ভালোবাসার সমীকরণ

ভালোবাসার সমীকরণ

লোকটা সিগারেটে একটা সুখটান দিতে দিতেই জিজ্ঞেসা করলেন,” রাত দশটায় কি কখনো ইন্টারভিউ হয় ,,,,মিস?

-মাথাটা নিচু করেই বললাম, না ! কিন্তু জবটা আমার ভীষণ প্রয়োজন। তাই আন্টির মুখে জবটার ব্যাপারে জানামাত্রই তাদের বাসা থেকে এখানে চলে এলাম। কাল যেহেতু শুক্রবার তাই আপনি হয়তো বাসায় নাও থাকতে পারেন।

লোকটি সিগারেটে অনবরত টান দিয়েই যাচ্ছে। আমাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নাম কি আপনার?জবটা কি সেটা সম্পর্কে কি আপনার কিছু আইডিয়া আছে,,,,,?

– আবারও মাথা নিচু করে বললাম, আমি অন্তি। জবটা কি তা আমি জানি না। আসলে একটা জব ভীষণ প্রয়োজন প্রিয়জনদের জন্য। প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য,একটু মাথা উঁচু করে সমাজে বাঁচার জন্য।

আমাকে থামিয়ে দিয়ে লোকটা বললো, এতো রাতে কোন পুরুষের কাছে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন, আপনার বাসায় জানতে পারলে আপনাকে কিছু বলবে না,,,?

– মা আমাকে বিশ্বাস করেন তার নিজের চেয়েও বেশি, শুধু সমাজটাকেই ভীষণ ভয় তার। মধ্যবিত্তদেরও অভিনয় করে চলতে হয় সমাজের ভয়ে!
কিন্তু আমাদের মতো নিম্ন বিত্তদের অভিনয় করে চলতে হয় না, জীবনের শুরু থেকেই জীবনসংগ্রাম শিখতে হয়।

লোকটি বললো, আমি ফারহান আহমেদ, আমার একটা সন্তান দরকার। আমি আপনাকে দুই বছরের জন্য বিয়ে করতে চাই, সেটা পারিবারিক ভাবেই ! যেহেতু বাচ্চা ছয়মাস পর্যন্ত তার মায়ের দুধ পান করে তাই বাচ্চাকে তার মায়ের কাছে রাখা অত্যাবশ্যকীয়। মানে দুই বছর আপনি আমার স্ত্রীর মর্যাদায় এ বাড়িতে থাকবেন। তারপর আপনাকে আর আপনার পরিবারকে সারাজীবন যাতে কোনরকম কষ্টে না থাকতে হয় তার ব্যবস্থাও আমি করে দিবো।

-লোকটি মানে ফারহানের কথায় ভীষন হাসি পেলো আমার। পৃথিবীতে এমন কোনো মেয়ে আছে নাকি যে কিনা জেনেশুনে নিজের সন্তানকে ছেড়ে যাবো সুন্দর ভবিষ্যতের আশায়,,,! পাগলীও তার সন্তানকে আগলে রাখে পরম মমতায়। আর আমি তো সুস্থ একজন মানুষ !

-আমি দৃঢ় কন্ঠেই বললাম, হয়তো আগে জানলে আপনাকে এতো রাতে বিরক্ত করতে আসতাম না।

-কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে দরজা দিয়ে একেবারে বাহিরে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু এ কি, হঠাৎ বৃষ্টি ! ব্যাগে ছাতাও নেই, তারপরে ভীষণ বাতাসে বৃষ্টি যেন উড়ে যাচ্ছে এক পশলায়।
চুপচাপ করে ডুপ্লেক্স বাড়িটার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছি। পাঁচ মিনিট পর এক লোক এসে বললেন, ম্যাম স্যার আপনাকে ভিতরে ডাকছে। আমি কোন কথা না বলে দাঁড়িয়ে আছি। লোকটি আবার বললো,ম্যাম স্যার আপনাকে ডাকছে, কিছু বলবে আপনাকে।
কি ভেবেই যেনো ভিতরে গেলাম! উনাকে দেখি বিশাল ড্রইং রুমের এক কোনায় রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে আর মনের সুখে সিগারেটে টান দিচ্ছে,,,,

আপনি আমাকে তিনদিন একঘন্টা করে সময় দিতে পারবেন মিস অন্তি,,,? তার জন্য অবশ্য আপনাকে ভালো পেমেন্ট করবো। তিনদিন এই সময়ে আসতে হবে, রাত দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত আমার সাথে থাকবেন।

– পেমেন্ট ভালো পাবার আশায় যদি শরীর শরীর বিলাতে হয় তবে তা অনেক আগেই করতে পারতাম! শুধু শুধু কষ্ট করে টিউশানি করে প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফোটাতে চেষ্টা করতাম না। আপনার অফারের জন্য ধন্যবাদ তবে অফারটি আমি গ্রহন করতে পারলাম না।

আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন মিস অন্তি ! তিনদিন আপনার কাছে সময় চাওয়ার মানে এই না যে, আপনাকে শয্যাসঙ্গী করতে চাইছি,,,! আপনি সময় নিয়ে ভাবতে পারেন, আপনার ইচ্ছে হলে আসবেন, নয়তো না !

বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে। আপনি চাইলে লেপ্টে যাওয়া কাজল আর একপাশে আঠা উঠে যাওয়া টিপ খুলে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বাসায় যেতে পারেন ! কথাগুলো বলেই লোকটি উঠে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন।

আমি রাস্তায় হাঁটছি আর ভাবছি লোকটি মানে ফারহান কেন আমাকে তিনদিন যেতে বললো ? তার কি কোন খারাপ উদ্দেশ্য আছে নাকি এমনি ! ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ি পৌছে গেছি খেয়াল করিনি। মা আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, আজ এতো দেরি করলি যে ?

– মা, কাল থেকে তিনদিন দেরি হবে। একটা জবের ব্যাপারে,,, তুমি আবার টেনশন করো না। মা মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ নিয়ে বলেন, এতো রাতে কিসের জব রে,,,,,?

– মা তুমি বিশ্বাস করো না আমায় ?

– বিশ্বাস অর্জন খুবই কঠিন রে কিন্তু বিশ্বাস ভাঙা খুবই সহজ !

পরদিন মিতুকে পড়াতে পড়াতে রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। তারপর বাসে করেই ছুটলাম সেই অদ্ভুত লোকের বাড়িতে। ঠিক দশটায় দরজায় কড়া নাড়তেই এক মধ্য বয়স্ক মহিলা দরজা খুলেই আমাকে ভিতরে ঢুকিয়ে বসতে বলে চলে গেলেন। প্রায় পাঁচ মিনিট পরে হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে দোতলা থেকে ফারহান বললো,

-অন্তি আজ জোৎস্না দেখতে দেখতে গল্প করবো ! উপরে চলে আসুন তাড়াতাড়ি।

আমি একটু ভয়ে ভয়ে দোতালায় উঠে দেখি একপাশে প্রশস্ত এক বারান্দা। কাছে গেলেই হাসনাহেনা ফুলের সুবাস নাকে এসে লাগে। আমি ফারহানের সাথে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। জোৎস্নার আলোয় অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে বারান্দায় রাখা গাছগুলোকে। আমাকে বসতে বলে ফারহান রেলিং ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে।

-জানেন অন্তি, “ছোটবেলায় মা মারা যাওয়াতে বাবাই ছিলো একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু বাবা ব্যবসায় কাজে প্রায়ই দেশের বাহিরে থাকতেন আর আমি এই বিশাল বাড়িতে রহিমা খালা আর আনোয়ার চাচাকে নিয়ে থাকতাম। তারাই আমাকে আর বাড়িটার দেখাশোনা করতো,এখনো তারাই করে। বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে নষ্ট হতে সময় লাগেনি আমার। ও লেভেল শেষ করার আগেই মেয়েদের সঙ্গ উপভোগ করেছি রাতের পর রাত !

-বাবা বাড়িতে থাকলেও নানা কাজে ব্যস্ত থাকতেন, আমাকে পাশে নিয়ে একটু কথা বলার বা একবেলা একসাথে খাবার খাওয়ারও সময় হতো না তার। যতই বড় হতে থাকি আমার মেয়েদের প্রতি আকর্ষনও বেড়ে যেতে শুরু করে। নিত্য নতুন মেয়েকেই উপভোগ করেছি হোটেলের বিলাসবহুলরুমে নয়তো কোন পল্লীর অন্ধকার ছোট রুমে। এক সময় নিজে নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি এসবে। যেখানে বন্ধু বান্ধব বিয়ে করে সুখে আছে আর সেখানে আমি নোংরামিতে ব্যস্ত থাকি ! ওদের দেখে খুব হিংসে হতো, কবে আমারও একটা ফ্যামিলি হবে! “একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিগারেটে অনবরত টান দিয়েই যাচ্ছেন তিনি। আমি চুপ করে বসে আছি পরবর্তী শোনার অপেক্ষায়!

রংচায়ে আদার সাথে একটু লেবুর রস, ভীষণ পছন্দ আমার, বলেই দুকাপ চা ঢেলে এক কাপ চা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন ! আমি চা নিয়ে বসে আছি আর তিনি সিগারেট রেখে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। চা শেষ করেই ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন বার বার। আর আমি পরবর্তী শোনার অপেক্ষায় আছি। পিনপতন নিরবতা প্রায় বেশ কিছুক্ষন ! তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, একঘন্টা হয়ে গেছে, আপনি এখন যেতে পারেন ! আমিও কথা না বাড়িয়ে হাত থেকে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে নিচে চলে আসি। বাড়ির বাইরে বেরুতেই তার ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আর বলতে থাকে, স্যার আপনাকে বাসায় দিয়ে আসতে বলেছে।

– আমার বাসা পর্যন্ত গাড়ি যায় না। আমি একাই যেতে পারবো।

– স্যার বলেছেন আপনাকে সহিহ সালামত বাসায় পৌঁছে দিতে। আপনি যদি না যান তবে আমার চাকরি থাকবে না। প্লিজ ম্যাম, জলদি গাড়িতে উঠুন।

– বললাম না আমি একাই যেতে পারবো, আমি একা চলায় অভ্যস্ত আছি। পেছন থেকে ফারহান এসে বললো, আপনার তিনদিনের দায়িত্ব আমার তাই চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসুন। আনিস আপনাকে বাসায় দিয়ে আসবে এই তিনদিন।

ফারহানের কথায় কোনো জবাব দিতে পারিনি। চুপ করে গাড়িতে যেয়ে উঠে বসলাম। তারপর আনিস আমাকে আমার গন্তব্যে নিয়ে গেলেন। যেহেতু বাসা চিপা গলিতে তাই গাড়ি ঢুকলো না , আমার মনে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ভাবলাম যাক কেউ হয়তো দেখবে না, বাঁচা গেলো। নয়তো মানুষ এতো রাতে আমাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখলে কত কি যে বলতো ! বাসায় যেয়ে হাতমুখ ধুয়েই শুয়ে পড়লাম। মা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি ? কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর আছে কিনা ?

– কিছুই হয়নি মা। এমনিতেই সারাদিন গরমে অস্থির লাগছে তাই ভালো লাগছে না। এখন আর খাবো না, খুব ঘুম আসছে মা। পরদিনও মিতুকে তাড়াতাড়ি পড়িয়ে ফারহানের বাসায় গেলাম। আজও সেই প্রশস্ত বারান্দায় চেয়ারে বসে আছি আর ফারহান সেই চিরচেনা রুপে হাতে সিগারেট নিয়ে রেলিং ঘেঁসে দাঁড়িয়ে !

আকাশের দিকে তাকিয়ে ফারহান বলতে শুরু করলেন,–“বাবা যখনই জানতে পারলেন আমি বিয়ে করতে চাই তিনি খুব খুশি হলেন। নিজেই আমার জন্য মেয়ে দেখা শুরু করলেন। শহরের নামকরা ব্যবসায়ীদের সুন্দরী মেয়েদের প্রস্তাব আসা শুরু করলো আমার জন্য। মেয়েগুলো অনেক সুন্দরী ছিলো একজন আরেকজনের চেয়ে কম না!
কিন্তু আমার মন যেন অন্য কিছু চাইছিলো।

একদিন বন্ধুর মেয়ের জম্মদিনের দাওয়াতে গেলাম।সেখানে নামীদামী মানুষের ভীড়ে এক কোনায় সাধাসিধে সুতি শাড়ি পরিহিতা এক মেয়েকে দেখলাম। মেয়েটা হয়তো খুব আনইজি ফিল করছিলো তাই এক কোনায় মাথা নিচু করে বসে ছিলো কিন্তু আমার চোখ এতো সুন্দরী সুন্দরী নারীদের রেখে তার সাধারণ সাজেই আকৃষ্ট হয়েছিলো।
আমি শুধু তাকেই দেখছিলাম। কিছুক্ষন পর বন্ধু তার মেয়ে অনন্যার গানের টিচারকে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। সেই মেয়েটিই অনন্যার গানের শিক্ষক লাবন্য। একটা সাধারণ মেয়ের মাঝে এতো অসাধারণ একটা প্রতিভা লুকিয়ে আছে, হয়তো লাবন্যর গান না শুনলে জানতামই না। সেই সাধারণ মেয়েটিই আমার মনে জায়গা করে নিলো।

পরদিন বন্ধুর বাড়িতে গেলাম লাবন্য যখন অনন্যাকে গান শিখাতে আসে। যে রুমে গান শিখানো হয় সেখানে বন্ধু আর ভাবিকে নিয়ে বসে বসে লাবন্যর গান শুনলাম মুগ্ধ হয়ে আর ওকে বারবার আড়চোখে দেখছিলাম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় লাবন্য একবারের জন্যও আমার দিকে তাকায়নি ! কিন্তু লাবন্যর প্রতি একটা টান অনুভব করছিলাম। হঠাৎ বলেই ফেললাম, লাবন্য আপনাকে বিয়ে করে আমার জীবনসঙ্গী করতে চাই !

ঘটনায় আকস্মিকতায় বন্ধু আর ভাবি বিস্মিত। আর লাবন্য তো মাথা নিচু করেই আছে। ও ওখান থেকে উঠে চলে যাবার সময় হাত ধরে ফেললাম। হাতটা এক ঝটকায় আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে বাহিরে চলে গেলো। ভাবি বলে উঠলো, ভাই আপনার মাথা ঠিক আছে তো? আপনার ফ্যামিলির সাথে কোনদিনও মানাবে না, লাবন্য নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে! আমি ভাবিকে বললাম, আমি মানিয়ে নিলে তো কারো কোনো সমস্যা হবার কথা না।
বন্ধুর কাছ থেকে লাবন্যর বাসার ঠিকানা নিয়ে বাসায় যেয়ে বাবাকে লাবন্যর কথা বললাম। বাবা বলেলেন, তোমার কোনো কাজেই তো কখনো বাঁধা দেইনি তবে আজও দিবো না।

বাবা তারপরের দিনই লাবন্যর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। ওর পরিবার সত্যিই আনন্দিত হয়েছিলো যে লাবন্যর এমন ঘরে বিয়ে হবে ভেবে। কিন্তু লাবন্য একবার আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। বাবা আমার ফোন নাম্বার লাবন্যকে দিয়ে আসে।

রাস্তার পাশে টংয়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি আমি আর লাবন্য। মেয়েটা এখনো মাথা নিচু করেই আছে। মাথা নিচু করেই বলতে থাকে সে কখনোই এই ফ্যামিলির যোগ্য হতে পারবে না। আর কেনো এতো মেয়ে থাকতে তার মতো একটা সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছি,,,?

সাধারণের মাঝেই যে অসাধারণকে খুঁজে পেয়ছি আমি লাবন্য, তাকেই আমার লাগবে জীবনটাকে গুছিয়ে নেবার জন্য । জীবনে অসংখ্য নারীর শরীর ছুয়েছি তবে সেটা ভালোবেসে না। লাবন্য তুমি কি পারবে না আমাকে নিজের মতো গুছিয়ে নিতে? ভালোবেসে নিজের করে নিতে?

লাবন্য চুপচাপ ! কিছুক্ষন পর জবাব দিলো আপনি যদি আমাকে আপন করে নিতে পারেন তাহলে আমিও পারবো। কথাটা শুনে আনন্দে আত্নহারা হয়ে গেছিলাম। লাবন্যর হাতদুটো নিজের হাতে রেখে কতক্ষণ যে বসে ছিলাম মনে নেই!

সাতদিন পরেই লাবন্য আমার ঘরের বউ হয়ে এলো। প্রতিদিন নতুন করে লাবন্যর প্রেমে পরতাম। আমার অগোছালো, নিয়ন্ত্রণহীন জীবন তখন নিয়মের মধ্যে বাঁধা পড়েছে। একটা পরিবার যে মানুষের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা লাবন্য আমার জীবনে না এলে বুঝতে পারতাম না। মেয়েটা বিয়ের আগেও যেমন সাধারণ ছিলো বিয়ের পরও তেমনি ছিলো, কোনো সাজগোজের বাহুল্য ছিলো না। শুধু আমাকে নিয়ে তার যতো আয়োজন ছিলো ! আমাকে আগলে রাখতো ছোট বাচ্চাদের মতো যেনো হারিয়ে না যাই! প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে সে আমাকে জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ দিলো যে আমি বাবা হতে চলেছি ! আমি খুশিতে লাবণ্যকে কোলে নিয়ে সারাবাড়ি মাতিয়ে ফেলি। বাবাও খুব খুশি হয়েছিলো যে সে দাদা হতে চলছে। বাড়ির সবার মধ্যমনি হয়ে ছিলো লাবন্য। প্রতিদিন বারান্দায় একসাথে বসে জোৎস্নাবিলাস, মাঝে মাঝে রাতে নিয়ন আলোতে দুইজন হাত ধরে হাঁটা, টংয়ের দোকানে বসে চা খাওয়া মাঝে মাঝে চা খাওয়া হতো আমাদের।

সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। সাতমাসের সময় একদিন ছাঁদে উঠতে যেয়ে পা পিছলে নিচে পড়ে যায়। আমাদের সন্তানকে আর বাঁচানো যায়নি আর লাবন্যও কোমায় চলে গেলো। আমি দিন রাত শুধু লাবন্যর পাশেই বসে থাকতাম এই যদি এখনই জ্ঞান আসে তাই ভেবে। নামাজ পরে আল্লাহর কাছে লাবন্যকে ভিক্ষা চাইতাম কিন্তু দশদিন কোমায় থেকে না ফেরার দেশে চলে যায় লাবন্য। ”

ফারহান চুপ করে আছে, হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলে। আমার চোখ থেকে পানি পরছে, কি বলবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। একঘন্টা হয়ে গেছে মিস অন্তি , আপনি এখন যান। আনিস আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে। আমি চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠি। মা যাতে আমার চোখে পানি না দেখে তাই বাসায় যেয়ে বাথরুমে ঢুকে ভালো করে হাত মুখ ধূয়ে নিলাম। মা কি হয়েছে জানতে চাইলে বললাম, চোখের ভিতর পোকা পড়েছে তাই চোখে ব্যথা করছে। না খেয়েই ঘুমিয়ে গেলাম মা আমার পাশে বসে ছিলেন অনেকক্ষণ।

পরদিন আবার মিতুকে পড়িয়ে ফারহানের বাসায় গেলাম। ফারহান ড্রইং রুমেই ছিলো। আমাকে দেখে বললেন, একটু বসুন আমি আসছি। পাঁচ মিনিট পর ফারহান এসেই বললো,উঠুন আমরা আজ রাস্তায় হাঁটবো !
রাস্তায় নিয়ন আলোতে ফারহানকে বেশ সুন্দর লাগছে। এই প্রথম কোনো পুরুষের দিকে ভালো করে তাকালাম। অদ্ভুত একটা মায়া মিশে আছে ফারহানের চেহারায় ! শুধু হাতে ওই সিগারেটটা না থাকলেই হতো।

— বাবার ইচ্ছে আমি আবার বিয়ে করি, সংসার করি, লাবন্যকে ভুলে যাই!

কিন্তু লাবন্য তো আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে আছে। কিন্তু বাবার শেষ ইচ্ছে একটাই, আমার সংসারী জীবন দেখে যাওয়া। তাই মেয়েদেরকে দুই বছরের বিয়ের কথা বলি যেনো কেউ বিয়েতে রাজি না হয়! কিন্তু কি অদ্ভুত , মেয়েরা রাজি হয়ে যায়, আমার হ্যাঁ এর সাথে হ্যাঁ মিলায়। খুব সুন্দর করে সেজেগুজে আসে আমাকে আকৃষ্ট করতে। আমি তো লাবণ্যর মতোই কাউকে খুঁজি যে কিনা আবার আমার জীবনটাকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসবে!

–চলুন চা খাই, মিস অন্তি । এখানের চায়ের স্বাদ খুব ভালো। তারপর আপনাকে আপনার বাসায় দিয়ে আসি। আমি কিছুই বলছি না, শুধু তার কথা শুনছি। চা খেয়ে বাসার পথে রওনায়া দিয়েছি। দুইজন দূরত্ব রেখে হাঁটছি !
ফারহান সেই কখন থেকেই চুপ করে আছে আর আমিও কিছু বলছি না।

–বাসায় কাছাকাছি চলে আসলেই তাকে বললাম, চলে এসেছি। এই তিনদিন আমার জীবনে একটা শ্রেষ্ঠ সময় হয়ে থাকবে। আপনি ভালো থাকবেন। আপনার জন্য দোয়া করি যেন লাবন্য আপুর মতো কেউ আপনার জীবনে আবার আসে !

–সব সময় দোয়াতে কাজ হয় না। আপনিও ভালো থাকবেন মিস অন্তি । আমার কোনো ভুল হলে মাফ করে দিবেন। পকেট থেকে দুটো খাম বের করে হাতে দিয়ে বললেন বাসায় যেয়ে খুলে দেখবেন। তারপর চলে গেলেন, একবারও পিছনে ফিরে তাকাননি ! বিদায় নেয়ার সময় মনটা কেনো জানি ছটফট করছিলো। যতক্ষন তাকে দেখা যাচ্ছিল আমি এক দৃষ্টিতে চেয়েই ছিলাম। বাসায় এসে বাথরুমে ঢুকে খাম দুটো খুললাম। একটাতে বিশ হাজার টাকা আর অন্যটায় একটা চিঠি।

চিঠিতে লেখা ছিলো, অন্তি আমি আপনার মাঝেই লাবন্যকে খুঁজে পেয়েছি । প্রথমদিনে আপনার চোখের ওই লেপ্টে থাকা কাজল আর একপাশের আঠা উঠে যাওয়া টিপ আর আপনার শুকনা মুখ, এগুলো আমার চোখে বারবার ভেসে উঠছে। আমি আপনার কাছে তিনদিন তিনঘন্টা সময় চেয়েছিলাম কারন আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো আর আমার জীবনটা আপনার কাছে তুলে ধরেছি। লাবন্যকে নিয়ে যে পথে হাঁটছিলাম সেটা হুট করেই থেমে গেছে। ওই পথটায় শুধু আপনাকে নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হাঁটতে চাই , যদি আপনার ইচ্ছে থাকে!  আমার শেষ আশ্রয়স্থল আপনি,  আপনাকেই ভালোবাসি  আশায় বেঁচে আছি  একদিন আপনাকে নিয়েই  হেঁটে যাবো বহুদূর,,,,

ঠিক সাতদিন পর কোনো জাঁকজমক ছাড়াই ফারহানের ঘরে এলাম বউ সেজে। একটা নীল শাড়ি, হাতে কাঁচের নীল চুড়ি আর কপালে নীল টিপ পরে বাসর ঘরে বসে আছি। ফারহান কাছে এসেই হাত ধরে বললো,চলো আজ আবার জোৎস্না বিলাস করবো তবে নিয়ন লাইটের আলোতে হেঁটে হেঁটে…. যাবে অন্তি? সবকিছুই আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে, ফারহানের হাতে হাত রেখে মাথাটা তার বুকে লাগিয়ে বললাম, যাবো বলেই তো এসেছি। নিয়ে চলুন আপনার স্বপ্নের রাজ্যে কিন্তু দুই বছরের জন্য নয়, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আপনাকে আগলে রাখতে চাই….

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত