প্রিয়জন

প্রিয়জন

আজ থেকে ঠিক বার বছর আগে সুপ্তির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। সেদিনও আকাশ মেঘলা ছিল আজও আকাশ কিছুটা মেঘলা। সেদিন ওর জন্মদিন ছিল, ওর বান্ধবিদের নিয়ে পার্কে এসেছিল কেক কাটার জন্য। কিন্তু কেক আনলেও ছুড়ি আনতে ভুলে গিয়েছিল, সেই সাথে মোমবাতি জ্বালানোর জন্য লাইটার।

আমি পার্কের একটা বেঞ্চে বসে ছিলাম, হঠাৎ করেই সুপ্তির এক বান্ধবি এসে বললো আপনার কাছে ছুড়ি হবে, আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম বললাম জ্বি না, তার পিছু পিছু আর একজন এসে বললো আপনার কাছে লাইটার হবে, আমি কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললাম জ্বি না, আমার কাছে লাইটার বা ছুড়ি নেই, না আমি ছিনতাই কারী না নেশাখোর।
আমার কথা শোনে সেদিন সুপ্তি দৌড়ে এসে বলতে শুরু করলো ওর বান্ধবিদের, এই তোরা কি শুরু করলি? দেখুন ওদের হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। ওর বান্ধবিরা চেচিয়ে উঠলো, এই সুপ্তি কি বলছিস এমন একটা ক্ষ্যাত টাইপ ছেলের কাছে ক্ষমা চাচ্ছিস। সুপ্তি বললো আর একটা কথাও বলবি না যা তোরা। তারপর সুপ্তি বললো কিছু মনে করবেন না আসলে আজ আমার জন্মদিন তাই ওরা কেক নিয়ে এসেছিল, কিন্তু ছুড়ি আর লাইটার আনতে ভুলে গিয়েছে আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি আচ্ছা ঠিক আছে বলে বসে পড়লাম।

আকাশের দিকে চেয়ে দেখি খুব মেঘ জমেছে যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে বলে, পার্কের বাহিরের দিকে একটা চায়ের দোকান দেখতে পেলাম, আমি সেই দোকানের দিকে ছুটে যেয়ে অনেক বলে তার ছুড়িটা আর একটা লাইটার নিয়ে আসলাম। তারপর ঐগুলো সুপ্তির হাতে দিয়ে বললাম নেন আপনারা কেক কাটেন, বলে পাশে হাঁটতেই সুপ্তি বলে উঠলো আপনিও আমাদের সাথে থাকুন আমার খুব ভাল লাগবে। আমি বললাম না আপনাদের আনন্দে আমি ভাগ বসাতে চাইনা, সুপ্তি মিষ্টি করে হেসে দিয়ে বললো কারো আনন্দে ভাগ বসানো যায় না, তবে আপনি পাশে থাকলে সে আনন্দটা আরও বেড়ে যাবে। আপনি আজ অনেক বড় একটা উপকার করেছেন না হলেতো কোন আনন্দই হতো না। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওদের সাথে জয়েন করলাম, তারপর কেক কাটার পর সকলে কেক খেতে খেতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।

সকলে দৌড়ে পার্কের ছাউনির নিচে যেয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ করেই সেখান থেকে সুপ্তি দৌড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করলো ঠিক যেন বাচ্চাদের মত লাফাচ্ছিল বৃষ্টির পানিতে, সেই মুহূর্তটা কখনোই ভুলার মত নয় জীবনে।তখন আমার ক্যামেরা ফোন থাকলে তা ক্যামেরা বন্দী করে রাখতাম। আমি মুগ্ধ হয়ে তার পাগলামী দেখে চলেছি, কখন যেন বৃষ্টি থেমে গেল। সকলে চলে যাবার সময় বিদায় নিতে এলো, সুপ্তি ধন্যবাদ দিয়ে বললো আপনার নাম্বারটা দেয়া যাবে আমি নাম্বারটা দিয়ে দিলাম। কিন্তু ওর নাম্বারটা নিতে আর মনে ছিল না। এভাবে চারদিন কেটে গেল, প্রতিটা মুহূর্তে সুপ্তির কথা মনে পড়তো। ভাবতাম এই বুঝি সুপ্তির কল এলো, কিন্তু না কল আসতো না, আর নিজকে নিজে বকা দিতাম বোকা ভেবে যে ওর নাম্বারটা কেন নিলাম না। চতুর্থ দিন বিকেলে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসলো। আমি রিসিভ করতেই মেয়েলি কন্ঠে বলে উঠলো কেমন আছেন, আমি বললাম ভাল কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। সুপ্তি হেসে বললো সেদিন পার্কে আপনার নাম্বারটা নিয়েছিলাম।

আমি বুঝতে পারলাম সুপ্তি, আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। কিন্তু ওকে বুঝতে দিলাম না। বললাম তা এতো দিন পর মনে পড়লো আমার কথা, সুপ্তি হেসে বললো জ্বি না জনাব এতো দিন কোথায় মাত্রই তো চারদিন। আর আমার খুব জ্বর হয়েছিল তাই আপনাকে ফোন দিতে পারিনি। আমি, আমার নাম জনাব না, আমি আসিফ আপনি চাইলে আমাকে এই নামেই ডাকতে পারেন। সুপ্তি, আপনাকে ধন্যবাদ আসিফ সাহেব, সে দিন আপনি না থাকলে পুরো জন্মদিনটাই মাটি হয়ে যেত। আমি, সাহেবটা বাদ দিয়ে শুধু নাম ধরেই বলেন ঐ সব সাহেব শব্দ আমার সাথে যায় না, আমি অতি সামান্য একজন মানুষ। আর হ্যাঁ সেদিনতো আপনার জন্মদিন কোন গিফট ছাড়াই খেয়ে নিলাম, চলুন না কোথায় কফি খেতে খেতে গল্প করি, মনে করবেন এটা আপনার জন্মদিনের গিফট হিসেবে। সুপ্তি, জ্বি কফি খাওয়া যায়, ঠিক আছে চলুন আজ বিকেলে দেখা করি পার্কের কাছেই একটা কফিশপ আছে। আমি, জ্বি অবশ্যই, তবে এতটা শর্ত আছে বৃষ্টি হলে কিন্তু ভিজতে পারবেন না।

সুপ্তি হাসতে হাসতে না না আমার পক্ষে ভেজা সম্ভব না আর। ওকে তাহলে বিকেলে দেখা হচ্ছে বলে সুপ্তি ফোন রেখে দিল। বিকেলে প্রস্তুত হয়ে বের হলাম সুপ্তির সাথে দেখা করতে। যাবার পথে ফুলের দোকান থেকে ওর জন্য ভাল একটা ফুলের তোড়া বানিয়ে নিলাম। তারপর আমিই আগে কফিশপ এ যেয়ে বসে রইলাম তার ঠিক দশ মিনিট পর সুপ্তি আসলো। বললো দেরী হয়নিতো, আমি বললাম না আমিই আগে এসে পড়েছি, তারপর ফুলের তোড়াটা সুপ্তির দিকে এগিয়ে দিলাম। সুপ্তি অবাক হয়ে বললো এটা কেন? আমি, আপনার জন্মদিনের দিনতো খালি হাতে খেয়েছি তাই আজ ফুল দিলাম, আসলে আপনার পছন্দ কি তাতো জানি না, তবে ফু্ল সবার পছন্দ তাই ফুল নিয়ে এসেছিলাম।

সুপ্তি ফুল গুলো রাখতে রাখতে সত্যিই ফুল আমার অনেক প্রিয়। সেদিনের পর থেকে আমাদের রোজ কথা হতে থাকে, একে অপরের সম্পর্কে জানা শোনা, সব কিছু একটা সময় খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যায় আমাদের মাঝে। ছয় মাসের মাথায় সুপ্তির অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। সুপ্তিই প্রথম বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে ভালবাসায় রূপ দিতে চায়।
সুপ্তিই প্রথম বলে আসিফ আমি তোমাকে বন্ধু থেকে আরও বেশী কিছু ভাবতে শুরু করেছি, আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। আমি সুপ্তিকে সেদিন ফিরিয়ে দিতে পারিনি, কিন্তু ওকে বলেছিলাম, তোমার পরিবার কোন দিনও আমাকে মেনে নিবে না। সুপ্তি হাসি মুখে বলেছিলো তুমি আর আমিতে না হয় নতুন পরিবার করবো। দুজন দুজনের প্রিয়জন হবোবো। সেদিন ওকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করেছিলাম। কারণ আমার মত অনাথকে এতোটা কেউ ভালবাসতে পারে তা কখনো বুঝিনি।

সুপ্তি ওর পরিবারে জানায় আমার কথা, আমিও তাদের সাথে দেখা করি, কিন্তু তারা একজন এতিমের কাছে তাদের মেয়েকে তুলে দিবেন না বলে সোজা জানিয়ে দেয়। আরও অনেক কিছু বলে অপমান করে তাড়িয়ে দেয় আমাকে। তারপর প্রায় একমাস সুপ্তির সাথে কোন ভাবেই আমি যোগাযোগ করতে পারিনি। তখন আমার মানুষিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়, কোন কিছুই ভাল লাগছিল না মনে হচ্ছিল যেন জীবনের সব কিছুই শেষ হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই এক সন্ধ্যায় বাসার কলিং বেল বেজে উঠে আমি দরজা খুলতেই অবাক হয়ে যাই, সুপ্তি বউ সেজে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বলি তুমি এভাবে কেন? সুপ্তি, এতো প্রশ্নের উত্তর দেবার মত সময় নেই চলো পালাতে হবে না হলে সমস্যা হবে, আমি, মানে কি? সুপ্তি, কোন কথা না বলে সোজা আমাকে নিয়ে চলে গেল একটা কাজী অফিসে সেখানে আগে থেকেই ওর বন্ধুরা উপস্থিত ছিল।

মুহুর্তের ভিতরেই আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল কেমন করে যেন। তখনো যেন আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না আমার বিয়েটা হয়েছে। সুপ্তি ওর বন্ধুদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে বললো চলো এবার বাসায় যাই, আমি, বাসায় গেলেতো ঝামেলা হবে তুমিই বললে। সুপ্তি হুম তখন হতো এখন হবে না। আমি, কেন? সুপ্তি কারণ এখন আমি তোমার বউ তাই, আর দুজনই প্রাপ্ত বয়স্ক সো আইনি কোন বাঁধা আর থাকছে না। বাসার সামনে যেতেই দেখি, সুপ্তির বাবা আর আত্মীয়রা এসে দাঁড়িয়ে আছে, আমি যেতেই সুপ্তির ভাই দৌড়ে আসে আমাকে মারতে, তখনি সুপ্তি যেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে আমার স্বামীর গায়ে কেউ একটা স্পর্শ করলে আমি সবার নামে মামলা করবো। সেদিন সেখানেই সুপ্তির বাবা, মা সুপ্তিকে ত্যাগ করে চলে যায়। সেদিন মেসের সব বন্ধুরা মিলে আমাদের রুমটা সুন্দর করে সাজিয়ে দেয় এবং তারা অন্য রুমে চলে যায় কি এক অদ্ভুত রকম ফিলিং হচ্ছিল, সেখানে আমরা সাত দিন থাকি তারপর ছোট একটা বাসা ভাড়া নেই।

শুরু হয় আমাদের দুজনের সুখের সংসার, আমাদের সংসারে অভাব থাকলেও কখনো ভালবাসার কমতি ছিল না। আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম কি পরিবেশে সুপ্তি ছিল আর কি পরিবেশ মানিয়ে নিয়েছে, সত্যিই প্রিয়জনরা এমনই হয়। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমাদের ঘর আলো করে আসলো, মেয়ে আফিফা। সেদিন আমার মনে হয়েছিল সত্যিই আমার জীবন পরিপূর্ণ এই অনাথেরও একটা ঘর হয়েছে একটা পরিবার হয়েছে। সেই পরিবারের সবাই প্রিয়জন।

বেশ সুখেই চলছিল আমাদের পরিবার কিন্তু কে জানতো এই সুখ বেশী দিন থাকবে না। হঠাৎ করেই একদিন সুপ্তি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল, তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার সব পরীক্ষা করে বললেন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে, সুপ্তির ব্রেইন টিউমার শেষ পর্যায়, হাতে সময় একদমই আর নেই। কথাটা শোনে কেমন যেন মাথাটা ঘুরে গেল, আমি ডাক্তারকে বললাম আপনাদের ভুল হচ্ছে কোথাও প্লিজ আপনারা আবার পরীক্ষা করুণ। ডাক্তার বললো আমরা ভাল করেই পরীক্ষা করে দেখেছি, কিন্তু কোন লাভ নেই, চাইলে বিদেশ নিয়ে যেয়ে দেখতে পারেন তবে লাভ হবে না।আমি সব লাজ লজ্জা ভুলে সুপ্তির মা বাবাকে জানাই, তারা সুপ্তিকে দেখতে আসে বিদেশ নিয়ে যেতে চায় কিন্তু সুপ্তি সে সুযোগ দেয়নি। আমাকে আর আফিফাকে আবারও এতিম করে দিয়ে চলে যায়। সেদিনের পর থেকেই আফিফাকে নিয়ে নতুন করে সংগ্রাম শুরু হয় আমার। দেখতে দেখতে আটটি বছর কেটে গেল, সুপ্তি নেই আমার পাশে কিন্তু প্রতিবছর এ বছর ওর জন্মদিনটা পালন করি।

বাবা এখনো বসে আছো, আফিফার ডাকে ঘুরে তাকালাম আফিফাও বড় হয়ে গেছে আমাকে এখন শাষণ করতে শিখে গেছে, চলো চলো বাবা কেক কাটবো, বলে আমার হাতটা ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে গেল। সবাই আছে সুপ্তির বাবা, মা ভাই শুধু আমার ঘরে সুপ্তিই নেই, রয়ে গেছে সুপ্তির গোছানো সংসার পুরো ঘর ময় স্মৃতি। সে স্মৃতিতেই আজও আমি বেঁচে আছি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত