আপু বিয়ের সময় মেয়েরা কান্না করে, ছেলেরা করেনা কেন ? নিশির কথা শুনে রিতা হঠ্যাত চমকে উঠার মতো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, এতো কঠিন প্রশ্ন কোথায় খুঁজে পেয়েছিস ? এতো কিছু জিঙ্গাসা করো কেন ? তোমার কাছে যা জানতে চেয়েছি উত্তর দাও! বুঝেছি, তুমি পারবে না তাইতো। নিশি বিছানা থেকে থেকে উঠে পাশের রুমে চলে গেল। রিতা নিশির চঞ্চলতা দেখে ভাবছে, বোনটা খুব কম বয়সেই পেকে গেছে। সাত বছর বয়সেই কতো কিছু নিয়ে ভাবে! আমার বিয়ের এক সাপ্তাহ বাকি। এই এক সাপ্তাহে হয়তো বিয়ে সম্পর্কিত আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইবে।
ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা বাজে। একটু পরেই সন্ধা হয়ে যাবে। রিতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের খোপায় ক্লিপ লাগাচ্ছে। হাবীব হয়তো অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না। রিতা হিজাব ঠিক করতে করতে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। ভাই বাদামের টাকাটা দেন, চলে যাই। হাবীব পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটি নোট বের করে দিলো। এহন বড় নোটের ভাংতি পাবো কই ? আমার কাছে ভাংতি নাই। মানিব্যাগে দেহেন দশ টাকা ভাংতি আছেনি ?হাবীবের মানিব্যাগে দশ টাকার অনেকগুলো নোট রয়েছে। কিন্তুু বাদামওয়ালাকে দিচ্ছে না! উদ্দেশ্য যতোক্ষণ রিতা না আসছে ততোক্ষণ আটকে রেখে গল্প করা। অস্থির হচ্ছো কেন ? বাদামগুলো খেয়ে নেই। এই ফাকে একটু গল্প করি। কতোদিন ধরে ব্যবসা করো শুনি।
গল্প করার জন্য বাদামওয়ালাকে বেশিক্ষণ আটকে থাকতে হলো না! রিতা চলে এসেছে।বাদামাওয়ালার সাথে কি নিয়ে তর্ক করছিলে ? তর্ক নয়! গল্প করছিলাম। তুমি আসতে এতো দেরি করেছ কেন ? বিকেলের এই সময়টাতে রিতাকে স্টুডেন্টদের টিউশনি করাতে হয়। টিউশনিতে সময় দেওয়ার কারনে রিতা কখনোই বিকেলে দেখা করতে পারে না। আজকে হাবীবের সাথে দেখা করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছে। তারপরে ও আসতে দেরি হয়ে গেছে।
রিতা শুনো, সামনে সাপ্তাহেই আমাদের বিয়ে। বিয়ের পরেই তো আমাদের বাড়িতে চলে আসবে। স্টুডেন্টেরকে বলে দাও তুমি আর পড়াচ্ছো না! ঠিক আছে, বলে দেবো। দাঁড়িয়ে না থেকে এখন চলো তো ওইদিকে গিয়ে বসি। হাবীব পার্কের বেঞ্চে পা তুলে বসলো। রিতা দাঁড়িয়ে আছে। হাবীবের পাশে বসতে তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। তিন বছরের রিলেশনে এতোটা লজ্জা কখনোই লাগেনি। পাশের এই ছেলেটে এক সাপ্তাহ পরে তার প্রেমিক থাকবে না, স্বামী হয়ে যাবে। এই কথাটি ভাবতে লজ্জাটা আরো বেশি বেড়ে গেলো।
কি হলো দাড়িয়ে আছো কেন ? না, এমনি। রিতা বসলো। তোমার কি মনে আছে, দু’জনের প্রথম পরিচয়ের কথা। রিতা কঠিন গলায় বললো, হয়েছে এখন আর রোমান্টিক হতে হবে না। অফিস থেকে ক’দিনের ছুটি নিয়েছ ? হাবীব একটি ডিটেকটিভ কোম্পানিতে চাকুরি করে। অফিসে কাজের তেমন চাপ না থাকলে ও বন্ধের দিন ছাড়া হাবীবের কলিগদের অতিরিক্ত ছুটির জন্য অফিসের বসের কাছে অনেকবার ছুটাছুটি করতে হয়। তবে হাবীবকে কিছুই করতে হয়নি। বিয়ের কথা বলতেই দশ দিনের ছুটি পেয়ে গেছে।
দশ দিনের ছুটির মধ্যে ইচ্ছে করলে আমরা হানিমুন থেকে ঘুরে আসতে পারবো। তুমি বললে স্পেশাল মুহূর্তের জন্য আরো কয়েকদিন বাড়িয়ে নেবো। রিতা চোখ নিচু করে বললো, অসভ্যের মতো কথা। মুখে কিছুই আটকায় না। সন্ধা হয়ে যাচ্ছে। চলো এবার উঠা যাক। রিতা বাসায় পৌঁছতেই সন্ধা হয়ে গেলো। হাবীব রিতাকে বাড়ির সামনে পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছে। রিতা ঘরে ডুকার দরজাটির কাছে এসে দাঁড়ালো। ছোট বোন নিশির গলার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। মায়ের রুমটা অন্ধকার। মায়ের রুমের লাইট নেভানো। সন্ধা হয়ে গেছে এখনো রুমের লাইট নেভানো কেন ?
রিতা হিজাব খুলে মায়ের রুমে ডুকলো। এই রুমটা অত্যান্ত ছোট। রুমে একটা আলমারি আর একটি বিশাল খাট। খাটে রিতার বাবা শফিকুর রহমান সবসময় শুয়ে থাকে। সব সময় বললে ভুল হবে, তিন মাসে আগে অফিস থেকে আসার সময় মাইক্রোর সাথে ধাক্কা লেগে এক্সিডেন্টে শরীরের তিনটি হাড় ভেঙ্গে গেছে। এই তিন মাস ধরে বিছানায় শুয়ে আছে। সামান্য আলোতে রুমটা যেমন আলোকিত হয়ে উঠে তেমনি সামান্য অন্ধকারেই রুমটা গাঢ় অন্ধকার হয়ে যায়। রিতা লাইটের সুইচ টিপে বাবার পাশে গিয়ে বসলো। সন্ধা হয়ে গেছে মা এখনো লাইট জ্বালেনি কেন ? মাকে দেখছি না যে! মা কোথায় গেছে ?
শফিকুর রহমান একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললো, তর মা বিকেলে স্বর্ণকারের দোকানে গেছে। এখুনি চলে আসার কথা। হঠ্যাত স্বর্ণকারের দোকানে কেন ? রিতার বিয়েতে খরচ করার জন্য জমানো পুরো টাকাটা শফিকুর রহমানের এক্সিডেন্টের চিকিৎসার জন্য খরচ হয়ে গেছে। বিয়েতে বরপক্ষের তিনশো মানুষকে খাওয়াতে হবে। রিতার বিয়েতে খরচ করার জন্য টাকার ব্যবস্থা করার জন্যই স্বর্ণকারের দোকানে যাওয়া!
শফিকুর রহমান নরম স্বরে বললো, তর চাচার কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা ধার এনেছি, বাকি টাকা জোগাড় করার জন্য তর মা নিজের গহনাগুলো বিক্রি করতে স্বর্ণাকারের দোকানে গেছে। রিতা কাঁপা স্বরে বললো, ফ্যামিলির এই রকম সংকট মুহূর্তে ধার করা টাকা ফেরত দিবে কিভাবে ? শফিকুর রহমান চুপ করে আছে। রিতা বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ক্রিং, ক্রিং শব্দে মোবাইলের রিং বেজে উঠলো। হাবীব ফোনটা হাতে নিয়ে ভাবছে, হঠাৎ রিতা ফোন দিয়েছে কেন ?
হ্যালো হাবীবের কণ্ঠটি শুনতেই রিতা চুপ করে রইলো। রিতার কাছে মনে হচ্ছে তার গলার স্বর আটকে যাচ্ছে, ইচ্ছে করলে ও কিছুই বলতে পারবে না! কিন্তুু কথাগুলো যে তাকে বলতেই হবে ? হ্যালো, হ্যালো রিতা চুপ করে আছো কেন ? হাবীব শুনো, আমাদের পারিবারের এই রকম সঙ্কটময় মুহূর্তে বিয়েতে এতো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব নয়!
বলছো কি এসব! ইতিমধ্যে কার্ড বিলিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে তিন-চারশো লোকের আয়োজন করাটা একেবারেই স্বাভাবিক এবং সামাজিক নিয়মের ব্যাপার।
রিতা ক্ষানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো, যেই সামাজিকতা রক্ষার জন্য আমার ফ্যামিলিকে আর্থিক সমস্যায় ভুগতে হবে আমার পক্ষে সেই সামাজিকতাকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়! যদি বলো এই সিন্ধান্ত শুনে তোমার ফ্যামিলি আমাকে মেনে নেবে না,তবু ও সম্ভব নয়!
রিতার কথা শুনে হাবীব হতভম্ব হয়ে গেল। এমনিতেই রিতার সাথে তার রিলেশনটা ফ্যামিলিকে মানাতে অনেক কষ্ট হয়েছে। এই মুহূর্তে রিতার এমন কঠিন সিন্ধান্তটা হাবীব ফ্যামিলিকে জানালে ফ্যামিলি কি ভাববে ? রিতা তিন বছরের রিলেশনের কথা না ভেবেই নিজের ফ্যামিলিকে এতো বড় করে দেখছে কেন ? কি করবে হাবীব ?
দু’জনের গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো! তবে গল্পটা শেষ হয়নি, এখান থেকেই শুরু হয়েছে দু’জনের নতুন অধ্যায়। হাবীব সেদিন তার বাবাকে রিতার সিন্ধান্তের কথা জানানোর পরে বাবা বলেছিল – “যেই মেয়ে তিন বছরের রিলেশনের কথা না ভেবে নিজের ফ্যামিলির পরিস্থিতিকে সম্মান দিতে পারে, সেই মেয়েকে ভালবেসে আমার খোকা নিশ্চয় ভুল করেনি।”