নয়ন সিগারেটটা ঠোঁটে দিয়ে দুটো টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো। জাহিদ সাইডে সরে গিয়ে ফোনে কথা বলছে। ফোনের ওপাশে রুমি সেটা জানে নয়ন। তার কষ্ট হবার কথা। কিন্তু আগের মতো এখন কষ্ট হয়না। তারা দুজনে ভালো আছে থাকুক। তার মতো তাদের ও কাউকে খুব করে চাওয়ার, ভালোবাসার অধিকার আছে।
নয়ন সিগারেটটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। জাহিদকে কিছু না বলে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। আজকে কেন যেন রুমির কথা মনে পড়ছে। নয়ন চোখ বন্ধ করে কল্পনায় রুমিকে ডাকলো। কল্পনায় রুমি আর সে পাশাপাশি হাঁটছে। নয়ন বুঝতে পারেনা রুমির মুখটায় এতো মায়া কেন। নয়নের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কাউকে ভালোবেসে কাঁদার মাঝেও সুখ আছে।।