ভালোবাসার কোন চেহারা নেই

ভালোবাসার কোন চেহারা নেই

আমি যখন পরকীয়ায় জড়িয়েছিলাম তখন আমার কখনো মনে হয়নি যে আমি কোন অপরাধ করছি। কারণ এই সম্পর্কটা সৃষ্টিতে আমার থেকে মেয়েটির অবদান ছিল বেশি। মেয়েটির সিদ্ধান্তই মূলত আমাদের এই অবৈধ পাপের প্রথম মানচিত্র এঁকে দেয়। আমি শুধু ধেয়ে আসা স্রোতে গা মিলিয়েছি।

ফেসবুকে পরিচয় হয় আমাদের। আর আমরা ছিলাম একই শহরের বাসিন্দা। শুরু শুরুতে মেয়েটি নিজের সংসারের টুকিটাকি গল্প করতো, শাশুড়িকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে, এক দেবরের বিচ্ছু ছেলে এসে শখ করে কেনা চারটি পুতুলের একটি ভেঙ্গে ফেলেছে, স্বামীকে ১০ টা কথা বললে উত্তর দেয় একটার এইসব স্বাভাবিক কথাবার্তা।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কথা আরও গভীরের দিক যেতে থাকে। মেয়েটি জানায় সে তার স্বামীর সাথে ভাল নেই। স্বামী একটু প্রাচীনপন্থী। জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করলেও এখন হুজুর। ধর্ম পালন এবং ধর্মীয় অনুশাসন পালনে খুব যত্নবান। অন্যদিকে মেয়েটি একটু আধুনিক চিন্তাধারার। সংসারের কড়াকড়ির মাঝে তার প্রচণ্ড দমবন্ধ লাগে। সে চায় কেউ তার কষ্টগুলোকে ভাগ করে নিক। তার ইচ্ছাগুলোকে মূল্যায়ন করুক।

আমি খুব বুদ্ধিমান টাইপ না হলেও দুর্ভাগ্যবশত এই মেয়েটির ইশারা বোঝার জন্য পর্যান্ত অপবুদ্ধি আমার মাথায় ছিল। প্রথমে প্রথমে আমার বিবেকের উৎপাত শুরু হলেও আমি নিজেকে বোঝায় আমি নিজ থেকে কিছুই চায়নি, মেয়েটিই আগ্রহী। এখানে আমার কেন দোষ হতে যাবে? তাছাড়া নিজের পৌরুষত্বকে অস্বীকার করাটাও সহজ কাজ নয়। আমরা দেখা করি।

মেয়েটি দেখতেও ছিল বেশ সুন্দরী। অন্তত কোন পুরুষ মেয়েটিকে প্রথম দেখায় ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে দেখার মত সুন্দরী। ওকে প্রথম দেখায় আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে শুরু করেছিলাম। ভেবেছিলাম বিবাহিত হলেও এত সুন্দর একটি মেয়েকে আমি পেতে চলেছি। আশ্চর্যজনভাবে মেয়েটিও শুরু থেকে একটি অবৈধ সম্পর্ক তৈরিতে ছিল খুব মনোযোগী।

আমরা নিয়মিত দেখা করতে শুরু করলাম। কখনো আমার বাসায়, কখনো কোন বন্ধুর বাসায় এমনকি সুযোগ হলে ওর বাসাতেও। ও কিন্তু আমাকে ওর বাসার সবার সাথে পুরাতন বন্ধু হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিলেছিল। আর অদ্ভুত হলেও সত্যি ওর স্বামীসহ ওর পরিবারের সবাই আমাকে মেনে নেয়।

আমি গেলে খুব যত্ন করত। ওর শাশুড়ি আমি গেলে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন আমাকে কি খেতে দেবেন সেটা নিয়ে। শ্বশুর এসে দীর্ঘক্ষণ ধরে গল্প জুড়ে দিতেন যেন আমি ঐ পরিবারের সদস্য। ও যে আমাকে বলেছিল ওর শ্বশুরবাড়ি বেশ রক্ষণশীল, এই ব্যাপারটা যে কত বড় একটা মিথ্যে সেটা বুঝতে আমার একটুকু সময় লাগেনি। আসলে ওর বলা ঐ আবেগময় কথাবার্তা ছিল আমাদের এই অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলার পিছনের সস্তা ছলনা।

ওর স্বামীর সাথে আমার একটা সময় ভাল পরিচয় হয় আমার। ভদ্রলোকের মাথায় সবসময় দেখতাম কিস্তি টুপি, কালো ঘন দাঁড়ি, চোখ দুটো সবসময় শান্ত। উনি নিজেও বেশ চুপচাপ গোছের। যাকে আমরা বলে থাকি পিওর জেন্টেলম্যান। তবে লোকটি ছিল কুৎসিত। গায়ের রঙ মিশমিশে কালো। চেহারার গঠনও কেমন রুক্ষ গোছের। আমি রেসিস্ট নই। তবে সাধারণের একজন মানুষ তাকে দেখলে এমনই ভাববে। আমি কখনো খুঁজে পায়নি এই মেয়েটি কেন এমন একজন মানুষের সাথে দিনের পর দিন বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে। শুধুই কি মানুষটি দেখতে সুন্দর নয় বলে? খুব শান্ত ব্যক্তিত্বের বলে? জীবনের মাঝে কোন বাড়তি কোন উত্তেজনা পছন্দ করেন না বলে? নাকি ব্যাপারটা শারীরিকও? আমি সত্যি কোনদিন জানতে পারিনি।

মেয়েটির স্বামীর পরিবারের সংস্পর্শে এসে সত্যিই আমার খারাপ লাগতে শুরু করে। প্রচণ্ড খারাপ লাগতে শুরু করে। কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই আমাকে ছাড়ছিল না। ও আমাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছিল যে আমি যেন আমার ছিলাম না। সব নিয়ন্ত্রণ যেন চলে গিয়েছিল ওর হাতে। আমি ভেবেছিলাম এই বিষাক্ত নাগপাশ থেকে আমি কোনদিন মুক্তি পাব না। কিন্তু একদিনের একটা সামান্য ঘটনা আমার জীবন বদলে দিল।

আমি বড়রাস্তার পাশে দুই বন্ধুর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন সকাল বেলা । অফিস টাইম। লোকজন হই হুল্লোড় করে বাস ধরছে। এখন বাস মিস মানেই অফিস যেতে এক দুই ঘন্টার ধাক্কা। আমি অলস নজরে দেখছি মানুষজনের কাণ্ড। হঠাৎ দেখি আমার দোকানের পাশেই কয়েকটা দোকান পরেই ভদ্রলোক বসা। অন্যদিক ফিরে বসা ছিলাম, খেয়ালই করিনি। উনিও দেখেননি আমাকে ভদ্রলোক অপেক্ষা করছিলেন বাসের জন্য। আমি ডাক দিতে যাব দেখি ভদ্রলোক উঠে দাড়ালেন। সম্ভবত খুব দূরে বাস দেখতে পেয়েছেন কিংবা বাস আসবার সময় হয়ে গেছে। আমি আর ডাক দিলাম না। কিন্তু আমি না দিলেও আরেকজন এসে ডাক দিল ওনাকে।

কোন মানুষ নয়। একটি গর্ভবতী বিড়াল এসে ঠিক ওনার বসা বেঞ্চের জায়গাটার পাশে এসে ডাক দিল।ওনাকে উদ্দেশ করেই যেন দিল। ভদ্রলোক শুনলেন। ফিরে তাকালেন বিড়ালটার দিকে। বিড়ালটা আবার ডাক দিল। আমি এখান থেকে বেশ দেখতে পাচ্ছিলাম মা বিড়ালটা বেশ শুকনো। হয়তো অনেকসময় খেতে পায়নি তাই কিছু খেতে চায়। একের পর এক মানুষের কাছে আবেদন করেছে। কেউ সাড়া দেয়নি। এরপর এসেছে আমার পরিচিত এই মানুষটির কাছে। আর এই মানুষটি ছিল ওর নির্বাচিত সঠিক মানুষ।

দেখলাম ভদ্রলোক রাস্তার দিকে একবার তাকালেন আরেকবার তাকালে শুকনো মুখের মা বিড়ালটার দিকে। যেন এক মুহুর্তে জন্য দ্বিধায় পড়ে গেলেন। কিন্তু ঠিক পরের মুহূর্তে দ্বিধা ঝেড়ে ফেললেন। ওনার বাস সেসময় চলে গেল। উনি একবার করুণ দৃষ্টিতেও সে বাসের দিকে তাকালেন না। কারণ এই শান্ত লোকটি ছিল সিদ্ধান্ত পাহাড়ের মত অটল। শান্ত হয়ে আবার এসে বসলেন ওনার বেঞ্চে। দোকানদারকে বললেন বিস্কুট আর রুটি দিতে। উফ! কি যত্ন করে জলে ভিজিয়ে নরম করে বিড়ালটাকে যে খাওয়ালেন! যেন মনটা ভরে গেল। বিড়াল পেট পুরে দুটোই খেলো। তারপর আরেকটু বেশ কিছুক্ষণ সময় ওনার পাশে বসেছিল। বিড়ালকে খাইয়ে লোকটির পরের বাস পেতে প্রায় বাড়তি দেড় ঘন্টার মত সময় লেগে গেল। কিন্তু আমি ওনার চোখে কোন উদ্বেগ দেখতে পাইনি। সেই সদা শান্ত চোখ আর প্রশান্ত মুখ দিয়ে নিয়ে বাসে উঠে গেলেন। এই সুন্দর দৃশ্যটা আমি কোনদিন ভুলব না। মনে হল ঈশ্বর আর কোথাও থাকেন না থাকেন আমাদের শুদ্ধ চিন্তায়, আমাদের আচরণে।

ঐদিন বাসায় ফিরে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি পরকীয়ার এই অভিশাপ থেকে আমাকে মুক্ত হতে হবে। আমি জানি আমি যতই ঐ মেয়েটিকে বোঝাতে যাইনা কেন ও বুঝবে ছাড়তে চাইবে না আমাকে। আমি ওকে হাড়ে নাড়ে চিনেছিলাম। আমি দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নেই। সবার প্রথম বাসা পাল্টে শহরের আরেক প্রান্তে নিয়ে যাই। ফোনের সিম পাল্টাই। ফেসবুক বন্ধ করে দেই দীর্ঘ একটা সময়ের জন্য। আর আমি জানতে পারি যে সম্পর্ক থেকে আমি কোনদিনই মুক্তি পাবনা ভেবেছিলাম সামান্য স্বদিচ্ছার জোর থাকলে সেটা ততটা কঠিনও নয়।

এখন আর আমাদের মাঝে কোন যোগাযোগ নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। না ঐ মেয়েটিকে মনে করে নয়। বরং মেয়েটি স্বামীর কুৎসিত চেহারার আড়ালে মানুষটির চেতনায় স্বয়ং ঈশ্বর বাস করে এই কথা মেয়েটি কোনদিন জানতে পারবে না। শুধুমাত্র এইজন্য।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত