প্রেমের টানে পালিয়ে যাবে তামান্না! সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সকালেই। যেসকল সিদ্ধান্ত মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়, অনেকসময় মানুষ সেই সিদ্ধান্তগুলো হুট করেই নিয়ে ফেলে! তামান্নার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। নইলে দুদিনের পরিচিত এক ছেলের জন্য পরিবার ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।
এখন রাত। কুয়াশার মতন নিবিড় হয়ে নামছে গাঢ় অন্ধকার। আকাশে তারা নেই। তামান্না ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলো বিকেলেই। রাত পড়ার সাথে সাথে বাজিতপুরের মানুষ ঘুমিয়ে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। এই সুযোগে তামান্না বেড়িয়ে পড়লো। কালো অন্ধকারে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো তার। কয়েকবার পা পিছলে পড়তে গিয়েও আবার উঠে দাঁড়ালো। গা ছমছম করছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। সন্ধ্যা থেকে ডাকতে ডাকতে ঝিঁঝি পোকারা এখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। মাঝেমধ্যে দু’একটা জোনাকি মিটিমিটি আলো জ্বেলে হারিয়ে যাচ্ছে ঝোপঝাড়ের আড়ালে।
অনেকক্ষণ হেঁটে উপস্থিত হলো নিকটস্থ রেলস্টেশনে। ভোর তিনটার ট্রেনে ঢাকা চলে আসবে। সৌরভ আগে থেকেই দুজনের জন্য টিকেট কেটে রেখেছিলো। স্টেশনে এসে দেখে সৌরভ তখনো আসে নি! অথচ ফোনে বলছিলো, আধঘণ্টা ধরে নাকি সে স্টেশনে অপেক্ষা করছে!
প্লাটফর্মে ভিখিরি মতন কয়েকটা পরিবার খবরের কাগজ বিছিয়ে জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে। গায়ে জীর্ণ পোশাক। অতিরিক্ত ময়লার কারণে কাপড়ের কালার চেনা যাচ্ছিলো না। মশার উপদ্রব খুব বেশি। প্যাঁন প্যাঁন শব্দ করতে করতে মশারা এদিকে ওদিকে ওড়ে যাচ্ছে। শুয়ে থাকা মানুষগুলোর শরীরে কামড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের ঘুমে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
তামান্না ভাবতে লাগলো এই মানুষগুলো কতো অসহায়। খাওয়ার জন্য পয়সা নেই। থাকার জায়গা নেই। তবুও তারা সুখ খুঁজতে কেও কাওকে ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে না! জীবনের যে রঙ তারা এই অসহায় জীবনে দেখেছে তা নিয়েই তারা সন্তুষ্ট। ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা হয়তো তারা অবশ্যই করে। কিন্তু বাস্তব জীবন উপেক্ষা করে হীনমন্যতায় ভোগে না! তার মানে কি তামান্না পরিবার ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে ভুল করছে?!
এতকাল যে পিতা তাকে আগলে রেখে মানুষ করলো, যে মা তাকে যত্ন করে লালন করলো, যে ভাই তার মুখের হাসি দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো—এই পালিয়ে যাওয়ার সময় কেনো তাদের কথা তামান্নার মনে পড়ছে না! কেনো কদিনের পরিচিত সৌরভের ছবিই তার কল্পনায় ভেসে বেড়াচ্ছে!
প্রেম নাকি অন্ধ! দুনিয়ার তাবৎ অবৈধ সম্পর্কগুলো অন্ধই হয়! তার মানে কি তামান্নাও অন্ধ হয়ে গেলো। এতোদিনের বিদ্যাবুদ্ধি এই সামান্য আবেগের কাছে পরাজিত?!কেনো সে আবেগ দমিয়ে রাখতে পারে নি — এটা ভাবতেই তামান্নার ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। এতক্ষণ সবুজের বুকে যে পাখিটা আয়েশ করে বসেছিলো, হঠাৎ যেনো কিসের তাড়ায় সেটা ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলো!
তিনটে বাজার কিছুক্ষণ আগেই সৌরভ হাঁপাতে হাঁপাতে স্টেশনে উপস্থিত হলো। এর বাদেই বিশাল বড় একটা চোখ জ্বালিয়ে প্রকট শব্দ করে প্লাটফর্মের সামনে এসে দাঁড়ালো ঢাকাগামী ট্রেনটি। তড়িঘড়ি করে সেটাতে উঠে বসলো তারা।
এরপর সকাল হতেই তামান্নার বাড়িতে চিৎকার চ্যাঁচাম্যাঁচি আরম্ভ হলো। যে গেলো—সে তো গেলোই। তার কোনো খবর নেই। যাবার আগে অবশ্যি একটা চিঠি সে লিখে গেছে—“ ভালো থেকো তোমরা! আমি গেলাম ”! তামান্নার বাবা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিলেন— সুখ খুঁজতে মানুষ কূপে নামে। অথচ বিষধর সাপ ফণা তুলে সেখানে আগেই দাঁড়িয়েছিলো। আমার মেয়ের কী হয় কেজানে?! তারপর?
অনেকদিন কেটে গেলো। তামান্নার কোনো খোঁজখবর নেই। বাড়ি থেকেও খোঁজার চেষ্টা করেছে। পায় নি৷ থানাপুলিশও কিছু করতে পারে নি। মাঝেমধ্যে নাকি বাড়ির নামে চিঠি লিখতো। শুনতাম, খুব নাকি কষ্টে আছে। ভালোবাসার দাম অনেক চড়া! পুঁজিবাদী সমাজে সকালে ভালোবাসার নাম হয় টাকাপয়সা। বিকেলে হয় ভোগ। যে আবেগের টানে তামান্না পরিবার ছেড়ে ছিলো, সে আবেগ বেশিদিন টিকবে না—এটাই স্বাভাবিক। ঘুমুতে খেলে বিছানা লাগে, ক্ষুধা লাগলে চাই খাবার — আবেগ বিক্রি করে এগুলো কিনা যায় না। যে মেয়েটা পরিবারে রাজকন্যার মতো জীবন কাটিয়েছে, পালিয়ে গিয়ে সে খুব একটা সুখী হতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক।
এর একাধিক কারণ আছে৷ একদিকে তামান্নাও বাড়িতে আসতে লজ্জাবোধ করছিলো, চিঠিতে এমনটাই বলেছিলো। দ্বিতীয়ত সৌরভের পরিবারও তাকে মেনে নিতে পারছিলো না! কেনো মেনে নিতে পারছিলো না, সেটা তার পরিবারই জানে! জীবন থেকে পালিয়ে কেও জীবনে সুখী হতে পারে না। তামান্নাও পারে নি। কয়েকবছর পর….! কমলাপুর রেলস্টেশনে আমি দাঁড়িয়ে আছি৷ হঠাৎ পেছন থেকে একটা শ্লেষ্মা জড়ানো নারীকণ্ঠ ভেসে আসলো। আমাকে নাম ধরে ডাকছে!
— এই অণু!
আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, একজোড়া হতাশা ভরা চোখ আমার দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে আছে। মুখের চামড়া বেশ কুঞ্চিত। হাড্ডিসার শরীর৷ অগোছালো কাপড়। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, —আমাকে চিনতে পারো নি?! ( শ্লেষ্মা জড়ানো কণ্ঠ)
— না চিনতে পারি নি!
— আমি তামান্না! তোমাদের বাড়ির পাশের—!
— আপনি! আপনি!! আশ্চর্য! আপনি এমন হয়ে গেলেন কী করে?!
তামান্নার বয়স তখন বড়জোর ৩০ হবে। অথচ তাকে দেখাচ্ছে পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধার মতো। মুখের কুঞ্চিত চামড়াই বলে দিচ্ছে, অনেকদিন ধরে এই দেহের সাথে সুখের কোনো সম্পর্ক নেই! অথচ এই দেহে একসময় রূপ ছিলো৷ ছিলো রূপের অহংকার! সামান্য ব্যবধানেই আল্লাহ তাকে বদলে দিতে পারেন, সে হয়তো কল্পনাও করে নি! অবৈধ সম্পর্কের টানে পরিবার ছেড়ে পালিয়ে এসে কী করুণ হয়েছে তার পরিণতি! আমি ঢুবে ছিলাম আমার কল্পনায়। হঠাৎ তামান্না ফ্যাশফ্যাশে গলায় বললো— বুঝলে ভাই, পরিবার ছেড়ে এসেই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছি!
— আপনার এমন পরিণতি হলো কী করে?
— সে অনেক কথা। সংক্ষেপে বলি। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর ঢাকায় আসি। এই সময় সৌরভের হাতেও কোনো টাকাপয়সা ছিলো না। আমার পরিবার আমাকে মেনে নিতো কিনা—জানি না৷ তবে সৌরভের পরিবার স্পষ্টই মেনে নেয় নি!
সৌরভ আমার অলংকারাদি সব বিক্রি করে কিছুদিন চললো। তারপর হঠাৎ আবিষ্কার করি সৌরভের ভয়ংকর এক চরিত্র। ড্রাগস সেবন করতো নিয়মিত। মাদক, মদ, পরনারীর প্রতি আসক্তি তো ছিলোই। আমি এসব থেকে ওকে নিষেধ করতে চাইলে সে বললো, এগুলো ছাড়া সে থাকতে পারবে না। আমাকে সব মেনে নিতে হবে! কিন্তু আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না! তারপর এগুলো নিয়ে ঝগড়া করে একপর্যায়ে সে আমাকে ফেলে রেখেই চলে গেলো!
কিন্তু হঠাৎ প্রকাণ্ড আওয়াজে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটি চিৎকার করে উঠলো। তামান্না দৌড়ে উঠলো ট্রেনে। জানালা দিয়ে মাথা বের করে বললো, কাজের খোঁজে নরসিংদী যাবে। কোনোদিন আবার দেখা হলে পুরো ঘটনা বলবে।
দুই টোনের সাইরেন বাজিয়ে শাঁ শাঁ গতিতে ট্রেন চলতে লাগলো। আর আমি নির্লিপ্ত চোখে তার চলে যাওয়ার পথে অপলক তাকিয়ে আছি। আহ্! বদলে যাওয়ার কী করুণ কাহিনী! ধর্ম-সমাজ সব উপেক্ষা করে, পরিবারের বৈধ সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দিলে হয়তো এমনই হয় পরিণতি!