চার নাম্বার বিবাহ করতে গিয়ে আক্কেল আলীর অনেক আক্কেল সেলামী এবার গুনতে হলো! পাঠক পাঠিকাগন মন্দ ভাববেন না? আক্কেল আলীর বিবাহ করা স্বভাব নয়! নিদারুণ নিষ্ঠুর ভাগ্যের ফেরে পড়ে বারবার আক্কেল আলীকে বিবাহ করতে হয়।
এই চার নাম্বার বিবাহ করতে গিয়ে আক্কেল আলীর নগদ পাঁচ ভরি খাঁটি সোনার গহনা, বিয়ের সমস্ত ব্যয় ভার ও মেয়ের নামে দুই কাঠা ফসলের জমি দিতে হলো! তবুও বিবাহ করা চাই নয়লে যে সংসারটা টেকে না! বিবাহ করা আক্কেল আলীর চরিত্র দোষ নয়! বরং ভাগ্য দোষ! এখন সে মনে মনে একটাই কামনা করে আর যেন তাকে বিবাহ করতে না হয়!
যেখানে মানুষ সখের বশে বিবাহ করে নয়তো নজর খারাপ বলে! সেখানে আক্কেল আলীর বারবার বিবাহ করতে হয় সংসার টিকিয়ে রাখতে!দুটি ডাল ভাত ফুটিয়ে দেবার জন্য! একটা সময় কাটানোর সঙ্গীর জন্য! সুখ দুঃখের কিছু কথা আছে যা কারও কাছে বলা যায় না তা,বলার জন্য! তার যখন বিশ বছর বয়স তখন সে প্রথম বিবাহ করে। মানে তার পিতার পুত্রবধূর মুখ দেখার সাধ হয়। সে বিবাহ করতে না চাইলেও তার পিতার কথার অবাধ্য হতে পারেননি! তাই অল্প বয়সেই তাকে বিবাহ করতে হয়। এবং অনেক নামীদামী বংশ থেকে অনেক সুন্দরী দেখে তার পিতা তাকে বিবাহ করিয়ে আনেন। আহা! কি সুন্দর মুখশ্রীই না ছিলো তার প্রথম স্ত্রী মেহেরজানের! এখনো তার মুখখানি আক্কেল আলীর চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলে হৃদয়ে তার তোলপাড় শুরু হয়!সেই দিনগুলোতে বারবার মন ফিরে যেতে চায়? কিন্তু সে জানে চাইলেই পৃথিবীতে সব কিছু পাওয়া যায় না ” পাওয়া সম্ভব নাহ্! তাই তো বুকের কষ্ট বুকেই চেপে রাখেন কাউকে বুঝতে দেন না?
কিন্তু কি আর করা ভাগ্যের লিখন কে খণ্ডাতে পারে? বছর দশেক সংসার করার পর তার মেহেরজান কে টাইফয়েডে কেড়ে নিলো! ডাক্তার কবিরাজি কোন কিছু বাদ রাখেননি কিন্তু মেহেরজান ফিরলো না! চলে গেল তাকে এবং তার আট বছরের ছেলে কুতুবউদ্দিন কে চিরদিনের মতো ফেলে রেখে!যাবার আগে বলে গেল কুতুবের বাপ! আমার কুতুব রইলো! তাকে তুমি কষ্ট দিওনা? আমারে কথা দাও? ওর কোন অভাব তুমি রাখবা না! সেদিন আক্কেল আলীর চোখ শুকিয়ে গিয়েছিল কাঁদতে পারেনি! কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলো, যাই হোক কুতুবউদ্দিন কে সে ছাড়বে না তার ছায়াতল থেকে। আর এটা করতে হলে তাকে আর বিবাহ না করেই বাকি জীবনটা অতিবাহিত করতে হবে? তাই সে আর বিবাহের নাম মুখে আনেনি! কেউ বললেও চলে আসতো সেখান থেকে! একবছর বাপ বেটা মিলে সংসারে খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করেছে তবুও বিবাহ করার নাম মুখে আনেনি!
দুটি ভাত রেঁধে খাবে সেই যোগ্যতা আক্কেল আলীর নেই! সংসারের টুকিটাকি কাজ করতে করতে বাপ বেটা বড়োই ক্লান্ত! তবুও বিবাহের নাম মুখে আনেনি আক্কেল আলী!ছেলে ও সে দুজনেই ঠিক মতো খেতে না পেয়ে। গোছল না করতে পেয়ে দিনদিন রোগা হতে লাগলো! তারপর ঘর গেরস্থালী সব লাটে যাবার যোগার! এভাবে চলতে গিয়ে তারা একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেলেন। তবুও তার সিদ্ধান্ত তিনি পাল্টাতে রাজি নন!
কিন্তু যখন দেখলো বাপ বেটা দুজনে মিলেই সংসারে বড় অসহায় হয়ে পড়েছেন, তখন তার রমিজা খালা এসে দেখে বললেন। তোর জন্য নাহয় ছেলেটা লালন পালন করার জন্য একটা বিয়ে তোকে করতেই হবে? সেদিন তার খালার মুখের উপর না বলার শক্তি তার ছিলোনা! সত্যি বলতে কি ইচ্ছেটাও মরে গিয়েছিল ততদিনে! তার রমিজা খালা তাকে বুঝিয়ে বলেন, বুঝতে পারি বাপধন! তোর মন থেকে তাকে তুমি মুছতে পারবেনা? তাই একটা সংসার মেয়ে মানুষ ছাড়া কি চলে? চলে না বাজান! ঘরের যেমন খুটি থাকে, তার উপর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঘর! তেমনি সংসারের খুটি মেয়ে মানুষ! যে সংসারে মেয়ে মানুষ নাই তা তো নড়বড়ে হবেই বাজান! ঠিক কথা ” একবছর পরে আক্কেল আলী বুঝতে পারে!,যে সংসারে মেয়ে মানুষের ছোঁয়া নাই সে সংসারের না আছে উন্নতি না আছে সোভা! তাই সে নিম রাজি হয়ে বলে, দেখ খালা মা,বললেও তুমি! খালা বললেও তুমি? তুমি যা ভালো মনে করো? তাই করো!
আবার তার জন্য পাত্রী দেখা শুরু হলো এবং খালা তাঁকে ভালোই একটা বিবাহ করিয়ে দিলেন! এবারের বউ তার মেহেরজানের মতো সুন্দরী না হলেও দেখতে ভালোই! বংশ পরিচয়ের দিক দিয়ে ভালো। মোটামুটি ধনী ঘরের মেয়ে। প্রাইমারী পাশ! শিক্ষিতাও বেশ! আক্কেল আলীর একেবারে না পছন্দ হয়নি! বউয়ের ব্যবহারও নজর কাড়া, একেবারে গাঁয়ের মুটে-মজুর যা আছে সবাইকে সে সম্মান দিয়ে কথা বলে! কোন মুরুব্বি তার বাড়ি থেকে কদমবুসি না পেয়ে ফেরেনি! এটা আক্কেল আলীর চিরশত্রুও বলতে পারবে না? সে হলপ করে বলতে পারে! কোন ফকির ফেরেনি খালি হাতে! আর তার সবচেয়ে বেশি যে ভয় ছিলো, তার কুতুবউদ্দিন কে সৎ মা কেমন করে নেবে? সমাজের যা রীতি নীতি সে দেখে এসেছে বহুবার সৎ মায়েরা কত অসৎ আচরণ করে সতীনের সন্তানের সাথে! কিন্তু তার নতুন বউ রহিতন তার সতীনের সন্তানকে এমন ভাবে বুকে টেনে নিল যে, কেউ না জানলে বলতে পারবে না এটা তার আপন সন্তান নয়? আর কুতুবউদ্দিন নতুন নায়ের একেবারে ভক্ত হয়ে গেল। শিশুরা আদর জিনিসটা বেশ বুঝতে পারে! যেখানে আদর নেই সেখানে তাদের ঠেলেও পাঠানো দায়!
গাঁয়ের মধ্যে আক্কেল আলীর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এই বলে যে, আক্কেল আলীর কপাল একখানা! মানুষ প্রথম বিবাহ করে এমন বউ পায়না? অথচ আক্কেল আলী দ্বিতীয় বিবাহ করে কি লক্ষ্মীর প্রতিমা বউ ঘরে নিয়ে এসেছে। একেই বলে কপাল! স্ত্রীর প্রশংসা অন্যের মুখে কোন স্বামীর ভালো না লাগে? তেমনি মানুষের মুখে নিজের বউয়ের প্রশংসা শুনে সিনা পাশ হয়ে যেত আক্কেল আলীর! তার বড় পোড়া কপাল! এই সুখ তার বেশি দিন সইলো না! বছর চারেক সংসার করার পর এই বউও তার সংসার ছেড়ে! তাকে ছেড়ে পালিয়ে গেল না ফেরার দেশে! মেহেরজান কে হারিয়ে সে অতি শোকে পাথর হয়ে ছিলো।
কিন্তু এবার রহিতন কে হারিয়ে সে উম্মাদের মতো হয়ে গেল। চোখের জল তার নিত্য সঙ্গী হলো! সংসার তার জেলখানা মনে হতে লাগলো। খাওয়া নেই নাওয়া নেই। চোখের সামনে শুধু রহিতন দাঁড়িয়ে থাকে! কি যে ভীষণ কষ্ট তিনি পেয়েছেন তা কেবল যারা দেখেছে তারাই বলতে পারবে? এমন করে যখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন তখন তার সেই রমিজা খালার ছেলে তাঁকে কবিরাজ দেখিয়ে সুস্থ করলেন! বললেন মনমরা হয়ে পড়ে না থেকে আবার বিয়ে করতে? কিন্তু তিনি কি করে করেন বিয়ে রহিতন যে তার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ভাত দিমু? এমন করে অবেলায় খাবার খেতে থাকলে শরীর কি টিকবে? কিন্তু তার রহিতনের স্মৃতি অবুঝ শিশু মিতুর কি হবে? কে লাগন পালন করবে তারে? মেহেরজান তার প্রথম জীবনের প্রথম প্রেম আর রহিতন যেন তার সারাজীবনের পাওয়া সেরা ভালোবাসা!
তবুও এই সংসারের চাপে আবার তাকে বিয়ে করার চিন্তা করতে হয়! লইোকে জোরাজোরি করে! বলে, তোমার এতবড় ঘর গেরস্থালী কে সামলায়? তোমার কুতুবউদ্দিন! তোমার মিতু কাকেই বা মা ডাকে? আক্কেল আলীর চোখ বন্ধ হয়! মন খুলে সত্যিই তো তার সংসারের তো একটা খুঁটির প্রয়োজন! নয়লে যে সংসারটা নড়বড়ে হয়ে যায়?