ফিরে দেখা

ফিরে দেখা

– অনেকদিন পর দেখা। তাই না? (মায়া)
– হ্যাঁ অনেক দিন পর। বারো বছর দুই মাস আঠারো দিন। (নিলয়)
– দিনটা মনে নেই? যাইহোক তা কেমন আছো?
– চলছে দিনকাল। তোমার?
– আমারো তাই। তুমি এই শহরেই আছো জানতাম না।
– মাস্টার্স শেষ করে নিজ শহরেই চলে এসেছি।

– কেন? ভালো ছাত্র ছিলে, ভালো জব করতে পারতে।
– ইচ্ছে করে নি সেই শহরে থাকার।
– বলতে পারতে তুমি এখানে আছো।
– দরকার ছিল না। তাই বলি নি।
– ওহহ্… তার মানে তুমি জানতে আমি এখানে থাকি?
– চোঁখে তো তোমার এখন মোটা ফ্রেমের চশমা!
– বলতে পারো সেটা।
– এখন চশমা পরতে আর বিরক্ত লাগে না?
– বিরক্ত আর লাগে না। কাছের জিনিসটা দেখতে সমস্যা হয়।
– অনেকটা বদলে গিয়েছো। চুলে পাক ধরেছে। চোঁখে চশমা লাগিয়েছো। আবার পাঞ্জাবি পড়া ধরেছো।
– তুমিও তো বদলে গিয়েছো।
– যেমন?
– আগে থ্রীপিছ পরতে আর এখন শাড়ী।
– তাই না?

– হুম। তবে আগের মতোই এখনো মায়াবতীই আছো।
– আচ্ছা বাদ দাও এইসব। তা তোমার খবর কি?
– এইতো চলছে। তোমার?
– চলছে স্বামী সন্তান নিয়ে। আর তোমার?
– চলছে ভালোই। বেশ দিন যাচ্ছে।
– বিয়ে করো নি?
– নাহ্। ইচ্ছে করে নি করার। কাওকে ভালোবাসতে পারি নি।
– কেন?
– এমনি।
– তাহলে তোমার মোবাইল ফোনের স্ক্রীনে তোমার সাথে এই ছেলেটা কে?
– বছর নয়েক আগে ফুটপাতে ওকে পেয়েছিলাম। তখন থেকে আমার সাথেই আছে।
– ঠিক আছে আজকে উঠি। মেয়েকে কোচিং থেকে আনতে হবে।
– কিসে পড়ে তোমার মেয়ে?
– এবার পঞ্চম শ্রেণীতে উঠলো। নীলা, এইযে এটা আমার মেয়ে। সুন্দর না? (মোবাইল ফোনের একটা ছবি দেখিয়ে বললো)

– হুম।
– তোমার পছন্দের নাম।
– ভালো। সবাই সুন্দর। তোমার মেয়ে, তোমার হ্যাজবেন্ড। পারফেক্ট ফ্যামেলী।
– আর আমি?
– তুমি? আচ্ছা তোমার হ্যাজবেন্ড কি করে?
– কেন জানো না?
– ভুলে গিয়েছি।
– সরকারী অফিসার। আর তুমি?
– করি ছোট খাটো একটা ব্যাবসা।
– আচ্ছা এখনো কি আমায় ভালোবাসো?
– আচ্ছা আজকে উঠি। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। (অনেক্ষন চুপ থেকে) ক্রিং ক্রিং (কলিংবেল বেজে উঠলো)…..

– ভাইজান আজ এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলেন? (নীল)
– হ্যাঁ রে। বাহিরে ঠান্ডা বেশ পড়েছে। (নিলয়)
– কই ঠান্ডা? এই গরমে আপনার ঠান্ডা লাগে?
– তো রাতে কি খাবেন? আজকে আমি রান্না করবো। (ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি রেখে)
– কেন? বুয়া আসে নি?
– না আজ আসে নি। আর ইচ্ছে হলো। প্রতিদিন তো আপনি না হলে সে রান্না করে। আজ না হয় আমিই করি।
– তুই পারবি? কোনদিন তোকে রান্না করতে দিয়েছি?
– মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে করতাম। আপনি যখন বাহিরে যেতেন কাজের জন্য তখন বুয়াকে আসতে মানা করে দিতাম।

– আজকে করা লাগবে না। আমি খেয়ে এসেছি।
– তাহলে ফ্রীজ থেকে খাবার গরম করে আমি খেয়ে নেই।
– দরকার নেই। আসার সময় তোর জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। টেবিলে আছে দেখ।
– ঠিক আছে।
– পড়তে বসছিলে?
– হুম বসেছিলাম।
– তোর না সামনে পরীক্ষা? ভালো করে পড়। ভালো কলেজে চান্স পাওয়া লাগবে। ভালো রেজাল্ট না করলে মোবাইল বন্ধ করে দিব।
– ঠিক আছে ভাইজান।

রাত এগারোটা বেজে আঠারো মিনিট। বিছানাতে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি। ঘুম ধরছে না। এতো বছরপর মায়ার সাথে দেখা না হলেই পারতো। সবই তো ভুলে গিয়েছিলাম। এগারোটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট, ছাঁদে আসলাম। আগের মতোই এখনো আকাশ দেখার স্বভাবটা বদলে নি। ছাদে রাখা কাঠের চেয়ারটাতে গাঁ টা এলিয়ে দিলাম আর চোঁখদুটো খোলা রেখে আকাশটা দেখছি। ধুমকেতু আকাশ থেকে ছিটকে পড়লো। বারো বছর আগে মায়া আমাকে বলেছিল আমার পক্ষে আর সম্পর্ক রাখা তার সম্ভব না। চোঁখটা বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। মনে পড়ছে কলেজ শেষে ভার্সিটি লাইফের কথা। প্রথম যেদিন মায়াকে দেখেছিলাম দিনটা ছিল বৃষ্টিমুখর। বৃষ্টিমুখর বললে ভুল হবে বর্ষার সময় ছিল। কালো রঙের শাড়ী পড়ে ছিল। বৃষ্টিতে কিছুটা কাক ভেজা হয়ে পড়েছিল মেয়েটা। শরীরের সাথে শাড়ীটা লেপটে ছিল। চোঁখের পাতায় আঁকা কালো কাজলটা ধুয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আশ্রয় হিসেবে নিয়েছিল বিশাল আকারের গাছের নিচে। অবশ্য আমি আগে থেকেই সেখানে দাড়িয়ে ছিলাম এক বন্ধুর অপেক্ষাতে। কেন জানি তাকে দেখে কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না।

– আপনি কিছু না মনে করলে একটা বলি?
– জ্বী বলেন। ( মেয়েটা কিছুটা অবাক হয়েই উত্তর দিয়েছিল)
– আমার কাছে ছাতা আছে। যদি কিছু না মনে করেন তাহলে আপনি ছাতাটা নিতে পারেন।
– আপনার কাছে ছাতা আছে তাহলে আপনি এই বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন?
– কোথায় ভিজছি? এখানে তো বৃষ্টির পানি পরছে না। আর আমি এখানে আমার এক বন্ধুর জন্য দাড়িয়ে আছি।
– আপনি নিতে পারেন। মেয়ে মানুষ এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে গেছেন এটা ভালো দেখায় না।
– ধন্যবাদ। (ছাতাটা নিয়ে)

কেমন মেয়ে ছাতাটা নিয়ে সোজা চলে গেল। একটা কথাও বললো না। আমি তার চলে যাওয়াটা দেখছিলাম। মনে হচ্ছিলো ভেজা পিচ ঢালা ছোট ছোট পাথরের রাস্তাতে কোন অপ্সরা যাচ্ছে। তবে নিজের কাছে তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো আমি যাবো কি করে? এর মাঝে আমারো ঠান্ডা লাগা লাগা ভাব। বন্ধুর কাছে ফোন দেওয়ায় সে বললো সে আসতে পারবে না। তাই আমিও পকেট থেকে পলেথিন বের করে মোবাইল, ঘড়ি আর ম্যানিব্যাগটা তার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে হাটা শুরু করলাম। তখনকার সময়ের মোবাইল বললে ভুল হবে। নোকিয়া বারোশো মডেলের সেট। তাও আবার কতগুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো। (কথাটা মনে পড়ে হাসতে থাকলো নীলয়)

আজ কয়েকদিন যাবৎ ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছে না। মৌসুমের শুরুর দিকের বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরটা ভালোই ঝাপটে ধরেছে। আজ জ্বর কিছুটা কম। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। তাই রওনা দিলাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। দশ মিনিট দেরী করেছি ক্লাসে আসতে। তাড়াহুড়ো করে বসে দেখি সেই মেয়েটা আমার পাশেই বসে আছে। বসে আছে বললে ভুল হবে আমিই তার পাশে এসে বসেছি। সে আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন সে আমাকে এর আগে কখনোই দেখে নি।

– আজ আকাশটা পরিষ্কার। চোঁখে কাজলটা দিলে বেশ লাগতো আপনাকে। (নিলয়)
– ছাতাটা সেদিন দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
– চিনতে পেরেছেন তাহলে?
– হ্যাঁ।
– তাহলে ক্লাসের সময় ওভাবে তাকিয়ে ছিলেন কেন?
– এমনি।
– আমি নিলয়। আপনি?
– নামটা জানা কি খুব দরকার?
– দেখলাম আপনি আমার সাথেই পড়েন। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
– ও আচ্ছা। আমি মায়া।
– মায়া! বেশ সুন্দর নাম। দেখতে অনেকটা মায়াবতীর মতো। (নিচু স্বরে বলে ফেলেছি)
– কিছু বললেন?
– নাতো। আচ্ছা বন্ধু হতে পারি?
– হলে তো সমস্যা নেই।

বন্ধুত্ব হয়েঝিল ঠিকই। কিন্তু বন্ধুত্বটা বেশি দিন ধরে রাখতে পারি নি। কারন মনের কথা মায়াকে বলেছিলাম অল্পতেই।

– মায়া তোকে একটা বলতে চাইছিলাম অনেক দিন ধরে। (নিলয়)
– হুম বল। (মায়া)
– মোবাইলে বলা সম্ভব না। কোথায় আছিস এখন?
– আমি তো এখনো বাসাতেই আছি।
– পার্কে আসতে পারবি?
– পার্কে? আচ্ছা তুই বস। আমি আসছি।
– ঠিক আছে। প্রায় ঘন্টা হয়ে গেল। এখনো তার আসার নাম নাই।

– সরি রে দেরী হয়ে গেল।
– হুম।
– বল কি বলবি।
– কথাটা কি করে বলি। আসলে অনেকদিন ধরে বলতে চাইছি। কিন্তু বলা হচ্ছে না।
– কি কথা বল।
– আচ্ছা তুই কি বুঝতে পারছিস না?
– আজব! না বললে বুঝবো কি করে?
– আসলে। আমি তোকে ভালোবাসি। (চোঁখ বুজে)
– তুই কি আমার বাকি জীবনটুকুর পথ চলার সঙ্গী হবি? (ভেবেছিলাম চড় থাপ্পড় দিবে। কিন্তু আমার ধারনা ভুল প্রমানিত করে সে উত্তর দিল)
– আরে বোকা তোর এই কথা বলতে এতোদিন লাগে?
– না আমি কখনো ভাবি নি তুই রাজি হবি।
– গাধা কথাকার।

ভালোই চলছে মায়া আর আমার সম্পর্ক। ভার্সিটি লাইফ শেষ হয়েছে অনেকদিন হলো। এই বছরখানেক তো হবেই। চাকুরীর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছি। বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থায় চাকুরী সোনার হরিণ। তবে সেই সোনার হরিণটা কিছু কাগজের নোট অথবা কাছের লোক না থাকলে পাওয়া যায় না। হঠাৎ সব চিন্তার মাঝে ছেদ ধরিয়ে ফোনটা বেজে ওঠলো। মায়া ফোন করেছে।

– হুম। (নিলয়)
– কোথায় আছো? (মায়া)
– কই আর থাকবো। আছি রুমে।
– দেখা করতে পারবে?
– এই বৃষ্টির দিনে দেখা করা খুব দরকার?
– হুম।
– ঠিক আছে। কই আসবো?
– যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল সেখানে।
– আরে বাহ্… ঠিক আছে আমি আসছি।

তৎক্ষণাৎ বেড়িয়ে পড়লাম ছেড়া স্যান্ডেলটা পায়ে দিয়ে। সেই জায়গাটাতে আসতে প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট লেগেছিল। দূর থেকে দেখি কেও একজন দাড়িয়ে আছে। একটু কাছে আসতেই দেখি অন্য কেও না, মায়া দাড়িয়ে আছে।

– আরে বাহ্ আজকে আমার আগেই এসে হাজির। কি ব্যাপার? (নিলয়)
-(মায়া চুপ করে দাড়িয়ে আছে)
– চুপ কেন? আচ্ছা আমি একটা বিষয় ভেবেছি।
– কি?
– চলো বিয়ে করে ফেলি।
– কই থাকবো? কি খবো?
– কই থাকবো মানে? এই গাছের নিচে। আর আলো বাতাস খাবো। পেট ভরে যাবে। (নিলয় উচ্চ স্বরে হেসে ওঠলো)
– তোমার বাড়িতে তো কেও নেই। তাই না?
– হুম। অল্প কিছু জমি আর কয়েকটা প্রাইভেট পড়াই চলে একপ্রকার। আচ্ছা তুমি তো এগুলো জানো। তাহলে হঠাৎ করে আবার জিজ্ঞেস করছো যে?

– তোমার বর্তমানটাকে মনে করাচ্ছি।
– মনে করে কি হবে? এরকম থাকবো নাকি? ব্যাগ থেকে একটা খাম হাতে ধরিয়ে দিল মায়া।
– এটা কিসের খাম? দেখেতো কারো বিয়ের কার্ড মনে হচ্ছে। ভালোই হলো অনেকদিন ভালো মন্দ কিছু খাওয়া হয় না। চলো আজকে পেট ভরে খেয়ে আসি।

– হুম। তবে আজকে না। এই সপ্তাহের শেষ দিনে।
– আচ্ছা বিয়েটা কার? তোমার কোন রিলেটিভের?
– কার্ডটা খুলে দেখ।
– হুম। ছেলে তো দেখছি ভালো জব করে। কিন্তু মেয়েটা (নামটা দেখে চুপ করে গেলাম। মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হলো না। অবাক দৃষ্টিতে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছি শুধু)
– তোমার সাথে আমার আর হবে না। ভালো থেকো। কর হ্যাঁ এসো কিন্তু। পেট ভরে খেয়ে যেয়ো। পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না, যদি সত্যি ভালোবেসে থাকো।

মায়া চলে যেতে লাগলো। পেছন থেকে ডাকলাম না। তার চলে যাওয়া দেখছি। হঠাৎ করে আবারো বৃষ্টি নামলো। মনে পড়ছে সেই দিনের কথা। সেই দিনটাও এমন বৃষ্টিস্নাত দিন ছিল। সেদিন প্রেমে পরে তাকিয়ে ছিলাম। আর আজকে তাকিয়ে আছি এক ব্যার্থতার ভেতর দিয়ে। আটকানোর চেষ্টা করি নি। শর্ত দিয়ে দিয়েছিল যদি ভালোবাসি তাহলে যেন না আটকাই। সত্যি ভালোবাসি যে তাকে। বাঁ পাশটা কেমন করে উঠলো হঠাৎ করে। তারপর আর মনে নাই।
হঠাৎ করে দেখি নীল ডাকছে।

– ভাইজান এতো রাতে ছাদের উপরে কি করছেন? নিচে চলেন, ঘুমান গিয়ে। রাত অনেক হয়েছে।
– ঘুম ধরছে নারে নীল। অতীত মনে পরছে খুব। শূন্যতা অনুভব করছি।
– কিসের শূন্যতা?
– তুই বুঝবি না। তুই যা, আমি যাচ্ছি।
– ভোর হতে চললো। চলেন তো নিচে। রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। দুপুরের দিকে ঘুম ভাঙ্গলো মোবাইলের আওয়াজে। দেখলাম অচেনা নাম্বার।
– কে? (নিলয়)
– কে মানে? আমি মায়া।
– কি?
– বিকেলে দেখা করো তো….

ফোন কেটে দিয়ে দিলাম। বড্ড হাসি পাচ্ছে। নাম্বারটা ব্ল্যাক লিস্টে দিয়ে দিলাম। ভাবতে থাকলাম অভাবে কিংবা বেকার থাকা খুব খারাপ। সেদিন এইদুটোই ছিল দেখে মায়া চলে গিয়েছিল কিছু না বলে। কিন্তু আজ, আজ আমি প্রতিষ্ঠিত।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত