বউ

বউ

আজ যে আমার বিয়ে হবে সেটা আমি সকালেও জানতাম না। দুপুরে ভাত খাচ্ছি হঠাৎ খালা এসে হাজির। বাজান তাড়াতাড়ি আমার সাথে চল এক্ষুণি বিয়ে করেএকটা মেয়ের জীবন বাঁচাতে হবে। আমার বাপ,মা মরে যাওয়ার পর এই খালা আমার একমাত্র আপনজন পাশের গ্রামে থাকে। খালা তুমি বললে আমি সব কিছু করতে পারি আর এ তো সামন্য বিয়ে। কিন্তু ঘটনা কি? ঘটনা মারাত্মক বাজান, আমার দেওরের মা মরা মেয়ে নুরী।নুরীর সৎ মা বুড়ো বেটার সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছে।

মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, চাচি ঐ বুড়ো খাটাসরে বিয়ে করার আগে আমি গলায় ফাঁস দেবো। আগামী কাল বিয়ে। তুই আজই বিয়ে করে নুরী রে তোর বাড়িতে আনবি। ভ্যান ভাড়া করে গ্রামের হাট থেকে একখান লাল শাড়ি, চুরি, লিপস্টিক আর কাজল কিনে খালা রে সাথে নিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছি। খালার বাড়িতেই বিয়ে হলো। নুরীর আব্বা আমার দু’হাত ধরে বললো,মা মরা মেয়ে সৎ মার সংসারে অনেক কষ্ট করেছে ওরে তুমি সুখে রেখো বাজান। নুরী সবাই কে জড়িয়ে ধরে একটু কান্নাকাটি করে ভ্যানে উঠে বসলো।

আমার কাছে সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে , এখনও পর্যন্ত ভালো করে বউ এর মুখ দেখতে পেলাম না। ভ্যানে বসে আড়চোখে বউএর মুখ দেখার চেষ্টা করছি। হঠাৎ নুরী ঘোমটা সরিয়ে বললো,দেখেন তো আমার কাজল কি লেপ্টে গেছে? কান্নাকাটি করছি তো, মুখখান কি বেশি কালো লাগছে? কাজল একটু লেপ্টে গেছে আস্তে করে মোছো উঠে যাবে। আমি আন্দাজে কিভাবে মুছবো?আপনি একটু মুছে দিতে পারছেন না?গ্রামের লোকজন তো আপনারে মন্দ বলবে। তারা বলবে, আক্কাস আলি বিয়ে করে বউ আনছে এক্কেবারে সাড়া গাছের পেত্নী। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে কাজল মুছতে গেছি। ও আল্লা আপনার তো দেখি হাত কাঁপে। থাক আপনার মোছার কাজ নেই আমি মুছছি। সন্ধ্যার পরপর বাড়িতে এসে হারিকেন ধরালাম। আপনার বাড়িতে আর কেউ থাকে না? নাহ্ আমি একাই থাকি,এই একখান ঘরই আমার।

নুরী অবাক হয়ে বললো,বাসর ঘরে একটু আধটু ফুল না থাকলে হয়? আমার কত শখ বাসর ঘরে ফুল থাকবে।
মনে মনে ভাবলাম বউটার এতো ফুলের শখ! কিন্তু এতো রাতে ফুল কোথায় পাবো? উঠানে মাচায় লাউ, কুমড়ো গাছে ফুল ধরে আছে তাই তুলে এনে বউয়ের হাতে দিলাম। এই ফুল দিয়ে আমি কি করবো? এখন কি ফুল ভেজে দেবো? আপনি খাবেন? আরে না দুপুরের ভাত তরকারি আছে তোমার রান্না করতে হবে না। তুমি বললে বাসর ঘরে ফুল থাকবে তাই নিয়ে এলাম। এই ফুল! আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি একটু বাইরে যান আমি খাট সাজাই। একটু পরে ঘরে ঢুকে দেখি লাউ, কুমড়োর ফুল বিছানায় ছড়িয়ে মধ্যেখানে ঘোমটা মাথায় দিয়া বউ বসে আছে।দুরুদুরু বুকে বউয়ের মাথা থেকে ঘোমটা ফেলে হারিকেনের আলোয় বউয়ের মুখ ভাল করে দেখলাম। কি মায়াভরা মুখ!

আচ্ছা একটা ধাঁধার উত্তর দেন তো দেখি আপনার মাথায় কেমন বুদ্ধি। ভাসুর শ্বশুর দেখলে দিই, পর পুরুষ দেখলে দিই, আপনি আমার আপনজন কিন্তু আপনারে দেখলে দিই না বলেন তো কি? আমি জানিনা বউ, বলে দেও। আজ সারারাত মাথা খাটান না পারলে কাল বলবো। নুরী তুমি আমারে আপনি করে বলছো কেন? তুমি করে বলো। ও আল্লা এইটা আপনি কি বলেন ! আমার আব্বা বেয়াদবি শিখাইনি।আব্বা বলেছে যারা বয়সে বড়ো তারা গুরুজন। গুরুজনদের কখনও তুই তুমি বলতে হয় না। আপনি আমার থেকে দশ বছরের বড়ো তো হবেনই আমি আপনারে তুমি করে বলতে পারবো না । নুরী কেমন ঠোঁট টিপে হাসছে।আমি ভালো করে বুঝেতে পেরেছি, এই মেয়ে আমার জীবন তেজপাতা করে দেবে। নুরী খুব সাংসারিক মেয়ে।সেই ছোটকালে মা’র ভালবাসা পাইছি আর এখন নুরী ভালবাসে। মেয়েটা খুব ভান করে, দেখায় সে আমারে একটুও ভালবাসে না কিন্তু আমি তো বুঝি।

দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় নুরী আল্লাদি গলায় বললো, আপনি আমারে একটা নুপূর বানিয়ে দেবেন? আমার খুব শখ।
ঠিক আছে বউ ধান উঠলে বানিয়ে দেবো। হাসি আনন্দে কিভাবে যে ছয়মাস পার হয়ে গেল! রাতে ঘুমিয়ে আছি হঠাৎ নুরী ধাক্কা দিয়ে বললো, একটা ধাঁধার উত্তর দেন তো, কোন গাছ একবার ফল দিয়ে মরে যায়? এইটা একটা কথা হলো বউ! রাত দুপুরে ধাঁধা! বলেন না, স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙছে মনটা খুবই খারাপ। পারবো না বউ, তুমি বলে দেও। এইটা হলো কলাগাছ।আমার মনের মধ্যে কু ডাকছে মনে হয় আমি ও কলাগাছের মতো একবার ফল দেবো। বউ তুমি কি কও না কও ! তুমি কি গাছ যে ফল দিবা? বেক্কল মানুষ! ঘুমান। হঠাৎ মাথার ভিতরে চিড়িক দিয়ে উঠলো, উত্তেজনায় উঠে বসে বউয়ের গায়ে ধাক্কা দিয়ে বললাম, বউ তোমার কি ছেলে মেয়ে হবে ?

যতটা বেক্কল ভাবছিলাম ততটা না। আমি আব্বা হবো এতো বড়ো আনন্দের খবর তুমি আমারে এখন দেচ্ছো বউ! আনন্দে সারারাত ঘুম হলো না। আমার সাধ্য অনুযায়ী নুরীরে যত্ন করতে লাগলাম। সকাল থেকে নুরী যেন কেমন করছে।বউ খারাপ লাগছে? আপনি দাইরে খবর দেন।আর চাচিরে আনতে লোক পাঠান। ঘরের ভিতর থেকে নুরীর চাপা গোঙানির আওয়াজ আসছে।আমার বুকের ভেতরটা ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে, আহারে মা হওয়া এতো কষ্টের!একটু পরে বাচ্চার কাঁন্নার আওয়াজ পেলাম। ঘর থেকে খালা বের হয়ে বললো,আক্কাস রে তোর ছেলে হয়েছে তবে নুরীর অবস্থা খুব খারাপ সদরে নেওয়া লাগবে রক্ত কিছুতেই বন্ধ হচ্ছেনা। জলদি ভ্যান ঠিক কর।

সদর আমাদের গ্রাম থেকে দশ মাইল দূরে। ভ্যানে করে নুরীরে নিয়ে যাচ্ছি।নুরীর মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। ইশারায় আমাকে কাছে ডেকে আস্তে আস্তে বললো আপনি মানুষটা বেক্কল হইলেও বড্ড ভালো।আপনার সাথে আর আমার থাকা হলো না, আফসোস আমি সৎমার অত্যাচার সহ্য করেছি আমার ছেলেরও সৎ মা’র অত্যাচার সহ্য করতে হবে। আপনি আমারে কথা দেন আমার ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি বউ তোমার ছেলেটারে মানুষের মতো মানুষ করবো।আর একটা কথা দিলাম নুরীকে, আমার ছেলের উপরে কোনদিন ও সৎ মায়ের ছায়া পড়তে দেবো না কিন্তু সেই কথা নুরী আর শুনতে পেলো না তার আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেল। নুরী চলে গেছে আজ ছাব্বিশ বছর।নুরী রে, দেওয়া কথা আমি রাখিছি ছেলেটা এখন ডাক্তার। সৎ মায়ের ছায়া ওর উপর পড়তে দিইনি। অনেক কষ্টে মানুষ করিছি।

আজ আমার ছেলের বিয়ে বৌমা ও ডাক্তার। দুইজনের আগে থেকে ভাব ভালবাসা আছে।বাসর ঘর নিজের হাতে লাউ আর কুমড়ার ফুল দিয়া সাজায়ছি। হাত ধরে বৌমাকে ঘরে নিয়া আসলাম। বৌমা অবাক হয়ে ঘর সাজানো দেখছে। এতো সুন্দর করে ঘর কে সাজিয়েছে আব্বা? অনেক রকমের ফুল দিয়ে ঘর সাজানো দেখেছি কিন্তু লাউ আর কুমড়োর ফুল দিয়ে সাজানো এই প্রথম দেখলাম। আমি সাজায়ছি গো আম্মা , আপনার পছন্দ হয়েছে? আপনার শ্বাশুড়ি আম্মা রে যখন বিয়ে করে আনছিলাম তখন সে লাউ, কুমড়োর ফুল দিয়া ঘর সাজায়ছিল। খুবই সুন্দর হয়েছে আব্বা । আম্মারে আপনি অনেক ভালবাসতেন তাই না আব্বা? আম্মা এই নুপূর দুটো নেন।নুরীর খুব নুপুরের শখ ছিলো। টাকার অভাবে বানাতে পারিনি, যখন বানালাম তখন নুপূর পরার পা নেই। আপনি নুপূর পায়ে দিলে আমি খুব খুশি হবো গো আম্মা।

আব্বা আপনাকে আর একা একা গ্রামে থাকতে হবে না। আমরা গ্রামে চলে আসবো, আপনার ছেলে বলেছে গ্রামে হাসপাতাল বানাবে। আম্মার মতো গ্রামের আর কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। কি বলছেন আম্মা! সব সত্যি? হ্যাঁ আব্বা আপনার ছেলে তো হাসপাতালের নামও ঠিক করেছে ” নুরী দাতব্য হাসপাতাল ” খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু হবে। আনন্দে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ঝাপসা চোখে আমি স্পষ্ট দেখলাম কাজল লেপ্টে যাওয়া অতি মায়াময় একখানা মুখ, ঠোঁট টিপে হাসছে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত