রুপার শ্বাশুড়ি বললেন, “এবার যদি একটা বংশের প্রদীপ না এনে দিতে পারো তাহলে ঘাড় ধরে এই বাড়ি থেকে বের করে দিবো।” রুপা কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। রুপা আর নয়নের বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত বছর।তাদের একটি ছয় বছরের মেয়েও আছে।কিন্তু এখন অবধি কোনো ছেলে সন্তান না হওয়ায় তার শ্বাশুড়ি আর স্বামী বেশ অসন্তুষ্ট! এর আগে দুইবার কনসিভ করেছিল রুপা।কিন্তু আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে কন্যাসন্তান নিশ্চিত হওয়ায় তীব্র অনিচ্ছা স্বত্তেও রুপাকে সেই মানব ভ্রুণ দুইটিকে নষ্ট করতে হয়।এখন সে ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নয়নের হুংকারে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এলো রুপা।সাথে সাথেই ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে গেল সে।
-এই বেয়াদব।আমার মোজাগুলো কোথায় রাখসস?
রুপা কোনো উত্তর না দিয়ে এদিক-সেদিক খুঁজতে লাগলো। নয়ন আবার বললো, “বেহায়া মেয়ে মানুষ!ঘরে বসে-বসে সারাদিন খাস আর ঘুমাস।এছাড়া আর কোনো কাজ তো করস না! সামান্য মোজাগুলোও ঠিক করে রাখতে পারস না!” রুপা এবার কথা বললো। “আপনার মোজা জোড়া আমি এখানেই রেখেছিলাম।হয়তো রিমা কোথাও রেখেছে।” নয়ন আরও জোরে চিৎকার করে বললো, “তোরা মা আর মেয়ে মিলেই তো সবকিছু শেষ করলি।কিন্তু পেটেরটা যদি ছেলে না হয় তাহলে তোরে আমি তালাক দিবো।”
ঠিক তখনই হঠাৎ করে কোথায় থেকে যেন দৌড়ে আসলো নয়ন আর রুপার একমাত্র মেয়ে রিমা।তার দুই হাতে দুইটা মোজা।সে নয়নের দিকে মোজাগুলো এগিয়ে দিয়ে বললো, “আব্বা,আব্বা,তোমার মোজাগুলো থেকে খুব গন্ধ করছিলো।তাই আমি এগুলো ধুয়ে দিয়েছিলাম।” নয়ন মোজাগুলো হাতে নিয়ে মেয়ে রিমার দিকে কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।তারপর মোজা আর জুতা পড়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
হাসপাতালে পৌছেই নিজের চেম্বারে ঢুকে চেয়ারে বসে পড়লো গাইনি ডাক্তার নয়ন চৌধুরী।অন্যদিন এই সময়ে তিনি হয়তো পাশের চেম্বারের ডাক্তার করিম আবদুল্লাহ-র সাথে কথা বলেন আর না হয় রোগী দেখতে যান।কিন্তু আজ চেয়ারে বসে থাকতেই তাঁর ভালো লাগছে।আজ অদ্ভুতভাবে এক তীব্র মায়ার অনুভূতিতে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে আছেন।এই মায়া কি পরিস্ফুটিত পিতৃত্বের!এই মায়া কি রিমা নামের সেই মেয়েটির জন্য যাকে কিনা নয়ন কোনোদিন মন থেকে মেনে নিতে পারে নি!নয়নের সবকিছু এলোমেলো লাগছে!এই পৃথিবীর সবকিছুই এরকম মায়াময়!নাকি নারী জাতটাই মায়াবতীর জাত!
বেশ কয়েকঘন্টা পর- লেবার রুমে ঢুকার সময় নয়ন দেখলো পাশের বেঞ্চিতে বসে আছে এক লোক।তার পাশে বসে আছে সাত-আট বছরের একটা মেয়ে।মেয়েটি হয়তো লোকটির সন্তান।তিনি সম্ভবত কৃষক বা ফেরিওয়ালা টাইপের কিছু একটা।তিনি একটা ময়লা ফুলহাতা শার্ট আর ময়লা লুঙ্গি পড়েছে।নিশ্চয় তার স্ত্রীর ডেলিভারি করাতে হবে ডাঃ নয়নকে।ডাঃ নয়ন লেবার রুমে ঢুকে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ পর- সেই লোকটির স্ত্রী একটি মেয়ে প্রসব করেছে।এই নবজাতককে দেখে আবার একটি মায়া জন্ম নিলো ডাঃ নয়নের মনে।কিন্তু একটা ছোট্ট খটকাও তার মনে উঁকি দিলো!এই মেয়েটিকে কি সেই অশিক্ষিত লোকটি মেনে নিতে পারবে।দ্বিতীয় সন্তানটিও যখন মেয়ে বলে শুনবে তখন ওই মানুষটি কি করবে তা দেখার একটা ইচ্ছা জন্ম নিলো ডাঃ নয়নের মনে।তাই নার্স যখন নবজাতটিকে কোলে নিয়ে লোকটিকে দেখাতে যাচ্ছিল তখন নয়ন বলে ওঠলো, “দাঁড়াও।বাচ্চাটাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি।তুমি রোগীর খেয়াল রাখো।”
নয়ন বাচ্চাটাকে কোলে নেওয়া সাথে সাথে বাচ্চাটা কেঁদে ওঠলো।বাচ্চাটাকে নিয়ে লেভার রুমের বাইরে বেরিয়েই সে মানুষটকে দেখতে পেল।মানুষটা দৌড়ে নয়নের দিকে আসলো।তার মুখে হাসি।নয়ন বললো, “অভিনন্দন!আপনার মেয়ে হয়েছে।আপনি কি তাকে কোলে নিতে চান?”
লোকটি উপরের দিকে তাকিয়ে হাত দুটিকে মোনাজাতের ভঙ্গিতে করে বললো, “হে আল্লাহ্! তোমারে অশেষ ধইন্যবাদ।মায়া হলো সৌভাগ্যের চিন্ন! আমার মাইয়্যা যেন আমার আয়ু শুদ্দ পায়,হে খোদা!” তারপর লোকটি নয়নের দিকে তাকিয়ে বললো, “স্যার।এই হাতে ধরলে আমার মাইয়্যাটার কোনো ক্ষইতি হইবে না তো?”
-না।কোনো ক্ষতি হবে না।
মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা হাত দুইটি বাড়িয়ে দিল লোকটি।মেয়েটি এখনও কাঁদছে।কান্নায় মগ্ন নবজাতকটিকে ডাঃ নয়ন তুলে দিলো সেটির বাবার হাতে।আর সাথে-সাথেই থেমে গেলো ছোট্টমেয়েটির কান্না! এই আকষ্মিক ঘটনায় ডাঃ নয়ন অবাক হয়ে গেল!নারীজাত-টা মায়াবতীর জাত বটে!