তুই কিন্তু আমাকে আপনি বলেই ডাকবি!” আমি ভ্রু কুচকে মিতুর দিকে তাকালাম৷ মেয়েটা এখনো হাসছে৷ আমি মুখে বিরক্তির আভা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম৷ যদিও আমি মনে মনে প্রচন্ড রকমের খুশি৷ আমার সামনে বসা খিলখিল করে হেসে যাওয়া মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ঘন্টাখানেক আগে৷ সকাল বেলা বেরোনোর সময় মিতুর সাথে দেখা হয়েছিল একবার৷ আমার মুখটা তখন সম্ভবত আষাঢ়ের মেঘ৷ মিতু আমার নাক টিপে দিয়ে বলেছিল,
-আমার বিয়েতে কি গিফ্ট দিবি?” আমি আব্বার পকেট থেকে মারা ৩টা ১০টাকার নোট দেখিয়ে বললাম,
-তোমার ভাগ্যটা খারাপ বুঝলে৷ আব্বার পান্জাবির পকেটে আজকাল টাকার আকাল পরেছে৷” মিতু একটা ভেংচি কেটে বলল,
-তুই না আমার ছোট ভাই!”
আমার ভেতরটা আমার মোচড় দিয়ে উঠে৷ তবুও সামাল দিলাম নিজেকে৷ হাসি মুখে প্রস্থান করলাম৷ যদিও আমার একবার হলেও মিতুর দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকানো উচিত ছিল৷ কিন্তু তাকালাম না একদমই৷
মিতু বড় চাচার মেয়ে৷ বয়সে আমার সপ্তাহখানেকের বড়, আর এক ক্লাস ফেইল মারার কারণে মিতুর ছোট বনে গিয়েছি আমি৷ আম্মার ভাষ্যমতে, ছোটবেলায় মিতুকে আমি আপু ডাকলেই সে রেগে লাল হয়ে যেতো৷ এরজন্য শ’খানেক কামড় খেয়েছিলাম ছোটবেলায়৷ দু’একটা কামড়ের কালো দাগ আমার হাতের চামড়ায় সিলমোহর হিসেবে লেগে আছে এখনো৷ মাঝে মাঝে মিতুকে রাক্ষসী ডাকার প্রমাণ স্বরূপ আমি এগুলো দেখায় এখনো৷
বড়বেলায় এসে আমি অনুভব করলাম, মিতু নামের মেয়েটাকে ছাড়া আমার চলবেনা৷ আমার ভালো লাগার সবটুকু জুড়ে মেয়েটা ছিল৷ পাড়ার মেয়েগুলোর সাথে আমি মিতুর তুলনা করা শুরু করে দিয়েছি ততদিনে৷ আমার তুলনায় প্রতিবারই মিতু এগিয়ে৷ আমি অনুভব করি আমার মনের আকাশে মেঘ হয়ে ভেসে বেড়ানো অনুভূতির সবটুকু জুড়েই মিতু মেয়েটা৷
আমি বেশিদিন চেপে রাখতে পারিনি৷ মিষ্টিরোদের শেষ বিকেলে হুট করে বলে ফেলেছিলাম আমার ভালো লাগাটা৷
মিতু মুচকি হেসে বলেছিল, আমার খুব শখ কেউ আমাকে প্রেমপত্র লিখবে৷” আমি খুশিতে গদগদ হয়ে বলেছিলাম, রাজি হয়ে যা তুই৷ আমি লিখবো৷” তারপরের সপ্তাহখানেকের বিকেলগুলো আমার আর দেখা হয়নি৷ সারাদিন রাত ভেবে মিতুকে নিয়ে ১০কিংবা ১২টা প্রেম পত্র লিখেছি৷ হাতটা ব্যাথায় ভরে গিয়েছিল একদম৷ আমার এসাইনমেন্ট লিখার অভিজ্ঞতা ছিল না বলে হাতের আরো করুণ দশা হয়েছিল একদম৷ শেষে গণিতের নোট আকারে মিতুর হাতে তুলে দিয়েছিলাম প্রেমপত্রগুলো৷ মিতুর সেকি হাসি৷ মেয়েটা অল্পতেই হাসে৷ তবুও আমার কম লাগে৷ ইচ্ছে হতো গালগুলো টিপে দিয়ে বলি, এতো কম হাসিস কেন? বেশি করে হাসবি বুঝলি৷”
ঝুম বৃষ্টির একটা মধ্যদুপুর৷ রুমের জানালাটা খুলে দিয়ে মাথার নিচে দু’হাত গুজে যখন আমার প্রেমের ভবিষ্যত নিয়ে ধ্যান বসেছিলাম৷ হুট করে আব্বার কর্কশ কন্ঠে আমার ধ্যানের বারোটা বাজলো৷ তার কিছুক্ষণ পর অবশ্য হবে হবে প্রেমটারও বারোটা বাজলো৷ আব্বার সামনে হাজির হলাম কাচুমাচু মুখ নিয়ে৷ আমি এমনিতেও উনার সামনে কাচুমাচুই থাকতাম৷ মুখ তুলতেই আব্বার পাশে মিতুকে দেখলাম৷ মুখে মুখটেপা হাসি৷ আমার মনেও আশার সন্ঞ্চারণ হয়েছিল বটে৷ এই ভেবে ,আব্বা হয়তো একেবারে বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছেন! পরক্ষণেই নিজেকে ধিক্কার দিলাম৷ দিনকয়েক প্রেমপত্র আর বাংলা ছায়াছবি দেখে বোধবুদ্ধি সব গিয়েছে৷ আব্বার যেমন কাষ্ঠমুখ তেমনি কাষ্ঠপ্রাণ৷
আমার লিখা প্রেমপত্রগুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছেন৷ মিতুর মুখটেপা হাসির রহস্য আমি ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি৷
আমার চোখ গেলো আব্বার হাতের দিকে৷ ভয়ংকর রকমের ভারি হাত আব্বারগুলো৷ এক প্রেম পত্রের পেছনে যদি একটা করে চড় হিসেব করেন৷ আমার গালটায় গায়েব হয়ে যাবে হয়তো৷ আমি পালানোর কথা ভাবলাম একবার৷ পরক্ষণেই ভাবলাম, ভাত বন্ধ হয়ে চিরতরে৷” সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল বলে প্রকৃতির মতো আব্বার রাগটাও শীতল ছিল৷ আমাকে কিছুই বললেন না৷ আমি আরো কিছুক্ষণ কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ফিরে আসার জন্য ফিরতেই আব্বা কাষ্ঠগলায় বলল, কাল থেকে মিতুকে আপু মনে করবি৷ ও তোর সপ্তাহখানেকের বড়, সাথে তোর চেয়ে বেশি ক্লাসে পড়ে৷” কথাটা শুনে আমার কেমন লেগেছে জানিনা৷ শুধু অবচেতন মনে একবার ইচ্ছে হয়েছিল, আব্বার পায়ে ধরে বলি৷ আব্বা আল্লার দোহায় লাগে আমাকে শ’খানেক থাপ্পর দেন৷ আমি দিনকয়েক বেহীশ থাকবো৷”
সিগারেট কেনার টাকা হয়নি তখনো৷ বিড়ি দিয়ে চালিয়ে দিয়েছিলাম৷ তারপর থেকে মিতু আমার মনে করা আপু হয়ে গেল৷ যদিও আমি আপু ডাকিনি কখনো৷ তারপরও আমার উপর মিতুর কতৃত্ব ছিল সবসময়৷ মিতু হুট হাট আবদার করে বলে বসতো,শুভ্র! আমার প্রেমপত্র পেতে ইচ্ছে করছে! লিখে ফেল৷” আমি আহত দৃষ্টিতে তাকাতাম৷ আব্বার ভারি হাতের চড়ের কথা মনে পরলেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠতো৷ তবুও মিতুর আবদার মেটাতে প্রথমে দু’একবার লিখলাম৷ তারপর আবার লিখলাম,পরেরবার আবার আমি নাহু নাহু ভাব ধরতাম মাঝে মাঝে৷ তারপর মিতু আগের সপ্তাহের পত্রখানা দেখিয়ে বলতো, এগুলো জায়গামতো পৌঁছে দিবো৷ আমি তখন লিখতে বাধ্য৷
মিতুর বান্ধবীদের কাছেও আমি ছোট ভাই৷ মিতুর তীক্ষ্ম নজরধারি ছিল আমার উপর৷ আমিও অবাধ্য হতাম না৷ তবে ইচ্ছে করতো খুব অবাধ্য হই হুট করে৷ পরক্ষণে আমার প্রেমপত্রের কথা মনে পরে যায়৷ কতবার ভেবেছি পাড়ার শিলা,বৃষ্টিদের ভেবে প্রেমপত্র লিখবো৷ সবই ব্যর্থ৷ মিতু ছাড়া আমার প্রেমপত্র কিংবা অনুভূতিতে কারো স্থান নেই৷ অতীব নজরধারী খপ্পরে পরে আমার আর প্রেম করাও হলো নাহ৷ সেই নজরধারীর খপ্পরে পরে আমার অনুভূতিগুলোই নজরধারীর খপ্পরে বন্দী হয়ে গেল৷” দিন কয়েক আগের সকালে যখন শুনলাম মিতুর বিয়ের কথাবার্তা চলছে৷ আমি মেঘলা আকাশটার দিকে তাকালাম হা করে৷ মনে মনে বলেছিলাম, ঐ এক ক্লাসটা কি দুধ ভাত বলে চালিয়ে দেয়া যেতো নাহ!” নিজের কপাল ভেবে আর ভাবলাম না কিছু৷ দিন দুয়েক মিতুর সাথে আমার দেখা হয়নি৷ ভালোই হয়েছে৷ গলার নিচের ব্যাথাটা একটু বেড়েছে৷ আজ হয়েছিল৷”
আব্বার পকেট থেকে মারা ১০টাকার নোটগুলো দিয়ে সিগারেট পোড়াচ্ছিলাম৷ ফোনটা বাজলো একবার৷ আব্বার ফোন৷ আমি অবাক হলাম একটু৷ পরক্ষণেই মনে পরলো, আজ মিতুর বিয়ে৷ কাজে ডাকছে হয়তো৷ আবার বাজলো৷ ওপাশ থেকে আব্বার কাষ্ঠকন্ঠ”ঘরে আয়” মিতুকে প্রেমপত্র দিয়ে ধরা খাওয়ার বৃষ্টিস্নাত দিনটার কথা ভাবতে ভাবতেই ঘরে পৌছালাম৷ মিতুর বিয়ের রেশ চারিদিকে৷ ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো আমার৷ যদিও আমার হাসি আসা একদমই মানায় না এখন৷”
আব্বা নতুন পান্জাবীটা আমার দিকে এগিয়ে দিল৷ আব্বার দিকে ভালোভাবে তাকালাম৷ চশমার ভেতরের গম্ভীর চোখ৷ আমার আর কিছু বলার সাহস হয়নি৷ সবকিছুর ফাঁকে একবার আম্মাকে মিনমিন করে বলে ফেললাম, আম্মা মিতুর জামাই কি অর্ধেক রাস্তায় মরেছে?” আম্মা আমার মাথায় চটকানা দিয়ে বলল, আমার ছেলে মরতে যাবে কেন?” আমি নিজেকে চেপে রাখলাম৷ যদিও আমার সেই মূহূর্তে লাফানো উচিত ছিল৷ একে হুট করে মিতুকে বিয়ে করা৷ আর বেতনের টাকাগুলোর পুরোটা আব্বার হাতে তুলে দিয়ে উনার পকেট মারা লাগবেনা৷ তবুও গম্ভীর থাকলাম৷ এখন মিতুর সামনেও গম্ভীর থাকার চেষ্টা করে চলেছি৷ মুখখানা এমন করে রেখেছি,যেন এই হুট করে হওয়া বিয়েটা আমি মেনে নিতে পারিনি৷
-শুনেছিস কি বলেছি?” কড়া গলায় বলল মিতু৷
-কী?
-আমাকে আপনি করে বলবি বুঝলি?” আমি মুচকি হেসে বললাম, আজ আর প্রেমপত্রের ভয় নেই৷ আমাকে জব্দ করা অতো সহজ নয়৷”