নারী নির্যাতন মামলার হাজিরা দিতে যাচ্ছি অাদালতে। অার অামার নামে মামলা করেছে অামার স্ত্রী।
পুলিশ গ্রেফতার করেছিল গত সপ্তাহে। প্রথম যেদিন কোর্টে তুলল সেদিন জামিন চেয়েছিলাম। কিন্তু নারী নির্যাতন মামলায় অামার জামিন হয়নি। অামার রিমান্ড চেয়েছিল বাদি পক্ষ। রিমান্ড না মঞ্জুর করে জেলগেইটে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলা হয়েছে। অামি এক সপ্তাহ ধরে জেল খানাতেই অাছি। অাজ দ্বিতীয়বারের মতো অামাকে কোর্টে তোলা হচ্ছে।
অাসামী কাঠগড়ায় দাড়িতে হাত দুটি সামনে জোড়হাত করে রাখতে হয়। নিজেকে এখন সত্যিই একজন অপরাধী মনে হচ্ছে। সোমার দিকে একটিবার তাকাতে ইচ্ছে হলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই সোমা’কে কাঠগড়ায় ডাকবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। সোমার চোখ দুটোর দিকে তাকাতে ইচ্ছে হচ্ছে। যে চোখে অামি স্বপ্ন দেখেছিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সোমা অামার শ্বশুর মশাইর সাথে বোরখা পরে বসা। কিন্তু তুলি? অামার মেয়ে তুলি কোথায়? একটি সপ্তাহ ধরে অামার মেয়েটাকে দেখি না। যে মেয়েটাকে একটি দিনের জন্য দূরে রেখে ঘুমাইনি। সে মেয়েটিকে ছাড়া একটি সপ্তাহ জেলখানায় কাটিয়েছি। উকিল সোমা’কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকলেন। সোমা একবার মাথা তুলে অামার দিকে তাকালো। তার কপালের সেলাইর দাগ এখনো অাছে। উকিল জানতে চাইলেন…
— অাপনি অভিযোগ করেছেন অাপনার স্বামী অাপনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই অাঘাত করেছে এবং অাপনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। দ্বিতীয় অভিযোগ করেছেন অাপনার স্বামী প্রতিরাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে এসে অাপনাকে মারধোর করত। ঘটনা সত্যি?
সোমা মাথা নীচু করেই জবাব দিল, “হ্যাঁ সত্যি” অামার তখন মনে হচ্ছিল আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি। কিছুক্ষনের মধ্যেই অামার স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাবে। সুন্দর একটি অাগামীর সকাল দেখতে পাবো। উকিল অাবারো প্রশ্ন করল অাপনারা তো স্বামী স্ত্রী, আর দুজন ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। তাহলে অাপনার স্বামী এমন পাল্টে গেল কেন? অাবারো সোমার মিথ্যে জবানবন্দী, “অামাদের মেয়ের যখন চার বছর বয়স তখন থেকে শ্রাবণের ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ করি। সবসময় ঝগড়া করত। একসময় জানতে পারি শ্রাবণ গোপনে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে। হয়তো সেজন্যই অামার উপর অত্যাচার। অনেকবার বলেছেও অামি যেন অামার মেয়েকে নিয়ে দূরে চলে যাই।
— অাপনার মেয়ের বয়স তো এখন পাঁচ। অনেককিছু বুঝতে শিখেছে। অাপনার উপর এত অত্যাচার হতো অাপনার মেয়ে কখনো দেখেনি? কখনো ভয় পেয়ে কান্না করেনি?
— হ্যাঁ অনেকবার দেখেছে।
— অাপনার মেয়ে অাদালতে হাজির অাছে?
—না। অামার মায়ের কাছে রেখে এসেছি।
— মাননীয় অাদালত, অামি ছোট মেয়েটিকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অাদালতে হাজির করবার অনুমতি প্রার্থনা করছি। জজ সাহেব দুই দিন পর তারিখ নির্ধারন করলেন। এবং তুলিকে অানার কথা বলে দিলেন। জেলখানার ভিতরে বসে অাছি। খাবার দিয়ে গিয়েছিল, খেতে ইচ্ছে করছে না। একমাত্র মেয়ে তুলির কথা মনে পড়ছে। দুদিন পর মাসুম মেয়েটাকেও অাদালতে হাজির করা হবে।
প্রতিদিন রাতে যখন বাড়ি ফিরতাম গিয়ে দেখতাম তুলি জেগে অাছে। অামি ঘুম পাড়িয়ে দিলে ঘুমাইত।
অার প্রতিদিন তার জন্য চকলেট তো অবশ্যই নিতে হতো। চোখের কোণে পানি চলে এল। কতদিন মেয়েটাকে কোলে নেই না। কেন এসব করছে সোমা? ছয় বছর অাগে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম সোমাকে। যখন সোমার সাথে অামার প্রেম চলছিল, তখন দুই দুইবার প্রেমের সমাপ্তি ঘটেছিল। একবার সোমা ভুল বুঝে ফিরে এসেছিল। অার দ্বিতীয়বার অামি তাকে ফিরিয়ে এনেছিলাম অামার ভালোবাসার বাহুডোরে। অার তখন ফিরিয়ে অানার সময়ই বিষয়টা অন্যদিকে মোড় নিল। দুইবারই প্রেমে সমাপ্তি ঘটেছিল একটি কারনে। সোমার তিন চারটা ছেলে বন্ধু অাছে। অামি বন্ধুত্বকে সমর্থন করি। কিন্তু অামাকে সময় না দিয়ে যখন সোমা বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা বলত, অাড্ডা দিত তখনই সোমার সাথে ঝগড়া হতো। সে ঝগড়া থেকেই দুইবার দুজনে দূরে সরে গিয়েছিলাম। শেষবার যখন সোমাকে ফিরিয়ে অানি তখন সোমা বলেছিল, “তুমি কি অামাকে সন্দেহ করো?’
— সন্দেহ করার মত কি যথেষ্ট কারন নেই?
— তাহলে বিয়ে করে ফেলো।
—চলো কাজী অফিসে, এক্ষুনি বিয়ে করব।
এক প্রকার জিদের বশে সেদিনই সোমাকে বিয়ে করে ফেলি।
বিয়েটা সোমার বাবা মেনে নেয়নি। সোমা অামার হাত ধরেই চলে এসেছে বাবা মা ছেড়ে। সেজন্য অামি সোমার কাছে কৃতজ্ঞ। অামাকে ভালোবেসে চলে এসেছে। বিয়ের দেড় বছর পর অামাদের মেয়ে তুলি অাসল পৃথিবীতে। খুব সুখেই দিন কাটছিল। কিন্তু চার পাঁচ মাস ধরে সোমার অাচরণে পরিবর্তন পাচ্ছিলাম। অাগে কাজে থাকা অবস্থায়ও একটু পর পর সোমার সাথে ফোনে কথা বলতাম।
কিন্তু চার পাঁচ মাস ধরে সোমাকে ফোন দিলেই ফোন ব্যস্ত বলে। জিঞ্জেস করলে এই বান্ধবী সেই বান্ধবীর কথা বলে।
যেদিন ঘটনা ঘটে সেদিন অামি বাসায় গিয়ে দেখি সোমা গোসলে। তার ফোনে কল অাসাতে রিসিভ করলাম। হ্যালো বলার অাগেই অপরপ্রান্ত থেকে বলছে, “এতক্ষন লাগে গোসল করতে? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি”
তার মানে সোমা গোসলের অাগেও ছেলেটির সাথে কথা বলেছে। রাগে চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। ফোনটি কেটে দিলাম। কাটার পর বার বার ফোন দিচ্ছিল। অামি রিসিভ করিনি। সোমা এসেও দেখে অামার হাতে ফোনটি বাজছে। অামি মোবাইলটি এগিয়ে দিয়ে বললাম, “অপেক্ষা করছে” সোমা রিসিভ করে শুধু বলল “পরে কথা বলব।”বুঝতে পেরেছে অামি রেগে গেছি অার কিছু হলেও জেনে গেছি।সোমা নিজে থেকেই বলছে,
—এটা অামার বন্ধু সৈকত।
—এজন্যই কি ফোন করে বিজি পাই?
— বিয়ের এত বছর পর এসেও অামাকে সন্দেহ করো?
—সন্দেহের কথা অাসছে কেন? বন্ধু বান্ধব ছাড়লেই পারো।
— অামি ছাড়ব না বন্ধু বান্ধব।
খুব রাগ উঠে গেছে। রাগের বশে চড় মেরে বসলাম সোমাকে। সোমা মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। অার খাটের কোণায় লেগে কপাল কেটে গেছে। অামি সোমার কপালে রক্ত দেখে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। দুইটা সেলাই লেগেছে।হাসপাতাল থেকে সোমা তার বাবাকে ফোন করে বলল, “বাবা অামি অাসছি” বাড়িতে এসে কাপড় চোপড় গুছিয়ে তুলিকে নিয়ে সোমা বাবার বাড়ি চলে গেল। বাঁধা দিয়েও রাখতে পারিনি। তিনদিন পরই অামার নামে নারী নির্যাতন মামলা।
দুদিন পর অার অামাকে কোর্টে যেতে হয়নি। একদিন পরই সোমা মামলা তুলে নিয়েছে। অামাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অামার পক্ষের উকিল বলেছিল সোমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে। অামি রাজী হইনি। বাড়ি ফিরছি অার ভাবছি সোমা কেনই বা মামলা করল অাবার কেনই মামলা তুলে নিল? এখন তাহলে তুলিকে অামার কাছে কিভাবে নিয়ে অাসব? বাড়িতে গিয়ে দেখি ঘরের দরজা খোলা। চাবি তো অামার কাছে অার সোমার কাছে। তাহলে দরজা খুলল কে? ঘরে ঢুকতেই দেখি সোমা ফুঁপিয়ে কান্না করছে খাটের একপাশে বসে। তুলি অামাকে দেখে দৌড়ে কাছে এসেছে। তুলিকে কোলে নিয়েছি। এখন কি বলা উচিত বা কি করা উচিত কোনো কিছু বুঝতে পারছিনা। অামি টেলিভিশন ছেড়ে দিলাম। তুলি অাবার কার্টুন খুব পছন্দ করে। বাপ বেটি বসে কার্টুন দেখছি অার সোমা কান্না করছে। সোমা হঠাৎ তুলিকে ডাক দিল,
— তুলি খেতে অায়।
— না, বাবার সাথে খাব।
— তোর বাবা’কে নিয়েই অায়।
ক্ষিধে অামারও পেয়েছে। কিন্তু দশদিন ধরে তো বাজার করি না। সোমা রান্না করল কী? গিয়ে দেখি খাবার তৈরী। ফ্রিজ থেকে মাছ নিয়ে ফ্রাই করেছে। পিয়াজ, মরিচ অার সরিষার তেল দিয়ে কি যেন একটা বানিয়েছে। খাবারের পর তুলিকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। সোমা হঠাৎ এসে অামার সামনে দাঁড়াল। দাঁড়ানো থেকে বসে অামার পা জড়িয়ে ধরে বলছে,
— শ্রাবণ অামাকে ক্ষমা করে দাও। অামার ভুল হয়ে গেছে। বাবা এসব করিয়েছে অামাকে দিয়ে। সোমা’কে পা ছাড়িয়ে দাঁড় করালাম।
— বাবা করিয়েছে মানে?
— হ্যাঁ, বাবা করিয়েছে।
তুমি ছাড়া তো অামার এখানে কেউ নেই। তুমি যখন অামাকে মারলে, অামি রাগ অার অভিমানে বাবার কাছে গেলাম। বাবা এখনো তোমাকে মানতে রাজী না। বাবা অামাকে এটা ওটা বলে মামলা করিয়েছে। কিন্তু তোমাকে পুলিশ ধরবে, কোর্টে যেতে হবে এতকিছু ভাবিনি। তুলিটা একদিন রাতেও তোমাকে ছাড়া ঘুমাতে চাইত না, শুধু কান্না করত। জবানবন্দী বাবা শিখিয়ে দিয়ে বলেছিল তোমাকে একটু অায়ত্বে অানার জন্য জবানবন্দীটা দরকার। বোকার মত সব করলাম। শেষে যখন বাবা বলল তোমাকে ডিভোর্স দিতে, অামাকে নতুন করে বিয়ে দিবে। তখন অার ঠিক থাকতে পারিনি। তুলিকে নিয়ে পাগলের মত ছুটে এসেছি তোমার কাছে। বড় মামাকে দিয়ে উকিলের সাথে কথা বলে মামলা তোলার ব্যাবস্থা করলাম।
অামার ভুল হয়ে গেছে শ্রাবণ। অার কখনো কোনো বন্ধু বান্ধবের সাথে কথা বলব না। অামাকে ক্ষমা করে দাও।
সোমাকে বুকে টেনে নিলাম। কানের কাছে বলছি, “তুমি যে ভুল বুঝতে পেরেছো তাতেই অামি খুশি। অাবারো অামার ভালোবাসা অামার কাছে ফিরে এসেছে। অামি অামার সোমাকে অার হারাতে চাই না। তুলিকে ছাড়াও থাকতে পারব না। তুলি পুতুলটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে অাছে। অামি অার সোমা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে অাছি।