প্রাক্তন

প্রাক্তন

কফি হাউজে বসে আছি। হাতের কফিটা অনেক আগেই শেষ। বাইরের পরিবেশটা দেখতে ভালোই লাগছে তাই এখনো বসে আছি। হঠাৎ সামনের ফার্মেসিতে অনেকদিন পরে তাকে আবার দেখে বুকের বামপাশটা কেমন যেন করে উঠল। অনুভুতিটা অন্যরকম। কিছুটা সুখের কিছুটা কষ্টের কিছুটা অপরাধবোধের। সব মিলিয়ে অন্যরকম একটা অনুভুতি। পরনের শাড়ির আচল দিয়ে বারবার কপালে জমে থাকা ঘাম মুছছে। ঠোটের কোণে সেই ভুবন ভোলানো হাসিটা আমাকে বারবার ওর দিকে তাকাতে বাধ্য করছে। সেও আমার দিকে তাকাল। প্রথমে তার দৃষ্টিতে কিছুটা বিষ্ময় প্রকাশ পেল। পরক্ষনেই ঠোটের কোনে আবারও আগের হাসিটা ফিরিয়ে এনে আমার দিকে এগিয়ে এল।আগের মত আর আমায় জরিয়ে না ধরে আমার সামনে বসতে বসতে বলল,
কেমন আছ আলিফ?

অনেকদিন পর তার ঐ কন্ঠস্বরে আবারও বুকের বামপাশে আগের অনুভুতিটা প্রবল বেগে নাড়া দিয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, দেখে কি মনে হচ্ছে। দেখে তো অনেক কিছুই মনে হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে জীবনে অনেক বড় কিছু হয়েছ তাই যে কেউ দেখলে তোমায় সুখিই বলবে কিন্তু আমি তো তোমার বাইরের ভালো লাগার কথা বলিনি আমি জানতে চাচ্ছি ভিতরের তুমি কেমন আছ। সেটা কি তুমি এখন আর বুঝতে পারবেনা? বোঝার চেষ্টা করলে অবশ্যই পারব কিন্তু আমি সেটা চাইছিনা। বিয়ে করেছ? ওর এ প্রশ্নের কি জবাব দেব ভেবে পাচ্ছিনা। মিথ্যা আমি ওকে বলতে পারবনা আর সত্যিটা জানলে ওর পরের প্রশ্নগুলোর কি জবাব দেব সেটাও বুঝতে পারছিনা। শেষে আর কিছু না ভেবে ছোট্ট করে শুধু বললাম,
নাহ।

আমাকে অবাক করে দিয়ে ও আর কোনো প্রশ্ন করলনা। ওয়েটারকে ডেকে দুকাপ কফি দিতে বলে আবারও আমার দিকে তাকালো। সে তাকানোর মাঝে কি ছিল আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। ওর চোখে অনেক খুজেও আমার প্রতি কোনো ঘৃণার মনোভাব পেলাম না। সেখানে আগের ভালোবাসা খুজতেও আমি ব্যার্থ হলাম। ও বোধহয় বুঝতে পারল। বলল, ঘৃণা আমি তোমাকে কোনোদিনও করতে পারবনা। তোমার প্রতি ভালোবাসাটা একচুলও কমেনি বরং তোমার প্রতি শ্রদ্ধাটা ভীষণ বেড়ে গেছে। আমার প্রতি ভালোবাসা না কমলে তোমার চোখে সেটা আর কেন খুজে পাচ্ছিনা আমি? কারণ সেটা অন্য কারো ভালোবাসার নিচে চাপা পরে গেছে। ওর এই কথায় অসহ্য এক ব্যাথার সৃষ্টি হলো আমার বুকে। কিছুক্ষণ করুন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। আমার অরু আজ অন্য কাউকে ভালোবাসে সেটা তো আমি কল্পনাও করতে পারিনা। ওয়েটার এসে কফি দিয়ে গেল। হালকা ফু দিয়ে ঠিক আগের ভঙ্গিমায় কফি খাচ্ছেও। খেতে খেতেই বলল, আজকের বিলটাও কিন্তু আমিই দিব।

আগে বাইরে ঘুরলে বা কোনো রেস্তোরায় এলে সমস্ত বিল ওই দিত। আমার সে সামর্থ ছিলনা বলেই দিত। কিন্তু আজ সে সামর্থ আমার হয়েছে তাই বললাম, সব বার তো তুমিই দাও আজ আমাকেই নাহয় দিতে দিলে। না থাক আজও আমিই দিব পুরোনো দিনের স্মৃতির সার্থেই দিতে চাইছি বারণ করনা। আমি কিছু বললাম না। ও আবারও আমার দিকে তাকালো। ওভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ও বলল, একবারও তো জানতে চাইলে না আমি কেমন আছি? কিভাবে চাইবো আমার মনে কি চলছে তুমি কি বুঝতে পারছ? হুম জানি সেদিন কাজী অফিসের সামনে যখন তোমার অপেক্ষায় কেউ দাড়িয়ে ছিল তখন তুমি যাওনি আজ তারই সামনে এভাবে বসে থাকতে অসস্তি হওয়ারই কথা বাট অনেস্টলি সেদিন না এসে ঠিকই করেছ।
লেইট মি এক্সপ্লেইন অরু।

আমি জানি তুমি কেন আসনি। তখন তোমার আমার দ্বায়িত্ব নেওয়ার মতো সামর্থ ছিলনা। আমার সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ নষ্ট করার ইচ্ছা হয়নি যা আদৌ তুমি আমাকে দিতে পারতে কিনা সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিত ছিলে না। তাই তোমার দোষ আমি দেবনা।  কিন্তু এখন তো আমার সেই সামর্থ আছে। এটা ভাবলেই খুব আফসোস হয় কেন একটু সময় চাইলাম না তোমার থেকে? আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তুমি সেদিন এলে হয়ত আমি আরেকজনকে আমার লাইফে পেতামনা যে আমাকে এত ভালোবাসে। যার কারণে আমি আজ সুখি।

সত্যিই তুমি সুখি? আমাকে দেখে বুঝতে পারছ না? তোমাকে বোঝার ক্ষমতা হয়তো আমি হারিয়ে ফেলেছি অরু। তাহলে তো আমার প্রতি ভালোবাসাটাও আর নেই। আছে বলেই তোমার জায়গাটা আজও কাউকে দিতে পারিনি। কিন্তু আমিতো তোমার জায়গাটা অনেক আগেই অন্য কাউকে দিয়ে বসে আছি। তাহলে তুমি কেন নয়? জানিনা তো।  দেখ আমি ভিষণ সুখে আছি কিন্তু আজ তোমাকে এভাবে দেখে সুখে থাকতে পারবো কিনা বুঝতে পারছি না। কেন? আমার বিরহে যদি এভাবে একা একা দিন কাটাও আমার খারাপ লাগবে। তুমি কি চাইছ নতুন করে সব শুরু করি? হুম নিজের জন্য না হলেও আমার জন্য শুরু করো। যাতে আমি নিশ্চিন্তে সংসার করতে পারি। ঠিকাছে তাই হবে।

তারপর দুজনেই চুপ। যাকে পাবার এক সুপ্ত আশা মনে নিয়ে চাকরি পাবার পর থেকে তাকে খুজে বেরিয়েছি আজ সে যখন আমাকে ছাড়া সুখে আছে আমি কেন পারব না। তবে একই শহরে থেকে আজ তিনবছর পরে তার সাথে আমার এই সাক্ষাত কি এজন্যই? হয়তো তাই। আমার সমস্ত দ্বিধা আজ এই এক সাক্ষাতেই সে শেষ করে দিল। জীবনটাকে নতুন করে সাজাতে পারবো কিনা জানিনা তবে আজ থেকে রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। কফির বিল সেই দিল। দিয়ে কিছু না বলে শুধু মিষ্টি করে হেসে উঠে পরল। উঠার সময় তার কোলে থাকা ব্যাগটিও উল্টে পরল। কিছু মেডিকেল রিপোর্ট পরে গেছে।

সে তারাতারি সেগুলো গুছিয়ে নিল। তারপর আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, এগুলো কিসের তুমি ঠিক আছ তো? কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আবারও ঠোট প্রসারিত করে বলল, আমি বেবী এক্সপেক্ট করছি ও এখনো জানেনা আজ গিয়ে ওকে সারপ্রাইস দিব। বলেই মুখটা নিচু করে নিল। ওর উজ্জল মুখটা না দেখলেও বুঝতে পারছিলাম ও কতটা খুশি আর এ খবর শোনার পর সেও কতটা খুশি হবে। হঠাৎই কেন জানিনা আমার মনেও এমন কিছু সুখ পাওয়ার প্রবল ইচ্ছাটা জেগে উঠল। ও মুখটা নিচু করেই বলল, তুমিও সুখি হবে কথা দাও। আমি শুধু বললাম, দিলাম।

আমার উত্তর শুনেই ও চলে যাচ্ছিল বললাম, আমরা কি বন্ধু হয়ে থাকতে পারিনা? ও বলল, না তোমার সাথে আমার এখন একটাই সম্পর্ক হতে পারে সেটা হলো তুমি আমার প্রাক্তন। বলে আর এক মুহুর্ত না দাড়িয়ে ও চলে গেল। অনেক দিন পর বুকের বামপাশটায় অনেক স্বস্তি অনুভব করলাম। ও আমার কথা মেনে যদি বন্ধুত্বটা রাখত তাহলে হয়ত পুরোনো অনুভুতিটা ফিরে আসত। কিন্তু ওর প্রাক্তন হয়ে আজ যে স্বস্তি অনুভব করছি তা হয়ত বন্ধু হয়ে পেতাম না। ওর জীবনে আমি প্রাক্তনের জায়গা অনেক আগেই পেয়েছি আজ ও নিজেকে আমার প্রাক্তন বানিয়ে চলে গেল।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত