তপুর সাথে বনিবনা হচ্ছিল না বেশ কিছুদিন যাবৎ ধরে। গতরাতে ঝগড়াটা তুমুল পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। তাই সকাল হতে কি না হতেই ওকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে আসলাম। কয়েকদিন পর খবর এলো তপু হাসপাতালে ভর্তি। হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে ওকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি তপুর হাত খুব যতন করে ওর বান্ধবী ধরে আছে। আমি দৃশ্যটা দেখে কিছুটা সময় থমকে রইলাম। ভালোবাসায় জোর শব্দটা বেমানান। তপুকে জোর করে আমার আঁচলে বেঁধে রাখতে চাইলেও ও সব সময় আমার থেকে মুক্তি চাইবে- এটা একদম স্বাভাবিক। দরজায় টোকা দিলাম। তপু আমার দিকে চেয়ে তৎক্ষণাৎ ওর বান্ধবীর মুষ্টিবদ্ধ হাত থেকে নিজের আঙুল ছাড়িয়ে নিলো। মাথাটা তুলতে গিয়ে সম্ভবত ঘুরে এসেছিল ওর। প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। আমি ছুটে গিয়ে তাকে ধরতে গেলাম। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমি এবং তপুর বান্ধবী দুজনই তপুকে ধরে বসলাম। হ্যাঁ কিছুটা অস্বস্তি তো লাগছেই। কিন্তু কী করব? ভালোবাসি যে তাকে! তপু হালকা স্বরে বললো, বসো। আমি কোনো মতো চেপেচুপে ওর পাশে বসলাম।
“এখন কেমন লাগছে শরীর?”
“ভালো। গতরাত থেকে স্যালাইনের ওপর আছি।”
“কিভাবে হলো এসব? খাওয়াদাওয়া করোনি নিশ্চয় ঠিকমতো?”
তপু চুপ হয়ে রইলো। ওর বান্ধবীর কী জানি মনে হলো। তপুকে বাই বলে চলে গেল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি। বেশ স্মার্ট। সুন্দরীও বটে। আপনাআপনিই নিজেকে তার সাথে তুলনা করে ফেললাম। যাকগে, ভালোবাসা যদি সৌন্দর্যতার ভেতর নিহিত থাকে তবে তপু ভুল কিছু করেনি আমার মতে। তবে ভয় হয় আজকাল সমাজে ভালোবাসার যা ছড়াছড়ি কোনটা সত্যিকার ভালোবাসা আর কোনটা অভিনয় বুঝা বড় দায়। তপু ভালো থাকুক এটাই একমাত্র চাওয়া। এখন তার ভালো থাকা আমাদের দুজনের কার ভেতর খুঁজে নিবে সেটা ওর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখি শুকিয়ে গেছে অনেক। হলফ করে বলতে পারি রাত জেগেছে। খাওয়াদাওয়া করেনি। সিগারেটে পার করেছে বেশিরভাগ সময়। তপুটা এমনই। আমি এ তপুকেই চিনে আসছি। কিন্তু ইদানীং কেমন জানি ওর ভেতর পরিবর্তন ধরা পড়েছে।
“খাওনি নিশ্চয়?”
“না, এখনও না।”
“তোমার জন্য বিরিয়ানি এনেছি। খাবে?”
“তোমার হাতের রান্না?”
“কী মনে হয়?”
তপু হাসলো। বললো, “দাও।” একা একা খেতে পারছিল না ও। মনে কিছুটা দ্বন্দ্ব আছে। যদি খাইয়ে দিতে গিয়ে তপু রাগ করে? তবুও জিজ্ঞেস করলাম, ”খাইয়ে দিব?” তপু চুপ করে মাথা নাড়ালো। আমি জানি ও বরাবরই আমার হাতে তুলে খেতে পছন্দ করে। তবুও ভয় হয়। আজ তো ওর জীবনে নতুন কারও আনাগোনা। আমাকে কি আর আগের মতো ভালোবাসে! লক্ষ্মী ছেলের মতো তপু সবটা খেয়ে নিলো। একটা ছোট ঢেঁকুর তুলে বললো, “তোমার হাতের বিরিয়ানি সব খাবারকে হার মানায়।”
আমি হাসলাম। বললাম, “এরপর থেকে অভ্যাসটা বাদ দিও। আমি তো আর থাকবো না।” তপু মুখটা কালো করে ফেললো। এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে দেখি ভাইয়ার ফোন। রিসিভ করতেই আচ্ছা মতো বকে দিলো। আসলে তপুকে ছেড়ে আসার পর থেকে আমার বাপের বাড়ির কেউ চায় না তপুর সাথে আমার যোগাযোগ থাকুক। কিন্তু যার জন্য ভালোবাসা বুকে আগলে রেখেছি সে হাসপাতালে আছে জেনে ঠিক থাকা যায়? ভাইয়ার বকুনি হজম করে নিলাম তবুও; সম্ভবত ভালোবাসার জন্যই। তপুকে বললাম, চলে যেতে হবে। ও ছোট্ট বাচ্চাদের মতো বায়না করলো। বললো, ” আরও কিছুক্ষণ থেকে গেলে হয় না?”
আমি বিস্ময়াবহ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম। নাহ, আমি ভুল ভাবছি। এ তপু তো আমার নয়। সে অন্য কারও। আমার তপু আমাকে ভালোবাসলে ঠিক আমার কাছে ফিরবে। মুচকি হাসলাম। বললাম, ভালো থাকো। নতুন জীবন সুখের হোক। বলেই হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে এলাম। বুকটা ব্যথা করছে। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। আমার ভালোবাসা ক্রমশ দূরে হারিয়ে যাচ্ছে। এরপর প্রায় দেড় মাস তপুর সাথে যোগাযোগ নেই। এক বিকেলবেলা বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই দেখি, তপু বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা অবাকই হয়েছি। ও ভেতরে এলো। বাড়ির লোকজন ফুঁসে আছে ওর ওপর। আমি কোনো মতে সবাইকে আটকালাম।
”কী বলতে এসেছো?”
” তোমাকে ভালোবাসি বলতে।”
“ও ভালোবাসা এখন অন্য কারও, আমি চাইলেই তা নিতে পারি না, তপু।”
“মিথ্যে। আমি কেবল একজনকেই ভালোবেসেছি। আর সে হলো তুমি।”
” তবে আমার চোখে যা ধরা পড়েছিল, সেসব সবকিছুই মিথ্যে ছিল?”
তপু মুখ ফুটে আরর কিছু বলতে পারছে না। আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে ভালো করে বুঝতে পারছি অনুশোচনায় ওর বুকটা খাঁ খাঁ করছে। তপু কাঁদতে লাগলো। পুরুষরা কাঁদলে কেমন জানি অস্বাভাবিক লাগে। সম্ভবত প্রকৃতিগত নিয়ম এটি। তবে পুরুষ যখন কাঁদে তখন ধরে নিতে হবে পৃথিবীর সব সত্যতা তার ভেতর লুকিয়ে আছে। নিষ্পাপ তপুর কান্না। আমি ওর কাছে এগিয়ে গেলাম। তপু আমার হাত দুটো ধরে ক্ষমা চাচ্ছে। আমি তপুর প্রতি অনেক দুর্বল। তাই বলে সব জায়গায় দুর্বলতা দেখাতে নেই। আমি চাই এ তপু শুধুই আমার হোক। যেখানে ভালোবেসে মন মরলেও ভালোবাসা যেন না মরে। যার হাতের নির্ভরতায় কাটানো যাবে বহু শতাব্দী। আর আমি তপুর চোখে সে সত্যিকার ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি। যার ভেতর কোনো খুঁদ নেই।
” তবে আমার সাথে কেন এমন করলে তপু?” “আমি জানি নীলিমার রূপে অন্ধ হয়ে অন্যায় করেছি তোমার সাথে। ও আমার ভেতরে যে লালসার জন্ম দিয়েছিল তাতে আমি সুখ খুঁজে পাইনি। কেবল আমার আভিজাত্যে চোখ রেখেছে সে। ভালোবেসেছে টাকাপয়সাকে। মানুষ বোধ হয় মানুষের মনের থেকেও টাকাকে বেশি ভালোবাসে। তবে কি জানো, আমি খুঁজেছি মন। তোমার থেকে এতদিন দূরে থেকে ভালোবাসা কী তা বুঝতে পেরেছি। পেয়েছি ভালোবাসার মানে।”
তপুর কথাগুলো একদম হৃদয়ের গভীর থেকে আসছিল। হ্যাঁ হয়তো বিবাহিত শর্তেও নীলিমার মতো মানুষ কোনো পুরুষের জীবনে মাঝেমধ্যেই আসে কিংবা এসে যায়। তবে পুরুষ কেবল দেহ দিয়ে কখনও সুখী হতে পারে না। তাদেরও মন প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় ভালোবাসার। তপু হয়তো সে জন্যই নীলিমার হাত ছেড়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে। তাহলে ওকে ফিরাবো কোন সাহসে? ভালোবাসা যে কেবল সত্যিকারের ভালোবাসাকেই অমর করে রাখে। এমন ভালোবাসা এবং তপু দুটোই আমার কাছে পাওয়া শ্রেষ্ঠ সম্পদ।