প্রতি বছর জম্ম নেয় প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিশু। এর সাথে জম্ম হয় ঠিক একই অংকের বাবারা। বাবা হওয়ার আনন্দটা প্রকাশ করার জন্য অপারেশন থিয়েটারের সামনে চুপ চাপ বসে থাকেন। ভেতর থেকে একটু কান্নার আওয়াজ পেলেই লাফিয়ে ওঠেন। একছুটে চলে যান তার সন্তানকে কোলে নিতে। তার স্ত্রীর পাশে তার সন্তানকে দেখে এক প্রকার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। তারপর তার হাত ধরেই আমাদের প্রথম পথ চলা শুরু। হাটা শিখতে গিয়ে একটু হোচট খেলেই ব্যাথাটা যেন তিনিই পান। তখন ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
একটূ আধটু কথা বলতে শিখলেই সব কিছু চিনতে শেখান। এটা চাঁদ, ওটা তারা, ওটা আকাশ আর সব শেষে নিজেকে দেখিয়ে বলেন “এটা আমি তোমার বাবা।” তারপর যখন আর একটু বড় হতে শিখি তখন কৌতুহলি হয়ে প্রশ্নের মেলা বসিয়ে দিয়। নতুন কিছু দেখলেই প্রশ্ন করি “বাবা এটা কি? বাবা ওটা কি? বাবা ওরা এমন কেন? ওরা কি করছে?”” এমন আরো কত অদ্ভুত প্রশ্ন। একটার পর আর একটা প্রশ্ন শুনেও তিনি কখনো বিরক্ত হন না। হাসি মুখেই সব প্রশ্নের জবাব দিতে থাকেন। তার সন্তানের খুশির জন্য তিনি সব কিছুই করতে প্রস্তুত।
তখন থেকেই আমরা নতুন একটা মানুষকে পায়। তার প্রতি কেমন মায়া পরে যায়। বাবার সাথে সবসময় থাকতে ইচ্ছা করে। বাবা যখন অফিসে যান তখন আমরা বাইনা ধরি বাবার সাথে অফিসে যেতে। মা আমাদের বোঝান তবুও যখন আর পেরে ওঠেন না তখন আমাদের খুশি করতে সাথে নিয়েই অফিসে ছুটেন। পথ চলার সময় শক্ত করে হাত ধরে রাখেন৷ যেন হারিয়ে না যায়। তার হাত ধরেই শুরু হয় প্রথম বিদ্যালয়ে যাওয়া। তার আঙ্গুলে ভাজে থাকে তার সন্তানের আঙ্গুল। এভাবে বাবার পায়ের সাথে পা মিলিয়ে বহু পথ পারি দেওয়া হয়ে যায়।
২৪ ঘন্টায় ৩৬ রকম কাজ তার। তখন বাবার কষ্ট বুঝতাম না। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে যখন বাবা বাসায় ফিরেন তখন প্রথমেই আমাদেরকে খুঁজেন। বাবার মুখের ডাক শুনেই এক ছুটে চলে আসি। আনন্দিত হয়ে বলি ” বাবা এসেছে বাবা এসেছে”তখন কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আমাদের একট খুশি করতে অফিস টাইমে লাঞ্চ শেষে তুলে নেন কমদামি সিঙ্গারাটাই। বাঁচানো টাকা দিয়ে যদি আমাদের একটু খুশি করা যায়! সন্তানের কোন ইচ্ছাই তিনি অপূর্ণ রাখেন না। মাস শেষে কিছু টাকা বাঁচিয়ে এক কেজি মুরগি আনেন। তার সুবিশাল পরিবারের সদস্যেদের নিয়ে এক বেলা আয়েশ করে খাবেন বলে। হাসি মুখে বড় মাংসটা তুলে দেন তার সন্তানের পাতে। তার সুবিশাল বাহু দিয়ে পুরো পরিবারকে আগলে রাখেন।
তারা দীর্ঘ পথ পারি দেন বাসে চড়েই । কখনো ভীরের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেতেও তার অসুবিধা হয় না। নজর রাখেন সিটের দিকে। কখন খালি হবে। কিন্তু যখনই খালি হতে যায় তখনই দেখেন অফিসের সামনে চলে এসেছেন। বাবাদের মোবাইল কখনো পুরানো হয় না। ব্যাটারিতে গ্যাটিস দিয়ে ঠিক চালিয়ে নেন৷ ডিসপ্লেতে দাগ পরে গেলেও নতুন একটা কেনার কথা ভাবেন না। হাত ঘড়িটার বয়স বাড়তে থাকে। তবুও চলতেই থাকে। তাদের শার্টের হাতা কখনো ছোট হয় না। পায়ের জুতোটাও কেন যেন বদলে যান না। চশমার আড়ালে সব কিছু লুকিয়ে রাখেন। মাঝে মাঝে চশমাটা একটু বেঈমানি করে ফেলে। চশমার কোনা দিয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। এ সব কিছু তার পরিবারের জন্য।
তারা কখনো থেমে থাকেন না। ছুটতে থাকেন জীবন যুদ্ধে। বাবার কষ্ট গুলো তখন বুঝতাম না। ভাঙ্গা হাসি দিয়েই আমাদের সামনে আসেন। কষ্ট লুকিয়ে রাখেন গোপনে। কাউকে জানতে দেন না। শেষ রাতে যখন চাঁদ ডুবে গিয়ে নক্ষত্রের আলোয় চারিদিক অন্যরকম হয়ে যায় তখন চুপিসারে সন্তানের পাশে এসে বসেন। ভাঙ্গা হাসি দিয়ে সযত্নে ঘুম পারান।
পূজোয় বা ঈদের দিনে তার সুবিশাল পরিবারকে খুশি করতে ফুতপাট থেকে নতুন জামা কিনে আনেন। শুধু কিনেননা নিজের জন্যই। দিনে শেষে দেখা যায় বাবার সেই পুরনো পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে হাসি মুখে থাকতে। আসলে বাবারা এমনই হয়। নিঃস্বার্থ মানুষ। তাদের কপালের ঘামের দিকে তাকালে ভালবাসার গভীরতা বোঝা যায়। বাবা সবসময় আমাদের পাশে থাকেন।
আমাদের আগলে রাখেন।কিন্তু আমরা বাবাদের একটুও খেয়াল রাখি না। না খেয়ে থাকলেও কখনো ভুল করে জিজ্ঞেস করি না। বাবাকে শুধু দেখি। তার কষ্ট গুলো বোঝার চেষ্টা করি না। আমরা একটু বড় হয়ে গেলেই বাবাকে অবহেলা করি।ছোট বেলা থেকে বাবা আমাদের অনেক কিছুই শিখেয়েছেন কিন্তু তারা নতুন কিছু শিখতে চায়লেই কোথা থেকে যেন একটা অবহেলা চলে আসে। নিজের পায়ে দাড়াতে শিখলেই বউ কে নিয়ে শহরে চলে যায়। আমাদের সাথে একটু কথা বলার জন্য বার বার ফোন দিতেই থাকেন। আমরা বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিয়। তারপরও ফোন দিতেই থাকেন।
বাবাদের এত কিছুর পরও বাবাদের স্থান হয় বিদ্ধাশ্রমে। তবুও তারা চুপ চাপ মেনে নেন। একটুও অভিশাপ করেন না আমাদের। আসলে বাবারা এমনই। বাবা ডাকটাই কেমন যেন এক অদ্ভুত রকমের ভালবাসা লুকিয়ে থাকে। বলতে পারি আর নাই পারি। তোমাকে অনেক ভালবাসি।