ফ্রেমে বন্ধী ভালোবাসা

ফ্রেমে বন্ধী ভালোবাসা

নিহাল আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ৮বছর হল। ও আমাকে কথা দিয়েছিল কখনো ছেড়ে যাবেনা। ও আমায় দেওয়া কথা রাখেনি। ও আমায় একা করে নিজেই স্বার্থপরের মতো চলে গেছে। নিহাল যাবার আগে আমার টেবিলের উপর রাখা বইয়ের উপর, একটা চিরকুটে লিখে রেখেছিল । কখনো যদি আমি ওর কবর জেয়ারত করতে যায়। তবে জেনো ওর দেওয়া নীল পাঞ্জাবীটা পড়েই যায়। আমি আজও ওর দেওয়া নীল পাঞ্জাবীটা খুব যত্ন করে তুলে রেখেছি। যেদিন ওর কবর জেয়ারত করতে যায়। সেদিনি পরি। এইতো মনে হয় সেদিন, একটি মেয়ে আমার ফেসবুক আইডিতে মেসেজ দিয়ে বলল,  সারাজীবন আমাকে আপনার পাশে রাখবেন?

-মানে?
-আমি আপনার বউ হয়ে সারাজীবন পাশে থাকতে চায়। সেদিন ওকে বলেছিলাম। যাকে বিয়ে করতে চাও সে বেকার। তোমাকে খাওয়াতে পারবেনা
– আমাকে খাওয়ানো লাগবেনা।  আমি জব করে নিজের খাবারটা যোগাড় করে নিতে পারবো।
– যার পাশে থাকতে চাও। সে যদি তোমায় জব না করতে দেয়?
-তাহলে আরো ভালো সারাদিন তার গলা জড়িয়ে ঝুলে থাকবো।

সেদিন মেয়েটির কথা শুনে খুব হেসেছিলাম। কিন্তু এই মেয়েটিই যে, আমার বউ হবে বুঝিনি। কখনো ভাবিনী।
শুধু সেদিন মেয়েটির উত্তরে বলেছিলাম, আমি বিয়ের পর প্রেম করব। বিয়ের আগে নই। মেয়েটি আমার কাছ থেকে আমার ঠিকানা চেয়েছিল। আমি কিছু জিজ্ঞেস না করেই মেয়েটিকে কৌতূহল বশত, ঠিকানাটা দিয়ে দেই। রাত তখন ১০/১১টা হবে। কলিং বেলের শব্দ পেয়ে দড়জা খুলে দেখি। একটি মেয়ে আমার সামনে। দাঁড়িয়ে আমি যেহেতু, মেয়েটিকে আগে কখনো দেখিনি। তাই চিনতে পাড়ছিলাম না। তখন মেয়েটিই বলল, কি চিনতে পারছো না?

– না,
-আমি নিহাল। যার সাথে একটু আগে তুমি চ্যাট করছিলে। আমিই সে। তুমি বলেছো বিয়ের আগে প্রেম করবেনা। বিয়ের পর বউয়ের সাথেই প্রেম করবে।
– হ্যা, তো?
-আমি তোমার বউ হতে চলে এলাম।

তখন কেন জানি মেয়েটিকে আমার খুব আপন মনে হল। আমার তখন মনে হয়েছিল, এই হয়ত সেই মেয়ে, যাকে আমি মনে মনে সারাদিন। খুঁজেছি যাকে নিয়ে কল্পনায় অসংখ্য গল্প লিখেছি। তাই আর দেরী না করেই মেয়েটির সাথে মানে নিহালের সাথে সোজা কাজি অফিস গেলাম। যেয়ে বিয়েটাও করে নিলাম। বাসর রাতে দুজনে পাশাপাশি বসে আছি। কি থেকে যে কি হয়ে গেল। বুঝতেই পাড়লাম না। আমি কখনো চিন্তাও করতে পারিনি আমার বিয়েটা এভাবে হতে পারে। তবুও হয়েছিল।

ওকে বুকের মাঝে নিয়েই ঘুমাইতাম। একটা দিন নেই যে ওকে বুকের মাঝে না নিয়ে ঘুমিয়েছি।  এভাবে বেশ কিছুদিন চলেগেল।  ওর কোল জুরে একটা নতুন অতিথি আসতে লাগল। আমাদের ছোট্ট সংসারটায়। সেদিন আমি যতটা না খুশি হয়েছি তার চেয়েও বেশি লজ্জা পেয়েছি। বাবা হতে চলেছি কিনা। কারো মুখ থেকে বাবা ডাক শুনবো। ভেবেই জেনো লজ্জাটা বেশি পেতাম। আমি তখন খুব ছোট্ট একটা জব করতাম ফার্মেসীতে। এতে করে দুজনের খুব ভালোভাবে না, চললেও আমাদের পুষিয়ে যেতো। আর ও পুষিয়ে নিতো।  আমার সবটা ভালোবাসা নিয়ে।

আমাদের ছোট্ট সংসার টায়, ভালোবাসার কোনো অভাব ছিল না। ভালোবাসা ছিল অফুরন্ত। আমি প্রতিদিনি নিয়ম করে ওর জন্য গোলাপ নিয়ে আসতাম। আর প্রতি শুক্রবার ওকে নিয়ে ফুঁচকা খেতে যেতাম। যদিও ফুচকা আমি পছন্দ করতাম না। তবুও ওর সাথে ফুচকার দোকানেই যেতাম। আর অবাক হয়ে আমি ওর ফুচকা খাওয়া দেখতাম। কিন্তু জীবনটা তখনি এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল, যখন শুনলাম।  ওর মা’ হওয়াতে রিক্স আছে। এতে করে দুজনেই মারা যেতে পারে। ও আমাকে প্রায় প্রতি রাতেই বলত, যদি আমি মারাযায়? তুমি কি অন্য কাওকে বিয়ে করে নিবে? তুমি কি তখন অন্য কারো জন্য গোলাপ নিয়ে আসবে?

আমি তখন নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পাড়তাম না। দুজনেই খুব কাঁদতাম। ও একদিন আমার কাছে বায়না ধরল। আমি জেনো ফেরার পথে ওর জন্য একটা পুতুল কিনে আনি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পুতুল কি করবে? এখন কি তোমার পুতুল খেলার বয়স?  ও সেদিন বলেছিল, বাচ্চাটাকে তো আর আদর করতে পারব না। পুতুল টাকেই নিজের সন্তান মনে করে আদর করব। খাওয়াবো, গোসল করিয়ে দিবো। আর তুমি দেরী করে বাসায় ফিরলে ওকে বলতে বলব যে তোর বাবা কে বল আজ ঘরে ঢুকতে পারবেনা। দেরী করে এসেছো কেন?

আর তখন তুমি কান ধরে আমার মেয়েকে বলবে, মামুনি আজকের মতো ক্ষমা করে দাও। আর এমন ভুল হবেনা। এসব কথা বলতে বলতেই কেঁদে উঠলো নিহাল, আর আমাকে বলল, শুভ্র আমি আমার বাচ্চাটাকে দেখে যেতে পারবোনা। ও কেমন হয়েছে? বাবারমতো না আমার মতো। আমি চাই আমাদের মেয়ে হোক। আমি ওকে কি বলে শান্তনা দেবো বুঝতামনা। আমার কোনো ভাষা জানা ছিল না। নিজেও যে খুব কষ্ট পেতাম। তবুও ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললাম। তোমার কিছু হবেনা। ওপরঅলা এতো নিষ্ঠুর হতে পারেনা। বাসা থেকেই এসে দেখতাম পাগলীটা কি জেনো লিখতেছে ডায়েরীতে। আমি দেখতে গেলেই আমার সামনে থেকে লুকিয়ে ফেলে আমাকে বলল, আমি যখন থাকব না। তখন এটা পড়বে। থাকবেনা মানে? কই যাবে?

– না ফেরার দেশে।
– কি বলছ এসব? তুমি জানোনা আমার খুব কষ্ট হয়।
-এটাইতো সত্যি শুভ্র।
– আমি সব সত্যিকে মিথ্যে করে দেবো আমার ভালোবাসা দিয়ে।

আমি পারিনি আমার ভালোবাসা দিয়ে সব সত্যিগুলো মিথ্যে করে দিতে। নিহাল কে নিয়তি আমার থেকে কেরে নিলো। শুধু নিহালকে নেয়নি আমার বাচ্চাকেও, সাথে নিয়ে গেল। চিরকুট টার অপর পাশে লেখাছিল, এবার তুমি ডায়েরী টা পড়তে পারো। আমি জানি আমার আর বাঁচব না। মৃত্যুর আগে প্রতিটা মানুষই টের পায়। তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। ডায়েরীটা হাতে নিয়ে খুলেই পড়তে লাগলাম।

আমি মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছি ধীরেধীরে। আজকাল কেমন জেনো লাগে। প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি। দেখি একটা বাঘ আমাকে আর আমার বাচ্চাটাকে খেতে আসছে। বাঁচানোর মতো কেউ নেই। তুমিও বাসায় ফেরোনি। আমি অনেক চিৎকার করেছি। কেউ বাঁচাতে আসেনি। সেদিন সারারাত ঘুম হয়নি, তোমার মাথার চুল নেড়ে দিচ্ছিলাম। কেমন জেনো ভালো লাগছিল।  তুমি জিজ্ঞেস করলে ঘুমাও নি? আমি বললাম ঘুম থেকে মাত্রই উঠলাম। আজ শুভ্র, আমার জন্য গোলাপ আনেনি। খুব মন খারাপ লাগছে। হয়ত আমি মরে যাবো তাই আর আমাকে মায়ায় জড়াতে চায়নি আমি জানি শুভ্র নিহালকে ভুলে যাবে। নাগো অভিমান করে বলেছি তুমি ফুল আনোনি বলে। হয়তো আজ মনে নেই আমার চিন্তাতেই ভুলে গেছো।

সকাল থেকেই খুব কষ্ট হচ্ছে, সমস্ত শরীর নেতিয়ে পড়েছে। তবুও শুভ্র কে হাসি মুখে বললাম। আমি ভালো আছি। অল্প কিছুতেই ছেলেটা অনেক দুশ্চিন্তা করে। শুভ্র আমি হয়ত, আর বেশিদিন নেই, আমার দেওয়া নীল পাঞ্জাবীটা কখনো পুরোনা হতে দিওনা। আমি চলে গেলে আমার স্থান আর কাউকে দিওনা। ওই বুকে অন্য কারো ঠায় জেনো না হয়। তুমি নীল পাঞ্জাবীটা পরে আসলেই আমার মনে হবে, আমি তোমার বুকের মাঝটাতে তোমাকে লেপ্টে জরিয়ে আছি।

আমি আর দ্বিতীয় বিয়ে করিনি। আমি নিহালের স্মৃতি বুকে নিয়ে  বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবো। ওর ভালোবাসা গুলো আমার হৃদয়ের ফ্রেমে বন্দি হয়ে রবে আজীবন। ভালোবাসি তোমাকে এখনো। তোমার জন্য এখনো বুকের মাঝটায় কম্পন দিয়ে ওঠে। এখনো তোমার কথা মনে হলে। তোমার আমার মেসেজ গুলো দেখি। মনেহয় তুমি পাশেই আছো। খুব কষ্ট হচ্ছিল সেদিন, যেদিন এই দুহাতে তোমাকে কবরে শুয়ে দিলাম। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। যখন তোমার দেহ মাটির নিচে তলিয়ে গেল। এখন আমি শুধু খোদার কাছে একটা জিনিষ চাই। আরো একবার তোমাকে জেনো পাই।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত