রাত প্রায় বারোটার মত হবে।মুখে একপ্রকার নিষ্পাপ ভাব এনে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছি।দরজা লাগানোর শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম সিমি রুমে ঢুকেছে। পরিস্থিতি কেমন সেটা জানতে হাল্কা করে চোখ খুলে আবছাভাবে দেখে যা বুঝলাম সিমি আমার দিকে ঝুকে এসে ভালো করে পরখ করে নিচ্ছে আমি সত্যি সত্যি ঘুমিয়েছি কিনা।
আমার নিখুঁত অভিনয়ের কাছে হার মেনে বেচারী এসে আমার অপরপাশে মুখ উল্টোদিক করে শুয়ে পড়লো।এখন শুধু তার ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা। আধঘন্টা পর সিমির ঘুমের অবস্থা কেমন সেটা যাচাই করার জন্য ঘাড়টাকে একটু উচিয়ে উকি মেরে সিমির দিকে তাকালাম। নাহ,ভালোই ঘুমে তলিয়েছে।যাক,এবার ওঠা যাক তাহলে । আসলে রাতের এসময়টাতে আমার খুব সিগারেটের নেশা হয়।সিগারেট না খাওয়া পর্যন্ত ভেতরে কেমন জানি একটা অস্থিরতা কাজ করে।আগে ওর সামনেই খেতাম,তেমন কোন প্রতিক্রিয়া করতো না। কিন্তু ডাক্তারের নিষেধ করার পর থেকে সিগারেটের ঘোর শত্রু হয়ে দাড়িয়েছে এই ভদ্রমহিলা।সিগারেটকে একপ্রকার অঘোষিত সতীন হিসেবে ধরে নিয়ে সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছে কখনো মুখে সিগারেট দেখলে ভুলে যাবে আমি তার স্বামী।আমাকে দ্বিগুণ খুশি করে দিয়ে সে এও বলেছে যে ঘর ঝাড়ু দেওয়ার বস্তুটার নাকি বিকল্প ব্যাবহারও করা হতে পারে। সেই থেকে চলছে;আমার আর সিগারেটের এই এই গোপন প্রেম,পরকীয়া।
বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পনে দরজার ছিটকিনিটা খুলে দরজা খোলা রেখেই বেলকনি লক্ষ্য করে এগুতে লাগলাম।বেলকনিতে পৌছে খানিক ঝুকে গিয়ে সেখানে রাখা টবগুলোর পেছনটা হাতড়াতে লাগলাম অনেক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরও পলিথিনে মোড়ানো সিগারেটের প্যাকেটটার কোন হদিস মিললো না। অথচ দিনের বেলাই একটা দেশলাই আর একপ্যাকেট সিগারেট এখানে লুকিয়ে রেখেছিলাম। অনেক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে নিরাশ হয়ে পেছন ঘুরে যেই বিছানার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি,দেখি ভদ্রমহিলা সামনে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ চোখের সামনে ঠাকুমার ঝুলি গল্পের শেওড়া গাছের পিশাচনীটার ছবি ভাসতে লাগলো। পরিস্থিতি সামাল দিতে অগ্রভাগের দাঁতগুলো উদোম করে বেকুব মার্কা একটা হাসি দিয়ে নিজে নিজেই কৈফিয়ত দিতে শুরু করলাম।
-বুঝলে সিমি,টবগুলোতে প্রচুর আগাছা জন্মেছে।আসলে অনেকদিন ধরে পরিষ্কার করা হচ্ছে না তো।
বলতে বলতে একটা টবের কাছে ঝুকে গিয়ে অনর্থক ঘষামাজা শুরু করলাম।
সিমির কোন ভাবান্তর হলো না,এরকম কর্মকান্ডে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে বলতে শুরু করলো।
-তুমি কি আমার কোনকথাই শুনবে না বলে ঠিক করেছো রায়হান?নিজের কথা না ভাবো,অন্তত আমার আর পাপ্পুর কথাটা ভেবেও তো ছাড়ো,কাকে কি বোঝাচ্ছি!শুতে এসো বলেই হনহন করে রুমের দিকে চলে গেলো সিমি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভদ্রমহিলার দৃষ্টি আকর্ষন করার জন্য করার জন্য বার কয়েক মৃদু কাশি দিলাম। ভদ্রমহিলা শুনলো কি শুনলো না বুঝলাম না।
-সিমি?
-(জবাব নেই)
-এই সিমি? (কাঁধে মৃদূভাবে ধাক্কা দিয়ে) এবার জনাবার টনক নড়ল।ফুলন দেবীর মত সমস্ত শরীরে আগুন মেখে ঝট করে আমার দিকে মুখ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে ঝাঝালো গলায় উত্তর দিলো
-কিহ?
-এমনভাবে তাকাচ্ছো কেনো?
মনে হয় তোমার কিডনি খুলে ভুনা করে পাশের বাসার ভাবীকে গিফট করে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করেছি?সিগারেট কম তোমার এই তাকানোটাই আমার আমার হার্টে বেশি প্রভাব ফেলবে জানোতো।তুমি নিশ্চই চাইবেনা আমি এত তাড়াতাড়ি অক্কা পেয়ে স্বর্গে গিয়ে অন্য মেয়ের সাথে বাদাম চিবোই? যদি না চাও তাহলে এভাবে তাকিও না প্লিজ। কোন কথা বললো না সে,রাগের পরিমাণেও তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।
-রাগ করোনা সুন্দরীগো,রাগলে তোমায় লাগে আরো ভালো।
অন্যদিকে তাকিয়ে পা নাড়াতে নাড়াতে ভদ্রমহিলার উদ্দ্যেশ্যে দুলাইন সঙ্গীত ছুড়ে দিলাম।মনে হচ্ছে কাজে দিয়েছে।খেয়াল করে দেখলাম কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে,আসলে কিছুটা না।বেশ ভালোই পরিবর্তন দেখা মিললো। ম্যাডাম জোর করে মুখে রাগী ভাবটা রাখতে গিয়েও রাখতে পারলো না। ফিক করে ক্ষণস্থায়ী একটা হাসি দিয়ে পুণরায় মুখ মলিন করে বলতে শুরু করলো
– রায়হান,এটা কিন্তু এক ধরণের টর্চার জানোতো?আমি না পারছি তোমার এইসব কর্মকান্ড সহ্য করতে আর না পারছি তোমার উপর রাগ দেখিয়ে থাকতে।আমি ঠিক কি করবো একটু বলে দিবে? জবাবে কি বলবো ভেবে না পেয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বলতে শুরু করলাম
-কাল সকালে টবগুলোর আগাছাগুলো একটু পরিষ্কার করতে হবে বুঝলে,আজ তো আর তোমার জন্য করা হলোনা।
-হয়েছে আর সাধু সাজতে হবেনা,সিগারেটের প্যাকেট দাড়োয়ান চাচাকে দিয়ে দিয়েছি।
পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে আমিও তার সাথে সুর মেলালাম।
-ভালো করেছো,বেচারা গরীব মানুষ।ঠিকমত সিগারেট খেতে পারে কি না পারে কে জানে!আসলে আমি ইচ্ছে করেই সিগারেটটা ওখানে রেখেছিলাম জানোতো? আমি জানতাম তুমি এই কাজটাই করবে। মুরুব্বী মানুষ,আমি দিলে কিনা কি ভেবে বসে থাকে,তাই তোমাকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নিলাম।
-আহা!এসেছেন আমার জনদরদী রে,তা এতই যখন দরদ তখন অন্যকিছু দেওয়া যেত না? অহেতুক শাক দিয়ে শুটকি ভর্তা লুকানোর চেষ্টা করবে না বলে দিলাম।
-শুটকি ভর্তা?
-অই হলো,শুটকিটা তো মাছ থেকেই আসে নাকি?
-আচ্ছা সিমি?
-কি?
-এই যে ডাক্তারের কথায় তুমি আমাকে সিগারেট খেতে মানা করছো।তুমি তো জানোই,ও শা শালা শব্দটা বলতে গিয়েও আটকে গেলাম।খেয়াল করলাম সিমি আবার আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আবার বলতে শুরু করলাম
-ও সাহেবওতো বোধহয় দিনে প্যাকেটখানেকের মত সিগারেট ফুঁকে দেয়।
চেম্বারে এশট্রেতে সেদিন দেখলে না কতগুলা সিগারেটের ফিল্টার দেখেছিলাম। ক’দিন আগেই বুকে ব্যাথা আর কাশি বাধিয়ে গিয়েছিলাম ডাক্তার আলমগীর সাহেবের চেম্বারে।উনি একজন হার্ট স্পেশালিষ্ট। যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার সাহেব এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে অতিরিক্ত সিগারেট খাওয়ার কারণেই আমার এই অবস্থা।
এখন সিগারেট খাওয়াটা একদম কমিয়ে ফেলতে হবে।কথাবার্তার একপর্যায়ে ডাক্তার সাহেব সিগারেট না খাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি প্রদান করে তিনি নিজেও সিগারেট খান না বলে নিজের পক্ষে সাফাই দিতে লাগলেন। ডাক্তারের কথাগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎ চোখ গিয়ে পড়লো টেবিলের কোণে রাখা এশট্রেটার উপর।যেখানে পড়ে আছে অনেকগুলা আধখাওয়া সিগারেটের ফিল্টার। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকানোয় বেচারা একটু বিব্রত হয়ে গিয়েছিলো। পরকীয়া করতে গিয়ে স্ত্রীর হাতে ধরা খাওয়া পুরুষের মুখ যেমন হয়,অনেকটা তেমন দেখাচ্ছিলো আলমগীর সাহেবকে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য মৃদু হাসার চেষ্টা করতে করতে টেবিলে রাখা ফাইল দিয়ে এশট্রেটা ঢেকে নিয়েছিলেন।কিছু সময়ের জন্য দুজনই চুপচাপ থাকলাম।খানেক পর সিমি নিজে থেকেই যথেষ্ট উৎসাহ ও উত্তেজনা নিয়ে জানতে চাইলো।
-আচ্ছা,তোমার মনে আছে কলেজে তুমি একবার আমার দিকে কাগজ ছুড়ে মেরেছিলে?
-হুম বেশ মনে আছে,আসলে হাতের কাছে পাথর ধরণের কিছু ছিলো না তো তাই ওটাই ছুড়েছিলাম।
-একদম ফাজলামো করবে না বলে দিলাম।বুড়ো ভাম কোথাকার! বলেই পুনরায় ফুলন দেবী অবতার ধারণ করে এক ঝটকায় আবার মুখ উল্টো পাশ করে শুয়ে পড়লো সে।
-স্কুটি চেঁপে এসো হে, পড়নে হলদে শাড়ি ভালোবাসা দাবি করো দিও, কলার চেপে ঝাড়ি।
ভদ্র মহিলাকে উদ্দ্যেশ্য করে একা একা চার লাইন ঝেড়ে নিলাম,পুরোটা মনে পড়ছে না।এরকমই কিছু একটা সেদিন কাগজে লিখে ছুড়ে মেরেছিলাম সিমির দিকে। ‘সবকিছু ঠিকই ছিলো।হলুদ শাড়ি,স্কুটি।শুধু কলার চেপে ধরে ভালোবাসা দাবি করার বদলে কয়েকটা থাপ্পড়ের কথা লিখলে আরো ভালো হত’ পাল্টা কাগজ ছুড়ে দিয়ে মুখে ভেংচি কেটে আবার স্যারের লেকচার শুনতে ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলো তৎকালীন সমগ্র কলেজের ছেলেদের ঘুম হারাম করে দেয়া মেয়েটি। কবিতাটা সে শুনলো কি শুনলো না বুঝলাম না।মুখটা ওপাশ করে রাখায় ভদ্র মহিলার প্রতিক্রিয়াটাও বুঝতে পারলাম না। হয়তো এতক্ষণে ঠোঁটের এককোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে,আবার এও হতে পারে এখন সে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেছে। হুম!দুনম্বর ধারণাটাই সঠিক।এখন সে ঘুমুচ্ছে। আসলে সে রুমের পরিবেশটাকে একটু রোমান্টিক করে তোলার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু সে চেষ্টায় পানি ঢেলে দেয়ায় বেচারী এখন ঘুমানোটাকেই শ্রেয় মনে করে শুয়ে পড়েছে।
বিছানা থেকে উঠে গিয়ে কতক্ষণ সিমির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কলেজের সেই সুন্দরী মেয়েটার মুখের সেই চিরচেনা জৌলুশ কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে ঘুমিয়ে থাকায় মুখে একটা নিষ্পাপ ভাব চলে আসায় তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। খুব আঁটোসাটো হয়ে ঘুমিয়ে থাকায় ঠান্ডা লাগছে ভেবে কাঁথাটা দিয়ে সিমির শরীরটা ঢেকে দিলাম। চুলের সিঁথি বরাবর একটা চুমু দিয়ে আমিও একপাশে এসে শুয়ে পড়লাম। আজ দশটা বছর ধরে চলছে সিমি আর আমার এই বিনিময় প্রথা। দিনের পর দিন এভাবে আমি তাকে কথিত টর্চার করে চলেছি,আর বিনিময়ে সে আদর,ভালোবাসা ও শাষণের সংমিশ্রণে তৈরি শংকর ধাতু দিয়ে আগলে রাখছে সংসারটাকে। জীবনে তেমন কিছু আর চাওয়ার নেই।