অব্যক্ত কৃষ্ণচূড়া

অব্যক্ত কৃষ্ণচূড়া

“কোথায় গিয়েছিলে?  অভির এমন প্রশ্ন শুনে পায়েল থমকে দাঁড়ালো। একটু অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিলো-‘রাজের কাছে’

: রাজ কে?
– আমার বন্ধু।
: কি জন্য গিয়েছিলে?
– এমনি।
: ওহ্…আচ্ছা। বলে অভি বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসলো।
: পায়েল ভাত দাও খিদে পেয়েছে।

অপর প্রান্ত থেকে কোনো উত্তর এলো না। মিনিট দুয়েক পর পায়েল খাবার নিয়ে এসেছে। অভির থালায় ভাত দিয়ে নিজের থালায় ভাত নিয়েছে।  পায়েল তার আপন মনে খাচ্ছে।

: পায়েল!
– হুমম বলো।
: রাজকে তুমি কতদিন থেকে চেনো?
– চিনি অনেক আগে থেকে।
: এর আগেও কি ওর সাথে দেখা করতে গেছো, নাকি এবার প্রথম?
– প্রতিদিন যাই। কথাটা শুনে অভি যেন বিদ্যুতের শক্ খেলো।
– আমাকে তো এর আগে কখনও বলোনি?
– বলার প্রয়োজন মনে করিনি।
– আমি তোমার স্বামী। তোমার বিষয়ে জানার অধিকার আমার আছে।
– আমি বলবো না।
– কেন?
– আমার ইচ্ছে।

অভি আর কিছুই বলতে পারেনি। সে পায়েলের রাগ সম্পর্কে জানে। এখন যদি বেশি কিছু বলে তাহলে রেগে গিয়ে নিজের ক্ষতি করতে পারে। এর আগেও দুইবার রাগ করে ছুরি দিয়ে নিজের হাত কেটেছে। বিয়ের ১ বছরও হয়নি, কিন্তু তবুও সে এই পায়েলকে ভালো ভাবে জানে । অভি হঠাৎ করে জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো। তবে কি পায়েল পরকীয়াতে আসক্ত হয়ে গেছে! না কি পুরনো কোনো প্রেম আবার জেগে উঠেছে!

না আর ভাবতে পারছে না। কেমন জানি দিকশূন্য হয়ে যাচ্ছে। নিজের ভিতর হীনম্মন্যতা তৈরি হচ্ছে! নিজেকে প্রাণপণে সংযত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।  পায়েলকে সে খুব ভালোবাসে, কিন্তু না এসব ভাবনা আর না! এসব নিয়ে কারো সাথে আলোচনা করতে হবে। কার সাথে করবে? যে নিজের বউ পরকীয়াতে আসক্ত! না! এর একটা সমাধান করতেই হবে। যা করার নিজেকেই করতে হবে নয়তো তাকে পালাতে হবে।

বিবেক বলে “যে তোমাকে ভালোবাসেনা তাকে ছেড়ে দে” মন বলে ”তুই তো তাকে ভালোবাসিস, তার ভুল পথ থেকে তাকে ফিরিয়ে নে” এই আত্মদ্বন্দে অভির হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হলো। মনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো পায়েলকে সে এই পথ থেকে ফেরাবে। জানতে হবে কে এই রাজ? যার জন্য সে আমাকে গোপন করছে। নিজের স্বামীকে গোপন করছে। পরেরদিন অভি অফিসে না গিয়ে তার বাড়ির সামনে নিজেকে গোপন রেখে অপেক্ষা করছে পায়েল কখন নিজের বাড়ি থেকে বের হয়। কোথায় যায় এটা দেখার জন্য! দুপুরের দিকে পায়েল বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। গাড়িতে করে যাচ্ছে, অভিও নিজেকে আড়াল করে পায়েল যাতে তাকে না দেখে এমন করে পায়েলকে অনুসরণ করছে! বাসা থেকে মাইল দু’য়েক দূরে একটা নদীর পাড়ে গিয়ে পায়েল গাড়ি থামিয়েছে।

পায়েল গিয়ে একটা বেঞ্চে বসে আছে। ঠিক তার সামনে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে। আড়াল থেকে অভি অপেক্ষা করছে রাজ কখন আসে! প্রায় ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করলো। কিন্তু কেউ এলো না। পায়েলকেও তেমন বিবস্ত্র দেখাচ্ছে না যে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করলে মানুষ কিছুটা বিবস্ত্র হয়। ক্লান্তি ভাব চেহারার ভেসে ওঠে। সে আপন মনে বেঞ্চে বসে আছে মাঝে মাঝে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। এছাড়া আর কিছুই লক্ষ্য করতে পারলো না পায়েলের আচরণে। পায়েল ধীরে ধীরে বেঞ্চ থেকে উঠে গাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। তার চেহারায় অপেক্ষার কোনো অভিব্যক্তি ফুটে ওঠেনি।  পায়েল চলে যাওয়ার পর, অভিও তাকে অনুসরণ করেছে।  পায়েল সোজা বাসায় চলে এসেছে। অভি ঠিক বুঝতে পারলো না। বাইরে ঘোরাঘুরি করে অফিস টাইম শেষে অভি বাড়িতে ফিরে আসে।

বাড়ি এসে দুজনেই স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। যে কাল তাদের মধ্যে কিছু নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছে, তার কোনো চিহ্ন নেই।দুজনেই স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করছে। এভাবে কয়েকদিন অভি পায়েলকে লক্ষ্য করছে। পায়েল নদীর পাড়ে বেঞ্চে বসে থাকে, আর মাঝে মাঝে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে।  মাঝে মাঝে মনে হয় গাছের সাথে কিছু বলে। কিন্তু পায়েলের কাছে কাউকে সে আসতে দেখেনি, পায়েলের সাথে কারো গল্প করতে দেখেনি বা পায়েল কাউকে ফোন করেনি। এইরকম কিছুই দেখেনি এই কয়েকদিনে। নদীর পাড় আর বাড়ি, মাঝে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ।

তবে কি রাজ নামে আসলে কেউ আছে? নাকি রাজ কোনো স্বপ্ন? নিজেকে প্রশ্ন করেও অভি কোনো উত্তর মেলাতে পারছে না। আবার পায়েলকে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। কেমন একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে অভির মনে। সারারাত অভি মনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো, কাল নদীর পাড়ে গিয়েই এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করবে? কে সে রাজ? যার জন্য প্রতিদিন এখানে আসতে হয়। অভিও দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। পরেরদিন পায়েল ঠিক দুপুরে যায় নদীর পাড়ে, ঠিক আগের মতোই বসে আছে। আজও অপেক্ষা করছে দুজনে। না কেউ আসেনি। পায়েল যখন উঠতে যাবে তখন অভি গিয়ে পায়েলের পাশে বসে। পায়েল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে অভি। কিছুটা অবাক হয়েছে। তবুও অবাক হওয়ার কারণটা লুকানোর চেষ্টা করছে। মানুষ যাই করে, তার চেহারায় সেই অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে।

– পায়েল বসো।
– তুমি এখানে?
– হ্যাঁ তোমার রাজকে দেখতে এলাম। কে সেই রাজ, যার জন্য তুমি অপেক্ষা করো।
– দেখেছো তাকে?
– না দেখতে পারিনি।
– ওহ্।
– আচ্ছা পায়েল একটা কাজ করলে কেমন হয়।
– কী?
– তুমি তোমার রাজকে ডাকো? ওনার সাথে কথা বলি, দেখা করি যে কি আছে ওনার মধ্যে, যা আমার নেই।
– ও আর কোনদিনই আসবে না।
– কেন?
– সে রাতের আকাশের তারা হয়ে গেছে।

আমার বাড়ির সবাই জানে। ভেবেছিলাম সময় করে একদিন তোমাকেও বলবো। কিন্তু সময় হয়নি। এই সময় গাছে কৃষ্ণচূড়া ফুটে ।  সে একদিন আমায় বলেছিল- “যদি কোনদিন আমি হারিয়ে যাই, রক্তিম কৃষ্ণচূড়া হয়ে ফিরে আসবো শুধু তোমায় দেখতে, তুমি আসবে তো আমায় দেখতে?” আমি সেদিন কোনো কথা বলতে পারিনি, জানতাম না সে আসলেই আমাকে ছেড়ে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। এখানে বসে আমরা বেশীরভাগ সময় কাটাতাম, ও চলে যাওয়ার পর এই সময়টাতে এসে এখানে বসতাম। কৃষ্ণচূড়ার সাথে সখ্য গড়তাম। মানুষ হারিয়ে যায় কিন্তু তার স্থানটা কখনও পূরণ হয় না।

– আমি কি চেষ্টা করতে পারি রাজের স্থানটা পূরণ করার?

অভি পায়েলকে খুব ভালোবাসে, তাই তার সবকিছু মেনে নিয়েছে। হয়তো একদিন সেও রাজকে ভুলে যাবে। পায়েল কিছু বলেনা। দুজনেই নীরব ভাবে বসে আছে কৃষ্ণচূড়ার পানে চেয়ে। পায়েল জানে কেউ কারো মনের গভীরে রাখা স্থান কোনোদিন দখল করতে পারে না। যে নতুন করে আসবে, সে নতুন করে হৃদয়ে স্থান করে নেবে। তার জন্য হৃদয়ে নতুন স্থান সৃষ্টি হবে। হৃদয়টা বিশাল! বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের থেকেও বড়। হৃদয়ে প্রতিটা মানুষের স্থান আলাদা আলাদা। পায়েল হয়তো একদিন রাজকে ভুলে যাবে। কিন্তু তবুও তার জন্য হৃদয়ে একটা শূন্যস্থান থেকে যাবে। যা কোনোদিন পূর্ণ হবে না।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত