মোরশেদ কাকার আজ আনন্দের সীমা নাই। তার সবচেয়ে ছোট মেয়ে নীতু আজ বি,সি,এস কেডার হয়েছে। অথচ নীতু জন্মের দিন কি হুলুস্থুল কান্ডই ঘটেছিল বাড়িতে। একই কারণে আমার আনন্দও হচ্ছে দুঃখও লাগছে। নীতু আমার থেকে সাত আট বছরের ছোট। আজ বি সি এস আর আমি চাকরির খোজে সুখতলা খোয়াই।
আসল ঘটনায় আসি। মোরশেদ কাকার ছয় মেয়ে। একটা ছেলের আশায় আশায় ছয় নম্বর মেয়ে নীতুকে জন্ম দেয়ার সময় প্রসব বেদনায় যতটা কষ্ট পেয়েছিলেন সেফালী কাকি তারচে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন উনার শাশুড়ী আর আশপাশের লোকজনদের কথায়। নীতুর দাদী সেদিন বলেছিল ‘এই অপয়া মাগী খালি ছেমড়ি বিয়ায়। পোলারে কত কইলাম আরেকটা বিয়া কর। এই মাগীরে ক্ষেদা। অপয়া মাগী। হুনলো আমার কথা? হুনলো না।
কথা গুলো আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেফালী কাকির কান্না সেদিন শুনতে না পাইনি তবে এখন বুঝি। আমাদের বাড়ি ছিল পাশাপাশি। পরে কাকা এখানে জমি কিনে বিশাল বাড়ি করেছেন। আগে সারাদিন থাকতাম এখন মাঝে মাঝে আসি। আগে খেলা করতাম মিলার সাথে এখন নীতুকে দেখতে আসি। আর মনে হয় তাও আসা হবে না।
মোরশেদ কাকার চার নম্বর মেয়ে ইলার বয়স তখন চার বছর। ইলা ভয়ে ভয়ে সেদিন কাকাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো ‘আব্বা আমরার খালি বইন হয়, এজন্য তোমার মন খারাপ? চার বছরের পুচকি মেয়ের এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে না দিয়ে মোরশেদ কাকা সেদিন ইলাকে জড়িয়ে ধরে কেদেছিলেন খুব। মেয়েদেরকে প্রচন্ড ভালবাসা সত্ত্বেও বৃদ্ধা মাকে বুঝাতে পারতেছিলেন না সন্তান আল্লাহর দান, এতে মানুষের কোন হাত নেই। মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছায় কিছুই আসে যায় না।
মোরশেদ কাকার মা খুব যে খারাপ প্রকৃতির মহিলা ছিলেন তাও না। মোটামুটি সরল সোজাও বলা চলে। আমাকে খুব আদর করতেন। উনার চিন্তা ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আর এই চিন্তাটা উনার মাথায় ঢুকিয়েছে আমাদের পাশের বাড়ির কায়েস ভাইয়ের মা। আমরা ডাকতাম খঞ্চুনী বুড়ি। নিজের তিন ছেলে নিয়ে তার বাহাদুরির কমতি ছিল না। কথায় কথায় বলতো আমার তিন ছাওয়াল। একটায় না খাওয়াইলে আরেকটায় খাওইয়াবো তোমার পোলার কি অইবো চাচি? বুইরা বয়সে শেষে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়া থাকবো। তাও মেয়ের জামাইরা যদি দয়া করে। কষ্ট লাগে গো চাচি, কষ্ট লাগে। তোমার ছাওয়ালের লাগি কষ্ট লাগে।
মোরশেদ কাকা ছিলেন আমাদের হাই স্কুলের কেরানি। দিন আনতে পানতা না ফুরালেও অবস্থা মোটামুটি বেগতিক। তবুও তিনি মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যান। কেরানি হিসেবে স্কুলের বেতন দিতে হতো না তাতে একটু ছিল রক্ষা। কিন্তু কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়? জমি জমা যা ছিল তা বেচে মেয়েদের লেখা পড়া করিয়েছেন।
একটা সময় চাকরির বয়স শেষ হয়। সব গুলা মেয়ে তখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। জমিজিরাতও শেষ। ভিটেমাটিও আব্বা কিনে নিয়েছেন। তবুও এই বাড়িতেই ছিলেন প্রায় তিন বছর। ধারদেনা করেও কোন রকম সংসার চলছিল না। স্ত্রীকে নিয়ে উপোসও থেকেছেন বেশ। আমার মাকে দেখতাম প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে চাল ডাল তরকারি দিতো। আমার বাবার চাচাতো ভাই হলেও বাবার সাথে মোরশেদ কাকার শেষদিকে বনিবনা ছিল একটু কম। বাবার ইচ্ছে ছিল তাড়াতাড়ি বাড়ি খালি করা। মা জোর করে থাকতে দিয়েছিলেন। কষ্ট করেছেন কিন্তু হাল ছাড়েন নি। তবে খুব বেশিদিন এভাবে কাটাতে হয়নি। এরমধ্যে সবার বড় সাফিয়া আপু ডাক্তারি পাশ দিয়ে দিয়েছে।
সাফিয়া আপু গাইনী ডাক্তার হওয়ার পর সংসারের অভাব কমতে শুরু করে। একে একে দ্বিতীয় মেয়ে আফিয়া আপু নার্স, তৃতীয়জন মিলা আমার ক্লাসমেট আমাদের স্কুলে সহকারী শিক্ষক। পঞ্চম ইলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর জয়েন করেছে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। পরে জমি কিনে বাড়ি করেন এইখানে।
চার নম্বর মেয়ে সবার থেকে সুন্দরী সে আছে স্বামীর সাথে দুবাই। এই মেয়েটাকেই মানুষ করতে পারেন নি মোরশেদ কাকা। বাউন্ডুলে একটা। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাশের গ্রামের পলাশের সাথে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলে। অনেক কষ্টে দিন কাটানোর পর যদিও এখন স্বামী সংসার নিয়ে ভালই আছে নীলা। বাড়ির সবার সাথে যোগাযোগ আছে। শুধু মোরশেদ সাহেব কথা বলেন না।
নীলা তার বাবার জন্য দামী মোবাইল, ঘড়ি, ছাতা, জুতা সব নিয়ে আসে আসার সময়। অন্য সবার মত বাবাও নেন কিন্তু ব্যবহার করেন না। এই নিয়ে নীলার দুঃখের অন্ত নেই। মোরশেদ সাহেবেরও এইটুকু ছাড়া সুখের কোন কমতি নেই।
নীতু ছাড়া সবার ভাল ভাল জায়গায় বিয়ে হয়েছে। নীতুর জন্যও ছেলেদের বাবারা যোগাযোগ করে যাচ্ছেন নিয়মিত মোরশেদ কাকার সাথে। আমার বেল নাই। তাও যদি একটা চাকরি বাকরি করতাম কথা ছিল। নীতু যদিও বলেছে সে দেখবে কিন্তু আমি জানি আমাদের বিরহ খুবই সন্নিকটে।
মোরশেদ কাকা মাঝে মাঝে শুধু আক্ষেপ করেন উনার মায়ের জন্য। যদি দেখে যেতে পারতো আজ মেয়েগুলা আমার ছেলে থেকে অধিক। আসলেই অধিক। আমি ছেলে হয়ে তাদের কারোর ধারে কাছেও নাই। একটা চাকরীর জন্য জুতা ক্ষয় করা ছাড়া কিচ্ছু করতে পারতেছি না।
এখন সংসারে আরো দুইজন বেশি খায়। কায়েসের মা আর কায়েসের বাবা নিখোজ। তিন ছেলে অথচ কোন ছেলেই খেতে দেয় না। বউদের সাথে ঝগড়া লেগেই থাকতো তার। অবশেষে বাড়ি থেকে বের হয়ে মোরশেদ কাকার সংসারে আশ্রয় নেয় খঞ্চুনি বুড়ি। কায়েসের মা সারা দিন বিলাপ করে ‘আমারে পাপে ধরছে, কুলাংগারের দল পেটে ধরে আমি পাপ করছিলাম আমি। খোদায় বিচার করছে। পাপের বিচার। আর সেফালী কাকির গুণকীর্তন করতে থাকে সারা দিন। যেমন’যে বউ সোয়ামীরে বালবায় তার ছাওয়াল মাইয়া সব বাপের মত হয়। আর বাপ গঠনের মেয়েরা হয় ভাগ্যবতী। তোমার সব কয়টা মেয়ে কত ভাগ্যবতী। সব কয়টা বাপের চেহারা কাইরা আনছে’।
মানে তেল যত বেশি তরকারি তত স্বাদ।
কাকার আজ মন মেজাজ খুব ভাল। অতিরিক্ত মন ভাল থাকলে মানুষ কাদে। মোরশেদ কাকাও কাদতেছেন। একটু আগে নীলার দেয়া মোবাইলে সীম ঢুকিয়ে দুবাই কল দিয়েছেন। এই কারণেই মুলত আমার এখানে আসা। আমি ইমু সেট করে দিয়েছি। এখন পাশের রুমে বসে চা বিস্কিট খাচ্ছি আর নীতুর বড় সাইজের একটা ছবির সাথে প্রেম করছি। ফাকে ফাকে মোরশেদ কাকার কান্না সুনতে পাচ্ছি। মোরশেদ কাকা নীলাকে ফোন যখন করে তখন আমি ওখানেই ছিলাম। তাদের বাবা মেয়ের কথাবার্তা এমন
– মা কেমন আছিস? ইমুতে কাকাকে দেখেই কান্নাকাটি শুরু করেছিল নীলা তাই উত্তর দিতে পারে নি।
– মারে তুই ত জানিস আমি সবার থেকে তোকে বেশি ভালবাসি। তোর বিয়েতেও আমার আপত্তি নাই। পলাশ আমার স্কুলের ছাত্র। আমি জানি পলাশও খুব ভাল ছেলে। কিন্তু তোর সাথে এই অভিনয় করেছিলাম তোর ছোটবোন গুলারে মানুষ করার জন্য। তোকে প্রশ্রয় দিলে তারাও যদি। এইটকু বলেই কেদে ফেলেন কাকা। আমি বেড়িয়ে আসি। এই অবস্থায় দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাপ বেটির এমন হাসি কান্নার খেলা দেখাটা অশোভনীয়। নীলা কালই আসবে পলাশকে নিয়ে। আগামী কাল হবে এই বাড়িতে ঈদের আনন্দ। নীতুও ইতোমধ্যে রাস্তায় আছে। আসতে হয়ত খুব দেড়ি নাই। রওনা করে আমাকে ফোন দিয়েছিল।
– রাফি?
-জ্বী কাকা।
– কাল দুপুরে তুমি নিজাম ভাই আর ভাবিকে নিয়ে চলে আসবা। নিজাম ভাইকে আমি নিজে গিয়ে দাওয়াত দিয়ে আসবো। আর শোনা এমন গেঞ্জি আর ছেড়া প্যান্ট পড়ে আসবা না। অনেক আত্মীয়রা আসবে। পাঞ্জাবী পড়ে আসবা।
– কাকা আবার পাঞ্জাবী কেন?
– যা বলছি তাই করবা। আর এখন যাও। আর অপেক্ষা করতে হবে না। নীতুর সাথে কাল দেখা করবা। আমি আমতা আমতা করে ভয়ে ভয়ে বললাম-
– না কাকা আমি নীতু জন্য ওয়েট করতেছি না তো।
– তোমরা মাত্র বড় হইছো আর আমরা এমন বড় আরো তিরিশ বছর আগেই হইছি। বুঝছো? আমি আর কথা বাড়ালাম না। হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলাম। তবে কিছুই বুঝলাম না ব্যপারটা।