কোমরে আচল গুঁজে হাস মুরগী গুলোকে খোপে যাওয়ার তাড়াকরছে কাজল। সূর্যটা হাড়িয়েগেছে সামনের গ্রামের আড়ালে। মসজিদের মাইকে এখনই হয়ত আযানের ধ্বনি ভেসে উঠবে। সন্ধ্যা হলেই প্রতিদিন কাজল প্রচন্ড ব্যাস্ত হয়েপরে। হাস মুরগী গুলোকে খাবার দিতেহয়, খোপে তুলতে হয়। উত্তরের ভিটাহতে ছাগলটা আনতেহয়।
ছয় বছর বয়সী ছেলেটাকে ডেকে আনতে হয়। নইলে সে খেলারসাথীদের সাথে একমনে খেলতেই থাকবে। ফেরার নাম স্বরনেও আনবেনা। তাকে এনে হাত পা ধুয়েদিয়ে পড়তে বসাতে হয়। প্রতিদিনের মত আজো সবকাজ শেষকরে- ছেলেকে পড়তে বসিয়ে নিজে একটু চৌকিতে শরীরটা এলিয়েদেয়। সারাদিন ঘড়ের এ কাজ সে কাজ করে শরীরটা একদম নুঁয়েপরে। একটুপর তাকে আবার উঠতে হবে। তার স্বামী মাইনুলের আসার সময় হয়েগেছে ।
রাজমিস্ত্রির কাজকরে সে। সেই ফজরের নামাযপরে বেরহয় আর ফিরে রাতে। কাজ ছেড়ে বাজারে কিছুটা সময় ব্যয়করে তবেই ঘরে ফিরে তিনি। আলগাকরে চেঁপেরাখা দরজা খোলার শব্দে কাজল উঠেবসে। ছেলেটা পড়াফেলে উঠে দৌরেগিয়ে বাপের হাতেথাকা ঠোঙ্গাটা নিয়েনেয়। এই লোকটা আল্লাহর ত্রিশটাদিনই কিছু না কিছু নিয়ে আসবে ছেলে আর বউয়ের জন্য। কখনো চানাচুর,কখনো বাদাম,কখনো শিঙ্গাড়া কিংবা পিয়াজু আর নাহয় মুড়ির মোয়া। মাইনুল- কি বাজান লেহা পড়া শেষ! না আব্বু আর একটু পড়লেই হইয়া যাইব। আচ্ছা পড় তাইলে। এই ছেলেকে নিয়ে মাইনুলের স্বপ্ন অনেক বড়। নিজে পড়ালেহা করতে পারেনাই। অল্প বয়সে বাপ মইরাযায়। তখন সবেমাত্র নবম শ্রেনীর ছাত্র। মেধাবী ছিল যথেষ্ট। কিন্তু বাস্তবতার নির্মম ছোবলে সংসারের জোয়াল নিজের কাধে তুলেনিতেহয়।
বড় বোনের বিয়ে,ছোট বোনের লেহাপড়া আর সংসারের চাইরটা মাইনষের খাওন যোগাইতে হয় তারে। হিমমম- মা,২বইন আর নিজে এই চাইরনিয়েই তহন তার সংসার। খেটে পিটে দুই বইনরেই বিয়াদিছে মাইনুল।
বেশ ভাল ঘরেই ওদের বিয়া হয়েছে। স্বামী সংসার নিয়ে দুবোনই মাশআল্লাহ বেশ সুখেআছে। তারপর মায়ের আবদারে কাজলকে ঘড়েতুলে সে।পাঁচগ্রাম পরের গ্রামে কাজলদের বাড়ি। বাপ মা নাই। ভাইয়ের হাতে মানুষ হওয়া মেয়েটা। যেদিন কাজলকে দেখতে গিয়েছিল- সেদিনতো মাইনুলের হাত পায়ে কাঁপনই উঠেছিল। মায়ের সাহস হল কিকরে- এত সুন্দরী মেয়েকে আমার বউ করার!! মেয়েতো নয় এযেন সাক্ষাৎ পরী। বারান্দাহতে কাজলের ডাকআসে- কি অইল খাইতে আহনা কেন!! মাইনুল ছেলেকে নিয়ে খেতে যায়। খাওয়া শেষকরে ঘুমাতেযায় ওরা। বিছানাতে শুয়ে সারাদিনের জমানো কথা একে অপরের সাথে বলেচলছে। মাঝে মাঝে ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও তৈরী করেওরা। ছেলেটা ঘুমিয়েপরেছে।
মাইনুল – কাজল শরীলডা বেশ ব্যাথা করতেছে। একটু মালিশ কইরা দিবা??
কাজল- পারুমনা। সারাদিন তুমিও খাটছো আমিও খাটছি। মাইনুল চুপকরে পাশফিরে শুয়েরইল। বেশ রাগ হচ্ছে কাজলের উপর। স্বামীর কথা এভাবে কেউ ফিরিয়ে দেয়!! বজ্জাত মহিলা। কিন্তু এ রাগ মনেমনেই চলে। প্রকাশ করার সাহস মাইনুলের নেই। আবার এই কাজলকে নিয়ে মাইনুল নিজে নিজেই বেশ গর্বকরে। কি সুন্দর তার চেহারাখান। দেখে মনেহয় কোনো ধনিঘরের মেয়ে। মায়ায় জড়ানো চাহনি তার। স্বপ্নেও ভাবেনি মাইনুলের ঘরে এত সুন্দরী বউ আসবে। গুনেও কমনা। মা মারা যাবার পর সংসারটা কি সুন্দর করে গুছিয়েনিছে।
মাইনুল কাজলকে খুব ভালবাসে। সংসার জীবনে অনেক সময়ই রাগারাগি হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত মাইনুল কখনো কাজলের সাথে বাজে ব্যবহার করেনি। অনেক রাগহলেও নিজেকে চেঁপে রেখেছে। কাজলটাকে মাইনুল ভয়োপায়। বেশ জেদও আছে ওর। প্রতিবাদ করতে ছাড়েনা একদমই। এরই মাঝে ভালবাসার কমতিনেই। মাইনুল ভাবতে ভাবতে এপাশহয়ে কাজলের কোমর বরাবর হাতরেখে কাজলকে তার দিকে ফিরিয়েনিতেচায়। কাজল হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে সরোতো। ছেলেটা ঘুমাচ্ছে। মাইনুল- ঘুমাবেইতো। ফেরোনা এদিকে। বলতে বলতেই মাইনুল খুব আদরের সাথে কাজলকে জড়িয়েধরে।
নাকের ডগাটা কাজলের গলার সাথে মিশেযায়। কাজল এবার মাইনুলের দিক মুখ করে- বুইড়া বয়সে এত ঢং বাদদেওতো। এক ছেলের বাপ হতেই বুইড়া বানাইলা! কাজল স্বামীর নাকটেনে দিয়ে বলে- তো কি!! এত ঢং শিখছো কই হিমমম!! ঢং বলো আর যাইবলো সেটাতো তোমার সাথেই করব তাইনা!! আর একটা বউতো আর নাই। ইচ্ছে আছেনাকি আর একটা বউ করার?? সেটাতো নেই তবে বর্তমান বউয়ের অনুমতি পেলে মেয়ে দেখা শুরু করব আরকি। কাজল একটু গরম গলায় বলেওঠে- বজ্জাত ব্যাটার সাহসতো কমনা। কানখুলে শুনেরাখো- বিয়েতো দূরের কথা বাহিরের মেয়েদের দিকে তাঁকানোটাও নিষেদ। যত ইচ্ছে আমাকে দেখো কোনো বারন নাই।মাইনুল হাসে খুব আনন্দের হাসিহাসে। কাজল তুমিযেভাবে কচ্ছো তাতে মনেহয় আমরা প্রেম করছি। বিয়েটিয়ে কিচ্ছু হয়নি। হ প্রেম করছি।
ধরেনাও আমিই তোমার প্রেমিকা আবার আমিই বউ। মাইনুল জড়িয়েধরে কাজলকে- কাজল নিজেও জড়িয়ে স্বামিকে।এরপর দুজনের বাহুতে দুজন আবদ্ধহয়ে হাড়িয়েযায় তৃপ্তিকর ঘুমের রাজ্যে। আযানের শব্দে কাজলের ঘুম ভেঙ্গেযায়। কাজল বিছানাছেড়ে উঠে বাতি জ্বালিয়ে আবার বিছানার পাশে আসে। মাইনুলকে উঠিয়ে মসজিদে পাঠাবে। নিজেও নামাযপরে স্বামী সন্তানের জন্য রুটি বানাবে। কাজল বিছানার পাশে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল। কি সুন্দর দুটি মুখ। নিষ্পাপ শিশুর মতকরে বাপবেটা ঘুমিয়েআছে। এই দুটি মুখ গিড়েই কাজলের যত স্বপ্ন আর ইচ্ছা। কাজল একবার সন্তানের দিকে আবার আরএকবার স্বামীর মুখেরদিক তাঁকায়। কাজলের সমস্ত ইচ্ছা,আবদার,ভালোলাগা আর ভালোবাসা এখন এই দুটি প্রানের সাথেই জড়িত। ছেলেটা দেখতেও ঠিক বাপের মত হইছে। নিজের অজান্তেই কাজল মাইনুলের একটি হাত নিজের মুঠোয়নিয়ে ঝুঁকেপরে মাইনুলের কপালে চুমো বসিয়েদেয়।
এরপর মাইনুলকে ডেকেতুলে সন্তানের গায়ে চাদরটা টেনেদিয়ে কোমল শিশুর কপালেও মায়ের মমতার ছাঁপ লাগিয়েদেয়। মাইনুল চোখ কচলাতে কচলাতে বেড়িয়েপরে মসজিদের পথে। কাজল পানির বালতিটা নিয়ে অযুর উদ্দেশ্যে বেরহয়। নামাযশেষে মোনাজাতে স্বামী আর সন্তানের জন্য দোয়াকরে রুটি তৈরিতে মনোযোগ দেয়। সময়ের সাথে সাথে রাতের আঁধার নিভেচলে। চারদিকে পাখ পাখালীর কিচিরমিচির শব্দ। হয়ত ওরাও সৃষ্টিকর্তার গুনগানে লিপ্ত। মাইনুল ফিরে আসে। কাজল স্বামীর সামনে গোটা তিনেক রুটি আর একগ্লাস চা এগিয়েদেয়। মাইনুলের একটা বদ অভ্যাসহল ও চা একগ্লাস নাখেলে তৃপ্তিপায়না। প্রতিদিনের মত মাইনুল চলেযায় কাজে। কাজলেরও শুরুহয় ব্যস্ততা।
আজ কাজল একটু আগে ভাগেই হাস মুরগী তুলে নিয়েছে। ছাগলটাকেও এনে উঠানের কোনে বেঁধে পাতা খেতে দিছে।ছেলেকেও কোথাও যেতে দেয়নি। প্রথমে ছেলে কান্না করলেও মায়ের পাটিসাপ্টা পিঠা বানানোর কথা শুনে আরকাঁদেনি। মাইনুল পিঠা তেমন খায়না। একমাত্র এই পাটিসাপ্টাই তার প্রীয় পিঠা। তাই কাজল তেমন বেশি পিঠা বানায়োনা। সংসারের পুরুষ মানুষযদি নাখায় তাহলে কোন নারীরইবা এত কষ্টকরে বানাতে ইচ্ছেহয়!! তাই মাঝে মাঝে পাটিসাপ্টাই বানায় কাজল। আপনমনের ভালোবাসা মিশ্রিত যত্নে পিঠা তৈরী করছে। ছেলেটা মায়ের পাশে বসেই কচি মনে জেগেওঠা এটা সেটাজানতে চাইছে।
যেমন- মা রুটি দিয়ে আবার কি পিঠা হবে? বললাতো কিযেন বানাইবা- তাইলে রুটি কেন! মা আব্বু কি পিঠা খাবে? মা আগুন কে বানাইছে? মা পিঠা বানাইতে শিখেছো কেমনে? ইত্যাদি ইত্যাদি।কাজল ছেলের এসব প্রশ্নে মোটেও বিরক্তহচ্ছেনা। সেও ছেলের প্রতিটা প্রশ্নের জবাব খুব মায়াজড়ানো হাসির সাথেই দিয়েচলছে।মনে মনে ভাবছে- মাইনুল আজ ঘড়ে ফেরার পর ওর সামনে ওর প্রিয় পিঠা বেরকরে দিলে ও কেমন খুশি হবে। প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী বেলা ফুড়িয়ে এল। সূর্যটা নিজেকে আড়ালে লুকিয়ে আধার নামাতে লাগল। কাজল অপেক্ষাতে আছে- মাইনুলের। ভালবেসে ভালবাসার সঙ্গীর জন্য এমনটা সব নারীই করতেচায়। কেউ পারে কেউবা না। মাইনুল বাজার হয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
স্ত্রীর জন্য আজ একটা নারিকেল তেলের ডিব্বাও কিনে নিয়েছে। কাজলের কোমরছাড়িয়ে গড়িয়েপরা কালোচুলগুলি মাইনুলের খুব প্রিয়। মাঝে মাঝেই সুযোগকরে মাইনুল কাজলের চুলে যত্নকরে তেল মেখেদেয়।
ওর চুলেরয়েছে এক অন্যরকম ঘ্রান। যেটা মাইনুলের কাছে মাদকের থেকে বেশি নেশাযুক্ত। মাইনুল ঠিকই কাজলের চুলের ঘ্রানে আসক্ত হয়। হতেচায় নিয়মিত। এ নেশাতে কি কোনো ক্ষতিআছে!!! থাকলেইবা কি!! আমি এ নেশায় ডুবদিতে সর্বদা প্রস্তুত। মাইনুল ছেলের জন্য আজ আম কিনে নিয়েছে। ছেলেটা আম খেতে খুব পছন্দকরে।পেছন থেকে সাবু মাইনুলকে ডাকে। মাইনুল দাড়ায়। কাছাকাছি এলে দুজন একে অপরের খোজ খবর নিতে নিতে হাটতে থাকে। কিছুটা পথ অতিক্রমের পর-
সাবু – মাইনুল ভাই একটা কথাবলার ছিল। কিভাবে যে বলি। আরে কইয়া ফালা। এত ঢং করিসনে।ভাই আমিজানি ভাবি খুব ভাল মানুষ। কিন্তু,,,মাইনুল থেমেযায়। কিন্তু কি!! বলনা সাবু।আসলে হইছেকি ভাই- আপনিতো সকাল হলেই কাজে নামেন আর ফেরেন সেই রাতে। আপনার ঘরেতো আর কেউ নেই যে ভাবিকে দেখেশুনে রাখবে। হ তাতো নাই। মা-টাও আমারে ফালাইয়া চলেগেল ওপরে। ভাই আপনাদের পাশের বাড়ির আজমল কিন্তু যথেষ্ট বাজে একটা ছেলে। যেকোনো সময় কেলেঙ্কারি ঘটাতে পারে। একটু নজর দিয়েন। মাইনুলের মাথাটা জিম জিমকরে উঠল। সে রহস্য জানতে সাবুকে খোঁচাতে লাগল। শেষে সাবু বলতে লাগল- ভাই আজ বিকেলে আমি আর আজমল বসে গল্প করছিলাম। তখন আজমল ওর মোবাইলটা বেরকরে একটা ছবি দেখায়। যেটাছিল ভাবির। ছবিটা একটু আপত্তিকর।
মূলত আজমল নিয়মকরে প্রতিদিন আপনার ঘরে যায়। রান্না বান্নার সময় গিয়ে ভাবির সাথে খাতির জমানোর চেষ্টাকরে। আর এই গরমে আগুনের পাশেবসে রান্নাকরা বেশ কষ্টকরই। ফলে গৃহস্থবাড়ির মহিলারা অধিক সময়ই বুকের কাপর ফেলে আপনমনে রান্নাকরে। ভাবিও সেটাই করছিল। যেহেতু ঘরে কোনো পুরুষ মহিলা কোনো লোকইনেই অতএব সে নির্ভয়েই এটা করতেপারে। কিন্তু আজমলের কুদৃষ্টি গোপনে সেটাকে মোবাইলে আটকেদেয়। ও আমায় এটাও বলল যে ভাবিনাকি সেইরকম একটা জিনিস। একটু চেখে দেখলেই ওর তৃপ্তিহবে। আমিজানি ভাবির কোনো দোষনেই এখানে। আপনি আবার ভাবিকে দোষারোপ করবেননা। আপনি পারলে ওই বদমাইশ আজমলরে আপনার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ বন্ধকরে দিন। তানাহলে কখন যে কি কেলেঙ্কারি করেবসবে বলাযায়না।
আর ওই ছবিটা আমি বুদ্ধিকরে ডিলিট করে দিয়েছি। নইলে বদমাইশটা লোকজনরে দেখালেতো সর্বনাশ হয়েযেত।
ছবি ডিলিট নিয়ে ওর সাথে আমার ঝগড়াও লেগেছে। আমি ভুুলে ডিলিট করছি বলে মাফচেয়ে চলেএসেছি। মাইনুল সাবুকে বিদায়করে হনহনিয়ে বাড়িতে চলছে। তার মাথায় এখন নানা সন্দেহের খেলাকরেচলছে। আসলে কারো প্রতি সন্দেহের চোখ পরলে তার ভালদিকটাকেও মন্দ মনেহয়। রাগে দুঃখে তার চোখে পানি চলে আসতেছে। নাজানি কি না কি করেছে। কেজানে মাগী নিজেও এতে সম্মতি দিছেকিনা। আমার অনুপস্থিতিতে কোন তামাশায় মেতে ওঠে কেইবাজানে। ভাবতে ভাবতে ঘরের দরজায় চলেআসে। ঘরেডুকে চুপচাপ শুয়েপরে। কাজল পিঠার বাটি এনে স্বামীর সামনেরাখে। ভেবেছিল মাইনুল অনেকটা খুশিহবে। কিন্তু না। মাইনুল চুপচাপ শুয়েরইল। কাজল মাইনুলের হাতধরে তুলতেচেষ্টাকরতেই মাইনুল কাজলের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে গরম স্বরে বলে তুই আমারে ছুঁবিনা। যা দূরে সর।কাজল কিছু বুঝেউঠতে পারছেনা। মাইনুলতো কখনো এমন ব্যবহার করেনা। আজ কিহল ওর।
কাজল বলে- নাওনা একটাপিঠা। কত কষ্টকরে বানিয়েছি তোমার জন্য। তুমি খাবে আর আমি দেখব বলে।
মাইনুলের কাছে কাজলের এসব আবেগমাখা কথা বিষের মত লাগল। সে পিঠার বাটিটা হাতেনিয়ে ফিকমেরে ফেলেদেয়।বলছিনা তোরে দূরে সরতে। যা তোর পিঠা তুই খা। আর পারলে বান্ধবের জন্যও রেখেদে।কাজলের বুকছিড়ে কান্না বেরিয়ে আসছে। যদিও সবসময় কাজল নিজেও ঝগরা সমতালে চালিয়েযায়। কিন্তু আজ পারছেনা। মাইনুলের হঠাৎ এমন আচরনে সে কষ্টপাচ্ছে। ভয়ংকর কষ্ট। তাছাড়া আগেকার সব ঝগড়ায় মাইনুল রাগকরে দুএকটা গরমকথা বলতে গেলেই রাগ পানিহয়ে হাসি হয়ে বেরহত। কখনোই কাজলের প্রতি রাগ দেখাতেপারেনি মাইনুল। সব সময় কাজলই জিতেযায়। আজ আর তা হচ্ছেনা। কাজল আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ওপাশে চলেযায়। ছেলেটা বাবার এমন চেহারাদেখে আমের পোটলা রেখে ভয়ে মায়ের কোলেগিয়ে চুপচাপ এদিক সেদিক তাঁকাচ্ছে। হয়ত বোঝার চেষ্টাকরছে। এরপর চাঁপারাগ নিয়ে রাতটা কেটেযায়।
মাইনুলকে আজ আর কাজল নামাযের জন্য ডাকেনি।হয়ত রাগ কিংবা অভিমানে। তবু জামায়েতের মিনিট খানিক আগে মাইনুলের ঘুমভাঙে। তাড়াহুড়ো করে মাইনুল মসজিদে দৌড়েচলে।নামায শেসকরে মাইনুল ঘরেফিরে। ক্ষুদায় তার পেট কচলাচ্ছে। রাতে রাগকরে আর কিছুই খায়নি। মাইনুল প্রতিদিনের মত খাবারের অপেক্ষাতে আছে। সময় বেড়ে চলছে। পূর্বআকাশের সূর্যটা উত্তাপ ডেলেদিতে হুরমুরিয়ে উপরে উঠছে। কিন্তু খাবার আসছেনা। রেগে মাইনুল কাজলকে ডাকে। কই খাইতে কি কিছু দিবি? ? কাজল রাগে গজগজ করতে করতে জানায় সম্ভবনা। রুটি বানাইনি। এমন উত্তর শুনে মাইনুলের মাথায় রক্ত উঠেগেল। প্রচন্ড রেগেগিয়ে কাজলের চুলের গোছা ধরে টেনে সামনের খোলা বারান্দায় ফেলেদিল। কিছু অশালীন ভাষায় গালমন্দকরে আবার চুলের গোছাধরে পিঠের ওপরে এক চড় বসিয়েদেয়।
কাজল চুলের টানে অসহ্য ব্যাথা হযমকরতে নাপেরে হাতের সামনে পরেথাকা ছেলের প্লাস্টিকের খেলনা দিয়ে মাইনুলের পায়ে সজোরে আঘাতকরে বসে। মাইনুল হতভম্ব হয়েযায়। কাজলকে ছেড়েদিয়ে বলেওঠে- মাগী কত খারাপরে তুই। শেষেকিনা আমার গাঁয়েও হাত তুললি!! কবে যেন আমারে তুই খুন কইরা নাগরের হাতধইরা পালাও কেযানে। ওদের চেঁচামেচিতে বাড়ির লোকজন জড়োহয়। পাশের ঘরের ভাবি এসে কাজলকে তাদের ঘরে নিয়েযায়। মাইনুলকে বাড়ির বৃদ্ধরা এটাসেটা বলে একেএকে কেটেপরে। মাইনুল আর সেদিন কাজে যায়না। পাশের বাড়ির আফজালের কাছথেকে কয়েকটা সিগারেট চেয়েনিয়ে দরজার সামনে বসে বসে একটার পর একটা টানছিল।
আগে সে ধূমপান করত। কিন্তু বিয়েরপর কাজলের নিষেধে আর করেনি । আজ সে আবার সেই ধূমপানে মনমজাচ্ছে। বাড়ির মহিলারা কাজলের থেকে ঘটনা কিহয়েছে সবটুকু জেনেনেয়। কেউ কেউ বলে হঠাৎ কিছু নাবলে গাঁয়েহাততোলা মাইনুলের একদম ঠিকহয়নি। আসলে পুরুষমানুষ গুলোই এমন।
সবকিছুতে খালি গাঁয়ের জোর দেখায়। বাড়ির মুরুব্বী চাচী দমকদিয়ে সবাইকে থামিয়েদেয়। সে কাজলকে বলে- যাইবলো বউ সেতো তোমার স্বামী। স্বামীর গাঁয়ে হাততোলাটা তোমার মোটেই ঠিক হয়নি। স্বামীর মনে কষ্টদিয়ে বা অখুশি রেখে মরলেও বেহেস্ত ঝুটবেনা। যা হইছে হউক। তুমি সময়করে মাফচেয়েনিও। ওদিকে লোকমুখে ঘটনা শুনে সাবু দৌড়াতে দৌড়াতে মাইনুলের সামনে হাজির। ভাই আপনারে না কইছিলাম ভাবি এব্যাপারে নির্দোষ। তবু কেন এটা করলেন!! আসলে আপনারে বলাটাই আমার উচিত হয়নি।
মাইনুল- ভাই কি করমু ক!!
নিজের বউয়ের নামে এসব শুনেকি আর মাথা ঠিকথাকে! আসলে রাগে আমি কি করমু বুঝেই উঠতে পারছিলামনা। আসলেই আমি মনেহয় অন্যায় করেছিরে। সময় গড়াতে গড়াতে দুপুর প্রায় বাড়টা বেজেএল। মাইনুলের রাগ কমেএল। সে চুপচাপ ছাগলটাকে গোসলকরাতে নিয়েগেল। অনেকদিন হইছে গোসল করানোহয়না। গাঁয়ে কেমন বোট্কা গন্ধদরেছে। কাজল নিজেকে সামলেনিয়ে ঘড়ে চলেএল। ছেলেটা ভয়ে মায়ের আচল ধরে বসেআছে। আবার মায়ের চোখের পানি দেখে নিজেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। কি বুঝে কাঁদছে এই অবুঝ শিশুটা??? কাজল চাল বসিয়ে দিল। লোকটা সেই কালহতে কিছুই মুখে দেয়নি। নাজানি কত কষ্ট হচ্ছে ক্ষুদায়। ইসসসস কেনযে এত রাগ করতে গেলাম আমি। কিইইবা হত সকালে রুটি বানিয়েদিলে। এসব ভাবতে ভাবতেই কাজল রান্না করতেছিল।
মাইনুল ছাগলটাকে নিয়ে রাস্তাদিয়ে মাঠেরদিক যাচ্ছিল। হঠাৎই সেই বেয়াদব আজমলটা সামনে হাজির। মাইনুলের চোখে মুখে রাগের তীব্রতা ফুটেউঠল। কিছু বুঝেওঠার আগেই আজমল দৌড়ে এসে মাইনুলের পাধরেবসে। মাইনুল মূর্তিরমত সোজা হয়ে দাড়িয়েথাকে। আজমল ইনিয়ে বিনিয়ে বলতেথাকে- আজমল ইনিয়ে বিনিয়ে বলতেথাকে- ভাই আমারে মাফকরেন। আমি চরম অন্যায় করছি এবার আমারে মাফকরেন। আর বিশ্বাস করেন ভাবির কোনো দোষনাই। আমারেতো সে ছোট ভাইয়ের মত দেখে। আর আমি কিনা সেই ভাবিরসাথে ছি ছি ভাই। আমারে আপনে মাফকরেন আর না হইলে যা খুশি শাস্তিদিন। মাইনুল আজমলের হাতধরে তুলে। দেখভাই তুই নিজের ভুল বুঝে মাফচাইছো এটাই অনেক। যা আমি তোরে মাফকরে দিলাম। আরশোন তোর ভাবি যেন নাযানে এইসব। তাইলে কিন্তু ছোটভাই জানবেনা। তোরে বেয়াদব ভাববে বুঝলি। মাইনুলের মনটা এখন সম্পূর্ন রাগমুক্ত।
সে এখন কাজলের সাথে দূর্ব্যবহারের জন্য নিজে নিজেই লজ্জিত। নাহ সময়করে বউকে বলব মাফকরেদিতে।
মাইনুল ঘরে এসে রান্নাঘরে কথার শব্দশুনে- লুঁকিয়ে লুঁকিয়ে একটু দেখতে গেল কে আর কারা ওখানে আলোচনায় বসল। গিয়ে দেখে পাশের ঘরের ভাবী,চাচী আর সাবু বসে আলোচনা করছে। সাবুটা সব ওদের সামনে খুলেবলেদেয়। তখন অবশ্য সকলেই আজমলের প্রতি ছি ছি করে আর আমার পক্ষনিয়েও সায়দেয়। ভাবীতো বলেই ফেলল- মাইনুলের আর কিদোষ বলো!ঘরের বউ সম্পর্কে বাইরে এসব শুনলে কারই বা মাথাঠিকথাকে!! গেলকই মাইনুল!!যাহোক অবশেষে মাইনুল গোসল সেরে এসে ছেলেকে ডেকেবলে- বাজান তোমার মাকে কও ভাতদিতে। ঘরথেকে কাজল অভিমানি সুরে–মাহির আব্বুকে কও মায়ের কাছে চাইতে।
মাইনুল- মাহির বাজান তোমার মাতো রেগেআছে আমার উপ্রে। সেকি ভাত দিবে আমায়!!
কাজল- মাহির আব্বুকে বলো – মা মোটেই রেগেনেই। সেচায় তুমি এখনই খেতেআসো। ছেলেটার মুখে সেই গতসন্ধ্যার পর এই প্রথম হাসি ফুটল।
সে কাজলকে বলছে– মা আমারে কইতে কও। আমি কইতেযাই তার আগেই আব্বু আবার কইয়াদেয়।
আমিতো কইতেই পারিনা। ছেলের কথা শুনে ওপাশে কাজল- এপাশে মাইনুল দুজনেই হেসেওঠে। কাজল ছেলের গালে হাতদিয়ে কপালের উপর চুমোখেয়ে বুকে জড়িয়েধরে। মাইনুল হাসতে হাসতে খেতে এসে মা ছেলের মমতা ছড়ানো মুহূর্তের সাক্ষী হয়েযায়। সময় গড়াতে গড়াতে আবার সন্ধ্যানেমেআসে। ছেলেটা গতরাতের কিনে আনা আম আরামকরে খাচ্ছে। মাইনুল কাজলকে ধরেএনে চৌকিতে বসায়। mকাজলের খোপাকরা চুলগুলি মেলেনেয়। পরম যত্নে কাজলের কাজল কালো চুলে তেল মেখেদিতেথাকে। কাজলের চোখবেয়ে পানি নামছে। মাইনুল তা দেখছেনা। সে চুলের মোহেপরেছে।
মাইনুল- কাজল
কাজল- হিমম বলো।
খুব বেশি লেগেছিল! লেগেছিল তখন এখন আর নেই। আসলে মাথাটা ঠিকছিলনা। আচ্ছা এভারের মত ক্ষমাকরেদিবে! কি সব বলছো!! ক্ষমাচেয়ে আল্লাহর কাছে আমাকে ঠেকিয়েদিচ্ছ কেন!! আমিতো মোটেই রেগেনেই। আমি যদি পুরুষহতামনা- তাইলেতো বউকে পিটাইয়া মাইরাইফালাইতাম। তুমিতো তার কিছুই করনি। হিহিহি। বউয়ের তো দোষছিলনা। আচ্ছা- আসলেই কি তুমি রেগে নেই?? না। সত্যিই রেগেনেই। তাইলে আমারদিকে তাঁকিয়ে বলো। কাজল ঘুরে তাঁকায়। স্বামীর চোখে চোখরাখে। সে চোখে অনুশোচনা দেখতেপায়। কাজল স্বামীর অনুশোচনা কাটিয়েদিতে স্বামীর ঠোঁটের উপর নিজের ঠোঁটজোড়া চেঁপেধরে। এরপর ছাড়িয়েনিয়ে মাইনুলের পায়েপরে কাজল।
মাইনুল — আরে আরে কি করছো!!
কাজল- আমারে তুমি মাফকরে দাও দয়াকরে।
আমি জানি আমি যে অন্যায়করছি তা খুব বেশিই জঘন্য। তবুও তোমার কাছথেকে ক্ষমার আশাকরছি। আমিচাই মরার পরেও বেহেস্তে তুমি আমি স্বামী স্ত্রী হয়েরব। তুমি আমায় মাফনাকরলে আমার এই ইচ্ছাটা যে পূরন হবেনা।
মাইনুল কাজলকে জোরকরে দাড়করিয়ে- আমি সত্যি কইতাছি তোমার উপরে আমার বিন্দুমাত্র রাগনাই। কাজল- তাইলে চোখের দিকে তাঁকিয়েবল। মাইনুল কাজলের চোখে চোখ রাখে- সে চোখে বেশেওঠে অপরাধবোধ। মাইনুল স্ত্রীকে এই অপরাধবোদের হাতথেকে ফিরিয়েআনতে চটকরে নিজের ঠোঁটজোড়া চেঁপেধরে কাজলের চিকন গোলাপী বর্নের ঠোঁটজোড়ার উপর। ওদিকে ছেলের আম খাওয়া শেষহয়। খবরটা মা বাবাকে জানাতে ছুটেএসে মা বাবার এমন দৃশ্যদেখে অবুঝ শিশু তার কোমলহাতে তালি বাজায়। সাথে বলে চলে আব্বু মাকে চুমো দিসে আব্বু মাকে চুমো দিসে।
ছেলের উপস্থিতিতে মাইনুল – কাজল দুজনই লজ্জায় পরেযায়। একে অপরকে ছাড়িয়েনেয়। মাইনুল ছেলেকে কোলে তুলেনেয়। কাজল মাইনুলকে বলে- ছেলেকে ডানপাশে নাও। তোমার বুকের বা পাশটা একান্তই আমার। মাইনুল মুচকিহাসে। ছেলেকে ডান বাহুতে আকড়ে ধরে। কাজল ছোট্টশিশুটার মতই মাইনুলের বুকের বাপাশে মাথারেখে জড়িয়েধরে। মাইনুল চোখবন্ধকরে অস্ফুটস্বরে বলেওঠে- হে খোদা এই জড়িয়েরাখা বন্ধনটুকু তুমি কবুলকরো। কখনো এ বন্ধনে ফাঁটল দড়িওনা।