খুনসুটি

খুনসুটি

মাহিমা একটা সিগারেট শেষ করে আরেকটা সিগারেট ধরালো। সচরাচর মানুষের মন অশান্ত থাকলে মানুষ এ কাজটা করে। দুঃখ, হতাশা, দুশ্চিন্তায় স্মোকাররা একের পর এক সিগারেট জ্বালায়। মাহিমা সিগারেটে দুটো গভীর টান দিয়ে শাহিনুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দোতলায় থাকো নাকি তিনতলায়?’ ‘দোতলায়।’ ‘ফ্লাট কিনেছো?’ ‘না। ভাড়া থাকি।’ ‘তোমার স্ত্রী কি জেগে আছে?’ ‘কেন?’ ‘বারবার ব্যালকনির দিকে তাকাচ্ছো সেজন্য জিজ্ঞাসা করলাম। তোমার স্ত্রীর নাম যেন কি?’ ‘তানহা।’

‘সুন্দর নাম। মেয়েটা দেখতেও বেশ মিষ্টি। অনলাইনে তোমাদের ছবি দেখেছিলাম। বয়স কম তাইনা?’ ‘হুম’ ‘বনিবনা হয় তোমাদের?’ ‘মানে?’ ‘না মানে দুজনের বয়সের পার্থক্যটা তো কম না। তাই জিজ্ঞাসা করলাম আরকি।’ মাহিমার সিগারেটটা শেষ হয়ে গেছে। কারের দরজা খুলে মাহিমা সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলো। মাহিমার চেহারায় মুহূর্তেই বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো। বিরক্তির কারন হলো সিগারেটের প্যাকেটটা খালি। মাহিমা হাতের মুঠোয় সিগারেটের প্যাকেটটা মুচড়ে দূরে ছূঁড়ে মারলো। রাস্তার পাশে একটা কুকুর ঘুমাচ্ছিলো। ছূঁড়ে ফেলা সিগারেটের প্যাকেটের সামান্য শব্দে কুকুরটা মাথা তুলে তাকালো।‘তোমার কাছে সিগারেট আছে?’ মাহিমার এমন প্রশ্নে শাহিনুর খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘সিগারেট কবে থেকে ধরেছো?’ ‘অনেক আগে। সিগারেট নেই তোমার কাছে?’ ‘না।’ ‘সিগারেট ছেড়ে দিয়েছো?’ ‘ছাড়িনি তবে বাসায় এনে রাখিনা।’ ‘তানহার নিষেধ তাইনা?’ ‘হ্যাঁ।’

শাহিনুর হিসেব মেলাতে পারছেনা। যেই মাহিমাকে শাহিনুর চিনতো সেই মাহিমার সাথে বর্তমান মাহিমার কোন মিল নেই। যেন দুটো আলাদা মানুষ। সময়ের সাথে মানুষের মাঝে পরিবর্তন আসে। কিন্তু মাহিমার পরিবর্তনটা অন্যরকম। যেন চেনা চেহারার পেছনে অন্য কেউ। প্রায় আট বছর পরে মাহিমাকে সামনা সামনি দেখছে সে। শাহিনুরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাহিমা বলল, ‘আগের চেয়ে অনেকটা মোটা হয়ে গেছি তাইনা?’ মাহিমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শাহিনুর বলল, ‘আজ এতো বছর পরে কি মনে করে? তাও এই মাঝরাতে। আমার ঠিকানা, ফোন নাম্বার কোথায় পেলে?’ ‘আমি আসায় বিরক্ত হয়েছো?’ ‘না বিরক্ত হয়নি তবে তোমার এভাবে আসার কারনটা বুঝতে পারছিনা। বিষয়টা খুলে বলবে?’ ‘বিপদে পরে এসেছি। মনে হলো আমার এই বিপদে তুমি অন্তত ফিরিয়ে দিবেনা।’ ‘কিসের বিপদ?’ ‘আমার কিছু টাকা লাগবে। একেবারে নিচ্ছি তা না। পরে ফেরত দিয়ে দিবো। গাড়িটা বিক্রি করলে বেশ কিছু টাকা হাতে আসবে।’

‘কতো টাকা লাগবে তোমার?’ মাহিমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘টাকা তো অনেক দরকার। তুমি কতো দিতে পারবে সেটা বলো।’ ‘আমার কাছে এখন তেমন টাকা নেই। যদি বলতে তোমার কতো প্রয়োজন তাহলে হয়তো সেই হিসেবে একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম।’ ‘বললাম তো তুমি যতো দিতে পারো।’ ‘আচ্ছা আমি দেখছি।’ কথাটা বলে শাহিনুর বাসার দিকে পা বাড়ালো। দু’পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালো। পেছন ফিরে মাহিমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে?’ শাহিনুরের কথা শুনে মাহিমা হেসে জবাব দিলো, ‘তোমার বাসায় নিশ্চই নিয়ে যেতে পারবেনা। তোমার স্ত্রী দেখে ফেললে সমস্যা হবে। আমি বরং এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি, তুমি তাড়াতাড়ি আসো।’

তানহা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো। ব্যালকনি অন্ধকার থাকায় নিচ থেকে বুঝা সম্ভব না যে কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তানহা জেগেই ছিলো। শাহিনুরের ফোনে একটা মেসেজ আসার পরে শাহিনুর ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। তানহা এসে দাঁড়িয়েছে ব্যালকনিতে। ল্যামপোস্টের আলোয় এতোক্ষণ তানহা দেখছিলো শাহিনুর একজনের সাথে কথা বলছে। লোকটা কালো রঙের কার নিয়ে এসেছে। তানহা একটু ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারলো শাহিনুর যার সাথে কথা বলছে সে আসলে একটা মেয়ে। কেননা তার পায়ে উঁচু হিল জুতা। দূর থেকে শার্ট প্যান্ট পরা দেখে প্রথমে ছেলে ভেবেছিলো। মেয়েটা চুল খোপা করে রেখেছে। মেয়েটাকে দেখার পর থেকে তানহার মনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কে হতে পারে মেয়েটা। কেনই বা শাহিনুর মেয়েটার মেসেজ পাওয়ার পরে চোরের মতো ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।

শাহিনুরকে উপরে আসতে দেখে তানহা রুমে এসে ঘুমের ভান করে শুয়ে পড়লো। যা ঘটছে তা শাহিনুরের কাছে ঘোরের মতো মনে হচ্ছে। শাহিনুর ঘরে এসে লাইট অন করলো। তানহার কাছে গিয়ে দেখলো তানহা ঘুমিয়ে আছে কি না। দেখে মনে হচ্ছে তানহা গভীর ঘুমে। শাহিনুর কোন রকম শব্দ না করে সাবধানে আলমারি খুললো। ড্রয়ার থেকে টাকা বের করলো। আবার খুব সাবধানে আলমারি বন্ধ করে ঘর থেকে বের হলো। পাঁচশত টাকার নোটের একটা বান্ডিল মাহিমার দিকে এগিয়ে দিলো। মাহিমা টাকাগুলো নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে রাখলো। শাহিনুর বলল, ‘তুমি ভালো আছো তো?’

শাহিনুরের প্রশ্ন শুনে মাহিমা একটু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ ভালোই আছি। তবে মাঝে মাঝে তোমার কথা খুব মনে পরে। তখন খুব কষ্ট হয়। কান্না পায়। আচ্ছা তোমার কি আমার কথা মনে পরে?’ শাহিনুরকে চুপ করে থাকতে দেখে মাহিমা বলল, ‘আচ্ছা আসি তাহলে।’ কালো রঙের কারটা দ্রুত গতিতে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলো। শাহিনুর ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। পাশেই তানহা ঘুমাচ্ছে। জীবন থেকে হুট করে হারিয়ে যাওয়া খুব কাছের একটা মানুষ কখনো এভাবে ফিরে আসবে ভাবেনি শাহিনুর। সবে মাত্র সে সব অতীতের মায়া কাটিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করেছিলো। তানহা তার জীবনটাকে আবার নতুন করে ভালোবাসায় সাজিয়ে তুলেছিলো।

পরিবারের সবাই মিলে একপ্রকার জোর করে তানহার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলো। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তানহা। তানহার হাসি মুখটা দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। বুকের মধ্যে ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসা অনুভুতিগুলোকে নতুন করে প্রাণ দানের ক্ষমতা রাখে এই মেয়ে। প্রথম প্রথম তানহা হয়তো তাকে মন থেকে গ্রহন করতে পারেনি। শাহিনুরের ও কোথাও কোন তাড়া ছিলোনা। বিয়ের পরে তানহা তাকে আপনি করে বলতো। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলতোনা। বাইকের পেছনে বসে কাঁধে বা কোমড়ে হাত রাখতোনা। হয়তো তার ইচ্ছে ছিলো রাজকুমারের মতো কোন টগবগে যুবক তার জীবন সঙ্গী হবে। সেখানে শাহিনুরের বয়স ছত্রিশ পার হয়েছে।
তানহার মতো মেয়েরা মানিয়ে নেয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। ধীরে ধীরে তানহা সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে থাকলো। একদিন হুট করে তানহা আপনি থেকে তুমি বলতে শুরু করলো। কিছু মানুষের তুমি সম্বোধন অন্যরকম ভালোলাগা সৃষ্টি করে। মানিয়ে নেয়া আর মায়ায় পড়ার মাঝে পার্থক্য করা খুব সহজ। মানিয়ে নেয়া মানুষদের চোখে মুখে সুখের ছাপ থাকেনা। তারা সুখে থাকার অভিনয় করে যায়। কিন্তু তানহাকে দেখে মনে হয় তার মুখের মিষ্টি হাসিটা অভিনয়ের না। মায়ায় পড়া মানুষেরা অধিকার খাটাতে চায়। মানিয়ে নেয়া মানুষেরা অধিকার খাটানোর ব্যাপারে উদাসিন।

মায়ায় পড়ে যারা ভালোবাসে তাদের ভালোবাসার গভীরতা মাপা খুব কঠিন। ইদানিং তানহা রোজ বিকেলে ফোন করে বলে, ‘অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’ বাইকের পেছনে বসে কাঁধে হাত রাখে, কখনো কখনো পিঠে মাথা এলিয়ে দেয়। ঘরে বসে অবসর কাটানো যার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো সেই শাহিনুর যখন তানহার সাথে শহরের অলি গলি চষে বেড়ায়। তখন নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হয়। আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশের মতো শাহিনুরের জীবনে যেন রংধুন হয়ে এসেছে তানহা। শাহিনুরের মাঝে মাঝে তানহাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে কি দেখে আমার মায়ায় পড়লে?

জীবনটা যখন এতো সুন্দরভাবে চলছিলো তখন কেন আবার মাহিমা ফিরে এলো। তার ফিরে আসাটা কি খুব বেশি জরুরি ছিলো। সকালে শাহিনুর অফিস চলে যাওয়ার পরে তানহা আলমারি খুললো। ড্রয়ারের টাকাগুলো নেই। তারমানে শাহিনুর রাতে আলমারি থেকে টাকা বের করে মেয়েটাকে দিয়েছে। রাতের আঁধারে চোরের মতো একটা মেয়েকে এতোগুলো টাকে দেয়ার কারন কি। শাহিনুর কোন কিছু লুকাচ্ছেনা তো তার কাছে। এক ধরণের ভয় দানা বাঁধতে শুরু করেছে তানহার মনে। যে সংসার সে ভালোবাসা দিয়ে সাজাতে শুরু করেছে সে সংসারে আসন্ন কোন অমঙ্গলের আশঙ্কায় চোখ ভিজে আসছে তানহার।

ভার্সিটিতে আজ পরীক্ষা ছিলো। বান্ধবীরা তানহাকে দেখে বলল, ‘কিরে সারারাত পড়ে তো চোখ লাল করে রেখেছিস।’ তানহা পরীক্ষা হলে চুপচাপ বসে থাকলো। খাতায় কিছুই লিখলোনা। বারবার সেই মেয়েটার কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সেদিনের পরে সেই কালো গাড়িটা ঠিক মাঝরাতে তাদের বাসার সামনে আরো দু’দিন এসে থেমেছে। ফোনে ছোট্ট একটা মেসেজ তারপর শাহিনুর চোরের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। তানহা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তাদের দেখেছে। গতকাল রাতেও মেয়েটা এসেছিলো। পড়ার অযুহাতে পাশের রুমে গিয়ে তানহা সারারাত কেঁদেছে। ভুল মানুষকে ভালোবেসেছে সে।

কনের সাজে মাহিমা শাহিনুরের অফিসে এসে উপস্থিত হয়েছে। লাল বেনারসি, হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি, নাকে নথ, মাথায় টিকলি, ঠোটে টকটকে লাল লিপিস্টিক। অফিসের সবাই নিজ নিজ কাজ ফেলে মাহিমাকে ঘিরে ভীড় জমিয়েছে। শাহিনুর কিছুই বুঝতে পারছেনা। সবাই জিজ্ঞাসা করছে, কাকে খুঁজছেন? শাহিনুর পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য মাহিমার হাত ধরে অফিস থেকে বেরিয়ে আসলো। বাইরে বের হওয়ার পরেও লোকজন তাদের দিকেই তাকাচ্ছে। শাহিনুর মাহিমাকে নিয়ে কফিশপে ঢুকলো। এখানে কাপলরাই বেশি আসে। তাদের একটু প্রাইভেসি দেয়া হয় বলে। কোণের একটা টেবিলে দুজনে বসলো। শাহিনুর বলল, ‘এসব কি মাহিমা? তুমি অফিসে এসেছো কেন?’ ‘তোমাকে ফোন করেছিলাম। তোমার ফোন বন্ধ।’

‘ফোন বন্ধ বলে এখানে চলে আসবে। তাও আবার এভাবে। মিটিংয়ে ছিলাম তাই ফোন বন্ধ ছিলো। পরে ফোন দিতে পারতে।’ ‘তুমি আমার সাথে এতো রেগে কথা বলছো কেন?’ ‘রাগ করার মতো কাজ করেছো তাই। আর তাছাড়া আমার কাছে এখন আর কোন টাকা নেই। কয়বার টাকা দিবো আর বলো?’ ‘আমি টাকার জন্য আসিনি শাহিনুর।’ ‘তাহলে?’ এবার মাহিমা কাঁদতে শুরু করলো। এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় শাহিনুর কি করবে বুঝতে পারছেনা। মাহিমাকে শান্ত করার জন্য মাহিমার পাশে গিয়ে বসলো সে। ডানে বামে তাকিয়ে বলল, ‘মাহিমা প্লিজ কোন সিনক্রিয়েট করোনা। কি হয়েছে সেটা বলো।’ ‘আমার আর এ জীবন ভালো লাগছেনা। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?’ ‘কি বলছো এসব? তুমি জানোনা আমি বিবাহিত।’

‘হ্যাঁ জানি। আমি তোমার কাছে তেমন কিছুই চাইনা। তুমি তানহার সাথেই সংসার করো। শুধু আমাকে একটু সময় দিয়ো। আমি জানি তুমি আমাকে এখনো ভালোবাসো।’ ‘এটা সম্ভব না মাহিমা।’ ‘কেন সম্ভব না? তুমি সত্যি করে বলো তুমি আমাকে এখনো ভালোবাসোনা?’ ‘আমি তানহাকে ভালোবাসি।’ ‘তাহলে কেন আমি বলা মাত্র ছুঁটে আসো?’ ‘তুমি বলেছো তুমি বিপদে আছো তাই তোমাকে সাহায্য করেছি। এর মানে এটা না যে আমি তোমাকে এখনো ভালোবাসি। হ্যাঁ একটা সময় তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসতাম তবে তুমি সেই ভালোবাসাকে অবহেলা করেছো।’ ‘তুমি কি তাহলে সেই অবহেলার প্রতিশোধ নিচ্ছো আজ আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে?’ ‘না তা না। ফিরিয়ে দিচ্ছি কারন আজ আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। এবং সেও আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে।’

মাহিমা দু’হাতে শাহিনুরের হাত শক্ত করে ধরেছে। মাহিমার দু’চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। শাহিনুর নিজের হাত ছাড়ানোর যতো চেষ্টা করছে মাহিমা ততো শক্ত করে শাহিনুরের হাত চেপে ধরছে। মাহিমার চোখে মুখে আকুতি। শাহিনুর চেষ্টা করেও খারাপ ব্যবহার করতে পারছেনা। মাহিমার মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হচ্ছে। মাহিমাকে শান্ত করার জন্য শাহিনুর বলল, ‘আচ্ছা তুমি একটু শান্ত হও। আমরা আগে কথা বলি। তারপর দেখা যাবে।’

অনেকক্ষণ আগে শাহিনুর অফিস থেকে ফিরেছে। চেয়ারে বসে তখন থেকেই আনমনে কি যেন ভাবছে। কাপড় ও পাল্টেনি। তানহা শাহিনুরের সামনে এসে দাঁড়ালো। শাহিনুর মুখ তুলে তানহার দিকে তাকালো। তানহা বলল, ‘তুমি কি কিছু বলতে চাও?’ তানহার প্রশ্নে অবাক হয়ে শাহিনুর বলল, ‘মানে?’‘আমারমনে হচ্ছে তোমার কিছু কথা আমাকে জানানো উচিত যা কিছুদিন যাবদ তুমি আমার কাছে লুকাচ্ছো।’
‘আমি কি লুকাচ্ছি?’

‘তুমি জানোনা তুমি কি লুকাচ্ছো? আচ্ছা আমি বলছি। যে মেয়েটা আজ তোমার অফিসে এসেছিলো সে মেয়েটাই কি রাতে তোমার সাথে দেখা করতে আসে?’ ‘তোমাকে কে বলল?’ ‘যেই বলুন নিশ্চই মিথ্যা কিছু বলেনি। আমি তোমার মুখ থেকেই সব শুনতে চাই। মেয়েটা কে?’ ‘আমার প্রথম স্ত্রী মাহিমা।’ ‘ও আচ্ছা। কিন্তু তুমি না বলেছিলে তার সাথে সাত বছর যাবদ তোমার কোন যোগাযোগ নেই।’ জানিনা কিভাবে সে আমার ফোন নাম্বার, বাসার ঠিকানা যোগার করেছে। আমাকে ফোন দিয়ে বলছিলো সে একটা বিপদে পড়েছে। তার কিছু টাকা লাগবে। আমি শুধুমাত্র তাকে সাহায্য করতে চেয়েছি।’ ‘তাহলে সে কনের সাজে তোমার অফিসে কি করছিলো?’ ‘সে চায় আমি তাকে বিয়ে করি।’ ‘শুধু সে চায় নাকি সেটা তোমারো চাওয়া? আমি কি তাহলে তোমাদের পথের কাটা? যদি তাই হয় তাহলে বলে দাও। আমি সরে যাবো তোমাদের দু’জনের মাঝ থেকে।’

কথাগুলো বলার সময় এক ধরনের চাপা কষ্টে তানহার গলা ধরে আসে। যা শাহিনুরের দৃষ্টি এড়াতে পারেনা। শাহিনুর চেয়ার থেকে উঠে তানহার হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসালো। গ্লাসে পানি ঢেলে তাহনার হাতে দিলো। চেয়ার টেনে তানহান মুখোমুখি বসলো। শাহিনুর তানহার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাকে শুরু থেকেই সব বলি। আমরা তখন ভার্সিটিতে পড়ি। আমরা মানে আমি আর মাহিমা। মাহিমা ভার্সিটির বিভিন্ন প্রোগ্রামে নাচ করতো, থিয়েটার করতো। আমাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্কটা বেশ গভীর ছিলো। দু’জনের গ্রাজুয়েশন শেষ হবার পরে পরিবারের অনুমতিতেই আমরা বিয়ে করি। আমি চাকরি করতাম। মাহিমা ঘর সামলাতো। খুব ভালোভাবেই কাটছিলো আমাদের সংসার। কিন্তু বছর খানেক পার না হতেই মাহিমা বলতে শুরু করলো তার একা একা বাসায় ভালো লাগেনা। আর ঘর সামলানোর জন্য তো সে গ্রাজুয়েশন করেনি।

তাই সে চাকরি করতে চায়। প্রথমে আমি রাজি ছিলাম না। কেননা দুজনে যদি চাকরি করি তাহলে সংসার দেখবে কে? তবুও মাহিমার ইচ্ছার কথা চিন্তা করে তাকে চাকরি করার অনুমতি দিলাম। কিন্তু মাহিমা সেই ভার্সিটি লাইফের মতো নাচ, থিয়েটার করতে শুরু করলো। একদিন অফিস থেকে আসার সময় একটা ম্যাগাজিনে দেখি মাহিমার ছবি। যখন মাহিমাকে নিষেধ করলাম সে বললো আমার ম্যান্টালিটি নিচু। তাকে বলেছিলাম, ‘শরীর দেখিয়ে খ্যাতি আর টাকা উপার্জন কি খুব উচু মানের মানসিকতার পরিচয়?’ মাহিমা সেদিন আমার প্রশ্নের জবাব দেয়নি। যতো সময় যেতে লাগলো আমাদের মাঝে তিক্ততা বাড়তেই থাকলো। একসময় মাহিমাকে বললাম, হয় এসব ছেড়ে দিতে না হয় আমাকে ছেড়ে দিতে। মাহিমা সেদিন তার খ্যাতি বেঁছে নিয়েছিলো। আমাদের ডিভোর্সের পরে আর কখনো সামনা সামনি দেখা হয়নি। তবে মাঝে মাঝে পত্রিকার পাতায় তার দেখা পেয়ে যেতাম। ওই ঘরে একটা তালা বন্ধ ট্রাঙ্ক আছে। সেটার ভেতরে সব পেপার কাটিং পাবে। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো।

মাঝে মাঝে মাহিমাকে ফোন করে ফিরে আসতে বলতাম। কিন্তু সে ফিরে আসেনি। তারপর একসময় একাকিত্ব উপভোগ করতে শুরু করলাম। তারপর আমার জীবনে তুমি আসলে। নতুন করে ভালোবাসতে শেখালে। ওদিকে এই কয়েক বছরে মাহিমার ক্যারিয়ারে দ্রুত উথান হয়েছে আবার পতন হয়েছে। সারাদিন কাজ করে মাহিমা বাসায় ফিরে এক ধরণের ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করে। মানুষ নানান কুপ্রস্তাব দেয়। খারাপ চোখে তাকায়। ডিপ্রেশন কাটাতে মাহিমা নেশা করা শুরু করে। একটা সময় আসে যখন মাহিমার শরীর থেকে যৌবন হারাতে শুরু করে। তার চাহিদাও কমতে শুরু করে। কাজ নেই, টাকা নেই। সেজন্যই মাহিমা আমার কাছে এসেছে টাকার জন্য। একটা মানুষের সাথে জীবনের এতোগুলো বছর কাটিয়েছি তার বিপদে পাশে না দাঁড়িয়ে পারি বলো?’

‘তুমি বললে মাহিমা আপু তোমাকে বিয়ে করতে চায়। এখন কি করবে?’ ‘আসলে সে আমাকে ভালোবাসতে পারেনি। নাহলে ছেড়ে যেতে পারতোনা। ভালোবাসলে ছেড়ে গেলেও ফিরে আসতো, কিন্তু আসেনি। আজ সে বড় একা হয়ে পড়েছে তাই তার একজন মানুষ দরকার। আমি শুধু এটুকু জানি আমি সেই মানুষ নই। আজ তার একটা ব্রাইডাল ফটোশুট হচ্ছিলো। সেখান থেকে সোজা সে আমার অফিসে এসেছে। তাকে বুঝিয়ে বাসায় পাঠিয়েছি। ভাবছি মাহিমার বাবা মাকে সবকিছু জানাবো। একমাত্র তারাই এই মুহূর্তে মাহিমার পাশে দাঁড়াতে পারেন।’

তানহা শাহিনুরের জন্য চা করে নিয়ে এসেছে। শাহিনুরের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে অন্য হাত থেকে সিগারেট নিয়ে সিগারেটটা জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। শাহিনুর বলল, ‘কি হলো সিগারেটটা ফেললে কেন?’ তানহা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘দেখছো যে বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে। কতোবার বারন করেছি ঘরে সিগারেট না খেতে।’ তানহা দু’দিন পর পর সিগারেটের জন্য শাহিনুরকে বকাবকি করে। শাহিনুর ইচ্ছে করেই ঘরে সিগারেট জ্বালায় যাতে তানহা এসে সিগারেটটা কেড়ে নিয়ে একটু বকাবকি করে। শাহিনুর এ সময় তানহার দিকে তাকিয়ে হাসে। এতে করে তানহা আরো বেশি রেগে যায়। তাদের খুনসুটি এভাবে চলতেই থাকে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত