বেলা একটা। টিএসসিতে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে ফোন এল। সাধারণত আমার ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তাই বেশির ভাগ ফোনকলই আমি রিসিভ করি না। কে ফোন করেছে দেখার জন্য স্ক্রিনে তাকালাম। দেখলাম লেখা ‘ভেজাল’। এই নামে যার নম্বর সেভ করা, একান্ত বাধ্য না হলে সাধারণত আমি তার ফোন ধরি না। এখনো ধরতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সে অনবরত ফোন করেই যাচ্ছে। সম্ভবত সেও ঠিক করেছে ফোন না ধরা পর্যন্ত সে থামবে না। ১৩ বার কল করার পর ১৪ বারের সময় ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ফোন রিসিভ করলাম।
: ওই কুত্তা, তুই ফোন ধরোস না কেন?
: প্লিজ, কুত্তা বলবা না, গায়ে লাগে। যদি একান্তই গালি দিতে মন চায়, তাহলে বড়জোর কুকুর বলতে পারো।
: কথা প্যাঁচাবি না। আগে বল, তুই ফোন ধরছিস না কেন?
: এই তো ধরলাম।
: শোন, তোকে আমি এ পর্যন্ত প্রায় এক লক্ষবার ফোন করেছি।
: মিথ্যে বলবা না। এ পর্যন্ত মাত্র ১৩ বার ফোন করেছ। ১৪ বারের মাথায় আমি ফোন রিসিভ করেছি।
: ও তাই! তা হলে এক কাজ কর, তুই ফোন রাখ। আমি আরও ৯৯ হাজার ৯৮৬ বার ফোন করি, তারপর ধরিস।
: ঠিক আছে, তোমার যখন ইচ্ছে তো তাই করো।
বলেই ফোনের লাইন কেটে দিলাম। আমি জানি এই ভেজাল এখন অনবরত ফোন করেই যাবে। আমি পকেট থেকে কাগজ–কলম বের করলাম কল গণনা করার জন্য। ঠিক করলাম আরও ৯৯ হাজার ৯৮৬ বার ফোন করার পরই ফোন রিসিভ করব। কিন্তু ৩৮ বার ফোন করার পর আর ফোন এল না। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। প্রায় পাঁচ মিনিট পরে আবার ফোন এল। তবে এবার ভেজাল না, এবার স্ক্রিনে লেখা ‘হিটলার’। এখন আর কোনো উপায় নেই, ফোন ধরতেই হবে। না হলে আমার গৃহহারা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। উনি আমার বাবা। তাকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি এবং সেই সঙ্গে যমের মতো ভয় পাই। আমার মতে, তিনিই পৃথিবীর সবচেয়ে একরোখা আর রাগী ব্যক্তি। যার কারণে তাঁকে আমি হিটলার নামে ডাকি। অবশ্যই তা মনে মনে। উনি সব সময় আমার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কথা বলেন। কোনো বাক্যই সম্পূর্ণ করে বলেন না। আমিও সব সময় তাঁর সঙ্গে এক কথায় উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি।
: কোথায়?
: টিএসসিতে।
: ব্যস্ত?
: জি, না।
: সেতুর ফোন ধরছ না কেন?
: সরি।
: ফোন দাও। বলেই কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লাইন কেটে দিলেন।এখন আর দেরি করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গেই ভেজালকে ফোন দিলাম। এক রিং হতেই ফোন রিসিভ করল।
: ওই কুকুর, তুই আমার ফোন কাটলি কেন?
: ধন্যবাদ কুত্তা না বলার জন্য।
: তুই আমার ফোন কাটলি ক্যান?
: তুমিই না বললে, তুমি আরও ৯৯ হাজার ৯৮৬ বার ফোন করবা।
: তুই কি আমার সাথে ফাজলামি করোস?
: অবশ্যই না। তুমি কি আমার ভাবি, যে তোমার সাথে ফাজলামি করব?
: শোন, তোকে আমি ১০ মিনিট সময় দিলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে তুই বাসায় আসবি।
: সম্ভব না।
: না হলে আমি কিন্তু আত্মহত্যা করব।
: তোমার যা খুশি করো। আমি আসছি না।
: আমি কিন্তু সিরিয়াস।
: আমিও সিরিয়াস। আচ্ছা তোমার বাসায় কি দড়ি আছে?
: না।
: বিষ আছে?
: না।
: ঘুমের বড়ি আছে?
: না। তুই এই সব ফালতু প্রশ্ন কেন করছিস?
: চিৎকার কোরো না। তুমি আত্মহত্যার ব্যাপারে কতটুকু সিরিয়াস সেটা বোঝার চেষ্টা করছি।
: তাই? তা কী বুঝলি?
: বুঝলাম, তুমি আত্মহত্যার ব্যাপারে একদমই সিরিয়াস না। সিরিয়াস হলে এগুলো বাসায় এনে রাখতে। এগুলো ছাড়া আত্মহত্যা করা সম্ভব না।
: মনে রাখিস, আমার বাসায় কিন্তু বঁটি আছে।
: তোমার মতো একটা স্মার্ট মেয়ে বঁটি দিয়ে আত্মহত্যা করবে, এটা কোনো কাজের কথা না। তুমি বরং তোমার বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে লাফ দাও। এর মধ্যে তবুও কিছুটা আধুনিকতা আছে।
: ঠিক আছে তাই করব। ছাদ থেকেই লাফ দেব।
: গুডলাক।
: তার মানে তুই আসবি না?
: তুমি তো আত্মহত্যাই করছ, তা হলে আর এসে লাভ কী?
: ঠিক আছে, আমি বাবাকে বলছি।
: আচ্ছা শোনো, তুমি কি এ জন্মে আর ভালো হবে না। আমি এখন টিএসসিতে। ১০ মিনিটের মধ্যে কীভাবে উত্তরা আসব?
: তুই এখনই রওনা দে। ট্যাক্সি নে, দরকার হলে হেলিকপ্টার নে।
: আচ্ছা আসছি। দুলাভাই কোথায়।
: আমার ধারণা, ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে এখন লুঙ্গি পরে ট্রেডমিলে দৌড়াচ্ছে।
সেতু আমার বড় আপু। অসাধারণ সুন্দরী। তার সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। যেকোনো ব্যাপারেই সে সবাইকে আত্মহত্যার হুমকি দেবে। যে কারণে তাকে আমি মনে মনে ভেজাল নামেই ডাকি। তবে সে আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। আপুর স্বামী একজন অসাধারণ ভালো মানুষ। উনি সরকারি চাকরি করেন। তাঁরা দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দুদিন পরপর তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কঠিন ঝগড়া লেগে যায়। আপুর ছয় বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে আছে। ওর নাম রুম্পা। আপুর বাসায় তিন ঘণ্টা পর পৌঁছলাম। দরজা খুলে দিল শিউলি। সে এ বাসায় কাজ করে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরের রুম থেকে কাচের জিনিস ভাঙার শব্দ পেলাম।
: শিউলি, কেমন আছ?
: ভাইজান, আমি কেমুন আছি, সেটা কোনো বিষয় না। এদিকে বিশাল যুদ্ধ লাইগা গেছে। আফায় কইছে আমাগো স্যারে নাকি পাগল হইয়া গেছে।
: তাই নাকি?
: জি ভাইজান। সকাল থেকে সে লুঙ্গি পইরা নাচতাছে আর মেশিনে দৌড়াইতাছে। আমার মনে কয় যেকোনো সময় সে ল্যাংটা হইয়া দৌড় দিব।
: নাউজুবিল্লা। বলো কী! এটা তো শরমের ব্যাপার।
: জি ভাইজান, বহুত শরমের ব্যাপার। একটা মানুষ ল্যাংটা হইয়া দৌড় দিবো, আর সেটা আমাগো দেখতে হইবো।ভাবতেই শরম লাগতাছে।কিন্তু কিৎছু করার নাই।
: শরম লাগলে চোখ বন্ধ রাখবা।দেখার কি দরকার।
: এটা কি কইলেন ভাইজান, চোখ বন্ধ রাখবো কি জন্য ? আল্লাহ কষ্ট কইরা এই চোখ বানাইছে কি জইন্য ? সব কিছু প্রাণ ভইরা দেখার জইন্য।
: তাহলে আর শরম করে লাভ নাই।তোমার স্যারে যখন লেংটা হয়ে দৌঁড় দেবে তখন প্রাণ ভরে দেখো।তা তোমার স্যারে এখন কোথায়?
: স্যারে এখন আপার ভয়ে বেডরুমের দরজা বন্ধ কইরা বইসা আছে। আর আপায় কাচের জিনিসপত্র নিয়া বাইরে বইসা আছে। যখনই স্যারে দরজা খুইলা মাথা বাইর করে, তখনই আপায় স্যারের মাথা নিশানা কইরা একটা কাচের জিনিস ছুইড়া মারে।
: তাই নাকি? তা একবারও কি মাথায় লাগাতে পারছে?
: না, একবারও লাগাইতে পারে নাই। তয় আপায় চেষ্টা করতাছে। ইনশা আল্লাহ কামিয়াব হইবো।
: অবশ্যই হবে। আমার বোন বলে কথা।
: তয় আমাগো স্যারেও কিন্তু বিশাল জ্ঞানী মানুষ।
: তাই নাকি? কীভাবে বুঝলে।
: কারণ, স্যারে ইন্দুরের মতো একটু কইরা মাথা বাইর করে। আর আপা কিছু মারার সাথে সাথেই স্যারে টুক কইরা মাথা ভিতরে ঢুকাইয়া দরজা বন্ধ কইরা দেয়। কিন্তু সমস্যা হইতাছে এদিকে এই করতে করতে আপায় সব জিনিসপত্র ভাইঙ্গা ফেলতাছে।
: এটা কোনো সমস্যাই না। তুমি জানো বিভিন্ন কোম্পানি প্রতিদিন কত কত থালা–বাটি বানাচ্ছে। না ভাঙলে এগুলো কিনবে কে? কোম্পানি তো বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি তো থেমে যাবে।
: ভাইজান, এটা তো একটা দামি কথা বলছেন। তয় আমিও কি কয়েকটা ভাঙুম?
: তোমার কি খুব ভাঙতে ইচ্ছে হচ্ছে?
: জি ভাইজান। খুবই ইচ্ছা হইতাছে।
: ইচ্ছে হলে অবশ্যই ভাঙবে। জীবনে কোনো সাধ অপূর্ণ রাখতে নাই। শিউলি ড্রয়িংরুমের টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানিটা হাতে নিল। তারপর বিসমিল্লাহ বলে ফ্লোরের ওপর আছাড় মারল।
: ভাইজান কয়টা ভাঙুম?
: তোমার কি আরও ভাঙতে ইচ্ছে করছে?
: জি ভাইজান, খুবই মজা পাইছি।
: আচ্ছা ভাঙো, যতক্ষণ মন চায় ভাঙো। যেভাবেই হোক দেশের অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিতেই হবে। শিউলি এবার একটা শো পিস নিয়ে ফ্লোরে আছাড় মারল। ড্রয়িংরুমের ভাঙাভাঙির আওয়াজের কারণে ভেতরের রুম থেকে আপা আর আপার পিচ্চিটা দৌড়ে এল।
: ঘটনা কী? এগুলো কে ভাঙল? আপা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
: আমি ভাঙছি। শিউলি উত্তর দিল।
: কেন! তুই এসব ভাঙলি কেন?
: দেশের ভালোর জন্য। না হলে অরতোনীতি থাইমা যাইব।
: মানে কী? বুঝলাম না। আপা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
: মানে বোঝার দরকার নাই। তুমি একা একা কষ্ট করে ভাঙছো, তাই ও তোমাকে সাহায্য করছে। আমি উত্তর দিলাম।
: ভেরি গুড। আরও ভাঙ শিউলি। ওই মিচকা শয়তানরে আজ আমি ফকির বানাইয়া ছাড়ব।
: খবরদার, আমার বাবাকে শয়তান বলবে না। মামা জানো, মা বলেছে বাবা নাকি পাগল হয়ে গেছে। রুম্পা কান্না কান্না কণ্ঠে বলল।
: তাই নাকি? তা তুমি কাঁদছ কেন? এটা তো আনন্দের সংবাদ। ভালো বাবা তো সবারই থাকে। পাগল বাবা তো সবার থাকে না। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত। কারণ, তুমি একটা পাগল বাবা পাচ্ছ।
: না, আমি পাগল বাবা চাই না। বলেই রুম্পা কাঁদতে কাঁদতে ওর রুমে চলে গেল।
: আপা, কাহিনি কী?
: কাহিনি খুবই ভয়াবহ। শোন, আমার ধারণা তোর দুলাভাই পাগল হয়ে গেছে।
: কীভাবে বুঝলে?
: সে আজকাল উদ্ভট আচরণ করছে। আর উদ্ভট ভাষায় কথা বলছে। মানে কী?
: জানি না। মনে হয়ে মাথায় ওয়ারিংয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে। সে এখন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে।
: সমস্যা কী? আঞ্চলিক ভাষা তো ভালো। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে।
: আরে, সেটা তো সমস্যা না। যেকোনো একটা ভাষায় কথা বলুক। কিন্তু সে তো কথা বলছে জগাখিচুড়ি ভাষায়। বরিশাল, ঢাকা, নোয়াখালী, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ সব মিলায়ে বলছে।
: তাই নাকি?
: ধর হয়তো একটি বাক্য শুরু করবে বরিশাল দিয়ে, শেষ করবে ময়মনসিংহ গিয়ে। হয়তো বলবে, মনু, তুই ভাত খাইসোইন? ক কেমন লাগে?
: তাই নাকি! এটা তো দারুণ ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার।
: শোন, গতকাল আমার এক বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল। এ অনুষ্ঠানে গিয়ে সে আমার বান্ধবীর বাবাকে দেখে বলে, মামুর ব্যাটা, কেমন আছ বে?
: মাইগড বলো কী! এ তো দেখি ভয়াবহ অবস্থা।
: শোন তোরে তো আসল কথাই এখনো বলা হয়নি।
: কী কথা?
: শোন, কাল ওই অনুষ্ঠানে ওদের একটা পর্ব ছিল গান, কবিতা, নাচ। যে যেটায় এক্সপার্ট সেটা করবে। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই সে হাত তুলল। কারণ কী? সে নাকি গান গাইবে। শুধু গানই না, সে ওই গানের সঙ্গে আবার নাচবে। যে ব্যাটা জীবনে একটা গান শোনে না, টিভিতে টক শো আর খবর ছাড়া কোনো অনুষ্ঠানও দেখে না, সে গাইবে গান আবার নাচও। মাহফুজুর রহমানও এর থেকে ভালো গান গায়। আর তার চেয়েও বড় কথা, যে গান গাইল, তা তুই কল্পনাও করতে পারবি না। মানুষের রুচি এতটা খারাপ হয় কী করে?
: কী গান? বেদের মেয়ে জোছনা?
: আরে না, ওটা হলেও তো কথা ছিল। সে গাইল মাই নেম ইজ শিলা, শিলা কি জাওয়ানি…।
: বলো কী! এটা তো মেয়েদের গান।
: তাহলে বোঝ। তুই জাস্ট কল্পনা কর, এত বড় এক দামড়া ব্যাটা ঘরভর্তি মানুষের সামনে কোমর দুলিয়ে, বুক ঝাঁকিয়ে বান্দরের মতো লাফায়ে লাফায়ে নাচছে আর গান গাইছে। আর উপস্থিত সবাই মুখ চেপে হাসছে। তুই জানিস সেই অনুষ্ঠান আবার ফেসবুকে লাইভ চলছিল। তুইও হাসছিস?
: আরে না, আমি হাসছি না। তুমি তো জানো, আমার চেহারাটাই হাসি মার্কা চেহারা।
: এবার সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটা শোন। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে আমি, তোর দুলাভাই, আমার বান্ধবী, তার বাবা একটি টেবিলের চারদিকে গোল হয়ে বসে চা খাচ্ছি। হঠাৎ সে নাক টেনে গন্ধ শুকতে শুরু করল। মুখ দেখে মনে হলো এখনই বমি করে দেবে। আমি বললাম কী হয়েছে তোমার? তুমি এমন করছ কেন? কী বলল শুনবি?
: কী বলল?
: বলে কী, আমার মনে হয় আমাদের মধ্যে কেও একজন পাদ দিয়েছে।
: নাউজুবিল্লা। কী বলছ তুমি।
এরপর সে নাক টেনে গন্ধ শুকতে শুকতে আমার বান্ধবীর বাবার দিকে ঝুঁকে বলল, চাচা মিয়া, আমার ধারণা এই বাজে কামডা আপনেই করছেন? তুই যদি আমার বান্ধবী আর তার বাবার বিব্রত চেহারা দেখতি। আমি লজ্জায় মারা যাচ্ছিলাম। বারবার আল্লাহকে বলছিলাম, আল্লাহ, তুমি মাটি ফাঁক করো আমি ঢুইকা যাই।
: তুমি ছিলা বিল্ডিংয়ের ভিতর, ওইখানে মাটি পাইবা কই।
: খবরদার, ইয়ার্কি করবি না।
: সরি। আচ্ছা এটা তো কালকের ঘটনা। কিন্তু আজকে ভেজাল লাগছে কেন?
: শোন, আজ রাতেও আমাদের একটি দাওয়াত আছে। খতনার দাওয়াত। আমি বলেছি, আমি তোমারে নিয়া আর কোনো অনুষ্ঠানে যাব না। কিন্তু সে যাবেই। শুধু তা–ই না, সে নাকি ওই অনুষ্ঠানে আজ আবার নাচবে গাইবে। তার জন্য সকাল থেকেই সে লুঙ্গি পরে নাচের রিহার্সাল করছে। আর সে নাকি আজ লুঙ্গি পরেই ওই অনুষ্ঠানে যাবে।
: লুঙ্গি পরে যাবে কেন?
: তার যুক্তি, প্রতিটা উৎসব বা অনুষ্ঠানের মতো খতনারও নাকি একটা ড্রেস কোড থাকা উচিত। আর যেহেতু খতনার পর লুঙ্গিই আরামদায়ক পোশাক। সে কারণে খতনা অনুষ্ঠানের ড্রেস কোড হবে লুঙ্গি।
: যুক্তিটা অবশ্য খারাপ দেয়নি।
: আর শোন, উনি আজ পুরো অনুষ্ঠানে অভিনয় করবেন ওনারও নাকি খতনা হয়েছে। এবং পুরো অনুষ্ঠানে উনি আজ লুঙ্গি ধরে আস্তে আস্তে হাঁটবেন। এভাবে নাকি যার খতনা হয়েছে, তাকে সহানুভূতি প্রদর্শন করবেন।
: আইডিয়াটা কিন্তু জোশ।
: শোন, সবকিছুতে তাল দিবি না।
: ঠিক আছে দেব না। তা দুলাভাই আজ কোন গানের সাথে নাচবেন? লুঙ্গি ড্যান্স, লুঙ্গি ড্যান্স…।
: না, কাটা লাগা…। কারণ খতনার সাথে নাকি কাটাকাটির সম্পর্ক। ভাইরে, আমি কনফার্ম ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার পক্ষে আর ওর সাথে থাকা সম্ভব না।
: তোমার কথা শুনে আমারও তাই মনে হচ্ছে। এক কাজ করো, তালাক দিয়ে দাও।
: ফালতু বুদ্ধি দিবি না। আমি ওরে তালাক দেই আর সে নাচতে নাচতে আর একটা বিয়ে করুক।
: তাহলে কী করবে?
: আমি ঠিক করেছি আত্মহত্যা করব। আর লিখে যাব আমার মৃত্যুর জন্য ওই ব্যাটাই দায়ী। যাতে সারা জীবন জেলেই পচে। তোরা শুধু আমার মেয়েটাকে দেখে রাখবি।
: রুম্পাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে আত্মহত্যা করতে পারো। তা কীভাবে আত্মহত্যা করবে কিছু ঠিক করছ?
: না, সেটা এখনো ঠিক করিনি।
: কোনো সমস্যা নাই। আমার কাছে জিনিস আছে। বলে একটি প্যাকেট আপুর হাতে দিলাম।
: কী এটা?
: ঘুমের বড়ি। এখানে ৫০টা আছে। এটা হচ্ছে সহজে ও আরামে আত্মহত্যার সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত উপায়।
: আচ্ছা তুই সব সময় মানুষরে উল্টাপাল্টা বুদ্ধি দিস কেন? তোরে কি আমি এটা আনতে বলছি?
: না, তা বলোনি। তবে ভাই হিসেবে আমার তো একটা দায়িত্ব আছে। তুমি সব সময় বলো আত্মহত্যা করবে তাই তোমার জন্য কিনে আনলাম।
: তার মানে তুইও চাস আমি আত্মহত্যা করি?
: অবশ্যই চাই। যার স্বামী পাগল, তার বেঁচে থেকে কী লাভ?
: ঠিক আছে, বল কয়টা খাব?
: খাবে যখন সবগুলোই খাবে। কারণ, তুমি মরলে বাকিগুলো কে খাবে? জিনিস নষ্ট করা ঠিক না। আচ্ছা আমি এখন যাই।
: যাবি মানে! তোরে আনছি আমার সমস্যা সমাধানের জন্য, আর তুই বলছিস যাই।
: সমস্যার সমাধান ঘুমের বড়ি তো দিয়েই গেলাম। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সব একসাথে খেয়ে ফেলবে। রাতের মধ্যেই সব ফিনিশ। সকালে এসে তোমার মেয়েকে নিয়ে যাব। আমি এখন যাই, আজ আমরা বন্ধুরা ঠিক করেছি,সবাই মিলে হলে গিয়ে একটা বাংলা সিনেমা দেখব। মানে কী! আমারে আত্মহত্যার বুদ্ধি দিয়ে তুই যাবি সিনেমা দেখতে? তোর কাছে সিনেমা দেখা বড় হলো! তোর বোন আত্মহত্যা করবে ,সেটা তোর কাছে কোনো বিষয় না।
: অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।তোমার মৃত্যুর পর সব কাজ তো আমাকেই করতে হবে। দাফন-কাফন, লাশ ধোয়া আরও কতো কিছু। আচ্ছা তোমার কবরে বাঁশ, নাকি চাটাই দিয়ে তারপর মাটি দেবো ? আর তোমার কবরের উপর কি গাছ লাগাবো ? লাউ গাছ নাকি বট গাছ ?
: হারামজাদা তোরে আমার খবর দেওয়াই ভুল হয়েছে। তুই আমার ভাই,কোথায় আমায় সাহায্য করবি,তা না।তোর ভাব দেখে মনে হচ্ছে পারলে তুই এখনই আমায় কবর দিয়ে আসবি।
: আচ্ছা বল, তোমার কি সাহায্য লাগবে ।
: তোর দুলাভাইয়ের সাথে কথা বল। দেখ ও কেন এমন করছে।
: অসম্ভব। পাগলের সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে আমার নাই। আমি শতভাগ শিওর, ভিতরে যেয়ে দেখব সে লেংটা হয়ে ট্রেডমিলে দৌড়াচ্ছে।
: এসব কী বলছিস! সে ল্যাংটা হয়ে দৌড়াবে কেন?
: তা আমি কী করে বলব। এটা শিউলি আমাকে বলেছে। শোনো আপা, পাগলের বিশ্বাস নেই। ওদের পক্ষে সবই সম্ভব।
: খবরদার, আমার স্বামীর ব্যাপারে আজেবাজে কথা বলবি না।
: সরি আপা, যা সত্য তাই বলছি। মনকে শক্ত করো। আমার তো ধারণা, তার সামনে গেলে কামড়ও দিতে পারে।
: এটাও কি শিউলি বলেছে ?
: জি আপা । মেয়েটা অনেক বুদ্ধিমতী। দেখলাম বড় আপু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
: আচ্ছা ঠিক আছে যাচ্ছি, এভাবে তাকিও না।
: ভাইজান ধরেন, এই লাঠিটা সাথে রাখেন। পাগলের তো মতিগতির ঠিক নাই। কখন কী কইরা বসে। বলে শিউলি একটা লাঠি এগিয়ে দিল।
: ধন্যবাদ শিউলি।
বলে লাঠিটা হাতে নিলাম।
: ভাইজান, ভয় পাইয়েন না। সাহায্য লাগলে বইলেন, আমি বঁটি নিয়া বাইরে দাঁড়াইতেছি।
লাঠিটা হাতে নিয়ে বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। অনেক আশ্বাসের পর দুলাভাই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে দিল। আমি চোখ বন্ধ করে ভেতরে ঢুকলাম।
: কী ব্যাপার, তুমি চোখ বন্ধ করে আছ কেন?
: ভাই, আপনি আগে কাপড় পরেন। তারপর চোখ খুলব। একটা বয়স্ক মানুষ ল্যাংটা হয়ে ঘুরছে, বিষয়টা দেখতে চাচ্ছি না।
: মানে কী! আমি ল্যাংটা হয়ে ঘুরব কেন! আমার কি মাথায় সমস্যা আছে?
: জি। আপনার স্ত্রী তো তা–ই বলল।
: ফাজলামি করবা না। চোখ খোলো। ভয়ে ভয়ে চোখ খুললাম। না ল্যাংটা না। কাপড় পরাই আছে।
: যাক বাঁচা গেল, আপনি ল্যাংটা না।
: তোমার হাতে লাঠি কেন?
: সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপনি কামড় দিতে আসলে আপনার মাথায় এটা দিয়ে বাড়ি মারব।
: মাই গড! তোমাদের ভাইবোন সবগুলার মাথায় তো দেখি সমস্যা। আগে জানলে এই পাগল ফ্যামিলিতে আমি বিয়েই করতাম না।
: কিন্তু আপা তো বলল আপনি পাগল হয়ে গেছেন।
: ওই মহিলার কথা আর বলবা না। সকাল থেকে আমারে দৌড়ের ওপর রাখছে। সারা দিন আমি বেডরুমে বন্দী, বের হতে পারছি না। বের হবার চেষ্টা করলেই কাচের জিনিস ছুড়ে মারছে। তাও আবার মাথা লক্ষ্য করে। কত বড় ডাকাত তুমি চিন্তা করো।
: সরি এখন চিন্তা করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আপনার সমস্যা কী? আপনি নাকি সব উদ্ভট আচরণ করছেন?
: শোনো, তোমারে বলি, আমি ঠিকই আছি। আমার কোনো সমস্যা নাই। আসলে আমি ভং ধরছি।
: কিন্তু কেন! অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
: তোমার বোনেরে ঠিক করার জন্য। আমার ধারণা, ঢাকা শহরের সব মানুষ তার পরিচিত। প্রতিদিন কারও না কারও বাসায় দাওয়াত লেগেই আছে। আমি তাকে বলি, সব দাওয়াতে যাওয়ার দরকার নাই। কিন্তু সে সব দাওয়াতেই যাবে। না যাওয়াটা নাকি অসামাজিকতা।
: ঠিকই তো বলছে।
: ভাইরে আমি সরকারি চাকরি করি। ঘুষ খাই না। এই বেতনে অত গিফট কেনা কি সম্ভব? এখন তোমার বোন যদি এসব দাওয়াতে যাওয়া বন্ধ না করে, তাহলে আমার ঘুষ খাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। কিন্তু আমি তো হারাম পয়সা ঘরে আনব না। আমার বউ–বাচ্চাকে হারাম পয়সা খাওয়াব না। তাই এই সব উদ্ভট আচরণ শুরু করছি। যাতে আমাকে নিয়ে কোথায়ও যেতে তার সংকোচ হয়।
: বুদ্ধি তো ভালোই বের করেছেন।
: এটা আমার উদ্ভাবিত পদ্ধতি। এই পদ্ধতির নাম দিয়েছি বউ সংশোধন পদ্ধতি।
: তা বুঝলাম। কিন্তু আপা যে বলল আজকের দাওয়াতে যেতে আপনারই নাকি আগ্রহ বেশি।
: আরে না। এটাই তো টেকনিক। আমার আগ্রহ বেশি দেখে যাতে সে না যায়। তবে আজ যদি সে খতনার দাওয়াতে যায়, তা হলে আমি আসলেই লুঙ্গি পরে ওই অনুষ্ঠানে যাব এবং লুঙ্গি পরেই নাচব। রিহার্সালও কমপ্লিট।
: গ্রেট আইডিয়া দুলাভাই, আমি আপনার সাথে আছি।
: নাচটা কেমন হয়েছে দেখবা?
: অবশ্যই দেখব।
দুলাভাই লুঙ্গিটাকে বুকের ওপর বাঁধলেন। এর ফলে লুঙ্গির নিচটা হাঁটু বারবার হলো। তারপর কাটা লাগা গান গাইতে গাইতে কোমর দুলিয়ে, শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে যে নাচটা করলেন, তা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে দেখানো সম্ভব না। আমি অবাক হয়ে নাচটা দেখলাম।
: বলো, নাচ কেমন লাগল!
: তার আগে বলেন, এই নাচের কোরিওগ্রাফার কে?
: আমি। কেন ভালো হয়নি?
: দুলাভাই, সত্য করে বলেন তো আপনার চৌদ্দগুষ্টির কেউ কি বাইজি ছিল?
: ছি, এগুলা কী বলো।
: না মানে আপনার নাচ দেখে তাই মনে হলো। আমি শিওর, আজ যদি আপনি এই নাচ ওখানে দিতে পারেন, আপা লজ্জায় জীবনে ঘর থেকেই বের হবে না।
: সত্যি বলছ। আমার নাচ এত ভালো হয়েছে?
: আমার জীবনে আমি এমন অশ্লীল নাচ আর দেখি নাই। আমারও এখন এই নাচ শিখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
: সত্যি! তুমি শিখতে চাও?
: নাচটা শিখতে পারলে ভালো হয়। আমার বিয়ের পর আমার বউরে সাইজ করতে ব্যবহার করা যাবে। দেন একটা লুঙ্গি দেন, একটু প্র্যাকটিস করি আপনার সাথে।
দুজনে একই স্টাইলে লুঙ্গি পরলাম। ক্যাসেট প্লেয়ারে কাটা লাগা গানটি ছাড়লাম। তারপর ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে তাকিয়ে শালা–দুলাভাই মিলে শরীর মোচড়ায়ে মোচড়ায়ে নাচতে লাগলাম। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য।