টিয়া আমার মা

টিয়া আমার মা

বাসর ঘরে এসেই বর অামার শাড়িতে অাগুন ধরিয়ে দিলো।অামি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরলাম।অামার কাছে জানতে চাইলো শাড়ি টা অামার পছন্দ হয়েছে কি না। অামি বললাম –

-বিয়ের শাড়ি বলতে অামি লাল রং কে বুঝি।

কথা শেষ করার অাগেই শাড়ির অাঁচলে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে দিলো।অামি ও নিভানোর চেষ্টা করছিলাম না কারন এই ঘটনায় অামি জ্ঞান শূণ্য হয়ে পরেছিলাম।বর-ই অাগুন নিভালো। পেস্ট রংয়ের অাঁচলের এক কোনা পুড়া বিয়ের শাড়ি টা যত্ন করে তুলে রেখেছি। অামার শাশুড়ী তার ছেলে কে বউ পাগলা ডাকেন।অবশ্য নিজে ডাকেন না মানুষ কে দিয়ে ডাকান।শুনেছি অামার শ্বশুর এক কালে বউ পেটানোর উস্তাদ ছিলো,সেই হিসেবে অামার বর মশা ও একটা ভালো করে মারতে পারে না। পরে অাস্তে অাস্তে বুঝতে পারলাম সে তার মায়ের কথা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। বাসর রাতে বিড়াল মারতে হয় বলে একটা কথা অাছে। সেই বিড়াল টা বর অামার শাড়িতে অাগুন দিয়ে মেরেছে। নতুন বউ দেখতে অাসা ভদ্র সমাজের মানুষেরা বললো-

– বউ অত কালো না শ্যামলা অারকি।শাশুড়ীর ছেলে অামার শাড়িতে অাগুন দিয়ে জ্বালাতে পারেনি যতো টা তিনি কথা দিয়ে জ্বালিয়েছেন। টিন এজে গায়ের রং টা নিয়ে বেশ কষ্ট লাগতো।এখন এসব ফালতু বিষয় ছাড়া কিছুই মনে হয় না। অামার যখন ছেলে হবে পুত্রে বধূর সৌন্দর্য দেখবো চোখে কাজল পরিয়ে। প্রথম প্রশ্ন করবো চোখে কাজল পরার অভ্যেস অাছে কি না? অামার প্রথম সন্তান হিসেবে মেয়ে চাই,কারন মেয়ে গুলো কে সাজানোর অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস থাকে অামার মেয়ে বাবু টা যখন বড় হবে তাকে সাজুগুজুর প্রধান সাজ চোখে কাজল পরা শেখাবো। বর অামাকে বললো কালো রংয়ের শাড়ি টা পরতে অার চোখ ভরে কাজল অাঁকতে।

যে লোক বউয়ের পরনের শাড়িতে অাগুন দিতে পারে তার মুখ থেকে এসব কাব্যিক কথা অামার কোন ভাবের উদয় হয়নি বরং সংকিত হয়েছি। রাতে বর দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে,তার হতে কেরোসিনের কুপি বাতি, বাতি টা জ্বালালো। ছোট বেলায় ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে অাম্মা কেরোসিনের কুপির অালোয় রান্না করতেন।অামারা ভাই-বোনদের দিতেন হারিকেন ধরিয়ে।অামাদের অবশ্য কুপিতেই অানন্দ ছিলো,কুপির অাগুনে কাগজ,ঝাড়ুর শলা পুড়াতে বেশ মজা লাগতো।ইলেক্ট্রিসিটি চলে এলে কে কার অাগে কুপি ফুঁ দিয়ে নেভাবো প্রতিযোগিতা করতাম। তার হাতে কুপি দেখে অামি নস্টালজিক হয়ে পরেছি।সে কি করতে চাইছে বুঝতে পারছি না। বর অামার পাশে বসলো,মুচকি হাসি দিয়ে। অামার চিবুকে ধরে কেরোসিনের কুপির অালোয় মুখ দেখছে বেশ যত্ন করে। অামি অজানা এক সংকায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। বাসর রাতের ভয় টা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছি না। অামার গালে অালতো করে একটা চুমু দিয়ে,অামরা নাকের নোলকে অাস্তে টুকা দিয়ে বললো-

– অপূর্ব,কুপির অালো তোমার রুপের কাছে হেরে যাচ্ছে।অামি বিলিন হয়ে যাচ্ছি বউ, অামি বিলিন হয়ে যাচ্ছি।
বরের মুখের এমন কথায় যে কোন মেয়ে,অাহলাদে অাটখানা হয়ে যাবার কথা। কিন্তু অামার ক্ষেত্রে কেনো এমন হচ্ছে না?

-অামি অাম্মার একমাত্র সন্তান। অাম্মা যখন কিছু বলে তখন তার কথা-ই জগতের শ্রেষ্ঠ কথা মনেহয়।বাছবিচার করার মতো ক্ষমতা অামার থাকে না।তোমাকে অামি ভালোবাসি খুশবু। এরপর থেকে মায়ের কথায় উঠবস করা মানুষ টা কে, দিন শেষে অামার বড় অাপন জন মনেহতে লাগলো। অামার পেটে বাবু,শাশুড়ী এক কথা ছেলে বাবু হতে হবে।তার সাথে কথা বাড়ানোর কোন মানে নেই তাই চুপ করে থাকি। বর অামার পেটে হাত দিয়ে বললো – খুশবু অামি একটা বংশ বানাবো,বংশের নাম হবে প্রেমিক বংশ।অামার ছেলের নাম রাখব পিয়ার মহব্বত। না এই নাম রাখা যবে না পুরাতন নাম,ছেলের বন্ধুরা চেতাবে।নাম রাখবো প্রেম সম্রাট। প্রেম সম্রাটের বাপ কে কি বলবো বুঝতে পারছি না,শুধু বললাম অাপনার হাতে কি?

-রক্ত জবা ফুল।
-এতো রাতে এই ফুল অানছেন কেনো?
-চলো জোছনা দেখি,

অাকাশে বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে।পুকুরের জলে তোমার ছায়া পরবে কানে রক্ত জবা।তুমি পুকুরের জলে হাত দিয়ে অমাকে ভিজাবে। চাঁদের রুপ টলমল করবে পুকুর জলে। অামার পোয়াতি বউয়ের রুপের কাছে পোয়াতি চাঁদের রুপ ফেইল মারবে। দৃশ্য টা অামার চোখে ভাসছে,অদ্ভুত সু্ন্দর একটা দৃশ্য।কিন্তু এতো রাতে ঘরথেকে বের হয়ে যাবার সময় এখন অামার নেই।

জবা গাছ টা পাশের বাসার খালার মেয়ে লাগিয়েছে,এইটা ওর গাছের প্রথম ফুল। শ্বাশুড়ি মা দাবী করছে গাছটা শ্বাশুড়ি মায়ের জায়গায় লাগানো হয়েছে। কয়েক বার গাছ টা উপড়ে ফেলতে ও গিয়েছিলো তিনি। বর কি মায়ের বাধ্য সন্তান হবার জন্য গাছ টা উপড়ে ফেলতে গিয়ে, নাকি অামাকে ভালোবেসে ফুল টা ছিঁড়ে নিয়ে এসেছে। কোন কোন প্রশ্ন থাকে সহজে উত্তর পাওয়া যায়,কিন্তু উত্তর টা জানতে ইচ্ছে করে না। অামি কিছু-ই বুঝতে পারিনা।তবে এই পর্যন্ত যা বুঝলাম একটা পাগলখানায় অাছি। অামার মেয়ে সন্তান হয়েছে নাম রাখলাম টিয়া। টিয়ার দাদী টিয়া কে খুব একটা সহ্য করতে পারে না,তার ইচ্ছে ছিলো প্রথমে নাতি হবে। টিয়া স্কুল থেকে এসে অামাকে বললো,

-মা অামি বড় হয়ে কি হবো? অামি কথা শুরু করার অাগেই টিয়ার দাদী কথা কেড়ে নিয়ে বললেন-
-কি অার হইবি ডেগ মাস্টার ছাড়া।

টিয়া তার দাদির অাচরণে কষ্ট পায় বুঝি, তাই তার কথার প্রভাব পরতে দেই না।ক্লাস ফোরে পড়া অামার ছোট্ট মেয়েটার উপর। বাড়ির পাশে মাঠের ওপারে চলেগেছে রেললাইন।বিকেলের ট্রেন ঝকঝক শব্দ করে একেঁবেঁকে চলে যায় দূরে বহু দূরে। টিয়া অার অামি এই দৃশ্য টা দেখতে খুব ভালোবাসি। মেয়েটার এতো কিছু বুঝার বয়স হয়নি,তবে যতটুকু বুঝবে ততটুকুই তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি সেই সময়টায়।

-মা, ডেগ মাস্টার কি?
-গৃহিণী কে বৃদ্ধ মানুষরা এমন করে বলে।

গৃহিণী একটা কাজের নাম,ডাক্তার একটা কাজের নাম,শিক্ষক একটা কাজের নাম।তবে যে কাজই করো অাগে ভালোমানুষ হতে হবে।

-মা,ভালো মানুষ হতে কি করতে হয়?
-কারো খারাপ হয় এমন কিছু করবে না।একটা মজার কথা বলি?
-অাচ্ছা মা।
-এ যে লাল কাপড়,

এইটা দেখালেথেমে থাকা গরু দৌড় দেয়,অার কু ঝিকঝিক করে দৌড়তে থাকা ট্রেন কে দেখালে ট্রেন থামে যায়। টিয়া খুব মজা পেয়েছে কথা টা শুনে বুঝাযাচ্ছে। টিয়ার বাবার শরীর বেশ কয়েক বছর ধরে অসুস্থ। সংসার চালানো বেশ কষ্টের হয়ে পরেছে। সে অাগের মতো অার নেই অসুখে অসুখে তার মায়ের মতোই রুক্ষ হয়ে গেছে। সয়াবিন তেল নেই,টিয়ার বাবার শরীর এতো খারাপ যে দোকানে যাবার কোন উপায় নেই। শাশুড়ী মা টিয়া কে বলতে লাগলেন –

-না হইলি হালের গরু, না হইলি জালের মাছ। টিয়ার বাবা ও তার মায়ের সাথে সম্মতি দিয়ে বললো-
– কপাল খারাপ হইলে যা হয়,অামার ও হইছে তাই।

তাদের সব রাগ ঝাড়ে অামার ছোট্ট মেয়েটার উপর। অামি বেশ অবাক হই এই যুগেও এই ব্যাবধানের মধ্যে তারা পরে থাকে কি করে। কি করে বাবা তার কন্যা সন্তানের উপর বিরক্ত প্রকাশ করতে পারে।

অামি টিয়াকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছি।মেয়ে টা কে একটা প্লেটে ভাত নিয়ে বিভিন্ন সাইজের চার টা লোকমা করতে হয়।ওর বাবা,মা,দাদী অার টিয়া তারপরে খায়। মেয়ে টা কে স্কুলে দিয়ে সংসারের কাজ সারতে ব্যাস্ত হয়ে পরি। টিয়ার অাব্বা কে গোসল করিয়ে উঠানে পেতে রাখা চেয়ারে বসিয়ে চা অানতে ঘরে গেলাম। দুপুরে চা খাবার অভ্যেস অামার নেই। তারপরও অামারা জন্য ও এক কাপ চা নিলাম। চাল লবন দিয়ে ভেজে ছাতু করেছি।চালে ভাজার ছাতু দিয়ে টিয়ার দাদী চা খেতে পছন্দ করেন। বাহিরে চিৎকার চেচাঁমেচি শুনে অামার বুকের ভেতর টা মুচড় দিয়ে উঠলো।একটা শব্দ -ই বেশি শুনা যাচ্ছে টিয়া,টিয়া,টিয়া।অামি পাগল হয়ে দৌড়ে বাহিরে চলে গেলাম। অামার ছোট্ট মেয়ে টার জন্য অাজ হাজার প্রাণ রক্ষা পেয়েছে।ট্রেন লাইনের অস্বাভাবিকতা টিয়া বুঝতে পেরেছে তার মাথায় পরা লালা ওড়না টা দিয়ে ট্রেন থামিয়েছে। অনেকেই মেয়েটা কে পুরুষ্কৃত করতে চাচ্ছেন। টিয়ার দাদী টিয়া কে কোলে নিয়ে শিখিয়ে দিচ্ছে-

-শোন বইন, তোমারে কইব এতো টাকা দিয়ে কি করবে?

তুমি কইবা টাকা এতিমখানায় দিয়া দিবো।এতিম খানার বাচ্চা গুলো যাতে সুন্দর মতো চলতে পারে।এতিম বাচ্চা গুলার কষ্টেের কথা শুনলে খুব কষ্ট লাগে। এই কথা বললে দেখবা লোকে তোমারে অারো কত কিছু উপহার দিবে,বাহঃ বাহঃ দিবে। টিয়ার বাবা বসে অাছে,তার শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না। টিয়ার সাথে কথা বলার জন্য সাংবাদিক সহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এসেছেন। অামি মেয়েটা কে সুন্দর একটা জামা পরিয়ে,চুলে একটা ঝুটি করে দিতে দিতে বললাম- কেউ যদি খুশি হয়ে তোমাকে কিছু দিতে চায় তুমি তা খুশি মনে নিবে। অন্য কাউকে দিতে হলে তিনি তো নিজেই দিতে পারতেন।উপহারের জিনিস নিজের জন্য রাখতে হয়।উপহার দাতার সামনে উপহার দান করা তার জন্য অসম্মানের। না টিয়া এতো কঠিন কথা হয়তো সহজে বুঝবে না অারেকটু সহজ করে উদাহরণ দিয়ে বলতে হবে।
বললাম-

– টিয়া তোমার ডলি অান্টি তোমাকে খুশি হয়ে একটা লিপস্টিক উপহার দিয়েছিলো।তুমি যদি এটা তার সামনে তোমার বান্ধবী অহনা কে দিয়ে দিতে চাইতে।তাতে তিনি খুব কষ্ট পেতেন তাই না। তুমি সে দিন অনেক ভালো অার বুদ্ধিমাতীর কাজ করেছো।তাই খুশি হয়ে এক অাঙ্কেল তোমাকে কিছু টাকা উপহার দিবে।তুমি চাইলে তোমার জন্য টাকা দিয়ে জামা কিনতে পারবে,তুমি অনেক বই কিনতে পারবে,অনকে অনেক চকোলেট কিনতে পারবে। টিয়া এতো মানুষ দেখে ভয় -লজ্জা জড়সড় হয়ে যাচ্ছে। অামি কোলে নিয়ে বসে অাছি, পাশে অাছে বসে অাছে টিয়ার বাবা। এক সাংবাদিক বললেন-

– তুমি এতো টাকা দিয়ে কি করতে চাও টিয়া? টিয়া চুপ করে অাছে,একবার অাকাশের দিকে তাকায় অারেক বার ওর বাবার দিকে তাকায়। অামার বুকে মুখ গুঁজে ধীরে ধীরে বললো-

-বাবা কে বিমানে করে বিদেশে নিয়ে যবো,বাবা সুস্থ হয়ে যাবে। অামার বুক ফেঁটে যাচ্ছে কান্না অাসছে না। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মেয়ে কে বুকে জড়িয়ে নিলো টিয়ার বাপ।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত