ফিরে পাওয়া

ফিরে পাওয়া

মিতুকে প্রথম দেখাতেই আমি চিনে ফেলেছি৷ ৮-১০টা মেয়ের মতো শাড়িতে মিতুকেও বেশ দারুণ মানিয়েছে৷ আমার ইচ্ছে হচ্ছিল মিতুকে কাছে ডেকে এনে৷ সামনে বসিয়ে রেখে বলি, ভালো হয়ে বসোতো৷ দেখে মনটা জুড়াই৷” আমার ইচ্ছের কথা ভেবে আমার নিজেরই হাসি পাই৷ আমি মিতুর কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে বাঁচি৷

সেদিন শরীফ ভাই যখন অফিসের সবার সাথে মিতুর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল৷ আমি টুপ করে সরে পরি৷ বলতে গেলে এর পরের কয়েকটা দিন আমি মিতুর কাছ থেকে একেবারে লুকিয়ে চলেছি৷ আগে কাজ না থাকলে অফিসের কলিগদের সাথে আড্ডা দিতাম৷ ওদের কাজের মাঝখানে গিয়ে আমি বকবক করে বিরক্ত করতাম৷ সবাই হাসিমুখে মেনে নিতো৷ অফিসের নীরু আপা উনার সরু নাকটা ফুলিয়ে বলতো, আমি বেঁচে থাকলে তোকে একটা বধির মেয়ের সাথে বিয়ে দিবো বুঝলি৷” নীরু আপার কথা শুনে হাসতাম আমি৷ আপার রান্নার হাত ভালো৷ আপাকে বিরক্ত করার এটাও বড় কারণ৷ আপার বকা শেষ হলে মিনমিন করে বলতাম, চলো লান্ঞ্চ পাল্টায়৷” আপা ফিক করে হেসে উনার লান্ঞ্চটা আমার হাতে দিয়ে বলতো, তুই আসলেই বেহায়া৷” আমার দিনকয়েক চুপচাপ থাকাটা নীরু আপার চোখ এড়ায়নি৷ নীরু আপার সাথে আমার কথা হয়েছে তিনদিন৷

-শুনলে মিতু৷ আজকে বিরিয়ানী এনেছি৷ কেউ লান্ঞ্চ পাল্টালে বলো৷” আমি চোখ তুলে তাকাতেই অবাক হলাম৷ নীরু আপা মিতুকে সাথে নিয়ে আমার ডেক্সের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ নীরু আপা ভ্রু কুচকে বলল,

-কিরে পাল্টাবি নাকি?”

জবাবে আমি কিছু বললাম না৷ মিতুর দিকে তাকালাম৷ মিতুর মুখে নির্লিপ্ত ভাব৷ আমার ভেতরটাতে প্রশান্তি বয়ে যায়৷ চিনতে পারেনি হয়তো৷

-চিনিস মিতুকে?” বলল নীরু আপা৷ জবাবে আমি মাথা নাড়ালাম৷
-ও কিন্তু বধির না বুঝলি৷”

আমি বুঝলাম নীরু আপা সুদে আসলে মজা নিচ্ছেন আমার উপর৷ আমি তাও কিছু বলিনা৷ কাজে মনোযোগ দেয়ার ভান করি৷ নীরু আপা আর মিতু মিনিটখানেক বাদে প্রস্থান করলো৷ আমি দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে গা টা এলিয়ে দিয়ে চোখ দু’টো হালকা বন্ধ করে রাখি৷”

-শুভ্র!” অফিস থেকে বেরোতেই নীরু আপার ডাক পরলো৷ আমি স্মিত হেসে সায় জানালাম৷
-কিরে কি হয়েছে তোর?
-কিছু না তো৷
-চল৷
-কই?
-বাসায়৷
-অন্য আরেকদিন৷
-বিরিয়ানী রেঁধেছি চল৷
-ইচ্ছে নেই৷
-পরেরবার কখনো যদি শুনি “আপা লান্ঞ্চ পাল্টাবা?” গালের চামড়া কষিয়ে ফেলবো৷ ধুর হ৷”

বলে হাঁটা ধরে নীরু আপা৷ প্রথম কয়েকটা কদম জোরে পা ফেলে চললো৷ তারপর আস্তে ধীরে হাঁটছে৷ মানুষটা খুব জানে, আমি পেছন থেকে দৌঁড়ে গিয়ে তার পথ আগলাবো৷ এই নিঃস্বঙ্গ শহরে এই মানুষটাকে আমার খুব আপন লাগে৷ নীরু আপার সাথে আমার পরিচয়টা এই অফিসের চাকরীর সুবাদে৷ একটু আধটু বিরক্ত করতে করতে মানুষটাকে আমি আপন করে ফেলেছি৷ নীরু আপার ছোটভাই ছিল একটা৷ আমার নামে নাম৷  চাকরীর মাস ছয়েকের মাথায় আমার ডেস্কের সামনে এসে নীরু আপা বলেছিল,

-জানিস আমার একটা ভাই ছিল৷ তোর নামের নাম৷ আমাকে জ্বালাতো খুব৷ কয়েকদিনের জ্বরে হুট করে মারা গেল৷ আমার সেকি দুঃখ৷” সেদিনের পর থেকে জ্বালানোটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছি আমি৷ নীরু আপাও উপভোগ করে আমার জ্বালানোটা৷  মাঝে মাঝে আমাকে বলে বসে,

-তুই আমার কাছে চলে আয় ভাই!”
-আমার একটা বৌ হলেই চলে আসবো!” নীরু আপা মাথায় হালকা চড় লাগিয়ে বলে,
-শখ কত৷” একটু দৌঁড়ে নীরু আপার পাশ ধরে হাঁটা ধরি আমিও৷ একটু যেতেই থামলো নীরু আপা৷ বিরক্তি নিয়ে বলল
-বেকুব কেন তুই এতো? হেঁটে যাবো নাকি?”

নীরু আপা আমাকে বেকুব কিংবা বেহায়া ডেকে বড্ড মজা পায়৷ সুযোগ পেলেই নতুন কিছু নাম আবিষ্কার করে বসে এই মহিলা৷”

-তুই পাল্টে গেলি কেন হুট করে?”

প্রশ্ন করে নীরু আপা৷ আমি মনযোগ দিলাম না ততটা৷ ভাতের প্লেটটা আমার সামনে থেকে টান দিলো নীরু আপা৷
আমার ভেতরটাতে অস্বস্থি ভর করে৷

-উত্তর দে৷
-এমনি৷
-মিতুকে চিনিস তুই?
-নাহ৷ নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলাম আমি৷ নীরু আপাকে দেখে মনে হল,উত্তর শুনে ব্যাথিত হয়েছে৷
– তুই মিথ্যে বলছিস?
-হ্যা!
-সত্যিটা কী?

-তোমাকে আমি আরো একটা মিথ্যা বলেছি জানো! এই যে বলেছিলাম, শুধু এই শহর না৷ এ পৃথিবীজুড়েই আমার কেউ নেই৷ কথাটা মিথ্যে৷ আমার একটা বাবা আছে৷ একটা মা আছে৷ তবে সেটা নিজের মা নয়৷ আমার নিজের মাকে আমি কখনো দেখিনি৷ আমার বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে আমার বাবাও নিষ্ঠুর হতে শুরু করেছিল৷

এই যে মিতু৷ মিতু মেয়েটাকে আমার বড্ড ভালো লাগে৷ এই ভালোলাগার শুরুটা মিতুর বড় বোনের কাছে পড়ার সময় থেকেই৷ কয়েকজন মিলে একসাথে পড়তাম৷ মিতু আমাদের সামনে বসে থাকতো৷ আমার ভালোলাগাটা তাকানোর মধ্যেই আটকে ছিল৷ কথা বলা হয়ে উঠেনি কখনো৷ মাসের শেষ হলেই আমার লজ্জার সীমা থাকতো না৷ মিতুর বড় আপা যখন বেতনের কথা তুলতো৷ আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকতাম৷ বাবার কাছ থেকে বেতন চাওয়ার দুঃসাহস আমার হতো না৷ তবুও মাঝেমধ্যে চেয়ে বসতাম৷ আব্বার মেজাজ ভালো থাকলে,পরে দিবো আর মেজাজ খারাপ থাকলে তুফান বয়ে যেতো৷

মাসকয়েক এভাবে কাটিয়ে আমার আর যাওয়া হয়নি পড়তে৷ মিতু আমাদের স্কুলেই পড়তো৷ আমার চেয়ে দুই শ্রেণী নিচে৷ মিতুর পুরনো কথা তোলার বাতিক ছিল৷ আমার বন্ধুদের কেউ তার আপার হাতে পিটুনি খেলে৷ বান্ধবীদের কাছে সেই ঘটনার বর্ণনা করে মজা পেতো মেয়েটা৷ এই জিনিসটা আমার বড্ড অপছন্দের ছিল৷ দেখা হতো মাঝেমাঝে৷ ভালোলাগার চেয়ে বিব্রত হতাম বেশি৷ কখন বলে বসবে, বেতন না দিয়ে পালালে কেন শুনি?” তারপর সবাই মিলে খিলখিল করে হাসা শুরু করবে৷ আরা আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবো৷ মিতুর হাসিটা বড্ড সুন্দর ছিল৷ এখনের হাসিটার মতো না৷ জানো নীরু আপা! মিতুর এখনের হাসিটা আমার মিথ্যে লাগে৷ মিতুর হাসিটা যখন লুকিয়ে দেখি আমি৷ আমি খুব ইচ্ছে করে সামনে গিয়ে বলি, তুমি সত্যিই হাসছো তো?”

সেদিন মিতুকে দেখেই আমার গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল৷ হুট করে পুরনো কথা মনে করিয়ে দিলে আমি লজ্জায় মরে যাবো৷  মনে হয় মেয়েটা আমাকে চিনেনি৷ কয়েকটা রাত আমি ভালোভাবে ঘুমোতে পেরেছি৷” নীরী আপার দিকে তাকালাম আমি৷ ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে৷ আমি ভাতের প্লেটটা সামনে টেনে আনি৷ নীরু আপা আবার কেড়ে নেয়৷ প্লেটটা নিজের হাতে তুলে বলল,

-হা কর৷” আমি তৃপ্তির সাথে খাওয়া শেষ করি৷ শহরটা আসলে ততটা নিষ্ঠুর না৷ যতটা আমি ভাবি৷ নীরু আপা আমার হাতে একটা খাম তুলে দেয়৷ “কিসের” জিজ্ঞেস করতেই বলল, মিতুর বিয়ের!

আমার ভেতরটাতে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করি৷ মিতুর মায়ামায়া মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে৷ আফসোস লাগে আমার৷ এই জীবনে মেয়েটাকে পাওয়া না হলেও একবার অন্তত বলা উচিত ছিল, ভালোবাসতাম,ভালোবাসি মেয়ে৷ একবার আমার হাত ধরে হাঁটবে?” মিতু রাজি হতো কিনা জানা নেই৷ বিষণ্ণতা বুকে নিয়ে রাস্তার পাড় ধরে হাঁটি আমি৷ রাস্তার পাশে মাথা ফেলে শুয়ে আছে পাগলটা৷ আমার ইচ্ছে হল,হাতের খামটা তার মাথার নিচে রাখি৷ রাস্তার ঘষা থেকে বাঁচবে মাথাটা৷ পরক্ষণে মনে হল, একটু পড়া যাক৷ বিয়ে খাওয়া হয়নি অনেকদিন৷ উপহার হিসেবে আমার এক আকাশ জমানো অনুভূতিগুলো মাখিয়ে একটা চিঠিও লিখবো৷” খামটা খুলতেই অপ্রস্তুত হলাম একটু৷ সাদা দু’টো কাগজ৷ দু’টোর পেছনে নাম্বার লিখে দেয়া৷ ১ আর ২৷ অদ্ভূত লাগলো৷ প্রথমটায় খুললাম৷ শুভ্র!

তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর আপুর পড়ানোগুলো দেখা হয় না আমার৷ অবশ্য আমি তোমাকেই দেখতাম৷ মাসশেষে তোমার অসহায় মুখটা দেখলেই আমার ভেতরটা মুচড়ে উঠতো৷ আমি জানি, আমার সামনে ছোট হতে তোমার খারাপ লাগতো৷ মাঝে মাঝে আমার দিকে লুকিয়ে তাকাতে তুমি৷ সেটা আমি খুব বুঝতে পারি৷ মাসের শেষদিকে আর তাকাতে না৷ বই এ মুখ বুজে থাকতে৷  তারপর হুট করে হারিয়ে গেলে একদিন৷ জানো সেদিন এর পর থেকে প্রচন্ডরকমের মন খারাপ ঘিরে ধরেছিল আমাকে৷ স্কুলে অকারনে সামনে পরতাম তোমার৷ তুমি লুকিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে সেটা আমি খুব বুঝতাম৷ আমার পুরনো কথা তোলার বাতিক ছিল৷ তুমি ভয়ে থাকতে সেটা নিয়ে৷ অভ্যাসটা আমার থাকলেও,তোমার জন্য অভ্যাসের রাজ্যটা আমি গায়েব করে দিতাম৷

তোমার বন্ধু অয়ন বলেছিল, আমাকে নাকি ভালো লাগে তোমার৷” কথাটা শুনতেই আমার ভেতরটা নেচে উঠেছিল৷ যদিও সেটা পুরনো কথা৷ পরক্ষণেই অয়ন বলল, তুমি নাকি বলেছো৷ যার প্রাইভেট বেতন দেয়ার সাধ্য নেই৷ সে প্রেম নিবেদন করবে কিভাবে?” আমার ভালোলাগাটা নিমিষেই মন খারাপে পরিণত হলো৷ ভাবলাম,আমিই তোমাকে শুনাবো আমার অনূভুতির গল্পগুলো একদিন৷ জানো শুভ্র? তোমার কাছে আপুর পাওনাগুলো আমি শোধ করে দিয়েছি৷ আমার জমানো টাকাগুলো দিয়ে৷ আমার মানেইতো তোমার তাইনা? তারপর থেকেই তোমাকে খুঁজছি৷ টাকাগুলো চাইবো বলে৷” পড়া শেষ করে আমি লম্বা শ্বাস নিলাম৷ প্রশান্তি বয়ে যায় আমার প্রত্যেকটা কোষে৷ দেরী না করেই পরের কাগজটা খুললাম৷

“শুভ্র স্যার৷ আপনি আমার একটু উপরে তাই স্যার বললাম৷ লুকিয়ে তাকানোর অভ্যাসটা ছাড়তে পারেননি দেখছি৷
লুকিয়ে লাভ নেই অবশ্য৷ আমার পাওনাগুলো দিয়ে দিবেন বলছি৷ পাওনাগুলো সুদে আসলে ভালোবাসায় উন্নীত হয়েছে৷ আমি বলছি, এক আকাশ ভালোবাসা দিয়ে আমার পাওনাগুলো মিটিয়ে দিবেন৷ আর শুনুন, নীরু আপা সিদ্ধান্ত পাল্টেছে৷ দেখে শুনে ভাইয়ের জন্যতো আর বধির মেয়ে বিয়ে করাতে পারবেনা৷” চলে আসুন৷ নয়তো তুলে আনা হবে৷”

ইতি
হবু প্রেমিকা কিংবা বৌ”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত