পাশের ফ্ল্যাটের লিমা আন্টি খুব করে বলেছিল যেন, তার ছোট মেয়ের জন্মদিনে আমি এটেন্ড করি। আন্টি এতো করে বললো তাই নিষেধ করতে পারি নি। আমি আন্টিকে বলেছিলাম অবশ্যই আমি এটেন্ড করবো। এসব জন্মদিন, বিয়ের দাওয়াত মূলত আমি এড়িয়ে যাই। কিন্তু কেনো যেন আন্টির কথা ফেলতে পারলাম না। কিন্তু আমার কাছে গিফট কেনার কানাকড়ি পয়সা ও নেই।
বাবা গত কয়েক মাসের বাড়ি ভাড়ার টাকা টা এখনো দেয় নি। এবার আমার পরিচয় টা দেয়া যাক, আমি ফাল্গুনী, বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। পড়ালেখা করার জন্য খুলনা এসেছি ফ্রেন্ড এর বাসায় সাবলেট হিসেবে। আমি যেই ফ্ল্যাটে সাবলেট থাকতাম তার পাশের ফ্ল্যাটেই লিমা আন্টি থাকে, খুব আদর করে আমাকে। যার জন্মদিনে এটেন্ড করবো সেই পরীটার নাম আজনি। আজনির জন্মদিনে আমার ফ্রেন্ড বিহা এটেন্ড করতে পারবে না তার কারণ সেদিন তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে যাবে। আমি রীতিমতো টেবিলে বসে বসে ভাবছি যে কয় টাকা আছে তা দিয়ে আমার ক্লাস টেস্টের ফি দিতে হবে। কি গিফট দেয়া যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না, পরেই মনে পড়লো একটা রঙিন কাগজে কিছু ডিজাইন করে সেটাই গিফট দিলে মন্দ হবে না। কারণ আজনি ডিজাইন খুব পছন্দ করে। আমি আজনির জন্য গিফট বানানো শুরু করলাম।
বিহা পাশে এসে বললো- “ফাল্গুনী এইসব ডিজাইনিং করে কি গিফট আর বানাবি, জন্মদিনে অনেক নামিদামি মানুষ আসবে তাদের গিফটের কাছে তোর এই গিফট অনেক তুচ্ছ মনে হবে। আর তখন তুই অপমানিত হবি নিজে থেকেই। এর চেয়ে ভালো আমি এক হাজার টাকা দেই সেটা দিয়ে কিছু কিনে নিয়ে আয়।” আমি মনোযোগ দিয়ে ডিজাইন করছি, তার কথার রেসপন্স করি না বলে সে আবার বলা শুরু করলো- “কিরে কি বললাম শুনিস নাই?” আমি এবার ডিজাইন করা রেখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম- “না বিহা, আমি তোর টাকা নিবো না। আর কেনোই বা নিবো গিফট তো গিফট-ই তাই না। যে যার সাধ্যমতো গিফট দিবে এখানে অপমানের কি আছে। আমি কোনো অপমানিত হবো না। তুই যা বলছিস তার কোনো যুক্তি দেখতে পাচ্ছি না।” বিহা এবার বিরক্তিকর ভঙিতে আমার হাতে টাকা টা দিয়ে চলে গেল। কিন্তু আমি এই টাকা কোনোমতেই নিবো না। ছোটবেলা থেকেই আমার আত্মসম্মানবোধ টা একটু বেশি।
যার কারণে আমি তার টাকাটা ফেরত দিতে যাবো তখনি শুনি বিহার আম্মু বিহাকে বলছে- “বিহা তুমি কি ফাল্গুনী কে বাড়ি ভাড়ার টাকা টা দিতে বলো নি?” বিহা উত্তর দিচ্ছে এভাবে- “আম্মু আস্তে বলো, সে শুনতে পেলে মন খারাপ করবে। আর তার ফ্যামিলিতে একটু প্রব্লেম আছে তাই দিতে পারছে না। আংকেল টাকা টা দিলেই বাড়ি ভাড়াটা সে সবার আগেই দিবে।” আন্টি এবার উচ্চস্বরেই বলছে- “জানি না কিছুই এই টাকা দিতে বলবা তাড়াতাড়ি।” বিহা আন্টির রুম থেকে বের হচ্ছিলো বিধায় আমি যে এইসব কথা শুনেছি তা যেতে সে না বুঝে তাই জোরে জোরে ডাকতেছি বিহাকে। বিহা আমার কাছে এসে বলে -“কি হয়েছে?” আমি তাকে তার টাকাটা ফেরত দিয়ে বললাম- “তুই খুব ভালো করেই জানিস, আমি যা বলি তাই করি। টাকাটা নে আর আমাকে তোর কালার পেন টা দে।” বিহা কিছু না বলেই তার কালার পেন আমাকে দিয়ে তার রুমে চলে গেল।
আমি আমার রুমে বসে বসে ডিজাইন করছি আর ভাবছি কিভাবে আন্টিকে বাড়ি ভাড়ার টাকা টা দিবো। আমরা মধ্যবিত্ত, বাবার ব্যবসায় লস গেছে অনেক বার। খুব কষ্ট হয় বাবার টাকা দিতে। আমি এই সব কিছুই জানি। কোনমুখে যে টাকা চাবো তাই ভাবছিলাম। কিছু দিন পরে জন্মদিনে এটেন্ড করতে যাব, আমার ড্রেস তেমন দামি না। গতবার রোজার ঈদে বাবা এক হাজার টাকা দিয়েছিল ড্রেস কেনার জন্য। সেই টাকা দিয়ে যেই ড্রেস টা কিনেছিলাম এটা পরেই সব জায়গায় যেতাম বলে ড্রেস টা কেমন যেন ঝলসে গেছে। তবুও সেই ড্রেস টাই পরেছি আর জুতা বাসার টাই পরেছি, কারণ পাশের ফ্ল্যাট এই তো যাবো। বিহা সকালে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে চলে গেছে। একটু সাজার কসমেটিক্স ও আমার নেই। না সেজেই সেই ডিজাইন করা গিফট নিয়ে আজিনের জন্মদিনে গেলাম। কলিং বেল দিতেই আন্টি দরজা খুলে বললো- “আসো মামনি, ভিতরে আসো।
এই আজিন দেখ তোর ফাল্গুনী আপু আসছে।” আমি মুচকি হাসি দিয়ে আজিনের কাছে গিয়ে বললাম- “হ্যাপি বার্থডে মাই ডিয়ার ফেইরি।” আজিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে- “থ্যাংক ইউ, আপু। কিন্তু এই ফেইরি মানে কি আপু?” আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম যে আজিন ফেইরি মানে বুঝবে না। তখন বললাম- “ফেইরি মানে পরী। তুমি তো পরীর মতো সুন্দরি তাই তোমাকে ফেইরি বললাম।” এবার আজিন বললো- “ওহ আচ্ছা, আপু আমার গিফট কোথায়?” আমি তাকে আমার সদ্যকৃত ডিজাইনের গিফট টা দিয়ে বললাম,” এটাই তোমার গিফট, খুলে দেখো কেমন হয়েছে। আর এটা তোমার ফাল্গুনী আপু নিজে করেছে।” আজিন গিফট টা দেখে অনেক খুশি হয়েছিল। আন্টি এসে গিফট দেখে বললো- “মামনি তোমাকে এসব নিয়ে আসতে কে বলেছে?” আমি কিছুই বললাম না। জাস্ট মুচকি হাসি দিলাম।
সেখানে অনেক বিত্তশালী লোক এসেছিল। অনেক নামিদামী গিফট ও দিয়েছিল। সেগুলোর মাঝে আমার দেয়া গিফট নিতান্তই তুচ্ছ মনে হচ্ছে। তখন বিহার কথাটা বার বার মনে পরছিলো। আসলেই তখন মনে মনে অনেক অপমানবোধ হচ্ছিলো। সবাই যখন গিফট খুলছিল দেখার জন্য যে কে কি গিফট করেছে, তখন আমার গিফট টা দেখে সবার মুখ চুপসে গেল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার দেয়া গিফট খুবই তুচ্ছ।
যখন চলে আসবো আজিনদের বাসা থেকে তখন আন্টির কাছে গিয়েছিলাম বিদায় জানাতে, তখন শুনতে পাই আন্টি আংকেল কে বলছে- “ফাল্গুনী এমন চিপ গিফট করবে ভাবতেও পারি নাই। আর কি একটা ড্রেস পরে আসছে দেখছো। এর চেয়ে সুন্দর ড্রেস তো আমার কাজের মেয়েটাই পরেছিল।” কথাটা শুনে বিন্দু পরিমাণ সময় দাঁড়াই নি। বাসায় চলে আসছিলাম। যখন দরজায় গিয়ে জুতা পরছিলাম, তখন অন্য এক গেস্ট ও বের হচ্ছিলো। আমার জুতা দেখে উনি উনার মুখের এক বিশ্রি ভঙ্গী করলো। যেন এমন জুতা কেউ পরেই না কখনো। বাসায় এসে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম বিহার আম্মু ফোনে বলছে- “ফাল্গুনী কালকের ভিতরে বাড়ি ভাড়া না দিলে, কালকেই তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো। শুধু বিহার জন্য কিছু করতে পারি না আমি। কিন্তু কালকে আর রেহাই নেই।
আমি কথাগুলো শুনার পর সাথে সাথেই ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম। আমার কানের রিং ছিল দুইটা আর নুপুর ছিল পায়ে। আমার বাবা অনেক শখ করে এগুলো কিনে দিয়েছিল। এগুলো একটা প্যাকেটে মুড়াই করে সাথে একটা চিঠি লিখে, সেগুলো বিহার টেবিলে রেখে বাসা থেকে বের হয়ে গেছি তখনি। চিঠিতে লিখেছিলাম এমন- “আন্টি, আমি আপনাদের বোঝা ছিলাম। এখন আর কেউ বোঝা থাকবে না। যে কয় মাসের বাড়ি ভাড়া জমেছিল সে টাকার তুলনায় আমার এই কানের রিং আর নুপুর এর মূল্য কোনোদিকে কম হবে না। বরং বেশি-ই হবে। আর অনেক ভুল করেছি আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি, দয়া করে মাফ করবেন।
ইতি-
অভাগী ফাল্গুনী ”
রাস্তায় হাঁটছি আর ভাবছি, টাকাই সব কিছু। টাকা ছাড়া কারো কোনো মূল্য নেই। আজ মধ্যবিত্ত বলে এমন হয়েছে আমার সাথে, কিন্তু আল্লাহ আমাকে একা করে দিবে না। আল্লাহ মধ্যবিত্ত বা বিত্তশালী বুঝে না, উনার কাছে সবাই সমান। রাত হয়ে আসছিলো, আসলেই উনি আমাকে একা করে দেন নি। বৃষ্টি পরছিলো অঝোরে, তখনি বুঝে গেলাম আমি একা নই, আল্লাহর রহমত আছে আমার সাথে।
আজ ছয় বছর পর, আমি একটা প্রাইভেট ব্যাংকের ম্যানেজার হিসেবে যথেষ্ট সম্মান পাচ্ছি। সেই দিনগুলোর মতো এখন আর আমার দিন কাটে না। বাবা কে আর কষ্ট করে টাকা দিতে হয় না। বরং আমি বাবা কে মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দেই। কারো জন্মদিন বা বিয়ে এখন আর আমি এভোয়েট করি না। এটেন্ড করি এবং নামিদামী গিফট ও দেই। সেই বিহার আম্মুর সাথে এখন দেখা হলে আন্টির জন্য শাড়ি নিয়ে যাই প্রত্যেকবার-ই, খালি হাতে উনাদের বাসায় যাই না। হুম এটাই আমার,আমাদের মধ্যবিত্তের গল্প। হতে পারে আমরা মধ্যবিত্ত, কিন্তু আমাদের মন কিন্তু মধ্যবিত্ত নয়। উদার মনের মানুষ এই জাতিরা।