আমি আর শ্রাবন্তী যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন থেকেই আমরা দুজন বন্ধু।এক সাথে স্কুলে যেতাম এক সাথে স্কুল থেকে আসতাম।স্কুলে যেতে শ্রাবন্তী কে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হতো।যার ফলে শ্রাবন্তী আমাকে সব সময় স্কুলে নিয়ে যেত।আমাদের বাড়িটা বাজারে যেতে পড়ে,আর শ্রাবন্তীর বাড়ি বাজার পেরিয়ে পড়ে। ক্লাস থ্রিতে থেকে আমরা খুব ঘনিষ্ঠ। এই নিয়ে অনেক ফ্রেন্ডের মাঝে তুমুল ঝগড়া বেধে যেত।শ্রাবন্তী কে ওরা গালা গাল দিত।আমার সাথে কেন চলে,ওদের সাথে কেন চলে না।
তখন কার সময়ে আমরা খুব আপন বন্ধু।এক জন আরেক জনকে ছাড়া কোনো কিছুই করতাম না।যা করতাম তাই দুজনে মিলে করতাম। স্কুল পালিয়ে নদীর ধারে গিয়ে দুজনে বসে গল্প করতাম।নৌকা দিয়ে ঐ পারে যেতাম।ফসলি জমির মাঝ খান দিয়ে ছুটে চলতাম।সে সময় আমাদের আনন্দ আর দুষ্টমি ছিল ভরপুর। স্কুলে দুজনে টিফিন ভাগ করে খাওয়া।একজনের বই দিয়ে অন্য জন চলা।সবই ছিল একটা ভালো লাগার মুহুর্ত। বলতে বলতে আমরা পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছি।তখন পড়া নিয়ে সময় কাটাতাম বেশি।কোথাও বেশি ঘুরতে যাওয়া হত না।
পঞ্চম শ্রেণিতে থাকা কালে সেই বার দূর্গা পূজা হয়ে ছিল।আর এই দূর্গা পূজা টা হয়েছিল শ্রাবন্তীদের বাড়িতে।একদিন শ্রাবন্তী আমাকে বলল, “জুবায়ের তুই তো মুসলিম,আমাদের পূজাতে কি আসবি” আমি কিছুক্ষন ভেবে বললাম, “তুই যদি বলিস তাহলে যাব” শ্রাবন্তী মুখে হাসি এনে বলল, “আচ্ছা তাহলে আসিস,আগামি সোমবার থেকে পূজা শুরু হবে” বলতে বলতে সোমবার এসে পড়ল।দূর্গা পূজা আমার দেখার সখ বেশি।তাছাড়া শ্রাবন্তীদের বাড়িতে পূজা হবে।ভালোই হবে। পূজার দিন নতুন একটা শার্ট পড়ে শ্রাবন্তীদের বাড়িতে চলে গেলাম।মানুষের সমাগম অনেক। কত মানুষ,এত ভিড়ের মধ্যে শ্রাবন্তী কে খুঁজে পাব কোথাই।বলতে বলতে শ্রাবন্তী আমার সামনে হাজির।আমার হাত ধরে শ্রাবন্তী ওদের ঘরে নিয়ে গেল।খাবার দিল,সাথে কেমন যে এক ধরণের একটা গোল মিষ্টি দিল।আমি তো আর এর আগে কখনো হিন্দু বাড়িতে যাই নি।শুধু এই প্রথম শ্রাবন্তীদের বাড়িতে আসলাম।অনেক্ষন শ্রাবন্তীর সাথে সময় কাটিয়ে পূজায় ঘুরে বাড়িতে চলে আসলাম।কারণ পূজা তো হবে রাতে।এখন তো পূজা উপলক্ষে মেলা জমেছে।তাই দেরি না করে সন্ধার আগেই বাড়িতে চলে আসি।
এক দিন, কি এক কারণে যে আমি শ্রাবন্তীর সাথে রাগ করেছি।তাই ওর সাথে কথা বলি না।ক্লাসে গিয়ে পিছনের বেঞ্চিতে বসলাম।শ্রাবন্তী আমার দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে।মেয়েটির মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা যাচ্ছে।ভিতরে ভিতরে ওর অপরাধটার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। কিছুক্ষন বাদে শ্রাবন্তী একটা কাগজের টুকরো আমার দিকে ছুড়ে মারল। কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম এটার ভিতরে লেখা, “তুই কি আমার সাথে আর কথা বলবি না।যদি না বলিস তাহলে আমাদের বন্ধুত্বটা এখানেই শেষ হয়ে যাবে” এই লেখাটা পড়ে আমার ভিতরে শ্রাবন্তী কে হারানো ভয় ঢুকে গেল।ক্লাস শেষ হতেই শ্রাবন্তীর সাথে কথা বললাম। হয়ে গেলাম আগের মতো।চলতে লাগল অামাদের দুষ্টমি।
সেই বার আমরা পঞ্চম শ্রেণি পাস করে হাই স্কুলে ওঠে যায়।আমাদের প্রাইমারি স্কুলের পাশেই ছিল হাই স্কুলটা।দুজনে এক সাথে স্কুলে যাওয়া, আসা।এগুলো যেন আমাদের রুটিন হয়ে গেছে।কাউকে ছাড়া আমরা থাকতে পারি না।একে অন্যের পাশে দুজনে সব সময় থাকতাম।যখন আমরা একটু বড় হয়ে গেলাম।তখন আর এত একটা মিশা যেত না।আগের মতো ঘুরতে যাওয়া হত না। কোনো কিছুই করা হতো না।দিন দিন সব যেন হারিয়ে যাচ্ছে।আমাদের নদীর পাড়ে যাওয়া,নদীর ওপারে যাওয়া,ফসলি জমির আইল দিয়ে ছুটে চলা, নদীতে এক সাথে গোসল দেওয়া এগুলো যেন আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে।হাই স্কুলে ওঠে,একটু বড় হয়ে সব হারিয়ে ফেলেছি। আমরা এখন নবম শ্রেনিতে পড়ি।এরি মাঝে আমাদের ভিতর একে অপরের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে গেল।আমি শ্রাবন্তী কে ভালোবেসে ফেলি।শ্রাবন্তী যে আমাকে ভালোবাসে না তা কিন্তু না।মেয়েটিও আমাকে ভালোবাসে।
আমাদের সময় টিভি ছিল না, তাই সিনেমা দেখারও কোনো সুযোগ ছিল না।তাই টিভি দেখা কিংবা সিনেমা দেখার জন্য যেত হতো শহরে।হল ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিনেমা হল রোডে। আমার আর কখনো যাওয়া হয় নি হলে সিনেমা দেখার জন্য। তাই মাঝে মাঝে কোনো ভালো ঔপান্যাসিকের লেখা বই পড়তাম।প্রেমের গল্প।সেখান থেকে জানতে পারি ভালোবাসার কথা প্রথমে ছেলেদেরকে বলতে হয়।তাই আমার ভিতরে ইচ্ছে পোষণ করলাম,আমিই শ্রাবন্তী কে আগে ভালোবাসার কথা বলব। কোনো এক সন্ধা হওয়ার আগে মুহুর্তে, সূর্য পশ্চিম দিগন্তে তলিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত, চারদিকে অন্ধকার গনিয়ে আসছে, জনমানবহীন রাস্তা গুলো, এমন মুহুর্তে আমি আমার ভালোবাসার কথা কাগজে লিপিবদ্ধ করে শ্রাবন্তীকে জানালাম।পরের দিন তার উত্তর আসে।এরপর থেকে আমাদের প্রেম-ভালোবাসা চলতে থাকে।কত আনন্দে,সুখে।আমাদের ভালোবাসা দেখে যেন আকাশ হিংসা করে, হিংসা করে প্রকৃতি, হিংসা করে বাতাস, হিংসা করে সমস্ত পৃথিবী।
এত সুখে ভালোবাসা চলবে তার মাঝে কোনো দুঃখ থাকবে না তা কি করে হয়। আমাদের ভালোবাসাতেও বয়ে আসে এক কাল- বৈশাখি ঝড়।যে ঝড়ে লন্ডবন্ড হয়ে যায় আমাদের ভালোবাসা। আমার আর শ্রাবন্তীর ভালোবাসার কথা এক এক করে সবাই জেনে যাই।ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রাম। কোনো সমস্যা ছিল না আমাদের ভালোবাসায়। তবে একটাই সমস্যা আমি মুসলমান আর শ্রাবন্তী হিন্দু।তারপরে আমাদের দুই পরিবার এটাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায়।কি করবে, কি করলে এর সমাধান দেওয়া যাবে।যেভাবেই হোক শ্রাবন্তীর পরিবার বিষয়টা মেনে নেই নি।আমার পরিবার রাজি হয়ে গেছে।আমাদের বিয়ে করার জন্য।হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এটাকে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারি নি।তারা আমার কাছে কখনো শ্রাবন্তী কে বিয়ে দিবে না।
এমন একটা হট্ট গন্ডগুলে দেশে নেমে আসে এক কালো রাত্রি।শুরু হয়ে যায় মহান মুক্তিযুদ্ধ।পাকিস্তানী বাহিনী শুরু করে নির্মম হত্যাকান্ড আর অত্যাচার।তা থেকে বাঁচার জন্য দেশের অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এই দেশ ছেড়ে চলে যায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে।তাদের মাঝে শ্রাবন্তীদের পরিবারও ছিল।শ্রাবন্তী কে নিয়ে তারা ভারতে চলে যায়। দেশে শুরু হয় এক মহামারি আর আমার শুরু হয় যন্ত্রনা,কষ্ট।যুদ্ধের মাঝ খান দিয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যায় শ্রাবন্তী।এদিকে দেশে যুদ্ধ চলতে থাকে।পাকিস্তানিদের হাত্যাকান্ড নির্মম অত্যাচার সইতে না পেরেই শ্রাবন্তীরা চলে যায় এই দেশ ছেড়ে।আপামর বাঙালি জাতিও নেমে পড়ে নিজের দেশের জন্য যুদ্ধে।শুরু হয় বাঙালিদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
দেশ স্বাধীনের পর প্রায় ৭-৮ বছর পরে শ্রাবন্তীদের পরিবার শ্রাবন্তীসহ আসে বাংলাদেশে।যখন শুনলাম শ্রাবন্তী আসবে তখন ঘোড়ার নেই,তীব্র গতি দিয়ে, ছুটে চললাম মেয়েটিকে দেখার জন্য। বাড়ির পাশেই বসা ছিল শ্রাবন্তী।এত বছর পর দেখা।কেমন যেন হয়ে গেছ চেহারাটা।কথা বলার ইচ্ছা ছিল শ্রাবন্তীর সাথে।শুনলাম শ্রাবন্তী নাকি এখনো বিয়ের পিরিতে পা রাখে নি।কিছু দিন থেকেই আবার শ্রাবন্তীদের পরিবার শ্রাবন্তীসহ ভারতে চলে যায়।কষ্টে বুকটা ছিড়ে যাচ্ছিল আমার। শ্রাবন্তী চলে যাওয়ার পর আমার পরিবার থেকে আমাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছে অনেক।আমি বিয়ে করে নি।কারণ আমি যে পণ করে বসে আছি শ্রাবন্তী কে বিয়ে না করতে পারলে এই জীবনে আর বিয়েই করব না।আর যে বিয়ে করে নি।চলে যায় শ্রাবন্তী,আমাকে ছেড়ে আমাদের ভালোবাসাকে ছেড়ে।সমাজ মানে নি আমাদের ভালোবাসাকে,সম্প্রদায় মানে নি আমাদের ভালোবাসাকে।
ডায়েরিটা পড়ে এতক্ষনে শেষ করলেন জুবায়ের সাহেব।বর্তমানে তার বয়স ১০০ এর কাছাকাছি হবে।এরি মাঝে একবার শ্রাবন্তী দিদি কে জুবায়ের সাহেব দেখেছিলেন।শ্রাবন্তী দিদিও বিয়ের পিরিতে বসে নি।জুবায়ের সাহেব এখন ছোট একটা কুড়েঘরে বসবাস করেন একাই।কারণ তিনি যে আর বিয়ে করে নি।শ্রাবন্তী দিদির ভালোবাসা নিয়েই এই ধরণীতে বেঁচে থাকবেন বাকি সময়টা। চশমাটা খুলে চোখ দুটি মুছে নিলেন জুবায়ের সাহেব।কিছুক্ষণের জন্য তিনি যেন কোথাই হারিয়ে গেছিলেন।পুরনো সেই ভালোবাসার দিনগুলোতে।শ্রাবন্তী দিদির খুঁজে…….