আমি বাড়ি পৌঁছানোর আগেই অনিতাকে কন্যা সাঁজে সাঁজানো হয়ে গিয়েছে, বাড়িতে চেনা অচেনা অনেক লোকজনের সমাগম ,
বাড়িটা আজ বিয়ে বাড়ির মত লাগছিলো,, কিন্তু বাড়িতে নেই কোনো ফ্যান্ডেল নেই আলোর ছড়াছড়ি, কেউকে রঙ ঢং করতেও দেখছি না যে !
বিয়ের মতো কোনো আমেজও নাই! বিয়েবাড়িতে একটু হৈহোল্লর না থাকলে কি চলে ? জীবনে কত বিয়ে বাড়ি গিয়েছি,
এমন বিয়ে বাড়ি এর আগে কখনো দেখিনি ! সবাই কেমন চুপচাপ ! প্রকৃতি ও যেনো নিরবতা অবলম্বন করছিল, কিঞ্চিত বিস্মিত হলাম,
ব্যাপার কি ? ভীড় ঠেলে ঘরে গিয়ে বুঝতে পাড়লাম,
.
অনিতা এর আগেও একদিন বধুর সাঁজে সেঁজেছিল, সেদিন বধু হয়ে এই ঘরে এসেছিল, বিশেষ কিছু দিয়ে গোসল করানো হয়েছে ,
ওর পাশে যেতেই তার শরীর থেকে আতরের সুগন্ধি সুভাবাস ভেসে আসছিলো, বউ মানুষ তো তাই হয়তো একটু সুগন্ধি কিছু ব্যবহার করছে !
আর আমি মনে করতেছি আতর ? পড়নে সাদা কাপড়, বধুরা কেন সাদা কাপড় পড়বে ? কিন্তু আমি তো তার এক ঘেঁয়েমির খবর জানি.
সে একবার যা ভালো মনে করবে সেটাই করবে, তাই হয়তো আজ সাদাটাই বেছে নিয়েছে!
.
অনিতা নিদ্রার পুরের অতল গহব্বরে ডুব দিয়েছে, পরিশ্রান্তের চাদর গায়ে মুড়িয়ে পরম সুখে ঘুমাচ্ছিল, ঘুম কাতরে মেয়ে,
সে ঘুমিয়ে গেলে ওর নাক- মুখ-ই ওর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়না, বরাবরের মত এবারো সে নিশব্দে ঘুমাচ্ছে,
মুখের দিকে তাকালে খুব নিস্পাপ লাগছিল, অনেক পবিত্র ও মনে হচ্ছে,যেনো স্বর্গের পুণ্যতায় ঘিরেছিল তাকে,
অপ্সরীদের অনিতাকে আজও অনেক সুন্দরও লাগছিল, ঘুমের মধ্যে মেয়েদের দেখতে সুন্দর লাগে, তার ওপর সে আমার স্ত্রী,
তাই হয়তো একটু বেশি ভাবছি, অনিতার জন্য আনা একজোড়া নূপুর পকেটে রেখে দিলাম, এই ভেবে..ঘুমথেকে উঠে যখন
নূপুর খানা আমার হাতে দেখবে তখন অনেক খুশি হবে ,ঘুম থেকে উঠলেই দিবো।
.
কিন্তু নূপুর খানা পড়তে পারবে বলে মনে হয়না, ঘুম থেকে উঠেই তো অনিতা তার আসল বাড়িতে নাইওর চলে যাবে.. স্ত্রীর
সাথে স্বামী যাবে তাই ভেবেছিলাম যুগলমিলনের টানে তার সাথে আমিও যাবো, কিন্তু না আদৌ আমার যাওয়া হবেনা, আজ সে
একাই যাবে, এই বাড়িতেও আর ফিরবেনা সে, তাহলে কি ধারণা করে নিয়েছেন অনিতার সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে ?…
না আজ কোনো ঝগড়া হয়নি তার সাথে, তাহলে কেনো সে ফিরবেনা ?.. ধরনী নামের কষ্টের তীরে জীবন যখন অসহ্য দহনে পুরে,
তখন সে মুক্তি চায়, কোনো এক মোড়ে এসে সে জীবন মুক্ত হয়, তখন আর সেই মুক্ত জীবন ধরণী নামের কষ্টের তীর ভিড়তে চায় না,
তাই সে ও আর ফিরবে বলে মনে হয়না।
.
বউকে বিদায় দিতে সবাই কেমন জানি ব্যস্ত হয়ে পরেছে, একমাত্র আমি-ই ব্যস্ত হইনি , আমিতো কখনো চাইনি সে চলে যাক,
শত রাগ অভিমান করলেও আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা কখনো ভাবেনি সেও, তবে আজ তাকে রেখে দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও
যে আমার নেই,,অনিতার কিনারা ঘেঁষেই বসে আছি, ইতিমধ্যে অনিতাকে বহনকারী গাড়ি উঠানে এসে উপস্থিত হয়েছে গিয়েছে।
.
অনিতা তখনও ঘুমাচ্ছিল, ঘুম কাতরে মেয়ে, তাই আর তাকে জাগিয়ে তুলতে চাইলাম না, আস্তে করে নিজের কোলে তুলে নিলাম,
খুব শীতল লাগছিল তার শরীর,শিরা উপশিরা যেনো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল,তাও ধীরেধীরে গাড়িতে নিয়ে ওর শরীর এলিয়ে দিলাম,
সবাই ওর জন্য কিছু সদাইয়ের যোগাড়যন্ত্র করলো । চার চাকা বিশিষ্ট গাড়ির চালকও চারজন. তার মধ্যে আমি একজন,
অনিতার গাড়িটা কাঁধে নিয়ে ধীয়গতিতে হাঁটতে লাগলাম, পা দুইখানা এগুচ্ছিলনা, তবে অনিতার আসল বাড়ি অব্দি গাড়িটা পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হইনি।
.
গাড়িথেকে আবারো আমি একা তাকে কোলে তুলে নিলাম, ওর ঘরের দিকে চলে গেলাম, আস্তে করে বিছানায় শুয়ে দিলাম,
ওর মুখখানা আবারো দেখতে চাইলাম, কিন্তু কেউ একজন আমার হাত ঝাপটে ধরল,শেষ বারের মতও দেখতে দিলোনা,
মন চাইছিলো একবার বলি…. অনিতা একবার চোখ মেলে তাকাও, দেখো তোমার ভালোবাসার মানুষ কি নিষ্টুর ভাবে কোথায় রেখে যাচ্ছে তোমায়।
.
নেই কোনো আলো, নেই কোনো বাতাস,নেই কোনো প্রিয়জনের আশ, নিকষকালো সে ঘর, আজ থেকে একা’ই থাকতে হবে এখানে !
কিন্তু একা থাকতে সে যে খুব ভয় পায়! আমায় ছাড়া সে যে থাকতে পারবেনা ! আমায়ও সাথে নিবেনা, সে যতই কষ্ট হোক একাই থাকতে হবে !
.
ঘরের ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কয়েক টুকরো কাঁচা বাঁশ মাত্র, তার উপর কিছু ঝুড়ি মাটি ,
সবাই মিলে সেই মাটি গুলা সুন্দর করে ফাঁক গুলা পূরণ করছিলো, আমিও নিজ হাতে মাটি গুলা ঠিক করে দিচ্ছিলাম,
যেনো পৃথিবীর কোনো সুখ-দুঃখ সেখানে পৌঁছাতে না পারে, সাথে আমার খবরটাও যেনে না পৌঁছায় সেই ব্যবস্তাই করে দিচ্ছিলাম,
প্রিয়জন থাকবে বলে কথা, প্রত্যেকের’ই কোনো না কোনো প্রিয়জনের বিচরণ আছে এই ঘরগুলাতে, তাই এই ঘরটা সবার চেনা,
হ্যাঁ এটা অনিতার হাতের মাফে বানানো সাড়ে তিন হাত মাটির ঘর.
.
একে একে সবাই চলে গেলো তখন, শুধো আমি’ই দাঁড়িয়ে তাকলাম কবরের পাশে.. পকেট থেকে সেই নূপুর জোড়া বাহির করে দেখতে লাগলাম.
আর বলতে লাগলাম “এই নূপুর জোড়া তোমায় দিবো বলে এনেছিলাম, কিন্তু তা আর দেওয়া হলো না চলে গেলে তুমি না ফেরার দেশে..
কথা দিয়েছিলে জীবনে মরণে পাশে থাকবে, কিন্তু আজ সে কথা রাখোনি।
.
তুমি নামক অস্তিত্বটা আজ বিবর্ণ , আজ আমি বিষণ একা , মুক্ত তোমার বিহঙ্গ, জরা-জির্ণতায় পরিপূর্ণ আমার মন, জানতে পারি ?
কেনো কথা রাখোনি ? তুমি পারোও বটে.. হা হা হা.. অট্টহাসি – হাসি আমি . বেগম রোকেয়ার একটা প্রবন্ধের কথা মনে পরে গেল “
অর্ধাঙ্গী` ` .. স্ত্রী নাকি স্বামীর অর্ধেক অঙ্গ ? অর্ধাঙ্গীনি এই অধ্যায়টা সেদিন বুঝিনি ,আজ সেই কথাটার মর্তমার্থ বুঝেছি,
তবে আজ মনে হচ্ছে আমি অর্ধাঙ্গহীন, অর্ধেক আছে তবুও পুরোটাই অসম্পূর্ণ এই আমি. ওর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে শেষ বারের
মতো এই দোয়াটাই করেছিলাম- অনিতা যেনো ভালো থাকে যোজন দূর দেশে।.. ভালো থেকো অনিতা!
.
এর পর থেকে কারণেঅকারণে হাসা ও কাঁদা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে, ধীরে ধীরে সব দুঃখ কষ্টের অবসান ঘটে আমার,
জীবন আমায় মুক্ত করে দিলো ,বেঁচে আছি আমি স্ট্যাচুর মতো, জীবনের কোনো স্বাদ ভোগ করতে পারছিনা, নিকটতম অতীতের
কোনো স্মৃতি’ই আমার মনে পরেনা, শুধো মাঝে মধ্যে বিরামহীন ভাবে সাইদ,,সাইদ,, বলে কেউ আমায় ডাকে।
.
ঘোর কাটিয়ে দৌড়ে ছুটে যাই আকাশের নিচে, ছানাবড়ার মতো দুই চোখ দিয়ে আকাশের তারাদের মধ্যে কেউকে খুঁজে বেড়াই ,
কিন্ত না কেউকে দেখতে পাইনা তো, আকাশের দিকে তাকিয়ে হলদে হওয়া দাঁত বাহির করে খিলখিল করে হাসতে থাকি,
কষ্ট ছাড়া অবুঝ শিশুদের মতো অযথা কাঁদি, এদিক ঐদিক ছুটাছুটি করি, মাথার চুল ছিঁড়ি..পাগল প্রলাপে ব্যস্ত থাকি সব সময় ।
.
চিকচিকে কালো সাড়ে তিন ইঞ্চি লম্বা চুল গুলা এখন ময়লায় দুসর বর্ণ ধারণ করে কাঁধে আছড়ে পরছে, খুঁচা দাড়ি গুলাও
বুকের মধ্যভাগে চলে এসেছে, দুই ইঞ্চি গোঁফ গুলাও দাঁত দিয়ে কামড়ে দেই মাঝে মধ্যে, ছিঁড়ে যাওয়া গোঁফের সুখে হি হি করে হাসি,
প্রয়োজন ছাড়া কেউ আমার কিনারা ঘেঁষে না আর যাও দুই একটা পাগল ঘেঁষে তারাও নাক চেপে ধরে কথা বলে.শেষ কবে
গোসল করছি সেটাও মনে নাই…হি, হি,হি,হি, কি অদ্ভুত আমি তাই না ?
.
রোজ দুইবার দুই-তিনজন লোক আমায় ধরে নিয়ে যায়, একটা পরিত্যক্ত রুমের অলস বিছানায় জোড় করে শুয়ে দেয়, এপ্রন পরা
পঞ্চাশঊর্ধ একজন এসে পাঁচ সি, সি সিরিঞ্জের দাঁড়ালো সুচ দিয়ে ইন্টারমাস্কুলার ইঞ্জেকশন পুশ করে দিয়ে চলে যায়, কিছুক্ষণ সময়
অচেতন হয়েই পরে থাকি সেই রুমে, ক্ষণিক পর আবারো ঘুম ভাঙে কোনো উন্মাদের চেঁচামেচিতে,কি বলি আমি নিজেই তো
একটা উন্মাদ, তাও অন্যদের উন্মাদ বলছি…হি, হি, হি, হি !
.
কোথায় থাকি আমি জানেন ?
উত্তর দক্ষিণ পূর্ব,এই তিন দেয়াল ইট সিমেন্টের তৈরী, আর পশ্চিমের দেয়াল লোহার শিখলে তৈরী, সে ঘরের বাসিন্দা এখন আমি,
সব সময় এক জোড়া নূপুর থাকে আমার পকেটে, তাই হয়তো আমায় ও নূপুর পড়িয়ে দেয়া হয়েছে… হি হি হি, কি আজব ?
পুরুষ মানুষ আবার নূপুর পরে ? পড়ে তবে সেটা লোহার নূপুর, পাগলাগারদে এটা দিয়ে পাগলদের বেঁধে রাখা হয় .. হি. হি. হি. হি …