বাসস্ট্যান্ডের ফুলের দোকান থেকে কয়েকটি গোলাপ আর রজনীগন্ধা ফুল নিয়ে বাড়ি ফিরছি। ফুলগুলো আমার বাবার জন্য। বাবা’কে আমি বড্ড ভালোবাসি। এত এত বন্ধুর ভীড়ে সেরা বন্ধুটাও আমার বাবা। আমি যখন প্রথম প্রেমে পড়ি বাবা আমার চেহারা, চলাফেরা দেখেই বুঝতে পেরেছেন। এই সময়টা একসময় তিনিও পার করেছেন। বাবা মাছ ধরতে ভালোবাসতেন।
একদিন বিকেলে ঘুম ভাঙ্গার পর মা বললেন, তোর বাবা বলেছে পুকুরপাড়ে যেতে। আমার বুঝতে বাকি নেই বাবা আমাকে কিছু বলবেন। আমার আর বাবার অসংখ্য কথার সাক্ষী এই পুকুরপাড়। বাবা গালে হাত দিয়ে পুকুরে বড়শি ফেলে বসে আছেন। গালে হাত দিলে অমঙ্গল হয় এমন কুসংষ্কার তিনি বিশ্বাস করেন না। আমাকে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে বসতে বললেন। জানতে চাইলেন ঘুম কেমন হলো? আমি হাসি মুখে বললাম, অনেক ভালো হয়েছে। ফুরফুরে লাগছে শরীরটা। বাবা বললেন, তোমাকে কিছু পরামর্শ দেব বলে ডেকে এনেছি। আমি আগ্রহ দেখিয়ে বাবার দিকে দৃষ্টি দিয়ে মনোযোগী হলাম। বাবা বলতে শুরু করলেন…
আমরা দুই ভাই দুই বোন। অর্থ্যাৎ তোমার একজন চাচা ও দুইজন ফুফু ছিলেন সেটা তুমি জানো। তোমার মতো ছাত্র থাকাকালীন আমার জীবনে একটি প্রেম আসে। তুমি আবার মনে করো না আমি এসব কী ধরনের কথা বলছি। তোমার হয়তো কাজে আসবে সেজন্যই কথাগুলো বলা। তোমার দাদা যখন মারা যান তখন তোমার ফুফুদের বিয়ে হয়নি। আমরা অথৈ সাগরে সাতার কাটার মতো বিপদে পড়লাম। তোমার দাদার যে দুইটা নৌকা ছিল গঞ্জে গঞ্জে মাল আনা নেয়া করার জন্য, আমরা দুই ভাই সে দুই নৌকার হাল ধরলাম। তোমার দুই ফুফুকে আমরাই বিয়ে দিয়েছি। বাবার দ্বায়িত্ব আমরা পালন করেছি। তোমার চাচা বিয়ে করলেন। যখন আমার বিয়ের সময় এলো তখন খেয়াল করে দেখলাম, আমার জীবনে যে প্রেম এসেছিল তা আমি অনেক দূরে রেখে এসেছি। বাবার অর্পিত দ্বায়িত্ব, বোনদের সুখী করার চেষ্টা আর মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে একসময় দেখি আমার হাসিটুকু বিলীন। দূরে রেখে আসা মানুষটি অন্যের হয়েছে অনেক আগেই। আমি অনেক কষ্ট পেলাম। কিন্তু যখন বাড়িতে এসে দেখতাম মা, বোন সবাই সুখী। তখন নিজেকে সুখীই মনে হতো। তোমাকে কথাগুলো বললাম, আমার কেন যেন মনে হলো তুমি আমার সেই রেখে আসা বয়সটাতে পা রাখতে যাচ্ছ। তোমাকে কথাগুলো জানানো দরকার ছিল।
বাবার কথাগুলো মনের ভিতর গেঁথে নিলাম।
আমাদের পরিবারে আমরা চারজন। বাবা-মা, ছোট বোন রেশমা আর আমি। রেশমা এবার দশম শ্রেণীতে পড়ে। আমি অনার্সে ভর্তি হয়েছি গত বছর। বাবা মাঝে মধ্যেই অসুস্থ থাকেন। যৌবনকালে কমদামী বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আজ এই দশা। বাবা কৃষি কাজ করেন। রাস্তাঘাট উন্নত হবার কারণে এই যুগে আর নৌকা লাগে না মাল আনা নেয়া করার জন্য। বেশ কিছু জমি গফুর চাচার কাছে বন্ধক রেখে বাবা টাকা এনেছেন। আমার আর রেশমার পড়ালেখার খরচ যোগানোর জন্য। আমি জানি আমাদের এই কৃষি কাজ দিয়ে আর বন্ধকী জমি ছাড়ানো যাবে না। একমাত্র চাচা মারা গেলেন মাস চারেক আগে। তারপর থেকে বাবা মানষিকভাবে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছেন। আমার পড়ালেখা শেষ হতেও বেশ দেরি। বিবেকের সাথে লড়াই করে পেরে উঠছিনা কিছুতেই। আমার জীবনেও এখন প্রেম আসাটা উচিত নয়।
বাবা যেদিন মারা গেলেন সেদিন ভোরে খুব বৃষ্টি ছিল। আমি আমার প্রিয় বন্ধুটাকে হারিয়েছি। বাবা বলতেন কখনো খুব বেশি আবেগী হবে না। তাহলে বাস্তবতা সামলাতে খুব কষ্ট হবে। আমি চোখের জলকে বাঁধা দিয়ে রাখতে পারিনি। এতটুকু আবেগ আমার থাকবেই। আমি বাবা হারিয়েছি, প্রিয় বন্ধু হারিয়েছি। শক্ত পাথর হতে তো পারব না। বাবা’কে দাফন করে এসে নিজেকে শক্ত করেছি। বাড়িতে মা বুক চাপড়ে কাঁদে, ছোট বোনটা কাঁদে। আমিও যদি এভাবে কাঁদতে থাকি তাহলে পরিবেশ সামাল দেব কী করে?
রিক্সাওয়ালা ভাইয়ের ডাকে বাস্তবে ফিরে এলাম। ভাড়া মিটিয়ে ফুলগুলো নিয়ে বাবার কবরের দিকে যাচ্ছি। এলাকার কবরস্থানেই বাবা’কে দাফন করা হয়েছিল। কবরস্থানের কাছাকাছি যাবার আগেই এলাকার এক চাচা আমাকে ডেকে দাঁড় করালেন। কাছে এসে বললেন, “বাবা শামীম, আমরা না মুসলমান? কবরে ফুল দিতে হয় না। তুমি কবর জিয়ারত করে বাবার জন্য দোয়া করো। বাবার জন্য সন্তানের দোয়া আল্লাহ তাড়াতাড়ি কবুল করবেন ইনশা আল্লাহ।”
উনার কথা আমার হৃদয় ছোঁয়ে গেল। দুর্বা ঘাসের উপর ফুলগুলো রেখে বাবার কবরের কাছে গেলাম। বৃষ্টিতে উঁচু করে দেয়া মাটিগুলো সমান হয়ে আছে। কবর জিয়ারত করে দোয়া করার সময় মনের অজান্তে গাল বেয়ে পানি নেমে এলো চোখ থেকে। ফুলগুলো নিয়ে বাড়ি এলাম। মা কোরআন মজিদ পড়ছেন পাশের ঘরে। আমি বাবার খদ্দরের চাঁদরের ভাঁজে ফুলের পাঁপড়ি সাজিয়ে দিলাম।
বাবা মারা যাবার আগেরদিন রাতে আমি বিছানার পাশে বসা ছিলাম। বাবা তখন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি যেমন আমার প্রিয় বন্ধু। আমার আরেকটা প্রিয় বন্ধু আছে। নরসিংদী শহরে বাড়ি করেছে, সেখানেই থাকে। তুমি যদি কখনো খুব বেশি বিপদে পড়ো তখন তার কাছে যাবে। সে তোমাকে সহযোগীতা করবে। তোমার খাতায় আমি তার ঠিকানা লিখে রেখেছি।” আমি জানতাম না পরদিনই বাবা মারা যাবেন। নরসিংদী ঘন্টা চারেকের পথ। ফোন নাম্বার জানা ছিল না। বাবার মৃত্যু সংবাদ উনাকে দেয়া দরকার ছিল। বাবার মৃত্যুতে অনেক কিছুই এলোমেলো হয়ে গেল। সংসারের হাল এবার ধরতেই হবে আমাকে। কিন্তু কিভাবে? এই লেখাপড়ায় চাকরি হবে না।
একদিন শীতের ভোরে বাবার খদ্দরের চাঁদরের ভাঁজে থাকা ফুলের শুকিয়ে যাওয়া পাঁপড়িগুলো ড্রয়ারে রেখে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। জমিতে নেমে পড়লাম লাঙ্গল নিয়ে। তখন মনে পড়ল, বাবা তার বন্ধুর কথা বলেছিলেন। উনাকে খবরটা দেয়া দরকার। বাবা বলেছেন বাবার প্রিয় বন্ধু তিনি। দুপুরে বাড়িতে এসে খেয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম নরসিংদীর উদ্দেশ্যে।
বাবার বন্ধুর নাম মোতালেব খন্দকার। উনার নরসিংদী বাজারে চাউলের আড়ৎ আছে। ঠিকানা বের করতে সমস্যা হয়নি। বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি অনেক দুঃখ প্রকাশ করলেন। অনেকক্ষন চুপ করে ছিলেন। উনাকে খবর দিতে পারিনি তাতেও তিনি কষ্ট পেয়েছেন। বন্ধুকে শেষবারের মতো দেখতে পেলেন না। রাতে আমাকে থাকতে বললেন। রাতের খাবার খেয়ে বারান্দার চেয়ার পেতে বসলাম আমি আর মোতালেব চাচা। চাচী সন্ধা রাতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ছেলে মেয়ে দু’জনই ঢাকায় লেখাপড়া করেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের আর্থিক অবস্থা এখন কেমন? সংসারের হাল ধরব কিভাবে? আমি চাচাকে বললাম, কিছু জমি বন্ধক রেখেছিলেন বাবা। বাকিটুকু আমি চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু লেখাপড়া হবে না হয়তো। চাচা আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, হবে না কেন? আমি কি মরে গেছি? কিছুটা অবাক কিছুটা ভালোলাগা কাজ করছিল। বাবা হয়তো এজন্যই বলেছিলেন, বিপদে পড়লে যেন তার বন্ধুর সাথে দেখা করি।
মোতালেব চাচা বললেন, “তোমার চাচা তোমার বাবাকে দুটি নৌকাই দিয়েছিলেন। নদীতে ব্রীজ হবার পর তোমার বাবা নৌকাদুটো বিক্রি করে দিলেন। মালবাহী বড় নৌকা, তখনই অনেক টাকা বিক্রি হয়েছিল। আমি তখন মাত্র চাউলের দোকান নিয়েছি বাজারে। টাকার খুব প্রয়োজন। তোমার বাবা আমাকে টাকাগুলো দিলেন। বললেন তুই আমার একটা ব্যাংক। আমার পরিবারের কোনো বিপদ হলে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে উদ্ধার হবো। আমি চাই না আমার ছেলে মেয়ে আমার মতো অথৈ সাগরে সাতার কাটুক। জানো বাবা? তোমাদের নিয়ে তোমার বাবা অনেক চিন্তা মগ্ন থাকতেন।” চাচার মতো আমার চোখেও পানি। একটি পরিবারের কর্তা হলে একজন বাবা হলে, স্বামী হলে কত চিন্তা থাকে। কত দ্বায়িত্ব থাকে কর্তার।
মোতালেব চাচা আমার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, ষোল বছর ধরে ব্যবসা করছি। এখন আল্লাহর রহমতে আমার অনেক আছে। তোমার বাবাও অংশীদার। তুমি লেখাপড়া বন্ধ করো না। আমার ছেলে মেয়ের মতো তোমাদের ভাই বোনের লেখাপড়ার দ্বায়িত্বও আমার। তোমাদের পরিবারের সকল দ্বায়িত্ব আমার। মনে করো সে দ্বায়িত্ব তোমার বাবা নিজেই আমার উপরে দিয়ে গেছেন। বাড়ি যাবার পথে বৃষ্টি এলো খুব। আমারো খুব ভিজতে ইচ্ছে হলো। বাবা মারা যাবার দিন ভোরেও বৃষ্টি ছিল। বাবার অদৃশ্য পরশ যেন আমার সারা শরীর ছোঁয়ে দিচ্ছে। মিস ইউ বাবা।