মেয়েটি জামা ঠিক করে পাশে শুয়ে থাকা মুহিতের দিকে তাকাল৷ মৃদু হেসে মুহিতকে বলল, ‘তৃপ্তি মিটেছে?’ ঠোঁটের মাঝে একটি সিগারেট জ্বালিয়ে, মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার দুটো নোট বের করে মেয়েটির হাটুর ওপর রেখে দিল৷ সিগারেটের ঘন ধোঁয়া ছেড়ে, বালিশের পাশে হতে মোবাইলটি হাতে নিয়ে বলল—‘কম হলে বলো৷ আরো এক হাজার দিচ্ছি’৷
টাকাগুলো হাতের মুঠে গুজে, মুহিতের বুকে মাথা রাখলো মেয়েটি৷ রেখে বলল, ‘টাকা আর কি়! তুমি চাইলে সারাদিন তোমার পাশে শুয়ে থাকব৷’ মেয়েটির নাম জানে না মুহিত৷ দু’ঘন্টা ধরে ওরা এক সাথে কাটাচ্ছে তবুও মেয়েটির নাম জানার আগ্রহ ওর হচ্ছে না৷ মেয়েটিকে এখন ওর ভীষণ বিরক্ত লাগছে৷ বুকে মাথা রাখার কারনে, মুহিতের অস্বস্তি হচ্ছে৷
ওর খুব অবাক লাগছে একটি কথা ভেবে৷ কামনা বাসনার মস্তিষ্কে এই মেয়েটির প্রতি কোন বিরক্তি বা অস্বস্তি ছিল না৷ সমগ্র বিশ্বের সুখ, লোভ, ভালো লাগা—সব যেনো ছিলো এই মেয়েটির শরীরে৷ বুকের ওপর থেকে মেয়েটিকে সরিয়ে মুহিত বলল, ‘ তুমি এখন যেতে পারো৷ দরকার হলে তোমাকে আবার ফোন করব৷ কিছুখন পর আমাকে বেরোতে হবে৷ জরুরী কাজ আছে৷’ মুহিতের কথায় যে মেয়েটির খারাপ লেগেছে৷ সেটি মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝা গেল না৷ বরং আবার মুহিতের পাশে শুয়ার, এক চাপা উত্তেজনা দেখা গেল মেয়েটির মুখে৷
মেয়েটি ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়ায়, খানিকটা স্বস্তি বোধ করল মুহিত৷ ওয়াইফাই অন করার সাথে সাথেই মেসেঞ্জারে ‘হানি বী’ নিক নামে চৈতীর মেসেজ— ‘আমি খালার বাসায় আসছি৷ তুমি বাসা থেকে বের হতে দেরি কর না৷ তিনটার মধ্যেই সরোবরের গেইটের সামনে দাঁড়াবে৷ আমি বের হওয়ার আগে তোমাকে ফোন দিব৷ বাই৷’ মুহিত এই ছোট মেসেজটি কয়েকবার পড়ে, এক ধরনের স্বস্তি বোধ করলো৷ ওর মনের ভেতর এক চাপা উত্তেজনা কাজ করতে লাগলো কারন, কয়েক ঘন্টা পর চৈতীর সাথে দেখা৷ আজ এক বিশেষ কথা বলবে চৈতী৷ কিন্তু সেই বিষয়টি কী, সেটা এখনো খোলাসা হয়নি৷
চৈতী ওর ভালোবাসার মানুষ৷ তার চেয়ে বড় বিষয়, চৈতী মুহিতের আপন মানুষ৷ ভালোবাসার মানুষ অনেকেই হতে পারে৷ অনেক কিছু দ্বারাই ভালোবাসার মানুষ পাওয়া যায়৷ কিন্তু আপন মানুষ পাওয়া দুষ্কর৷ সবাই আপন মানুষ হতে পারে না৷ ওরা প্রথমে আপন মানুষ হয়েছে৷ তারপর ভালোবাসা হয়েছে৷ কাজেই ওদের মধ্যে বোঝাপড়া এবং বিশ্বাসটা খুব শক্ত৷
মেসেজটি পড়া শেষে ঘড়ির দিকে চোখ রাখল মুহিত৷ দুপুর একটা বাজে৷ এখনো ঘন্টা দুয়েক সময় আছে, এর মাঝে গোসল করে ফ্রেশ হতে হবে৷ ওর সারা শরীরে, ঐ মেয়েটির গায়ের ঘ্রান লেপ্টে আছে৷ আজ মেয়েটিকে না ডাকলে ভালো হত৷ আবার এক হিসেবে ডেকে ভালোই হয়েছে৷ চৈতীর হাতের ছোঁয়া লাগলে বা বুকের দিকে চোখ পড়লে, মনের কামনা বাসনা জাগবে না৷ কামনার তৃষ্ণা ঐ মেয়েটির কাছে থেকেই মিটিয়ে নিয়েছে৷ চৈতীর পাশে বসবে শুধু ভালোহাবাসার তৃষ্ণা নিয়ে৷ কিন্তু মুহিতের মেয়েদের শরীরের প্রতি এক নেশা আছে৷ সেই নেশা যেনো চৈতীর শরীর না হয়৷ সেটির প্রতি ও সব সময় সচেতন৷ অনেক নারীর সাথে সে এক ছাদে শুলেও, চার বছরের সম্পর্কে চৈতীকে কখন বাধ্য করেনি৷ বিশ্বস্থ ও আপন মানুষ হওয়ার জন্য বুঝি এতটুকুই যথেষ্ট৷
হুট করেই যে ও চৈতীর আপন মানুষ হয়ে উঠেছে৷ তা মোটেও না৷ এজন্য ওকে বিভিন্ন কিছুর সেক্রিফাইস করতে হয়েছে৷ ফিজিক্যাল চাহিদাটির থেকে সেক্রিফাইস বেশি করতে হয়েছে৷ প্রায়ই ক্লাস মিস দিয়ে বা সময় পেলেই মুহিতের ব্যাচেলার ফ্লাটটিতে এসে সময় কাটায় চৈতী৷ সে সময়ে মুহিতের জন্য রান্না করে, এক সাথে খাওয়া-দাওয়া করে৷ খাওয়া শেষে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে, দুনিয়ার সব থেকে অর্থহীন কথাটিও রস-কস লাগিয়ে অর্থবহ এবং ইন্টেরিস্টিং করে বলে৷ মুহিত কেবল শ্রোতা হয়ে সে কথা শোনে না৷ ওর বুকের দিকে, কথা বলার সময় চঞ্চল ঠোঁটের দিকে ভোগ দৃষ্টি ফেলে, আবার সেটি মুহূর্তেই ইন্টেরেস্টিং গল্প শোনায় বিষ্ময়ের দৃষ্টিতে রূপান্তর করে৷
বিছানা ছেড়ে সোজা বাথরুমে গিয়ে গোসল করে বের হল মুহিত৷ নিজের শরীর থেকে ঐ মেয়েটির গন্ধ সরে যাওয়ায় বেশ স্বস্তি বোধ করল৷ কিন্তু গোটা ঘর অনেকখন বন্ধ থাকায়, চাপা গন্ধটি সুরসুর করে নাকে ঢুকছে৷ ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে পার্ফিউমের বোতল নিয়ে ঘরে ছিটিয়ে দিল৷ বিছানার চাদর ও বালিশের কাপড় খুলে ছুঁড়ে ফেলল বাথরুমের দরজার সামনে৷ তারপর নিজের মনকে বলে বসল, আমি ওর বিশ্বাস জয় করে থাকতে চেয়েছি, সত্যিই কী পারছি? নিজের মনে এই প্রশ্ন রেখে, পা বাড়াল জানালার দিকে৷
জানালা খুলে দিতেই মুহিতের চোখ পড়ল, রাস্তার ওপাশে সৃতি কোচিং সেন্টারের সামনে৷ একটি কলেজ পড়ুয়া মেয়ে খুব ধীরে হেটে যাচ্ছে৷ এবং পিছনে হাটা ছেলেটির দিকে বার বার ফিরে তাকাচ্ছে৷ ছেলেটি তার দৃষ্টির সামনে কেবলই সে মেয়েটিকে দেখছে৷ মেয়েটি মুচকি হাসছে৷ মুহিত ঐ দিকটায় ভালো করে তাকিয়ে বুঝলো, মেয়েটি রত্না৷ ওদের অ্যাপার্টমেন্টে চতুর্থ তালায় থাকে৷ এবং পেছনে হাটা ছেলেটি ওর প্রেমিক৷ এলাকায় ওরা কখনো পাশাপাশি হাটে না৷ এখানে সবাই পরিচিত৷ প্রেম করছে কেউ বুঝে ফেললে সমস্যায় পড়তে হবে৷ কিন্তু বিভিন্ন বিশেষ দিবসে ওরা এলাকার বাহিরে চুটিয়ে প্রেম করে৷
যেমন গত বৈশাখে রত্না এবং ঐ ছেলেটিকে এক সঙ্গে দেখেছে টিএসসিতে৷ ছেলেটির হাত শক্ত করে ধরে, একই রঙের শাড়ি পাজ্ঞাবি পড়ে রাস্তার পাশে হাটতে৷ হটাত মুহিতকে সামনে দেখে রত্না ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে, ‘কেমন আছেন ভাইয়া?’ মুহিত দু’জনার দিকে কয়েক বার তাকিয়ে বলল, ‘ভালো আছি, তোমরা ভালো?’ রত্না ওর প্রেমিকের সাথে মুহিতের পরিচয় করিয়ে দিল, এলাকার বড় ভাই হিসেবে৷ তারপর মুহিতকে আড়ালে ডেকে বলল, ‘ভাইয়া প্লিজ, কেউ যেন কিছু জানতে না পারে’৷ ধুর পাগল’—বলে এক বিনোদনের হাসি হেসে সেখান থেকে কেটে পড়ে মুহিত৷
রত্না বাড়ির গেইট দিয়ে ঢুকার সময় ছেলেটি রাস্তার ওপাশ থেকে দাড়িয়ে, মনে মনে কতবার আলিঙ্গন করল, কতবার বলল— বাসায় গিয়ে মেসেজ দিও, কতবার বলল—আল্লাহ হাফেজ৷ রত্না চোখ টিপে, ঠোঁটে হাসি টেনে বিদায় জানাল৷ গোপন প্রেম ওদের৷ যে প্রেমের গোপনীয়তা এতই গভীর, রাস্তায় কত জোড়া চোখের মাঝেও দু’জোড়া চোখ প্রেম নিবেদন করল৷ হটাতই মোবাইল ফোন বাজায়, ঐ দিক থেকে মুহিতের ধ্যান ভাঙলো৷ চৈতী ফোন করেছে—‘হ্যালো’৷ ‘হ্যালো আবার কি! তুমি এখন বের হও নাই?’ ‘না, মাত্র গোসল শেষ করেছি৷ তোমার ফোন পেলে বের হতে বলেছিলে, সেটারই অপেক্ষা করছিলাম৷’‘ওহ, হ্যা৷ নীল পাঞ্জাবিটা পড়ে পাঁচ মিনিট পর বের হও৷ আমি বের হচ্ছি৷’‘আচ্ছা’—বলে ফোন সমাপ্তি ঘটল৷
ফোনটা সরিয়ে মুহিত আবার উকি দিল রাস্তায়৷ ঐতো ছেলেটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে৷ সিগারেট ফুঁকছে৷ ওর মনে হলো, চৈতীর প্রেমেও এমন গোপনীয়তা রয়েছে৷ কিন্তু সেটা মুহিতের জন্য না৷ বা এলাকার লোক কি বলে—সেটির জন্যও না৷ চৈতীর পরিবার মুহিতকে বেশ ভালো চেনে৷ সেদিকেও সমস্যা নেই৷ চৈতীর গোপনীয়তা কেবল হাসান নামের ছেলেটির কাছে৷
হাসান দু‘বছর চৈতীর পিছনে ঘুরে প্রোপজ করে৷ সোজা সাপ্টা মেয়ে চৈতী, তাই সোজা ভাষায় না করে দেয়৷ এবং হুমকি পর্যন্ত দেয়, যেন এই বিষয় নিয়ে কোন জ্বালাতন না করে৷ করলেই ইভটিজিং মামলায় কেইস৷ মুহিত যখনই চৈতীদের বাসায় যায়৷ কিংবা চৈতীকে বাসা অবধি পৌঁছে দিয়ে আসে৷ তখন মোল্লা হোটেলের সামনে চৈতী পাশা-পাশি হাটতে মানা করে৷ হয় ও একটু সামনে হাটে৷ তা নাহলে পেছনে পেছনে৷ সে হাটার দৃশ্য যে কেউ দেখলে মনে হবে, চৈতী ও মুহিত দুজন দুই প্রান্তের মানুষ৷ এই বিষয়টির কারন কয়েকবার চৈতীর কাছে জানতে চেয়েছে মুহিত৷ কিন্তু কখনই উত্তর দিতে আগ্রহ বোধ করে না ও৷
আর চৈতীকে, কোন কিছুতেই মুহিত জোরাজুরি করতে পারে না৷ তাই সেটির কারন এখন আর জানতে চায় না৷ তবে মুহিত বুঝতে পারে৷ সে কারনটি শুধু হাসান৷ চৈতী একটি ছেলের সাথে প্রান খুলে হেসে পাশাপাশি হাটবে৷ এই দৃশ্য মোল্লা হোটেলের ভেতরে আড্ডা দেয়া হাসান, দেখে কষ্ট পেতে পারে৷ চৈতী গোপনে হাসানকে সেই কষ্ট থেকে বিরত রেখেছে৷ চৈতীর ভেতর হাসানের প্রতি এই দুর্বলতা ও প্রায়ই খেয়াল করে৷ এর অাসল কারনটি শুধু চৈতীই ভালো বলতে পারবে৷ গোপন বিষয় গোপনই রাখা উত্তম৷ উত্তেজনা বা আবেগে সেই গোপন জিনিস খুঁচিয়ে বের করলে, এর ভালো ফল পাওয়া যায় না৷ মুহিত ভালো করেই জানে, হাসানের প্রতি দুর্বলতা ঐ মোল্লা হোটেলের কয়েক গজ রাস্তা পর্যন্ত৷
দুজনে বাকি জীবনে যে কোটি কোটি মাইলের স্বপ্ন দেখেছে৷ সেখানে কোথাও হাসানের চিহ্ন নেই৷ বা কখনো প্রভাব ফেলবে না—এই দৃঢ় বিশ্বাসও রয়েছে মুহিতের মনে৷ চৈতীর গোপনীয়তাকে সে সম্মান করে৷ এই নিয়ে রাগা-রাগি বা খারাপ ভাষা সে কখনই উচ্চারন করে না৷ কিন্তু মুহিতের গোপন চাহিদাটা চৈতী জানতে পারলে কি কখনই সম্মান দেবে! এই কথাটি ভাবার মাঝে মুহিত সিগারেট ধরাল৷ দীর্ঘ টানে ঘন ধোঁয়া ছেড়ে ও ঠিক করলো৷ চৈতীকে সব বলবে৷ কত মেয়ের সাথে বিছানায় শুয়েছে, সবই খোলাসা করে বলবে৷ এবং তা আজই৷ বলার পর যা হাওয়ার হবে৷
ফার্মগেট থেকে নিউমার্কেটের গন্তব্যে রিক্সা ঠিক করলো চৈতী৷ মুহিত পাশে বসে বলল, ‘আমরা নিউমার্কেট কেন যাচ্ছি’? ‘ওখানের এক দোকান থেকে আমার বান্ধবী বিয়ের শাড়ি কিনেছে৷ সেই দোকান থেকে একটি কার্ড দিয়ে বলেছে, কেউ যদি এই কার্ড দেখিয়ে কিছু কিনতে চায় তবে ২০% ডিসকাউন্ট রয়েছে৷ তাই আমার বিয়ের শাড়িটা আজই কিনে ফেলব৷’ ‘আজই কেন! তোমার বিয়ে মুহিতের কথায় বাধা দিয়ে ও বলল, ‘হু, কাল আমরা বিয়ে করছি৷’
চৈতীর মুখের উপর মুহিতের চোখ চেয়ে রইলো, পৃথিবীর সমস্ত বিস্ময় নিয়ে৷ ও মাঝারি সুন্দর্যের মেয়ে৷ সব সময় সুন্দর দেখায় না, ক্ষেত্র বিশেষে সুন্দর্য ফুটে উঠে৷ তবে আজকে সুন্দর লাগছে৷ গুন গুন সুর তুলে কিসের একটি গানও গাইছে৷ মুহিত ঠিক করল, এখনই ওকে সেই গোপন কথাটি বলবে৷ মনে মনে সেই কথাটি গুছিয়ে নিল বলার উদ্দেশ্যে৷ মুহূর্তেই ওর খেয়াল হল, চৈতী যদি কোন কিছু গোপন রেখে সামনে এগোতে পারে৷ ও যদি মনে করে কিছু বিষয়ের গোপনীয়তাই ভালো, বাকি জীবনের জন্য৷ তবে আমি কেন গোপন চাহিদাটাকে গোপন রাখতে পারব না, ওর সুখের জন্য৷ কাল বিয়ের পর ওতো আমারই৷ তখন আর নাম না জানা সেই মেয়েটি মুহিতের ফোন পাবে না৷ অস্বস্তি দূর করার জন্য সারা ঘরে পার্ফিউম ছিটাতে হবে না৷
কাল থেকে সারা ঘরে মিশে যাবে ভালোবাসার গন্ধ৷ মনের খাতায় গুছিয়ে লেখা গোপন কথাটি মুহিত ছিড়ে ফেলল৷ চৈতীর হাতটি শক্ত করে ধরে বলল, ‘আষাঢ় মাসের মধ্য দুপুরে, সূর্যের আলোয় এক গোপনীয়তা আছে৷ খেয়াল করেছ?’ গুনগুন গান থামিয়ে মুহিতের কাঁধে মাথা রেখে চৈতী বলল, ‘খেয়াল করিনি৷ তবে বুঝতে পারি৷’
( সমাপ্ত )