হয়ত ভালবাসি

হয়ত ভালবাসি

ক্লাস টেনে থাকতে একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম। ক্লাসে মাঝে মাঝে তাকে আড়চোখে দেখতাম। এমন ভাবে তাকাতাম যেন বুঝতে না পারে। মাসের পর মাস চলে যেত কোনদিন তার সাথে কথা কথা বলার সাহস হত না। কোন মেয়ের সাথে কথা বলা দূরে থাক, সামনে দাড়ানোর সাহস হয় নি। এমনকি আজোও না। মেয়েটা খুব চুপচাপ আর শান্ত স্বভাবের ছিল। যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুদ্ধ করত। ও ছিল অন্যান্য মেয়েদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ছিল না কোন অতিরিক্ত ভাব।

এক কথায় সাদা মাটা সহজ সরল একটা মেয়ে। ক্লাসে বরাবরই সামনে বেঞ্চে বসত। পড়ানোর সময় স্যারদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনত। পরিক্ষা গুলোতেও খুব ভাল রেজাল্ট করত। সে সময়ে ক্লাসে যদি ৫ জন ভাল শিক্ষার্থী ছিল, তার মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। সেই সুবাদে মেয়েটা আমাকে চিনত। কিন্তু কেউ কারো সাথে কোনদিন কথা বলি নি। স্কুল ছুটি হলে ওর জন্য অপেক্ষা করতাম। নানা বাহানায় এমন ভাব নিতাম যেন ও না বুঝতে পারে যে আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি। যখনই আমরা মুখোমুখি হতাম আমি মাথাটা নিচু করে থাকতাম। কেন জানি না ও সামনে আসলেই ওর চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না।

ওর বাসা আমার বাসা থেকে কিছুটা দূরে ছিল। রোজ যখন মাঠে খেলতে,যেতাম তখন মেয়েটাকে দেখা যেত রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে। মেয়েটা ফুচকা বোধ হয় বড্ড পছন্দ করত। তখন ভাবতাম ইশ আমি যদি ফুচকাওয়ালা হতে পারতাম তবে তার সাথে ভাব জমাতে পারতাম,একেবারে সামনে থেকে মেয়েটার ফুচকা খাএয়া দেখতে পারতাম। দূর থেকেই বূঝা যায় কেমন বাচ্চাদের মত ফুচকা খায়। দেখতে দেখতে চলে আসলে এসএসসি পরিক্ষা। রেজাল্টও পেলাম । ও ভর্তি হল মহিলা কলেজে আর আমি দূরের কোন কলেজে। তারপর থেকেই কিছুটা দূরত্ব। মেয়েটা আর এখন ফুচকা খেতে আসে না। ওকে তখন আর দেখা যেত না বলে স্বস্তি পেতাম না। আমার তপ্ত চোখ জোড়া ওকে শুধু খুঁজত। কিন্তু পেত না। মাঝে মাঝে একা একাই ওর সাথে কথা বলি!

— এই মেয়ে তুমি আর ওই মোড়টাই এখন আর ফুচকা খেতে আসো না কেন? তুমি জানো না যে তোমাকে একনজর না দেখলে ভাল লাগে না?

আচ্ছা মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল না তো? না না সেটা কি করে সম্বব? বিয়ে হলে তো আমি জানতে পারতাম। ওদের বাড়ি তো তাহলে লাইট দিয়ে সাজাত, বক্স বাজত। কই এমন তো কিছুই দেখলাম না বা শুনলাম না। তবে কি কোথাও বেড়াতে গেল? নাকি ওকে এখন আর বাসা থেকে বের হতে দেয় না? নাকি পড়ায় ব্যস্ত থাকে? এমন যে কত্ত কত্ত বোকা বোকা প্রশ্ন করি! কিন্তু কোন উত্তর মেলে না। ঠিক একমাস পর হঠাৎ করেই আবার সেই ফুচকার দোকানে তাকে দেখা গিয়েছিল ! অনেক দিন পর তাকে দেখতে পেয়ে মনে হল বুক থেকে পাথড় নেমেছে। বড্ড ইচ্ছে করছিল তাকে ধমুক দিয়ে বলি-

— এই মেয়ে এই এত দিন আসো নি কেন?

ইদানিং ওর কলেজের সামনে দিয়ে ঘুরাঘুরি করি। মাঝে মাঝে ও আমার সামনে চলে আসত ঠিকিই কিন্ত কথা হত না। রোজ ভাবতাম ওর সামনে পড়লেই ওকে মনের কথাটা বলে দিব। কিন্রু ও সামনে আসলেই আমার,শরীর যেন কাঁপতে থাকত। ফেসবুকে গেলেই ওর আইডি চোখে পড়ত। আইডিতে ঢুকে ওর পোষ্টগুলো পড়তাম। ভুলেও কোনদিন মেয়েটাকে রিকুয়েষ্ট পাঠাই নি।

ভাবতাম যদি কিছু মনে করে বসে আবার। এই ভেবে আর দেওয়া হত না। একদিন ফেসবুকে গিয়ে দেখি ও আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে। আমি এততাই খুশি হয়েছিলাম যে ইয়া হু বলেই খাট থেকে যেই না লাফ দিয়েছি আর ওমনি দেখি ভুল করে ডিলেট আইকনে চাপ লেগে গিয়েছিল। আমার এত বছরের সাধনা এক ক্লিকেই শেষ হয়ে গেল। বন্ধুদের কাছ থেকে কোন রকমে নাম্বার যোগার করে ফেললাম। ভেবেছিলাম আজকে ওকে সব খুলে বলব। কিন্তু ডায়াল করতে হাত কাঁপছিল। প্রায় অনেক ভেবে চিন্তে সাহস করে কল দিয়ে ফেললাম। ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠে কেউ বলে উঠল—

– হ্যালো কে বলছেন?

তখন আমার সাড়া শরীর থরথর করে কাঁপছিল। মুখ দিয়ে একটুও আওয়াজ বের হচ্ছিল না। ওপাশ থেকে হ্যালো হ্যালো বলেই যাচ্ছে আর আমি শুধু শুনছিলাম। এক পর্যায়ে ফোনটা কেটে দিলাম। বুকের ধুকবুকানি একটু সামাল দিয়ে আবার কল দিলাম। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করা হল। এবার যা হল আমি তা কল্পনাও করতে পারি নি।

— হ্যালো কে? এই কে কথা বলছেন না কেন?

খেয়ে দেয়ে কাজ নাই ফোন দিয়ে চুপ করে থাকিস? সাহস থাকলে কথা বল। আমি আরো ভয় পেয়ে এবার ফোনটাই ওফ করে রাখলাম। এটা নিশ্চই ওর কোন বড় ভাইয়া ছিল। একটুর জন্য বেঁচে গেছি।এর পর থেকে ওই নাম্বারে কল ঢোকানোর কোন সাহস হয় নি।

এভাবে দিন যায় মাস যায়, বছরের পর বছর চলে গেল, ওকে আর বলা হয়ে উঠল না। পল্লিমেলা,বর্ষবরন এমনকি ভালবাসা দিবসের মত দিনগুলো একে একে এসে আমার মনে কথাটা বলার জন্য অপেক্ষা করে চলে গেল৷ আমি বলতে আর পারলাম না। একদিন কোথা থেকে যেন সাহস চলে এল৷ মনে মনে শপথ নিলাম হয় আজ বলব না হয় মরব। তাই আয়নায় বারবার রিয়েসসেল শেষে ওকে বলতে গিয়েছিলাম ভালবাসি। কিন্তু সেদিন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমি বড্ড লেট করে ফেলেছি।

ওর হাত এক নায়কের হাতে। ওই নায়কটা আর কেউ না আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড শুভ্র। সেই মুহুর্তে নিজেকে ভিলেন মনে হচ্ছিল। না আমি ভিলেন না। আমি তো আর ওকে জোড করে শুভ্রর কাছ থেকে কেড়ে নিতে আসি নি। আমি তো এসেছিলাম নিজের মনের লুকায়িত কথাটা জানাতে৷ এই গল্পের নায়কও আমি নয়, ভিলেন নয়।আসলে আমি এই গল্পের লেখক ছাড়া কিছুই নয়। সে দিন ফিরে এসেছিলাম খালি হাতে। আমার সব অনূভুতি গুলো মিথ্যে হয়ে গিয়েছিল।একটু একটু করে হৃদয়ে জমানো ভালবাসার বিষর্জন এভাবে দিতে হবে ভাবতে পারি নি।

রূপাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে চূড়ে চুড়মার হয়ে গেল। মেয়েটাকে দেখে বুঝাই যেত না যে ওর বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারে। খুব সাবধানি একটা মেয়ে। আমার ফ্রেন্ড শুভ্রটাও আমাকে কিছু জানালো না যে ওরা রিলেশনে গিয়েছে।একটাবার জানাতে পারত।শুভেচ্ছা জানিয়ে আসতাম ওদের। এই তো এক বছর হল শুভ্র নামের এই ছেলেটা আমাদের এলাকায় নতুন এসেছিল।বাসা থেকে বের হলেই দেখতাম ও একা একা থাকত, একাই ঘুরত। এক সময় ওর সাথে কথা বলতে বলতে ভাল সম্পর্ক হয়ে গেল। আর কখন জানি দুজনে বেষ্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলাম। এটা ভেবে খুব ভাল লাগছে যে, আমি গত ছয় বছর ধরে যে কথাটা বলতে পারি নি, সেই একই কথাটা ও এক বছরের মধ্যেই বলে ফেলল৷ আর তাকে পেয়েও গেল। হাহাহাহা। খুব হাসি পাচ্ছে আমার। আমি কতটাই না বোকা। রুপা বিশ্বাস কর আমি সত্যিই বোকা। সে দিন গুলোতে তোমাকে যদি একবার বলতে পারতাম রূপা আমি তোমাকে খুব ভালবাসি, তবে হয়ত আজ শুভ্রর জায়গাই আমি থাকতাম।

আচ্ছা রূপা আমি যে তোমাকে ফলো করতাম তুমি কিছুই বুজতে না? তোমার দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিতাম তখনো কি তুমি বুঝতে না একটা বোকা ছেলে তোমাকে কিছু বলতে চায়? শুনেছি মেয়েদের নজর ছেলেদের থেকে বেশি, এরা অল্পতেই ছেলেদের হাব ভাব বুজতে পারে। তুমি কি আসলেই বুঝতে পারো নি? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে গেছো এতদিন? আচ্ছা আমি কি এততাই খারাপ দেখতে? নিজেকে সেদিন বারবার আয়নায় দেখছিলাম। নিজের চেহারা নিজেই চিনতে পারছিলাম না। আচ্ছা এটা সত্যিই আমি?

সব মেনে নিয়ে ওদের থেকে দূরে থাকার যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। ওদের কে যখন একসাথে দেখি তখন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠি। এবার ভালবাসা দিবসে ওরা নাকি ঘুরতে গিয়েছিল। আমাকে শুভ্র যদিও ইনভাইট করেছিল আমি মিথ্যা বলে কাটিয়ে দিয়েছি। শুভ্রর আইডিতে দেখলাম ওদের ছবি পোষ্ট করেছে। বাহ ভালই মানিয়েছে। রূপার চেহারা থেকে চোখ সরাতে পারছি না। ঠিক আমি যেমনটা চেয়েছিলাম ঠিক তেমনটাই সেজেছে।নীল রঙের শাড়ী, চোখে হালকা কাজল, হাতে কাঁচের চুরি, কপালের ঠিক মাঝখানে লাল টিপ। দেখে মনে হচ্ছিল রূপা আমার জন্যই সেজেছে। কিন্তু না ও শুভ্রর জন্য সেজেছে।

আজ ৪ বছর পর ওদের বিয়ে। এই বিয়েতে শুভ্র সম্পূর্ণ দায়িত্বটা আমাকে দিয়েছে। কিছুক্ষন আগেই ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন সবাই ঘুমুচ্ছে। আমার চোখে একটুও ঘুম নেই। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ওদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। বিশাল আকাশের নিচে আজ নিজেকে অন্যরকম লাগছে। আমি আরো একটা গল্পের জম্ম দিয়েছি। যেই গল্পে একটা বোকা ছেলে ছিল। যে কিনা আজোও তার ভালবাসার কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারে নি।

অনেক দিন ধরেই চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলাম।২৭ টা ইন্টারভিউয়ের পর হয়ত ভাগ্যের জোরে চাকরিটা পেয়ে গেছি। এইত কালই যশোরে পোষ্টিং। শুভ্র বা রূপা কেউ জানে না কাল আমি চলে যাচ্ছি। ওদের কে না জানিয়েই আজ ভোরেই রওনা হব। ভালই হয়েছে৷ ওদের থেকে এখন অনেকটা দূরে থাকতে পারব। আবার আমি যে কখনো রূপাকে ভালবেসেছিলাম সেটা কেউ কোনদিন ও জানতে পারবে না। এমন কি রূপাও না।আমার ডাইরিতে একটা ছোট্ট চিঠি লিখে যাচ্ছি। যদি কখনো ওরা আমাকে খুঁজতে আসে তবে এই চিঠিটা পাবে।

প্রিয় শুভ্র, আমি চলে যাচ্ছি। ভয় পেয়ো না আমি আবার আসব। প্লিজ আমাকে খোঁজার চেষ্টা করো না৷ তোমাদের বিবাহিত জীবন সুখের হোক। ভাল থেকো।

ইতি,
নিলাদ্রি নীল।

ক্লাস টেনে সামনের বেঞ্চে বসে থাকা সেই সহজ সরল মেয়েটাকে হয়ত ভুল করেই খুব মিস করে ফেলব। আমার এই গল্পটা ছোট্ট হলেও সুপ্ত ভালবাসাটা কিন্তু আকাশের ন্যায় বিশাল ছিল। বলতে পারি আর নাই পারি, হয়ত তোমাকে ভালবাসি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত