১০ মিনিট ধরে খুব সতর্ক হয়ে পুরো ঘরে ইচ্ছেমতো পেট্রোল ছিটালাম। আমার নিজের ঘর। ঘরের ভেতর আমার স্ত্রী এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আজ সব জ্বালিয়ে দেবো। আমার ঘর, প্রেম, স্বপ্ন, যন্ত্রণা- সব জ্বালিয়ে দেবো।
বুকপকেট থেকে ফায়ার বক্স বের করে আগুন ধরানোর চেষ্টা করছি। কিছুতেই আগুন ধরাতে পারছি না। দেশলাইয়ের কাঠি ঘষতেই বারুদ খসে পড়ছে। কাঠিগুলো ক্যামন যেনো ভিজে নেতিয়ে আছে। ঘামে ভিজেছে বোধহয়।
ভাবছি, কিভাবে আগুন মেনেজ করা যায়। পুরো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজছি, কোথাও কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। প্রতিটি আসবাবের ড্রয়ার চেক করলাম। একটা দেশলাইয়ের কাঠিও নেই। হঠাৎ আমার পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেলাম। আচমকা ঘুরে দেখি আমার স্ত্রী দেশলাইয়ের একটা জ্বলন্ত কাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ফিরে তাকানো মাত্রই সে আগুনটা ছুঁড়ে ফেললো দেয়ালে। পুরো ঘরটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো এক মুহূর্তেই। আমার স্ত্রীকে আগুনের লাল আভায় ভয়ংকর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার চেহারায় আস্ত একটা সূর্য আত্মহত্যা করেছে। তার উপর সে চিৎকার করে হাসছে, মনে হচ্ছে ওর হাসির আওয়াজটা কয়েক হাজার মাইল অবধি ভেসে যাচ্ছে। আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করলাম, “নিশি, আগুন নেভাও, আগুন নেভাও প্লিজ, আমি মরে যাচ্ছি, আমার কষ্ট হচ্ছেততোক্ষণে আচমকা একটা চিৎকার দিয়ে ঘুম ছেড়ে উঠে বসলাম। কি ভয়ানক স্বপ্ন! শতো মাইল রাস্তা দৌড়ে আসা কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছি আমি। পুরো শরীর ঘামে জবজব করছে। নিশি চোক কচলাতে কচলাতে উঠে টেবিল থেকে তাড়াহুড়ো করে আমাকে একগ্লাস পানি এনে দিলো। পুরো পানিটা ঢকঢক করে গিলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস উড়িয়ে নিশির দিকে তাকালাম।
মেয়েটা বড্ড ভয় পাচ্ছে। ঠোঁট কাঁপছে ওর। বারবার ঢোক গিলছে। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ওর হাত ধরে টেনে কাছে আনলাম। ভয় পাওয়া চেহারায় ঘুমোঘুমো ভাব, ওর প্রতি খুব মায়া হচ্ছে আমার। ওর মুখটা আমার বুকে গুঁজে দিয়ে আলতো করে চেপে ধরে বললাম, “নিশি, তুমি কি ভয় পাচ্ছো?” আমার বুকের মধ্যে মাথা ঝাঁকিয়ে না-সূচক ইঙ্গিত করলো। বড়ো ভদ্র মেয়ে, বাধ্যও বটে। আমি পারিবারিক ভাবেই নিশিকে বিয়ে করেছি। আজ আমাদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী ছিলো। সন্ধ্যা থেকে বহুরাত অবধি বার্ষিকী পালন করে ঘুমিয়েছিলাম, তারপর-ই এই ভয়ানক স্বপ্ন। আমি প্রায়ই এমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি। এমন স্বপ্ন দেখার কারণটাও খুঁজে বের করেছি। সারাদিন নিশিকে হারিয়ে ফেলার চিন্তায় নিজেকে ভীষণ গম্ভীর করে রাখি।
সবসময় কল্পনা করি নিশিকে হারিয়ে আমি আমার অস্তিত্বে খন্তি দিয়ে বারবার আঘাত করছি, আর ভেতরে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এমন দুর্ভাবনার কারণেই হয়তো রাতে ঘুমের মধ্যে আমার অবচেতন মস্তিষ্কটা এগুলো ঘেঁটে বেড়ায়। আর এমন কল্পনা করার বা স্বপ্ন দেখারও যৌক্তিক কারণ আছে। আমাদের বিয়ের দুবছর পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, আমাদের মধ্যে এখনো পুরোপুরি শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে নি। আমার মনে হয়, নিশি অনুভব করে না আমাকে, ভালোও বাসে না। বিয়ের পরদিন নিশিকে কেবল একটুখানি ছুঁয়েছিলাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য ওর ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিলাম; আর তাতেই কান্নার শোরগোল পড়ে গিয়েছিলো। অনেক জোর করার পর নিশির মুখ থেকে বের করতে পেরেছিলাম যে, ওর একজন ভালোবাসার মানুষ আছে, যাকে খুব যত্ন করে অনেক আগেই তার অস্তিত্বে ঠাঁই দিয়ে রেখেছে।
আমি কখনো কারো উপর কিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে শিখি নি। ইচ্ছে করলেই আমার অধিকার আমি জোর করে আদায় করতে পারি। কোনো আপত্তি করবে না নিশি, বড়ো বাধ্য মেয়ে আগেই বলেছি। আমার বুকের মধ্য থেকে ওর মাথাটা সরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ঘুমাবে এখন?” নিশির ঠোঁট নড়ে নি। আমি এসে চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়ালাম। নিশিও আমাকে অনুসরণ করলো। এই গভীর রাতে বারান্দায় শিরশিরানি বাতাস বইছে। ঠিক বাতাস নয়, যেনো কিছু শান্তির নিঃশ্বাস বা অদৃশ্য কিছু স্পর্শ যা আমার হৃদয় পর্যন্ত প্রবেশাধিকার রাখে। নিশি এই গভীর অন্ধকারে ধীরেধীরে তার নিঃশ্বাস ফেলছে। ভীষণ চুপচাপ। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে।
নিশি সবসময় চুপচাপ থাকে। বিয়ের পর থেকে আজ অবধি যে কয়েকটা কথা বলেছে, চাইলে সেগুলো গুনে রাখা সম্ভব ছিলো। তার অন্যতম একটা বৈশিষ্ট হচ্ছে, চোখের পলক ফেলে অনেক বিলম্বে, ধীরেসুস্থে। মাঝেমধ্যে মনে হয় এই কাজের উপর সে কোনো ডিগ্রীলাভ করেছে। তা না হলে, চোখের পলক ফেলে আমার মতো একজন কঠিন মানুষকে এতো সহজে গ্রাস করতে পারতো না। নিশি যখন চোক বুজে তখন আমি অনুভব করতে পারি, পৃথিবীর কোথাও বিষণ্ণ অন্ধকার নেমে এসেছে। আর যখন চোখ মেলে, মনে হয় আকাশে বহুদিন পর সূর্য উঁকি দিলো।
“নিশি, তোমার যখন ভীষণ মন খারাপ হতো তখন তোমার প্রেমিক কি করতো?” নিশি এবার আমার দিকে তাকালো, তবে ঠোঁট নড়ায় নি। অর্থাৎ, বলবে না। চুপচাপ থাকবে। “জানো নিশি, আজ আমার ইচ্ছে করছে তুমি অনবরত কথা বলে যাবে, আমি বোকার মতন দেয়ালে হেলান দিয়ে শুনে যাবো।”
“আমি কথা বললে ভালো লাগে আপনার?”
“সেটা অনুধাবন করার জন্য একদিন তোমার মনখোলা কথন তো শুনা চাই?”
“আচ্ছা, আপনি কি আমার প্রেমিকের নাম জানেন?”
“কখনো বলো নি। তাহলে জানবো কি করে বলো তো?”
“ওর নাম শিহাব। আমরা ক্লাসমেট ছিলাম। তারপর বন্ধুত্ব, প্রেম।
ও আমাকে মন থেকে খুব যত্ন করতো। আমার যদি কখনো মন খারাপ হতো, তাহলে শিহাব ওর সমস্তকাজ একদিকে আলাদা করে রেখে, আমার মন ভালো করার যুদ্ধে নেমে যেতো। একদিন সব বন্ধুরা মিলে রাতে সিনেমা দেখার প্ল্যান করেছিলাম, সবাই যেতে পারলেও আমি যেতে পারি নি আম্মুর নিষেধের জন্যে। সেদিন ভীষণ মন খারাপ হয়েছিলো। মন খারাপ করে বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, আহ, আমি যদি পুরোপুরি স্বাধীন হতাম! ঠিক সেই মুহূর্তেই দেখি, শিহাব আমার বারান্দার গ্রিলে ঝুলছে। ঘেমে পুরো ভিজে গিয়েছিলো ছেলেটা।”
আমি ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর কি হলো?” “শিহাবের হাতে ছিলো এক বয়োম আবদ্ধ জোনাকিপোকা। সে বয়োমটা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কোনোভাবে আমার কাছে দিলো। তারপর বললো, নিশি আমি জানি আজ তোমার ভীষণ মন খারাপ। তোমার স্বাধীনতা নেই তাই তো? বোকা মেয়ে। এটার জন্য মন খারাপ করতে হবে না। তোমার স্বাধীনতা নেই তাতে কি? এখন তুমি এই আবদ্ধ জোনাকিপোকা গুলোকে নিজ হাতে মুক্ত করে দাও। ওরাও তোমার মতো স্বাধীন হতে চাচ্ছে। স্বাধীনতা দাও, মনের অন্ধকার সরাও। আমি নিজ হাতে মুক্ত করেছিলাম জোনাকিপোকা গুলোকে, অন্ধকারে ওরা কি সুন্দর মিটমিট করে উড়ে বেড়াচ্ছিলো। আমার সত্যিই তখন মন ভালো হয়ে গিয়েছিলো। আর সেদিনই আমার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুলটা করে বসলাম।”
এই প্রথম আমার স্ত্রীকে এমন মন খুলে কথা বলতে দেখলাম। আজ মেয়েটাকে বড্ড প্রফুল্ল মনে হচ্ছে। ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে আগুন ধরাতে ধরাতে হাসি মুখে বললাম, “কি ভুল করেছিলে নিশি?” “আমি শিহাবকে আমার একান্ত সবকিছুই দান করে দিয়েছিলাম। আমি তাকে বাধা দিতে পারি নি সেদিন। তাকে স্বাধীনতা দিয়েছিলাম, ঠিক জোনাকিপোকাদের মতো করে। তারপর স্বাধীনতার সুযোগ পেয়ে শিহাব, জোনাকিপোকা-সব আমায় ছেড়ে চলে গেলো। কি নিষ্ঠুর সবাই!”
আমার ঠোঁটে এখনো হাসি লেগে আছে। জোরে জোরে সিগারেট টানার এটাই প্রকৃত মুহূর্ত। মনের স্বাদ মিটিয়ে সিগারেট টানছি। ধোঁয়া ছাড়ার সময় মনে হচ্ছে, ধোঁয়ার এপাশটায় আমি পৃথিবীর আড়াল হয়ে যাচ্ছি। নিশি আমার পা জড়িয়ে ধরে বেশ শব্দ করে কান্না করছে। আমি স্তব্ধ হয়ে সিগারেট টানছি, যেনো এটা ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কোনো কাজ নেই। আজ মেয়েটাকে কান্না করতে দেয়া উচিৎ। বৃষ্টি শেষে স্বভাবতই আকাশটা পরিষ্কার হয়। লক্ষণীয় যে, নিশি বিলাপের সুরে আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে ঠিকই, তবে মুক্তি বা স্বাধীনতা নয়। বলছে, “আমি স্বাধীনতা নয়, ভালোবাসা চাই।”
আমাদের সমাজের শিহাবরা বড্ড স্বাধীনতা-প্রিয় অন্যতম চালাক প্রাণী। একসাথে দুজনকে ঠকিয়ে নতুন নেশার সন্ধান খুঁজে। আর হ্যাঁ, হুমায়ুন আহমেদ স্যার বলেছিলেন- “নারীজাতি হচ্ছে সবথেকে বোকা প্রাণী।” কথাটা মিথ্যে নয়, তারা সাধারণ মোহ আর ভালোবাসার পার্থক্যটাই বুঝে উঠতে পারে না।